জান বাঁচানোর জন্য সাকিব ক্ষমা চাইলে, এতে আপত্তির কিছু নাই। একজন লোক জান বাঁচাইতে চাইতেই পারে, আর তার জানের মূল্য যেহেতু দেশের জন্য অনেক বেশি। নিজের জন্য তো অবশ্যই।
প্রিয় দার্শনিক ডেভিড হিউম একবার গর্তে পড়েছিলেন। উঠতে পারেন না। তার এক প্রতিবেশী বৃদ্ধ মহিলারে দেখে বলছিলেন, আমারে তোল।
মহিলা বলে, নাস্তেকের নাস্তেক, মর এইখানে। তুলব গডের প্রতি ইমান আনলে।
সাথে সাথে বিজ্ঞ হিউম ভক্তি ভরে ইমান আনলেন। মহিলা তারে তুললেন।
যদিও হিউমের ক্ষেত্রে ঐটা ছিল একজন মাত্র লোক, আর হিউম নিজের চিন্তার সততার জায়গা থেকে এক চুলও নড়েন নাই। তার সময়ে সমসাময়িকেরা তার লেখাগুলারে বাদ দিতে চাইছিল সন্দেহবাদ ও নাস্তেকতার অভিযোগে। পরে, এইগুলা প্রভাব ফেলছে তার বন্ধু, আরেক স্কটিশ এডাম স্মিথ সাহেবের চিন্তায়, জেরেমি বেন্থামের চিন্তায়, কান্টের চিন্তায়, এবং মহাত্মা ডারউইনের তত্ত্বে।
ফলত, সাকিবের কর্মের সাথে হিউমের ঘটনা আনাটা সমীচীন না, তথাপি আনলাম তারে বেনিফিট অব ডাউটে রাইখা, তার জীবন বাঁচানিটারে ফোকাসের কেন্দ্র বিন্দু ধইরা। অন্যথায়, আমি আশাও করি না যে, একজন কেরিয়ারিস্ট ক্রিকেটারের নৈতিক অবস্থান একজন দার্শনিকের মত হবে।
কিন্তু কখনো এইটা হয়ে যায়। যেমন মোহাম্মদ আলী নামে একজন মস্ত খেলোয়াড় ছিলেন। দার্শনিক নাসিম তালেব বলছিলেন, যারা নন হিরো এদের জিতার বিভ্রান্তি দিতেই খেলা তৈরি হইছে। এই লাইনে গিয়া বলা যায়, নন হিরোদের সমাজে হিরোর সম্মান দিতে কেরিয়ারিস্ট খেলাধুলার ব্যবসাপাতি। কারণ এরা যত হিরো হবে সমাজে, তত পণ্য প্রচারে সুবিধা, যেহেতু ব্যক্তি হিসাবে এরা সাধারণত হিরোয়িক হয় না। এদের হিরোগিরি হচ্ছে হিরগিরির ইল্যুশন। বাট কেউ কেউ হয়ে যান, যেমন এই মোহাম্মদ আলী।
আমেরিকান নাগরিকত্বের নিয়ম আছে, যুদ্ধে ডাকলে আপনারে যাইতে হবে যুদ্ধ করতে। ১৯৬৭ সালে এপ্রিল মাসে আলীরে ভিয়েতনামে যুদ্ধে যাইতে বললে তিনি বিরোধিতা করেন। বলেন যে, আমি মুসলমান, আমার ধর্ম বলে না আক্রান্ত না হইলে আক্রমণ করতে। আর ভিয়েতনামের লোকদের সাথে আমার তো মাইর নাই। তারা আমারে কেন বলে ইউনিফর্ম পইড়া দশ হাজার মাইল দূরে গিয়া এইসব বাদামি লোকদের বুম ও বুলেট মারতে যেখানে এই লুইভিলেই নিগ্রো লোকদের কুত্তার মত দেখা হয়?
