সেকুলারিজম কেন রাষ্ট্রের জন্য দরকারী?

সেকুলারিজম  ধারণাটি একটি আধুনিক ধারণা, যার জন্ম হয়েছে ইউরোপিয়ান জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রেমিজে। সেকুলারিজমের বাস্তব প্র্যাক্টিসের মূল আইডিয়া ছিল সেখানে চার্চ এবং রাষ্ট্রকে আলাদা করা।

কিন্তু মাল্টি রিলিজিয়াস যেসব দেশ আছে যেমন ইন্ডিয়া বা নন ইউরোপিয়ান বাস্তবতার বাংলাদেশ ইত্যাদির ক্ষেত্রে এই সেকুলারিজমের আইডিয়াটি কতটুকু কার্যকরী?

প্রশ্নটার মূল সুর এটাই, কারণ সকল আধুনিক রাষ্ট্রের ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি এক না।

আমাদের সমাজে সেকুলারিজমের যে সমালোচনা আছে তার মূল সুর হলো সেকুলারিজম ইউরোপিয়ান, এটি আমাদের সমাজে চলবে না। সেকুলারিজম মানে সমাজকে ধর্মহীন করে তোলা। মোল্লাদের ওয়াজ থেকে মডারেট এবং অনেক বুদ্ধিজীবী এই দুই লাইন ধরেই তাদের সমালোচনা নিয়ে আগান।

একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আলাদা করা দরকার।

সেকুলারাইজেশন ও সেকুলারিজম এক না।

সেকুলারাইজেশন হলো, সামাজিক ও মতাদর্শিক পরিবর্তন। ইউরোপিয়ান বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে ঈশ্বরের মৃত্যু সাধিত হয়, এবং ম্যাজিকের মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনার ফলশ্রুতিতেই ধর্ম থেকে মানুষের সরে আসার শুরু, এবং এই সামাজিক ও মতাদর্শিক পরিবর্তন হলো সেকুলারাইজেশন। যেমন চার্চে যাওয়া কমলো, দুনিয়া তৈরি বিষয়ে ঐশ্বরিক মিথগুলির উপর আস্থা কমলো, ধর্মীয় আচার খাবার দাবারের রীতি ইত্যাদি বদলালো। এই সমস্তটা সামাজিক ও মতাদর্শিক পরিবর্তন।

পক্ষান্তরে সেকুলারিজম বা যেটাকে আমরা ধর্ম নিরপেক্ষতা বলি, সেটা হলো, কোন ভাবেই সামাজিক মতাদর্শিক সাধারণ পরিবর্তন নয়, বরং একেবারে নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ। সমাজে ধর্মীয় রীতি নীতি বা আচার নিয়ে এটি ভাবিত নয়। বরং রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে তার মূল জায়গা হলো, পলিটি তথা রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ও আইনকে ধর্মের সরাসরি প্রভাব থেকে দূরে রাখা।

এখন কেউ বলতে পারেন সমাজে ধর্মীয় রীতি আচার ইত্যাদি থাকলে রাষ্ট্রে তো তার প্রভাব থাকবেই, বিশেষ করে পরোক্ষ প্রভাব। সেক্ষেত্রে সামাজিক মতাদর্শিক পরিবর্তন ব্যতিরেকে কি রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব?

এর উত্তর হলো, রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে সেকুলারিজম রাষ্ট্রকে ধর্মের প্রত্যক্ষ বা সরাসরি প্রভাব থেকে বাঁচাতে চায়। পরোক্ষ প্রভাব থাকলে তা ভিন্ন কথা।

একজন ব্যক্তির ধার্মিক হয়েও সেকুলার হওয়া সম্ভব। তেমনি কোন জায়গার সেকুলারাইজড না হয়েও সেকুলার হওয়া সম্ভব। যেমন আমেরিকার অনেক রাজ্য।

সেকুরালিজম একটা আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে হলে দুইটা দিকে ভাবতে হবে-

প্রথমত, দেখতে হবে কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, কোন যুক্তিতে এর জন্ম হয়েছিল। এটি কী ভূমিকা রেখেছে।

দ্বিতীয়ত, টার্মটিকে বিশ্লেষণ করতে হবে।

কেউ যদি কেবল টার্মটিকে বিশ্লেষণ করেন ও এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে, এই কনসেপ্ট আসার যুক্তিকে অস্বীকার করেন, তাহলে এটি ভুল বিচার হয়, এবং এর সম্পর্কে ভুল মেসেজ ছড়ায়।

ঐতিহাসিক বুঝাপড়া ও টার্মের এনালাইসিস, এই দুইয়ের ভারসাম্যই দেখিয়ে দিতে পারে আসলে সেকুলারিজমের কোন গুরুত্ব আছে কি না।

সেকুরালিজম কনসেপ্টটি আসার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে সহজভাবে এইরকম বর্ণনা করা যায়,

১৭ শতকে ইউরোপে আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্তার শুরু হলো। আগে ধারণা ছিল যারা রাজা বা ক্ষমতায় আছে তাদের ক্ষমতায় থাকার বা শাসন করার ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা আছে। যেটাকে বলে ডিভাইন রাইটস থিওরি। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের ফলে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির যে বিকাশ হলো তাতে তারা বুঝতে পারলো এটা ঠিক না। ফলে এই কনসেপ্টে মানুষ আস্থা হারাল।

