অন প্রবাদ

প্রবাদ প্রবচনরে আমরা প্রাচীন উইজডম ধরে বসে থাকি। কিন্তু সব সময় এগুলি প্রাচীন উইজডম না, বরং অনেক ক্ষেত্রে এগুলি উইজডমই না। এসব কথা প্রচলিত কারণ সংখ্যাগরিষ্টের মত এগুলি ধারণ করে।

প্রবাদ প্রবচনের বাক্য সম্পর্কে প্রথমে দেখতে হবে এটি কার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এবং কাকে টার্গেট করে বলা হচ্ছে। তাহলেই আপনি এর দূর্বলতা ধরতে পারবেন।

যেমন একটি প্রবাদমূলক কথা আছে, ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপন দেখা ভালো না।

এখানে, যারা এটি বলছে তারা হয়, ভালো কাঁথায় শুয়ে থাকা লোকেরা। তারা যখন দেখতেছে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে একজন লাখের স্বপ্ন দেখছে তখন তারা টিটকারি দিচ্ছে। হাস্যরস আনার চেষ্টা করছে, এবং এর মাধ্যমে তাকে দমিয়ে দেবার চেষ্টা করছে।

কারণ এরকম যদি ছেড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপন দেখা নিয়ম হয়ে যায় তাহলে একশোজন দেখলে দশজন তার স্বপ্নের পিছনে ছুটবে। তিনজন কৃতকার্য হয়ে যেতে পারে। তখন সেই ভালো কাঁথায় শুয়ে থাকা অর্থাৎ সম্পদশালীদের ক্লাসে ভাগ বসানোর জন্য আরো লোক বাড়বে। কে চায় নিজের জায়গায় আরো লোক বাড়ুক? বিশেষত কম বুদ্ধির স্বার্থপররা ত চাইবেই না। আর পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই এমন।

দ্বিতীয়ত যারা এটি বলছে তারা হয়ত অন্য ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে থাকা লোকেরা। তারা যখন দেখছে তাদেরই একজন বড় ভিশনারি, বিরাট স্বপ্ন দেখছে, তখন তাকে দমিয়ে দেবার জন্য এই টিটকারি তারা করছে।

টার্গেট এখানে ভিশনারি লোকটি। সে যদি এদের কথায় দমে যায়, তাহলে তাকে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়েই আজীবন কাটাতে হবে।

আর যদি সে এদের কথায় না দমে, তাহলে স্বপ্নের পিছনে ছুটলে হয়ত তার অবস্থার উন্নতি হবে। সে যদি ঝুঁকি নেয়, হয়ত সে পারবে। সে না পারলে তাকে দেখে স্বপ্ন দেখতে শেখা অন্য কেউ পারবে। বা তার উত্তরপুরুষের কেউ পারবে। যেমন ডারউইনের পিতামহের কবিতায় বিবর্তনের আভাস ছিল। সেই স্বপ্নের পূর্নতা দান করেছেন ডারউইন। আর এমন উদাহরণ প্রচুর রয়েছে।

Organic life beneath the shoreless waves
Was born and nurs’d in ocean’s pearly caves;
First forms minute, unseen by spheric glass,
Move on the mud, or pierce the watery mass;
These, as successive generations bloom,
New powers acquire and larger limbs assume;
Whence countless groups of vegetation spring,
And breathing realms of fin and feet and wing.

Erasmus Darwin. The Temple of Nature. 1802.

এই প্রবাদ, প্রবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আমাদের সমাজে। এটি বুঝায় যে, আমাদের এখানে বড় স্বপ্নকে নিরোতসাহীত করার মতো মানুষজনই বেশি ছিল। যারা অন্যকে দমিয়ে রাখতে পছন্দ করে, তাদের সাথে রাখতে পছন্দ করে। এর ফলে কী হয়েছে তা আমরা আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার দিকে তাকালেই দেখতে পাই।

আরেকটি প্রবাদ বাক্যের মতো কথা আছে, বামন হয়ে চান্দের দিকে হাত বাড়াইও না। এই কথাটির ক্ষেত্রে যারা বলতেছে, তারা হয় নিজেরে মনে করছে চাঁদ। বাংলা ফিল্মের গানে নায়িকা যখন গানে গানে এই কথা বলেন তখন তিনি নিজেকে চাঁদই মনে করে বলছেন। মানে চাঁদের মতোই সুন্দর। কিন্তু কথা তো সত্যি নয়। কতো যে সুন্দর মেয়েরা আছেন ধরায়। তিনি আলাদা বিশেষ চাঁদ তখন কোন হিসাবে? বাংলা ফিল্মে নাহয় স্নো পাউডার মাখা নায়িকা অসুন্দর সখীদের নিয়ে ঘুরাঘুরি করেন। কিন্তু বাস্তব জীবনে তো এমন হয় না। আমরা দেখি যে সব সখী মিলে মিশে সবাই সুন্দর, সবাই একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করে তিব্বত স্নো, বিদেশী ক্রিম এইসব মেখেটেখে একাকার হয়ে, বিশাল সুন্দরী রূপে আবির্ভূত হয়ে হাঁটাচলা করেন।

