সত্যজিৎ রায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন কথা বলেন নি, একথা জেনে অবাক হয়েছিলাম; এবং মেজাজ খারাপ হয়। সত্যজিৎ এর গল্প ও তার সৃষ্ট চরিত্রসমূহকে অত্যধিক পছন্দ করে এসেছি, সুতরাং এই বড় প্রতিভার এহেন নিরবতা যুগপৎ অবাক ও ক্ষুব্দ করে।
অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র এরা ফোনে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তাকে বাংলাদেশের পক্ষে কলকাতায় অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে যেতে। সত্যজিৎ যান নি। মৃণাল সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাকে আনতে বাসায় গিয়েছিলেন, তাও তিনি মিছিলে বা সভায় যান নি।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সত্যজিৎ বাংলাদেশে আসেন আমন্ত্রণে ও ভাষণ দেন। মাত্র কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু সত্যজিৎ এর সেই ভাষণে এই যুদ্ধ, স্বাধীনতা ইত্যাদির কোন উল্লেখ নেই। তিনি কেবল বলেছেন “হঠাৎ কিছুদিন আগে ইতিহাসের চাকা ঘুরে গেল…”।
এই ভাষণটি আমি সম্প্রতি শুনলাম ও আবার চিন্তা করলাম সত্যজিৎ এর এই নিরবতার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে। সেই কারণ বিষয়ে চিন্তাই আমার এই লেখা, এবং এই লেখার ভিত্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সত্যজিৎ এর নিরবতা। আমার জানামতে তিনি নিরব ছিলেন। কিন্তু আমার জানার বাইরেও অনেক কিছু থাকতে পারে। তাই যদি দেখা যায় সত্যজিৎ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন, এমন কোন প্রতিবাদ বা বিবৃতি বা মন্তব্য আছে তার, তাহলে আমার লেখাটি তার ভিত্তি হারাবে। সেই সম্ভাবনা রেখেই আমি লিখছি।
ধারণা করি সত্যজিৎ রায় ১৯৪৭ এর দেশভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন, এবং পূর্ববাঙলার মানুষেরা ধর্মকেন্দ্রিক এই ভাগ বিভাজনে উন্মাদনা সহকারে অংশ নেয়, এতে তিনি আহত হন। ফলে পরবর্তীতে যখন পূর্ববাঙলার লোকেরা পাঞ্জাবীদের হাতে নির্যাতীত হয় তখন তিনি নিরব ছিলেন।
১৯৭২ এর ফেব্রুয়ারিতে সত্যজিৎ যে ভাষণ দেন, সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন তার ছোটকালের বাংলাদেশ ভ্রমণের কথা। তখন তার পাঁচ বা ছয় বছর বয়েস। পদ্মায় স্টিমারে থাকা অবস্থায় এক ভোরে তার মা ডেকে দেখিয়েছিলেন নদীর উপর সূর্যোদয়। সত্যজিৎ পরে বললেন তিনিও এও দেখেছিলেন যে পদ্মা ও শীতলক্ষ্যার জল যেখানে মিশেছে, সেখানে দুই নদীর পানি আলাদা রঙের হয়ে যাচ্ছে, একে অন্যের সাথে মিশছে না।
সত্যজিৎ ঐ ভাষণে বার বার বাংলাদেশকে “নিজের দেশ” বলেছেন, এবং আসলেই এটি তার নিজের দেশ। কিন্তু নিজের দেশে আসার প্রতি তার উদাসীনতা শীতলক্ষ্যা ও পদ্মার স্রোতধারা পরস্পরের সাথে না মেশার রূপকে দেখলে বলা যায়, একটা কারণ ছিল পূর্ববাঙলার লোকদের ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন ও উন্মাদনা, যা তার মতে এই অঞ্চলটিকে শীতলক্ষ্যায় পরিণত করেছে, ও মূল বাংলার ধারা অর্থাৎ পদ্মা থেকে রেখেছে আলাদা করে। এই নদীর স্রোতধারা না মেশাকে সত্যজিৎ দুঃখজনক হিসেবেই দেখেছেন।
