এই লেখাটা কেরিয়ার বিষয়ক বা লাইফ বিষয়ক কয়েকটা স্কিল নিয়ে লেখা। আমার এই সাইটের এক বড় অংশ পাঠক বয়সে ইয়াং। তারা তাদের স্কিল বাড়ানো, বা কী স্কিল নিয়ে কাজ করবেন বা প্যাশন কী বুঝতে পারছেন না, ইত্যাদি সমস্যায় পড়ে থাকেন ও কেউ কেউ আমাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেন বা করবেন বলে ভাবেন।
এই অংশটি পড়ে আপনি হয়ত ভাবছেন আপনি তাদেরই একজন।
এই লেখাটি এইসব পাঠকদের জন্য।
এটি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা।
সবার জন্য কাজ নাও করতে পারে। দিনে দিনে আমার এই ধারণাটি পোক্ত হচ্ছে সবাই বই থেকে বা অন্য কোন রিসোর্স থেকে একইভাবে নিতে পারে না। একই বই থেকে হয়ত দেখা যাবে কেউ গ্রেট ইনসাইট পেয়ে গেছে, অন্যজন পেয়েছে তত্ত্ব, আর আরেকজন কিছুই পায় নি।
এবং আরেকটা কথা হলো, আমরা মনে করি অমুক তমুক সফল ব্যক্তি মনে হয় সব জানে। কিন্তু এটা ভুল লাইনের চিন্তা। আমরা জিনিসগুলাকে লিনিয়ার ভাবি ও দ্রুত ব্যাখ্যা দাঁড় করাই। আসলে লাইফের প্রায় এভ্রি জায়গায় দক্ষতা ও ভাগ্য ওতপ্রোতভাবে একটার সাথে আরেকটা জড়িত। কোন জায়গায় দেখা যায় ভাগ্যের প্রভাব বেশি। সফল হতে হলে, কেবল স্কিল বা কেবল ভাগ্য থাকলে একজনের হয় না, দুইটাই থাকতে হয়। ফলে সফল অমুক তমুকেরাও আসলে কিছু জানে না বা সূত্র তারা বের করে ফেলে নাই জীবন সম্পর্কে। কারো কোন ক্লু নাই, সবাই ফিগার আউট করতে চাইতেছে।
তো আমি যেগুলারে কাজের মনে করি এমন কিছু স্কিলের ব্যাপারে এই লেখা।
এক – ইংরাজী
প্রথম স্কিল হিসেবে আমাদের দেশের লোকদের জন্য দরকার ইংরাজি ভাষায় দক্ষতা। এটিকে কেবল একটি ভাষা হিসেবে শিখতে হবে। এর গুরুত্ব বেশি কারণ এই ভাষায় ব্যবসা বাণিজ্য অধিক হওয়ার কারণে সুযোগ বেশি।
ইংরাজীতে দক্ষতা অর্জনের জন্য ইংরাজী বই পড়তে হবে। আগ্রহের বিষয়ের উপর ইউটিউব ভিডিও, কোর্সেরা এডেক্সে কোর্স করতে হবে।
ভাষাকে ভাষা হিসেবে শিখতে গেলে মনে রাখবেন ভাষার ফ্লো নষ্ট করা যাবে না। অনেকে ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড অর্থ বের করে পড়েন। আমি কখনো এটি করি নি, এবং এটি মারাত্মক বিরক্তিকর।
ভাষার ফ্লো দেখে অর্থ অনুমান করে নিয়ে এগিয়ে যাবেন। আপনি স্কুলের পরীক্ষার জন্য ইংরাজী শিখতে বসেন নি। ভাষা হিসেবে শিখতে বসেছেন।
অনেকে কঠিন কঠিন জিআরই টাইপের শব্দ শিখে এগুলি দিয়ে বাক্য রচনা করে অন্যকে চমকানোর বৃথা চেষ্টা করেন। এগুলি শিশুসূলভ বলে এড়িয়ে যাবেন।
যখন আপনার আগ্রহের বিষয় নিয়ে পড়তে থাকবেন, একসময় অভ্যাস হয়ে যাবে। ঘড়ি না ধরে দিনে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা এভাবে করে যান পাঁচ থেকে সাত বছর। ইংরাজী স্কিল অনেক উন্নত হয়ে উঠবে।