এই হিরোইজমের জন্য তারে মূল্য দিতে হইছিল। যেইটা দুনিয়ার তাবৎ হিরোদেরই দিতে হয়। ৩ বছরের নিষেধাজ্ঞা, হেভি ওয়েট টাইটেল কেড়ে নেয়া। এবং তার সাজা হইছিল ৫ বছরের জেল এবং ১০ হাজার ডলার ফাইন।
যাক, এইটা সবাই পারবে না। কারণ এই জায়গায় স্কিন থাকে, একটা রিস্ক নিতে হয় বা মূল্য দিতে হয়। সিনেমার নায়ক বা খেলার নায়কদের কাছ থেকে বাস্তব জীবনের হিরোইজম প্রত্যাশা না করাই ভালো।
যেই জায়গায় সাকিব আসল সমস্যা করছেন, তা হল, মুসলিমদের একতার ডাক দিয়া। এটা খুবই প্রবলেমেটিক। প্রবলেম ধরতে পারবেন যদি ভাবেন সৌম্য সরকার বা লিটন দাস বলতেছেন, আমাদের হিন্দুদের এক থাকতে হবে, দুই হইলেই আমরা দূর্বল বা ওয়ার্নার বলতেছেন আমাদের খ্রিস্টানদের এক থাকতে হবে..বা কোহলি বলতেছেন সকল হিন্দু এক হইয়া থাকতে হবে, নাইলে আমরা দূর্বল….বা বাঙালী ছাড়া ভিন্ন জাতিস্বত্তার কোন কিরকেটার যদি জাতীয় দলে চান্স পাইয়া যান, ধরা যাক চাকমা, আর তিনি বলেন, আমাদের চাকমাদের এক থাকতে হবে, নিজেদের মধ্যে বিভেদ করলে আমরা দূর্বল…তখন ভাবেন জিনিসটা কী অর্থ নিয়া আপনাদের সামনে আসত আর উক্ত ব্যক্তিরা ফেইসবুকে কী প্রত্যক্ষ করিতেন। সৌম্য বা কোন হিন্দু কিরকেটার, বা ভিন্ন জাতিস্বত্তার কেউ এইরকম কথা বললে, তার আর জাতীয় দলে খেলা হবে না, খুব সম্ভবত।
এমন কিছু যেন আমরা না করি যেটা মানুষকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলে দেয় যে আমরা আসলে এক নাকি আলাদা। কারণ, আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত এক থাকব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা শক্তিশালী।… আমি মনে করি, আমরা যারা মুসলমান আছি, এক থাকব সবসময়। কারণ, আমাদের এক থাকা জরুরি। যখনই আমরা আলাদা আলাদা হয়ে যাব, তখনই আমরা দুর্বল, যখনই আমরা এক থাকব, তখনই আমরা স্ট্রং।
সাকিব আল হাসান, ক্রিকেটার।
সাকিবের ভক্ত নানা ধর্ম গোত্রের লোক ছিলেন। ক্রিকেট দেখে ভালবাসছেন তারে। তিনি এখন এমন একতার ডাক দিয়া ফেললেন, যা এক গোত্র ছাড়া অন্য সবাইরে এক্সক্লুড করে। সামাজিক প্রেক্ষাপটে, অন্যদের এক্সক্লুড করার এই ডাক প্রতিক্রিয়াশীলদের অবস্থান, যা অন্য গোত্র ও জাতি যারা সংখ্যায় কম তাদের সামাজিকভাবে অনিরাপদ করে, মানসিকভাবে নিরাপত্তাহীনতার ফিল দেয়। সাকিব এই ডাক দিয়া সামাজিক অন্যায় করেছেন। তার বেশীরভাগ ভক্তকূলদের মন রাখতে গিয়া, সংখ্যায় কম থাকা ভক্তদের বিশ্বাস ও আবেগরে কেয়ারই করেন নাই। এটাই পপুলিজমের বিপদ। আল্লার দুনিয়ায় সমস্ত রকম নৈতিকতাবর্জিত দোজখ কায়েম করার জন্য এই পপুলিজম যথেষ্ট।
এবং দ্বিতীয়ত, সমস্যাটা মুসলমান সমাজের। যে এই সমাজ এখন এই অবস্থায় যাইতেছে যে, পূজা উদ্বোধনের ছবি ভাইরাল হবার নিমিত্তে একজন মুসলমানরে, যে কিনা দেশের সবচাইতে পপুলার সেলিব্রেটি, তারেও জনতার সামনে দাঁড়াইয়া এইভাবে মাপ চাইতে হয় ও প্রমাণ দিতে হয় যে সে মুসলমান। এইটা সেই বাংলাদেশ যেইখানে পূজার মেলায় হিন্দু মুসলমানের সংযুক্তি ছিল, এর ভালো বর্ণনা কবি জসীমউদ্দিনের ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত জীবন কথা বইয়ে মিলে, “চৈত্র-পূজা” প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য। তখন ঝামেলা যে হইত না, এমন মনে করি না। হইত, মিটতো। কিন্তু যেহেতু “কম্যুনিটি” ভিত্তিক ছিল ব্যবস্থা, তাই গোত্রদের পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতা ছিল কমবেশি। আর এই নির্ভরশীলতা একসাথে থাকার পরিবেশ তৈরি করেছিল সময়ের ব্যবধানে। এই বাংলাতে যে ভয়ের কালচার তৈরি হইতেছে ইসলামের নাম দিয়া, তা কেন, ও কারা তৈরি করতেছে? এর ফল কি দেশের মানুষের জন্য ভালো হবে, সেইটা ভাবা জরুরী, দেশের বুদ্ধিমান মুসলমানদের, এবং রাষ্ট্রচালকদের দায়িত্বই বেশি এক্ষেত্রে।
কারণ লোকালয়ে যখন আগুন লাগে, তখন কারো পুটকিই বাঁচে না, এমন বলে গেছেন প্রাচীন বিজ্ঞজনেরা। তাদের কথারে ফেললে হবে না। যেই জায়গায় লোকালয় গণহারে নাশ হইবার আশংকা থাকে, সমস্ত সমাজের স্ট্র্যাকচার ভাইঙ্গা পড়ার আশংকা থাকে, সেইখানে ঘটনা ঘটার আগে স্টেপ নিতে হয়।