আদিপুরুষ, রামায়ণ এবং সমুদ্র পারে যাবার দুই ভিন্ন তরিকা

এক

আদিপুরুষ দেখলাম। প্রভাসরে ভালো লাগে নাই, পরিচালক ঠিকমত তারে ব্যবহার করতে পারেন নাই। রাবণের চরিত্রে সাইফ আলী বেটার। ফিলিমটা কার্টুন কার্টুন হইছে, বাট উপভোগ্য।

ইন্ডিয়ান হিরোদের ক্ষেত্রে, রামায়ণে বা মহাভারতে কমিটমেন্ট এক বিশাল জিনিশ। বচন দেতা হু, এই বচন দিয়া দিলে প্রাণ দিয়ে হলেও তারা রক্ষা করতে যান।

সকল অভিযান বা স্ট্রাগলের মূলে দেখা যায় আছে কোন বচন।

যেমন রাজা দশরথ রানী কৈকেয়ীর সেবায় মুগ্ধ হয়ে তার দুইটা ইচ্ছা পূরণ করবেন কথা দিছিলেন। ছেলে রাম যখন রাজ্যে রাজা হবেন তখন রানী তার দুই ইচ্ছা নিয়া আসলেন। বললেন আমার ছেলে ভরতরে বসাইতে হবে, আর রামরে দিতে হবে নির্বাসন। রাজা ক্ষিপ্ত হন, কিন্তু রাম মেনে নেন।

বনবাসে যখন সীতা উদ্ধারের জন্য লক্ষণ কইলেন, ভ্রাত রাম, আমরা অযোধ্যার সেনা লইয়া লংকা এটাক করি, তখন রাম না করেন। কারণ তিনি তখন অযোধ্যার কেউ না। এই বিপদেও নিজ থেকে এটাকের চিন্তা করেন। লক্ষণ কন, তাইলে ভ্রাতা, আপনে কি সীতামারে ভালোবাসেন না? রাম কন, সীতা আমার লাইফ, বাট আমার সম্মান আমার কাছে লাইফের চাইতেও বড়!

কথা দিয়া কথা রাখা আর আত্মসম্মান দুইটা একটার সাথে আরেকটা জড়িত বিষয়।

রাম ও লক্ষণ ছিলেন সৎ ভাই, বৈমাত্রেয়। লক্ষণ রামের জন্য উতসর্গীত প্রাণ। অন্যদিকে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দূর্যোধনেরা ছিল পাণ্ডবদের চাচাত ভাই। পাণ্ডবেরা তিনজন এক মায়ের ছেলে বাপ ভিন্ন, দুইজন অন্য মায়ের। তাদের বড় ভাই কর্ণ তাদের বিরুদ্ধে থাকেন বন্ধুর প্রতি দায়িত্ব ও লওয়ালটির অংশ হিশাবে।

সৎ ভাইরা মিলমিশ করে থাকেন। চাচাত ভাইরা শত্রুতা করে, এটা কি এক ইনসাইট?

ভাইয়েরা যে পরস্পর মিলেমিশে থাকেন, এটা লওয়ালটির শিক্ষা। বচন দেয়া ও আত্মসম্মানরে লাইফের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ধরাটাও। একটা কন্ট্র্যাস্ট এখানে পশু বানররাজ সুগ্রীব ও তার ভাই বালির কাহিনীতে। বালি বড় ভাইরে মানে নাই। ফোর্স দিয়া সব দখল করে নিছিলো।

অন্যদিকে মানুষ রাম ও লক্ষণ ভাইয়ে ভাইয়ে লয়াল।

লঙ্কারাজ রাবণের ভাই বিভীষণও “সত্যের” খাতিরে ভাইয়ের প্রতি লয়ালটি বাদ দিয়ে রামের পক্ষ নিলেন। একইরকম ন্যায়ের দ্বন্দ্ব উপস্থিত হইলে মহাভারতের ভীষ্ম তার বচন ও কুরু সিংহাসনের প্রতি তার লওয়ালটি হারান নাই, পাণ্ডবদের বিরুদ্ধেই থাকছেন।

আবার, লঙ্কেশ রাবণ যে সীতা অপহরণ করলেন, সেটা তো তার বইন সুপর্নখার নাক কাটা অপমানের প্রতিশোধ নিতে। অনেকে রাহুল গান্ধীর মত বলবেন, লাংকা কো হানুমান নে নেহি জ্বালায়া, লাংকা কো রাবান কে আহাংকার নে জ্বালায়া তা।

যদিও এইভাবেই উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু, সে অহংকার দিয়া যুদ্ধটা শুরু করে নাই। বইনের অপমানের প্রতিশোধ নিতে গেছিল প্রথমে। পরে নিজের “সম্মান” রাখতে পিছু আর হটে নাই।

মহাবীর হেক্টরও তো ভাই যখন এগামেমনের ভাইয়ের বউ ভাগাইয়া নিয়া আসলো, তখন গ্রীকদের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে ভাইয়ের পক্ষেই দাঁড়াইছিলেন। এই কারণে তারে সম্মানও দেয়া হয়।

