বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী সলিমুল্লাহ খান প্রকাশ্যে টিভি টকশোতে গোলাম মুরশিদ নামক আরেক বুদ্ধিজীবীকে গোলাম বলে গালি দিছিলেন।
সলিমুল্লাহ খান একাত্তর টিভির টকশোতে কথাবার্তার এক পর্যায়ে বলেন, “এই ধরণের বুদ্ধিজীবীরা যতদিন পর্যন্ত সমাজে আধিপত্য বিস্তার করবে, এই গোলাম মোরশেদের মত গোলামেরা, তখন কিন্তু দেশে কোন ধরণের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হবে না।”
বাংলার মুসলমানদের মধ্যে গোলাম এবং নফর শব্দ দুই প্রচলিত আছে। হিন্দুদের মধ্যে দাস এবং ক্রীতদাস। একটা বিখ্যাত উপন্যাস আছে, ক্রীতদাসের হাসি।
স্লেইভ অর্থে এই শব্দগুলা ব্যবহৃত। কোন ব্যক্তিরে যদি আপনে পণ্যের মত কিনতে বেচতে পারেন এবং তারে নিজ সম্পত্তির মত ব্যবহার করতে পারেন, সেইটারে দাসব্যবস্থা বলে। বাংলায় এই দাস ব্যবস্থা চালু ছিল। গালি হিশাবে এর মাহাত্ম্যপূর্ণ অবস্থান এখন বুদ্ধিজীবীদের মুখ পর্যন্ত চালু।
মধ্যযুগের বাংলায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ছিল দাস। বাংলার সুলতান সাহেবেরা দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দাস আমদানী করতেন। যেমন আফ্রিকা, ইরান, চীন, তুরস্ক, আরব, আসাম, আরাকান, নেপাল ইত্যাদি।
আফ্রিকা থেকে আনা দাসেরা হাবশি, কাফ্রি নামে পরিচিত ছিলেন, এবং বাংলায় একসময় এই হাবশি দাসেরা ক্ষমতাও নিয়া নিছিলেন, পনের শতকের শেষ দিকে, আপনারা পড়েছেন ইতিহাসের বইয়ে।
হিন্দুরা দাসদের মধ্যে যারা উচ্চ জাতের যেমন কায়স্থ, বৈদ্য গোয়ালা ইত্যাদি, এদের তুলনামূলক বেটার ট্রিটমেন্ট পাইতেন। এনারা ঘরের কাজ করতে পারতেন, যেহেতু এনাদের টাচ করতে কোন অসুবিধে ছিল না। কিন্তু নিচু জাতের দাসেরা ছিলেন অপবিত্র হিসেবে চিহ্নিত, এদের টাচ করা যাইত না। এনারা বাইরের কাজে নিযুক্ত থাকতেন। ব্রাহ্মনদিগকে আবার দাস করা পাপ ছিল।
মুসলমানেরা এই ছুত্মার্গের হিশাবে যাইতেন না। তারা দাসরে ডাইরেক মুসলমান বানাইয়া ফেলতেন। মহিলা দাসদের বলা হইত বান্দি এবং লন্দি। সুন্দরী মাইয়াদের লন্দি বলা হইত সাধারণত, যারা মালিকের সেক্সুয়াল কাজে ব্যবহার হইতেন। হিন্দুরা নারী দাসদের দাসী বলতেন, এন্ড ইউ আর রাইট, হিন্দু মুসলমান উভয়েই নারী দাসদের সেক্সুয়াল কাজে ব্যবহার করতে পারতেন।
এইটা বেশ কমন ছিল যে, কয়েকশ বছর আগেই, গ্রামে বিয়ার সময় বান্দি সাথে দেয়া হইত। সেই বান্দির ঘরে আবার বাচ্চাও হইত। সেই বাচ্চা আবার সন্তানের অধিকার পাইতেন না, দাস হিশাবেই দেখা হইত এদের।
সাধারণত দাসেরা ঘরের কাজ ও কৃষিকাজ, এই দুই প্রকারের কাজে নিযুক্ত হইতেন। বাংলা থেকে দাসেরা রপ্তানিও হইতেন। বিভিন্ন প্ল্যানেটেশনের কাজে, যেহেতু এনারা কৃষিকাজে ভালো ছিলেন।
