পর্নো, লরা মালভে ও জিজেক বিতর্ক, এবং আলোচনা

এই লেখাটি ক্রিটিক্যাল থিওরীর অন্তর্ভূক্ত। প্রথমত এখানে লরা মালভে’র মেইল গেইজ থিওরী, এবং এর বিরুদ্ধে জিজেকের যুক্তি নিয়ে কথা বলা হয়েছে। এর পরে রেনে জিরার্দের মিমেটিক ডেজায়ারের আলোকে মেইল গেইজ থিওরী নিয়ে বলা হয়েছে।

লরা মালভে বলেন, ফিল্মে/পর্নে দর্শকদের হেটারোসেক্সুয়াল পুরুষ হিসেবে ধরে নিয়ে যখন দৃশ্য উপস্থাপন করা হয় তখন আমরা পাই মেইল গেইজ। সেইসব দৃশ্যে নারীদের দেহের কার্ভ, বিভিন্ন অংশ ইত্যাদি নানা ভাবে দেখানো হয়। ঐ সব দৃশ্যে থাকা নারীকে অবজেক্ট হিসেবে ধরা হয়, যে কেবল দর্শক (যাদের হেটারোসেক্সুয়াল পুরুষ ধরে নেয়া হয়েছে) তাদের আনন্দ দিবে।

লরা মালভে, জন্ম ১৯৪১, ব্রিটিশ ফেমিনিস্ট ফিল্ম থিওরিস্ট

বেশীরভাগ ক্ষেত্রে যে নারী চরিত্রটি ফিল্মে থাকে তার আলাদা গুরুত্ব থাকে না, সে অবস্থান করে পুরুষ চরিত্রটির সাথে সম্পর্কের নিমিত্তে। ফিল্মে নারীর কাজ থাকে পুরুষ চরিত্রটির এরোটিক অবজেক্ট হওয়া, অথবা দর্শকদের এরোটিক অবজেক্ট হওয়া।

মালভে বলেন, এভাবে নারীরা যখন মিডিয়ায় পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপিত হন, তখন দর্শক নারীরাও মেইল গেইজ লাভ করেন। তারাও পুরুষের মতো দৃশ্যটি দেখতে থাকেন। তারাও এই দেখার মাধ্যমে পুরুষের মতো ঐ দৃশ্যের নারীদের অবজেক্টিফাই করেন।

যেসব চরিত্র তাকাবে অন্যদের দিকে তাদের দেখা হয় একটিভ চরিত্র হিসেবে।

যেসব চরিত্রের দিকে তাকানো হবে, তাদের দেখা হয় প্যাসিভ চরিত্র হিসেবে। মালভের মতে নারীরা প্যাসিভ চরিত্রে থাকেন। তারা সব সময় তাকেন মেইল গেইজ বা মেইল দৃষ্টির মধ্যে, এবং তাদের দেখাজনিত আনন্দ দানের জন্য।

দেখা যায় ফিল্মের গল্প ধীর করে দেন নারী চরিত্র, কিন্তু পুরুষ চরিত্রটি গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যান।

ইত্যাদি পয়েন্ট তুলে ধরে লরা মালভে বলেছেন কীভাবে ফিল্মে, মিডিয়ায় নারীদের অবজেক্ট হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, মেইল গেইজের উপকরণ হিসেবে রাখা হয়, এবং এর প্রভাব পড়ে সমাজে।

দার্শনিক স্ল্যাভো জিজেক, জন্ম ১৯৪৯, স্লোভেনিয়ান।

স্লোভানিয়ান দার্শনিক, ক্রিটিক্যাল থিওরিস্ট ও সাইকোএনালিস্ট স্ল্যাভো জিজেক অবশ্য মালভে’র এই তত্ত্বের বিরোধীতা করেন।