সত্যজিৎ শেষপর্যন্ত ইন্ডিয়ান ইউনিয়নে বিশ্বাস করতেন। ফলে, বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের সাথে চলে গেল তখন এ নিয়ে তার আর কোন আগ্রহ ছিল না। এইজন্য তার গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদা নেপাল টেপাল ঘুরে আসলেও বাংলাদেশে কখনো আসেন না। বাংলাদেশের ঐতিহ্য কতো আংটি স্বর্ণমুদ্রা যে চুরি ডাকাতি হয়ে গেলো, সত্যজিৎ বা ফেলুদার সেদিকে কোন নজর ছিল না।
এই উদাসীনতা ইচ্ছাকৃত। এমনকী বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও ফেলুদাকে বাংলাদেশে আনেন নি সত্যজিৎ। নিজে সম্ভবত ঐ একবারই এসেছিলেন, আর আসেন নি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও সত্যজিৎ নিরব ছিলেন কারণ তিনি কলকাতাকে বাংলার কেন্দ্র মনে করতেন। তার কলকাতা প্রেম বিশাল। অন্য অনেক জায়গা থেকে ফিল্ম বানানোর আমন্ত্রণ পেলেও তিনি কলকাতা ছাড়েন নি। তিনি মনে করতেন কলকাতা ছেড়ে গেলে তিনি তার সৃষ্টির শক্তিটা হারাবেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, এবং যেহেতু ভাষা ভিত্তিক আন্দোলনটি ছিল এর জাতীয়তার মূলে, তাই বাংলাকেন্দ্রিক স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ায় বাংলার কেন্দ্র বাংলাদেশে চলে আসবে এটা বুঝতে পেরেছিলেন সত্যজিৎ।
ইতিমধ্যেই কলকাতার প্রাচীন ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে বলে আশংকা তিনি প্রকাশ করে যাচ্ছেন তার লেখায়। তার গল্পের বিখ্যাত নায়ক ফেলুদা মাড়োয়ারি ভিলেন মগনলাল মেঘরাজদের হাত থেকে রক্ষা করার শেষ চেষ্টা চালাচ্ছেন বাংলার ঐতিহ্য। প্রাচীন ও ক্ষয়ে যাওয়া জমিদার পরিবারের হাহাকার ছড়ানো সেইসব কাহিনীতে ফেলুদা যেন ঐতিহ্য রক্ষার শেষ যোদ্ধা, যিনি তৈরী করছেন ভবিষ্যত প্রজন্মের তোপসেকে। উপস্থিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে সত্যজিৎ দেখালেন লালমোহন গাঙ্গুলীর রূপকে। মগনলাল মেগরাজদের সামনে বড়ই দূর্বল।
ঐতিহ্য সচেতন সত্যজিৎ এর কাছে তাই স্বাধীন বাংলাদেশ আরেক আশংকা তৈরী করেছিল।
হয়ত তিনি তখন এই দ্বিধায় পড়েছিলেন যে, কলকাতার ঐতিহ্য বাঁচাতে কি ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হতে হবে, যেরকম বের হলো পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ? হয়ত ক্ষীণভাবে এই ভয় সত্যজিৎ এর মনে উঁকি দিয়েছিল।
ইন্ডিয়ান ইউনিয়নে বা অখন্ড ভারতে বিশ্বাস করা কারো কাছে ব্যাপারটা অস্বস্থিকর।
ফলে স্বাধীনতার আগে ও পরে দুই সময়েই বাংলাদেশ সত্যজিৎ এর কাছে স্বস্থিকর কিছু ছিল না।
এবং তিনি নিজের চিন্তা ও আবেগের প্রতি সৎ থেকেই বাংলাদেশের পক্ষে কিছু বলেন নি।
সংযুক্তিঃ
বাহাত্তর সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় সত্যজিৎ রায়ের ভাষণ – লিংক।