কৃষিকাজের দাসেরা বাংলার সমাজ থেকেই আসতেন। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগে সর্বশান্ত হওয়া লোকেরা দাস হইতে বাধ্য হইতেন। তাদের কিনে সমাজের পাওয়ারফুল অন্যরা কৃষিকাজে লাগাইতেন। আর দাসেরা প্রজন্মান্তরে দাস হিশাবে কাজ করে যাইতেন।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধ্বে আপনি বাংলায় ২০ রূপিতে ইয়াং হেলদি দাস কিনতে পারতেন বলে গবেষকেরা জানান দেন। তবে যদি আপনার ব্যবসা করার নিয়ত থাকে, তাহলে প্রাকৃতিক দূর্যোগের জন্য অপেক্ষা করতে পরামর্শ দিবেন কোন বিজনেস এনালিস্ট। কারণ ঐ সময়ে দাসদের সংখ্যা বাইড়া যাইত, ফলে দাম যাইত কইমা। আপনি তখন ২০ রূপিতে হয়ত তিনজন দাস খরিদ করতে পারতেন। পরে আবার মার্কেট ভালো হইলে বিশ রুপি করে ছাইড়া দিলেন।
বাংলা থেকে রপ্তানী হওয়া হাবশি ওরিজিনের বাঙালি দাস যামুরের কথা আপনি হয়ত শুনেছেন। যামুরে ধরে নেয়া হইছিল চিটাগাং থেকে। ১১ বছর বয়স তার তখন, বাংলা সুবা, মুঘল সাম্রাজ্যের সরকার বাহাদুর ক্ষমতায়।
ব্রিটিশ দাস ব্যবসায়ীরা ইয়াং যামুররে কিনে, মাদাগাস্কার হয়ে, ফ্রান্সে নিয়ে বিক্রি করে রাজা পঞ্চম লুইয়ের কাছে। লুই তারে উপহার দেন কাউন্টেস মাদাম দ্যু ভেরিরে। কাউন্টেস ছেলেটারে লাইক করতেন। পড়ালেখা করান। যামুর রুশোর লেখা দ্বারা প্রভাবিত হইছিলেন।
তিনি ফ্রেঞ্চ বিপ্লবে অংশ নেন। জাকোবিনদের পক্ষে ছিলেন। কাউন্টেসের বিরুদ্ধে একসময় অবস্থান নেন যামুর, কাউন্টেসকে গ্রেফতার করতে, এবং গিলেটিনে তার মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ক্ষেত্রে, যামুরের ভূমিকা ছিল। কাউন্টেস দুধ কলা এবং রুশো পড়িয়ে কালসাপই পুষেছিলেন।
এই যামুর পরে একজন স্কুলটিচার হিশাবে মারা যান। তিনি তার জন্মস্থান হিশাবে তিনি চিটাগাং এর নাম বলতেন।
যাইহোক, গবেষকেরা বলেন, বিশ শতকের শুরুর দিক থেকে বাংলায় দাস ব্যবস্থা মুক্ত হয়।
অমুক গোলাম ছিল ইত্যাদি বলে যখন তাদের নিচা দেখাইতে যায় এখনো লোকে, আসল বাস্তবতা হইল, যদি সত্যিই ধরে নেই অমুকেরা গোলাম ছিল একসময়, এটা তাদের দোষে না। তারা দূর্বল ছিল, এবং সমাজের সবল ক্রিমিনালেরা তাদের ব্যবহার করছিল, অধিকার কাইড়া নিছিল।
আমরা সেই পূর্বেকার গোলাম রাখা লোকদের পক্ষে গিয়া তাদের গোলাম বলতে সুখ পাই, ও আমাদের পূর্বপুরুষ এইসব গোলাম রাখা লোক ছিল ভাইবা আহ্লাদিত হই। আবার আমরা আধুনিক মানবাধিকারের কথাও বলি, নিজেদের মানবিক দেখাইতে সমাজে। অভিনয় ঠিক আছে, খালি অস্কার মিলে না।
বাংলাদেশ থেকে এখনো বছরে ৫০ হাজার মেয়ে ভারতে পাচার হয়। মানব পাচারকারীরা এদের বিক্রি করে, এবং ইন্ডিয়ার ব্রথেল চালানো লোকেরা এদের কিনে ব্রথেলে ব্যবসা করায়। প্রায় ৩০০,০০০ বাংলাদেশী শিশু ভারতীয় ব্রথেলে কাজ করতে বাধ্য হইতেছে। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস এন্ড সিক্যুরিটির রিপোর্ট, ঢাকা ট্রিবিউনে বিস্তারিত।