এরপর এলো, দর্শন দিয়ে রাজার শাসনকে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা। হবস এবং লকের মাধ্যমে সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব। এর কথা হলো মানুষ প্রকৃতিগত ভাবে পাশবিক। তাই নিয়ম শৃঙ্খলার জন্য উপরে কেউ থাকা দরকার। এখানে চুক্তিটা হলো, রাজা নিয়ম শৃঙ্খলা বজায় রাখবেন আর এইজন্য প্রজারা তাকে মানবে।

কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে এই তত্ত্ব বেশি গৃহীত হলো না। তখন দর্শন বা দার্শনিক ব্যাখ্যা থেকে অন্যভাবে এই “শাসকের শাসন করার ন্যায্যতা” জনিত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হলো।

এই সময়ের মধ্যে, ওয়েস্টফেলিয়ান শান্তিচুক্তিগুলির প্রভাবে জাতি-রাষ্ট্রের শুরু হয়েছে।

এই জাতি ভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা আগে ছিল না। নতুন ধরণের এসব রাষ্ট্রেও শাসকের ন্যায্যতার জন্য দরকার ছিল জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ মানে জাতিভিত্তিক চেতনা, দেশপ্রেমও যেটাকে বলে। সমগ্র ইউরোপে এই জাতীয়তাবাদ একটা পদ্বতিতেই জাগানো হয়েছে। তা হলো কোন অঞ্চলের লোকদের শত্রু হিসেবে ঘোষনা দেয়া ও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। আর জাতীয়তাবাদ জাগ্রত হলে, হিউমেন সাইকোলজির প্রকৃতি অনুযায়ী মানুষ দেশপ্রেম, হিরোইজমে মগ্ন হবে, এবং শাসককে শাসনের ন্যায্যতা দিয়ে দিবে। এভাবে দিয়েছেও।

কাদের শত্রু বানানো হয়েছিল? অঞ্চলভেদে আইরিশদের, ইহুদিদের, ক্যাথোলিক অঞ্চলে প্রটেস্টেন্টদের, প্রটেস্টেন্ট অঞ্চলে ক্যাথোলিকদের। এভাবে, শত্রু বানিয়ে তাদের উপর অন্যায় নির্যাতন করে ম্যাস পিপলকে একতাবদ্ধ করা হয়েছে।

এই জায়গাতেই সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর ধারণা আসলো। সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করেছে ও এর মধ্য দিয়ে তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার বিস্তার হয়েছে, এবং জাতি রাষ্ট্রের নির্মান হয়েছে। এই নির্মানটা ধর্মীয় নির্মান, যেহেতু ধর্ম ও ধর্ম ভিত্তিক “আমরা” ও “তারা” ভাগই ছিল এর মূল। এই হলো ইউরোপিয়ান জাতি রাষ্ট্র তৈরি হবার ইতিহাস।

এখন ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদের ফলে জন্ম নেয়া এসব রাষ্ট্রে যেহেতু সংখ্যালঘুরা নির্যাতীত হয়েছিল তাই প্রায়ই সংখ্যালঘুরা বিদ্রোহ-আন্দোলন করতো। এর ফলে অশান্তি ও আইন শৃঙ্খলার অবনতি শুরু হলো একটা পর্যায়ে।

একসময় বুঝতে পারা গেল ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদই সমস্যার মূলে, এবং এটিকে দূর করা না গেলে রাষ্ট্র থেকে অশান্তি যাবে না। তখনই সেকুলারিজমের উদ্ভব হয়। রাষ্ট্রিয় আইন, প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মের প্রভাব দূর করার নিমিত্তে, ও ধর্মকে ব্যক্তির ব্যক্তিগত লাইফে নিয়ে যেতে।

আধুনিক রাষ্ট্রে যখন ধর্মের প্রভাব থাকবে রাষ্ট্রের আইনে বা প্রতিষ্ঠানে, তখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা একইভাবে নির্যাতীত হবে ও অন্যায়ের স্বীকার হবে। বর্তমান ভারতে দেখা যায় হিন্দুত্মবাদী রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের পরে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলিমদের নাজেহাল অবস্থা। ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদ এখানেও কাজ করছে একটা রাজনৈতিক শক্তিকে একত্র করতে। এখানেও ‘আমরা’ ও ‘তারা’র ভাগ হয়েছে।

একইজিনিস যেকোন সমাজে হবে যখন ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদকে প্রাধান্য দেয়া হবে ও রাষ্ট্রকে ধর্মের নিয়ন্ত্রণাধীন করা হবে। যা সংখ্যালঘুদের নির্যাতন, তাদের প্রতি অন্যায় ও দিন শেষে রাষ্ট্রে অশান্তি নিয়ে আসবে।

এজন্য প্রতিটি আধুনিক রাষ্ট্রের উচিত ধর্ম নিরপেক্ষ হওয়া। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ছবিঃ দার্শনিক আকিল বিলগ্রামি।

আরো পড়তে হলে বই Secularism, Identity, and Enchantment (Harvard University Press, 2014),  দার্শনিক Akeel Bilgrami।