কথাটির আরেক অর্থ, নিজের ক্ষমতার বাইরে থাকা কোন বিশাল বস্তুর দিকে হাত বাড়াইও না।

এখানেও সমস্যা আছে। কারণ যাকে বলা হচ্ছে যে সে বামন, তার ক্ষমতা যে অল্প তা কিন্তু নিশ্চিত হবার উপায় নেই। মানুষ কী না করতে পারে।

আর ধরা যাক ছয় ফুটিয়া লোকেরা গর্বভরে বামন একটা লোককে বলছেন, হেই বামন, তুই বামন হইয়া চান্দের দিকে হাত বাড়াবি না। চান্দ তোর জন্য নয়।

তখন বামন সাহস করে যদি বলে ফেলে, তা ছয় ফুটিয়া ভাই, আপনি কি হাত বাড়াইয়া চান্দ ধইরা ফেলেন?

তখন ছয় ফুটিয়ারা কী উত্তর দিবেন!

চাঁদ ধরতে তো দশ ফুট বা বিশ ফুটের লোকেরাও পারবেন না, হাত বাড়াইয়া। আর রকেটে চড়ে দশ ফুটিয়ারা যেমন চাঁদে যেতে পারবেন, বামনও পারবে।

সুতরাং, চাঁদ ধরার চেষ্টার মধ্যে যে আনন্দ আছে তার থেকে বামনকে বঞ্চিত করা কেন? তার কম উচ্চতার জন্য তাকে এই টিটকারি দেয়া কেন, কেন তারে কারণ ছাড়াই হেয় করা? সে ধরতে না পারলে না পারবে, আপনিও তো হাত বাড়িয়ে চান্দ ধরতে পারেন না।

চৈনিক কবি লি পো তো চাঁদ ধরতে গিয়ে মারাই গিয়েছিলেন। একদিন মধ্যরাতে মাতাল অবস্থায় তিনি নৌকায় ছিলেন। পানিতে স্থির চাঁদের ছবি দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। তার মনে হয় একে তার ধরতেই হবে। তিনি চাঁদ ধরতে লাফিয়ে পড়েন, ও মারা যান। কবি এজরা পাউন্ড এই ঘটনা নিয়ে একটি কবিতা লিখেছেন।

“And Li Po also died drunk.
He tried to embrace a moon
In the Yellow River.”

Ezra Pound

তারপরে আরেকটি প্রবাদ আছে, আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর।

এখানে আদার ব্যাপারীকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে, তাকে নিরোতসাহীত করার চেষ্টা করা হয়েছে টিটকারি দিয়ে। এটা করছে কিন্তু হয় জাহাজ দিয়ে ব্যবসা করারা অথবা অন্য আদার ব্যাপারীরা।

জাহাজ দিয়ে যারা ব্যবসা করছে তারা নিজেদের আর প্রতিদ্বন্দ্বী চায় না। ফলে এর কোন বীজও তারা রাখতে ইচ্ছুক নয়। আজ আদার ব্যাপারীটি জাহাজ নিয়ে আগ্রহী হলে হয়ত তার ছেলে বা নাতি জাহাজ নিয়ে ব্যবসায় নেমে যেতে পারে। এরা হবে বর্তমানে জাহাজ দিয়ে যারা ব্যবসা করছে তাদের বা তাদের ছেলে/নাতিদের প্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে আগে থেকেই তাকে দমিয়ে দেয়া বেটার তাদের জন্য।

একইভাবে অন্য আদার ব্যাপারীরা মনে করছে, তোর কেন এতো আগ্রহ। এতো কিছু কেন জানবি তুই। তাহলে তুই আমাদের চাইতে আলাদা হয়ে গেলি। এতে তোর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কম্পিটিটিভ এজ পেতে পারে। অথবা তোর জাহাজের জ্ঞান দিয়ে তুই নিজে কিছু সুবিধা পাবি হয়ত। তাই তোকে এই পথে যেতে দেয়া ঠিক হবে না।

কিন্তু আমরা দেখতে পাই, আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবরে আগ্রহ থাকায় কোন দোষই নেই। বরং এটা তার সেরা একটি গুণ। আগ্রহ থাকাটা বিরাট গুণ। এইসব আগ্রহ তাকে জ্ঞান অর্জনের দিকে নিয়ে যাবে। আর বেশি জ্ঞান অবশ্যই তাকে নানাভাবে সাহায্য করবে, হাতেহাতে ফল না আসলেও। নিন্দুকেরা এই হাতেহাতে ফল আসছে না, এটার উপর ভিত্তি করেই কিন্তু সমালোচনাটি করছে। নিন্দা যতই হোক, আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর নেয়া যদি চালিয়ে যেতে থাকেন, এতে একসময় এর উপকার পেতে পারেন।

এই প্রবাদ জনপ্রিয় হয়েছে আগ্রহলেস অল্পবুদ্ধি মানুষের জন্য। তাদের আগ্রহ কম তাই তারা চায় সবার আগ্রহ কম হোক।