তার মতে, ‘হেটারোসেক্সুয়াল পর্নোগ্রাফিতে নারীরা পুরুষ দৃষ্টির উপকরণ বা অবজেক্টে পরিণত হন বলে সিনেমা তাত্ত্বিক লরা মালভে যে থিওরী দিয়েছেন, তার সাথে সম্পূর্ন দ্বিমত পোষণ করি।  আপনি কি লক্ষ করে দেখেছেন পর্নোতে নারীরা যখন ফাকড হচ্ছেন তখন সিনেমা বা ফিল্মের মূল নিয়মটি উপেক্ষা করে তারা ক্যামেরার দিকে সরাসরি তাকান? এখন যে পুরুষ ফাক করছে তার সাথে আপনি নিজেকে আইডেন্টিফাই করবেন না। সে কেবলই এক যন্ত্রমাত্র। আপনি যদি কোন হেটারোসেক্সুয়াল পুরুষ হন, এবং কোন হার্ডকোর মুভি দেখতে থাকেন, তাহলে আপনি যা দেখতে চাইবেন বা খুঁজবেন তা হলো ঐ মহিলার থেকে সিগনাল- সিগনালটা হলো তিনি আনন্দ পাচ্ছেন। এই কনফার্মেশন আপনি খুঁজেন। আসল অবজেক্ট বা বস্তু হচ্ছে বেচারা লোকটি যে মহিলাটিকে ফাক করে যাচ্ছে। এবং এই জন্যই, একটি অলিখিত নিয়মের মতো, ঐসব ফিল্মে মহিলারা এতো সাউন্ড করে।’

জিজেকের এই উলটা বক্তব্য দেখায় দৃশ্যে মেইলও অবজেক্ট হতে পারে।

মেইল গেইজ নারীদের এমনিতেই থাকে বিবর্তনীয় মনস্তত্ত্ব অনুযায়ী। কারণ, এটি খুব দরকারী তার মেটিং স্ট্র্যাটেজির জন্য। অন্য নারীরা যেহেতু বিবর্তনিক অবচেতনে সঙ্গী পাবার প্রতিযোগীতায় তার প্রতিযোগী তাই সে পুরুষের দৃষ্টিতেই ঐ নারীকে দেখে তার খুঁত বার করে।

ফিল্মের ক্ষেত্রে, নারী বা পুরুষের উপস্থাপিত চরিত্রসমূহকে দেখা আরো গভীরভাবে ডেজায়ারের সাথে জড়িত। এইসব চরিত্রদের দেখে দেখে তাদের ডেজায়ার তৈরী হয়। কী ডেজায়ার করতে হবে এবং কীভাবে সে ডেজায়ার পূরণ করতে হবে এসব সে বুঝে ও নেয় ফিল্ম থেকে।

রেনে জিরার্দ, ফ্রেঞ্চ হিস্টোরিয়ান, ক্রিটিক, দার্শনিক। জন্ম ১৯২৩, মৃত্যু ২০১৫।

কালচারাল থিওরীস্ট ও ফ্রেঞ্চ দার্শনিক রেনে জিরার্দ এর একটি থিওরী আছে, মানুষের ডেজায়ার কিভাবে জন্ম নেয় তা নিয়ে, মিমেটিক ডেজায়ার নামে। মানুষের ডেজায়ার জন্ম নেয় অন্যের ডেজায়ার কপি বা অনুকরণ করার মাধ্যমে। ফিল্মের চরিত্ররা এক্ষেত্রে গল্পের মাধ্যমে, তাদের অভিনয়ের মাধ্যমে আমাদের যা দেখায় তার উপর ভিত্তি করে সে সংস্লিষ্ট ডেজায়ার মানুষের তৈরী হয়।

এজন্যই ফিল্মের চরিত্রের মতো চুল কাটা, কাপর পরা ইত্যাদি ফ্যাশন হয়।

ফলে গেইজ কেবলই মেইল গেইজ হয় না ফিল্ম দেখায়। ঐ নারীকে যৌন উত্তেজক হিসেবে ব্যবহার করলে নারীরাও মেইল গেইজ নতুন ভাবে লাভ করবেন তা বলা যায় না, বরং তার মধ্যে থাকা বিবর্তনীয় মেইল দৃষ্টিভঙ্গী ব্যবহার করে তিনি নারী চরিত্রটিকে মাপবেন। এছাড়াও একে দেখে তার ডেজায়ারের তৈরী হতে পারে, নিজের বডিকে ঐরকম করার, ইত্যাদি।

 

রেফারেন্সঃ

১। Mulvey, Laura. “Visual Pleasure and Narrative Cinema.” (PDF)

২। Camera Shy, Blah, Blah, Blah -Slavoj Žižek

৩। René Girard (1923—2015): Internet Encyclopedia of Philosophy and its Authors | ISSN 2161-0002