পরে এটি মারাত্মক কাজে দিবে।
ইংরাজি আপনি যাই পারেন, যতটুকুই পারেন কথা বলেন কথা বলার স্কিল বাড়াতে। অনেক সময় দেখা যায় আমরা অনেক ওয়ার্ড জানি, বাক্যের গঠন জানি কিন্তু কী বলব তা মুখে আসছে না। এটা হয় অভ্যাসের অভাবে।
অভ্যাস হলে, ব্রেইন খুব দ্রুত এগুলি প্রসেস করতে পারে।
অনেকে হাসবে এই ভয় পাবেন না। বাংলাদেশী মূর্খ ইডিয়টগুলাই হাসবে, এই ইডিয়টগুলার অনেকটার আবার একাডেমিক ডিগ্রিও আছে। এরা হলো নেগেটিভ, হীনম্মন্য ও তারা আপনারে দমাইতে এগুলা ব্যবহার করবে। আপনি তা পাত্তা দিবেন না। লাইফের কোন ক্ষেত্রেই এদের পাত্তা দিবেন না। প্রথমত এদের আইডেন্টিফাই করতে হবে ও রিমুভ করতে হবে লাইফ থেকে। এটা আরেক স্কিল।
লাইফে রাখবেন বা রেসপেক্ট করবেন কনস্ট্রাকটিভ সমালোচকদের। এরা ফিডব্যাক দিয়ে আপনার অনেক উপকার করে যান।
দুই – ইন্টারনেট
ইন্টারনেট কীভাবে ব্যবহার করতে হয় এটাও একটা স্কিল।
আমাদের দেশে ফেসবুক ব্যবহার এবং আরো কিছু ফালতু কাজে ইন্টারনেট অধিক ব্যবহার হয়।
আপনাকে শিখতে হবে, কীভাবে গুগলে সার্চ দিয়ে অথেনটিক তথ্য বের করা যায়। কীভাবে একাডেমিক জার্নালগুলা বের করা যায় ইন্টারনেটে। কীভাবে টপিক ভিত্তিক বেস্ট ব্লগ সাইটগুলি পাওয়া যায়। কীভাবে কোন ইমেজ বা তথ্যের সত্যতা পরীক্ষা করা যায়।
অর্থাৎ, বলা যায় ইন্টারনেট রিসার্চ।
একটু আগে আমার এক বন্ধু ফোন দিল, যে বড় সরকারী চাকরি করে। ফোন দিয়ে বলল, সাউথ এশিয়ার জিওপলিটিক্স নিয়ে ভালো সাইটের বা পডকাস্টের লিংক দিতে।
এই স্কিল তার নেই, এটা বের করার।
এই বন্ধু এক সময় দিনে পাঁচ থেকে সাত ঘন্টা ল্যাপটপে ফিল্ম দেখে কাটিয়েছে বছরের পর বছর।
কিন্তু ইন্টারনেট ব্যবহারের স্কিলটি আয়ত্ত্ব করে নি।
আমি তাকে কাস্পিয়ান রিপোর্ট নামক ইউটিউব চ্যানেলটির কথা বললাম। রেডিটের জিপলিটিক্স সাবরেডিটের ইন্ডেক্স বা উইকি পেইজটি দেখতে বললাম, যেখানে অঞ্চলভেদে থিংক ট্যাংক বা জিপলিটিক্স বিশ্লেষণ করা সাইটগুলির লিংক আছে।
ফোন রাখার পর, সে আবার ফোন দিয়ে জানাল কিছুই পাচ্ছে না। কারণ সে রেডিট কী জানেই না।
আগামীতে যেকোন বিজনেসই ইন্টারনেটের উপর নির্ভর করবে অনেকটাই। তাই ইন্টারনেট ব্যবহারের দক্ষতা অপরিহার্য।
আর যদি কোন স্টোর হাউজ অব নলেজ থেকে থাকে, তাহলে সেটা হলো ইন্টারনেট।
এই পয়েন্টের সারকথা হলো ইন্টারনেট রিসার্চ শেখা ও ইন্টারনেটরে রিসোর্স হিসেবে ব্যবহার করতে শেখা।
তিন – স্মার্ট মানুষের সাথে থাকার স্কিল
স্কিল বলতে আমরা কেবল কাজ করার দক্ষতাই বুঝি। এটা খুবই অপ্রশস্ত ও বাজে ধারণা।
এমন অনেক স্কিল আছে যেগুলা দেখতে সাধারণ, কিন্তু এদের প্রভাব মারাত্মক বেশি। এগুলি আপনার জীবন বদলে দিতে পারে পজেটিভ ভাবে ও অন্যান্য স্কিল বাড়ানো সহজ করে দিতে পারে।