আরেকটা প্রবাদ আছে, পয়লা দর্শনদারি, তারপর গুণবিচারি।

সাইকোলজিক্যালই ফার্স্ট ইম্প্রেশন অনেক গুরুত্বপূর্ন। এদিক থেকে বাক্যটির এক অংশ ঠিক আছে, মানব প্রকৃতির সাথে যায়। কিন্তু এই প্রকৃতির বশবর্তী হয়ে চলা সব সময় ভালো ফল বয়ে আনবে না। ফার্স্ট ইম্প্রেশনে কাউকে ভালো মনে হলেই সে ভালো হবে বা ফার্স্ট ইম্প্রেশনে খারাপ মনে হলেই খারাপ হবে এমন নয়। কারণ ঐ ফার্স্ট ইম্প্রেশনের সময় তার মানসিক শারীরিক অবস্থা কেমন ছিল ও আপনার মানসিক ও শারীরিক অবস্থা কেমন ছিল তাও গুরুত্বপূর্ন এখানে।

এছাড়া এই প্রবাদটি বিয়ের ক্ষেত্রে শোনা যায়। আগে কন্যার রূপ, পরে দেখ গুণ।

এখানে একটি বিষয় আছে বুঝার মতো। এই কথাটি পশ্চিমা বর্ণবাদী কথা নয়। পশ্চিমা বর্ণবাদ ও আমাদের চেহারা ফর্সা হওয়া জনিত কথাবার্তা এক নয়। আমাদের ব্যাপারটা হলো অর্থনৈতিক।

যেমন, কোন মেয়ে দেখতে ফর্সা মানে, তার বিয়ে দেয়া সহজ। ভালো ঘরে বিয়ে দেয়া যাবে। এখানে বাপের পরিবার থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা।

আর বরের বাপের পরিবার থেকে অর্থনৈতিক সুবিধাটা হলো, কন্যা ফর্সা হলে তার সন্তানাদি ফর্সা হবে। এদের তখন বিয়ে দেয়া, ও ছেলে হলে তাদের জন্য ফর্সা বউ আনা সহজ হবে।

এখানে ফর্সার তাই একটা অর্থনৈতিক মূল্য আছে। এর উপর ভিত্তি করেই ফর্সা ও কালোর বৈষম্য হয়। এটি একটি অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় বৈষম্য। (পশ্চিমের বর্ণবাদ হয় আলাদা জাতির মধ্যে। কালো এবং সাদা তাদের আলাদা জাত। এইরকম জাতবৈষম্যের প্রবণতা হিন্দুদের বর্ণপ্রথার মধ্যে আছে আরো তীব্রভাবে। )

রঙ ফর্সা ও কালোর বৈষম্যের পিছনের মূল কারণ যে অর্থনৈতিক তা বুঝতে আরেকটি প্রবাদ স্মরণ করা যায়, সেটি হলো, “জাতের মেয়ে কালো ভালো” । জাতের মেয়ে হলে কেন কালোও ভাল? কেন তখন দর্শনদারি হয় না প্রথমে? কারণ এই মেয়ে ভাল জাতের তাই এর আচার ব্যবহার ভাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এর পরিবার প্রতিষ্ঠিত ফলে অর্থনৈতিক সুবিধাও আছে।

অর্থনৈতিক ভিত্তিমূলের উপর দাঁড়িয়ে, এবং এই কারণে কালো রঙের মানুষের উপর আজীবন বৈষম্য করে যাওয়া হয়, যা স্পষ্টত অনৈতিক। এই প্রবাদটি তাই খারাপ একটি জিনিসকে প্রমোট করে। এটি প্রবাদে পরিণত হয়েছে কারণ অধিকাংশ মানুষ এই খারাপকে ধারণ করে।

পহেলা দর্শনদারি, পরে গুণবিচারি, কথাটি বর্তমান আধুনিক বাস্তবতায় আর মানানসই নয়। কারণ এখন অর্থনৈতিক পটেনশিয়াল গিয়ে ঠেকেছে ছেলে বা মেয়ের যোগ্যতার উপরে। সে যোগ্যতা লেখা পড়া বা অন্য কোন স্কিল দিয়ে হতে পারে।

এরকম যে আরো কতো প্রবাদে সমস্যা আছে। এছাড়া এগুলি হিন্ডসাইট বায়াসে আক্রান্ততার চমৎকার নিদর্শন। যেমন, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো বলা হবে যখন দেখা যাবে কিছু নাই থাকার চেয়ে একটা কিছু থেকে ভালো হবে। আবার সেই একটা কিছু থেকে খারাপ হলে বলা হবে দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো।

দুই ক্ষেত্রেই ঘটনা ঘটার পর এমনভাবে বলা হবে যেন প্রাচীন এই উইজডমে আগেই বলা ছিল, আমি আগেই জানতাম, কিন্তু এগুলি আসলে হিন্ডসাইট বায়াস।