এই লওয়ালটি, বচন দেতা হু বলে বচন দিলে প্রাণ দিয়া হলেও তা রক্ষা, এইটা দিন শেষে বিশ্বাসের ফাউন্ডেশন তৈরি করে। বিশ্বাস তৈরি পারস্পারিক ইউনিটি, সমৃদ্ধি ও শক্তির পথ।

এইসব গল্পে বিশ্বাস ও ধর্ম (সত্য ও ন্যায় অর্থে) এর নানা কনফ্লিক্টিং সিচুয়েশন দেখানো হয়।

কখন আপনে লওয়াল থাকবেন, আর কখন ধর্মের লগে সংঘর্ষ দেখে লওয়ালটি ত্যাগ করবেন।

কিন্তু মানুষের মনে এইসব প্রশ্ন আসবেই, বিভীষণ যে ভাইয়ের পক্ষ ত্যাগ করলেন রামের পক্ষ নিতে, কাজটা ঠিক হইল কি না? প্রিয়াম পুত্র হেক্টরের কি উচিত হইল ভাইয়ের কুকর্মের পক্ষে দাঁড়ানো, না দাঁড়ানো কি বেটার হইত?

আধুনিক সমাজে লওয়ালটি, বিশ্বাস এবং আত্মসম্মান এই তিনটা হারাইয়া গেছে। এর নামে যেগুলা আছে প্রচলিত সব ফেইক। নিশ্চিত পতন জেনেও লওয়ালটি ও আত্মসম্মানের জন্য আমরা লোকদের স্ট্যান্ড নিতে দেখি প্রাচীন গল্পগুলিতে, সেইখানে এখন অল্প কিছু টাকা বা ক্ষমতার জন্য এখন মানুষেরা ধান্দাবাজি করে। যেমন ইভ্যালিরে কত সেলিব্রেটি সাপোর্ট করলো, প্রমোট করলো।

দুই

অলৌকিক ভাবে সমুদ্র পার হবার আব্রাহামিক ক্যাননেও আছে, হিন্দু প্রাচীন গল্পেও আছে। কিন্তু দুই পার হওয়া দুইরকম।

হিব্রু প্রফেট ও লিডার যখন ইজরাইলাইটদের নিয়ে পালাচ্ছিলেন মিশরের ফারাওয়ের হাত থেকে বাঁচতে, তখন তিনি রেড সি ভাগ করে ফেলেন। তার লোকেরা পার হয়ে যায়। ফারাওয়ের সেনারা আসলে পানি আবার এক হয়ে যায়।

এই সমুদ্র দুইভাগ করার সময়ে তিনি তার গডরে স্মরণ করেন উপায়ান্তর না দেখে। তখন গড বলেন, সমুদ্রের উপরে দুই হাত প্রসারিত করো, সমুদ্র ভাগ হয়ে যাবে, শুকনার উপর দিয়ে পার হয়ে যাবে লোকেরা।

টেন কম্যান্ডমেন্টস ফিলিম থেকে বামের ছবি।

আর রামায়ণে যখন সমুদ্র পার হবার দরকার পড়লো লংকায় যাইতে, তখন রাম সমুদ্রে ব্রহ্মাস্ত্র মারতে উদ্যত হন। সমুদ্র বলে উঠে, দয়া রাঘব, দয়া!

সে বলে, আমি সমুদ্র, এইটাই আমার স্বভাব। আমার কোন শুরু বা শেষ নাই।

রাম বলেন, কিন্তু আমার যাইতেই হবে, তোমার স্বভাব যাই হউক।

সমুদ্র বলে, আপনার নাম নিয়া কতো দীন দুখী পার পাইয়া গেল রঘুনন্দন, আপনার সেনাদের বলেন আপনার নামে পাথর নিঃক্ষেপ করতে, আমি ডুবাব না।

বানরেরা রামের নামে পাথর ছাড়লো, ডুবলো না। তৈরি হলো ভাসমান সেতু।

মোজেস যেখানে সমুদ্র ভাগ করে ফেলেন, রাম সেখানে ভাসমান সেতু তৈরি করে সমুদ্র পার হন।

পরিস্থিতি দুই জায়গাতে ভিন্ন ছিল, কিন্তু তাও, দুই ধরণের এপ্রোচ দেখেন।

রাম স্বয়ং ঈশ্বর, আর মোজেস ওইখানে প্রফেট, ঈশ্বর না।

আব্রাহামিক গল্পগুলির ধারাবাহিকতায় সমুদ্র প্রাকৃতিক, এর কোন ব্যক্তিত্ব নাই যে সে কথা বলবে। অদৃশ্য ঈশ্বর যা চাইছেন তাই হইছে।

অন্যদিকে হিন্দু গল্পের যে ধরণ তাতে সমুদ্রের কথা বলা অস্বাভাবিক না। ঈশ্বররে নিজের অনুরোধ জানানোর জায়গা থাকে, এই জায়গা থেকে সমুদ্র রামরে অনুরোধ জানাইছে।