এরকম একটি খুবই উপকারী স্কিল হলো স্মার্ট মানুষের সাথে থাকার স্কিল।
সাথে থাকা বলতে আমি সাথে সাথে ঘোরা বুঝাচ্ছি না এখানে। কারণ এটি সব সময় সম্ভব হবে না। আবার অনেকে থাকেন অন্তর্মুখী স্বভাবের, তারা সহজে মিশতে পারেন না।
ইন্টারনেটের কল্যাণে স্মার্টদের সাথে থাকার সুযোগ এসেছে বেশী এবং প্রক্রিয়াটি হয়ে গেছে সহজ।
আমি অনেক আগে থেকেই ইন্টারনেটের স্মার্ট লোকদের ব্লগ পড়েছি। ইন্টারনেট বলতে এখানে বাংলাদেশ মনে করবেন না। পুরা পৃথিবীর লোক। যেমন, পল গ্রাহামের ব্লগ, শন প্যারিশের ব্লগ, রবার্ট হ্যানসনের ব্লগ, টাইলার কোয়েনের ব্লগ, অভিনাশ কৌশিকের ব্লগ এরকম অনেক নাম আসবে। এরা যেহেতু স্মার্ট তাই এদের ব্লগ হলো আরো আরো স্মার্টদের আখড়া। ফলে আপনি আরো অনেক ব্লগের, আরো কতো কতো বইয়ের সাথে পরিচিত হবেন।
এই স্কিলটিকে স্মার্ট হয়ে উঠার ক্ষেত্রে সবচাইতে উপকারী স্কিল হিসেবে গণ্য করি আমি।
চার – এড়িয়ে যাবার স্কিল
এটিও আন্ডার রেটেড স্কিল।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বাঙালী মাত্রই এখন যেন বুদ্ধিজীবী হতে চায়। এক ছটাক বুদ্ধি থাকলেই বুদ্ধিজীবী হতে লাফ দেয়।
এদের যে মারাত্মক ইল্যুশন জীবন নিয়ে, পিটার প্যানের মত এক কাল্পনিক বাস্তবতায় বাস করা চির শিশুরা। অপিনিয়ন দেয়াকেই তারা বিরাট কাজ মনে করে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ বুদ্ধিজীবী হতে পারেন, কিন্তু এর জন্য তার জীবনে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি আছে। তাকে অনুকরণ করলেই আরেকজন বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠবে না।
বরং, ট্র্যাপে পড়ে যাবে।
ফেইসবুক যেভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, একটি হ্যাবিট ফর্মিং প্রোডাক্ট হিসেবে। এর ট্রিগার হল নটিফিকেশন। নটিফিকেশন দেখা মাত্র মস্তিষ্কে সুখের রাসায়নিকের নিঃসরণ হয়।
এই নেশা খুবই মারাত্মক।
এইরকম নেশা, যেগুলি একটা বিভ্রান্তিতে ব্যক্তিতে রেখে দেয় এগুলি এড়িয়ে চলতে হবে। তা না হলে স্কিল বাড়ানোর সময় আপনি পাবেন না।
সব সময় লং টার্মে চিন্তা করতে হয়। আমি আজ ফেইসবুকে বুদ্ধিজীবী হয়ে, লাইক গুণে সময় ব্যয় করে আসলে কী করছি? নিজের স্কিল না থাকলে আমি পিছিয়ে থাকব, ও লাইফে লুজার হবো। এটি মানুষ হিসেবে তো ব্যর্থতা।
সবারই ফ্যামিলি আছে। রেস্পন্সিবিলিটি আছে। দুর্বল ও অক্ষমেরা এগুলি এড়িয়ে চলতে চায়।
এই এখন আরেকটি কথা আসবে অনেকের মনে।
যে, লাইফে সফলতা আর ব্যর্থতাই কী, বা ব্যর্থতাই মহৎ, বা এরকম অনেক ভাববাদী কথাবার্তা। যারা এটি বলবেন, ওকে ফাইন, আপনাদের অপিনিওন আপনাদের কাছে। এই নিয়াই হ্যাপী থাকেন। আপনারে তর্ক করে বুঝানো আমার দূরতম কোন দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে না।
তো, এই স্কিলটা হলো, কীসব জিনিস ও কাদের এড়িয়ে চলতে হবে এ নিয়ে স্পষ্ট থাকতে হবে।
ইন্টারনেটে প্রচুর তথ্য। সব বেহুশের মত খেতে থাকলে আপনার কোন স্কিলই হবে না।
ফিয়ার অব মিসিং আউট নামে একটা জিনিস হয় মানুষের। কী ঘটে যাচ্ছে আর আমি মিস করে ফেলতেছি এই ভয়। এই জিনিস আপনার মনযোগ এবং ফোকাস একেবারে নষ্ট করে দিতে পারে।
পাঁচ – সাইকোলজি অব পারসুয়েশন
পারসুয়েশন হলো কাউকে কোন কিছু করতে পারসুয়েড করা।
ধরা যাক, আপনি একজন গাড়ি বিক্রেতা। আপনি ক্রেতাদের কাছে গাড়ি বিক্রি করতে হলে তাকে পারসুয়েড করতে হবে। আপনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। ভোটারদের ভোট পেতে হলে কথার মাধ্যমে বা লেখার মাধ্যমে তাদের পারসুয়েড করতে হবে।
এটি একটি অসামান্য ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্কিল।
এবং এর জন্য হিউম্যান সাইকোলজি সম্পর্কে আপনার ক্লিয়ার ধারণা থাকা দরকারী।
কীভাবে এই পারসুয়েশনের স্কিল আয়ত্ত্ব করা যাবে এই প্রশ্নটি এখন আপনার মনে এসেছে হয়ত।
আমি এর উত্তর দেব। কিন্তু এভাবে সবাই শিখতে পারবেন এটি আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারছি না।
পারসুয়েশনের বই আছে, রবার্ট চিয়ালদিনির পারসুয়েশন ও প্রিয়েসুয়েশন। এই দুইটা।
ড্যান আরিয়ালির বইগুলি, যেমন ইর্যাশনালি র্যাশনাল, অনেস্ট ট্রুথ এবাউট ডিজওনেস্টি।
ডেনিয়েল কায়নেম্যানের বই থিংকিং ফাস্ট এন্ড স্লো।
স্কট এডামসের বইগুলি, যেমন উইন বিগলি।
নাজ নামে একটা বই আছে রিচার্ড থ্যালারের।
এইরকম বইগুলি আপনাকে পড়তে হবে। এদের মূল কথা হলো, মানুষ অযৌক্তিক আচরণ করে, এবং তাদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
আমার সাইটেই আছে চার্লি মাঙ্গারের সাইকোলজি অব হিউম্যান মিস জাজমেন্ট নিয়ে লেখা, এটি হিউম্যান সাইকোলজির খুবই বড় অংশ ধারণ করে আছে।
বিহেভিওরাল একোনমিক্স নিয়ে এডেক্স ও কোর্সেরায় কোর্স আছে, এগুলা দেখতে পারেন। যেমন, কানাডার রটম্যান ইন্সটিটিউটের একটি কোর্স বিহেভিওরাল একনোমিক্স এট একশন, অধ্যাপক দিলীপ সোমান এর ইন্সট্রাক্টর, এটি খুব ভালো।
টেড এ বিহেভিওরাল একনোমিক্সের উপরে বা সাইকোলজির উপরে কিছু লেকচার আছে, এগুলি দেখতে হবে ও মর্মবস্তু উপলব্ধি করতে হবে।
এই মুহুর্তে মনে পড়ছে প্যারাডক্স অব চয়েজ লেকচারটির কথা। এছাড়া কায়নেম্যানের একটা লেকচার আছে রিমেম্বারিং সেলফ ও এক্সপেরিয়েন্সিং সেলফ বিষয়ে। আরিয়ালির কয়েকটা আছে।
এই, এতোসব রিসোর্স সবই ফ্রি। জাস্ট সময় দরকার, মনযোগ দরকার, জানার জেনুইন আগ্রহ দরকার। আমি এগুলি থেকেই শিখেছি ও শিখি।
শেষ কথা হলো, মনে রাখবেন, নলেজ হচ্ছে একটা লেভারেজ। যেই লেভারেজ আপনাকে অলওয়েজ কিছু বাড়তি সুবিধা দিবে।