রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোস্টমাস্টার গল্পে কাহিনী এইরকম যে একজন শিক্ষিত ইয়াং পোলা যিনি পোস্টমাস্টার হইয়া গ্রামে গেছেন। মানুষের সাথে তিনি মিশতে পারেন না। ঐ অবস্থায় তার ঘরের পাশে বাস করা একটা অল্প বয়েসী মাইয়ার সাথে তার কথাবার্তা হইত। মাইয়াটার নাম রতন, বয়স বারো তেরো।
পোস্টমাস্টার গল্প করতে করতে অনেক কিছুই বলতেন, তার লাইফের কাহিনী, ফ্যামিলির বিত্তান্ত। ঐ নিঃসঙ্গ জায়গায় একটা শ্রোতা পাইয়া তার একলা লাগাটা দূর হয়।
একদিন তিনি অসুস্থ হইলে পরে রতন তার সেবা করে। তিনি সুস্থ হন। আর ঠিক করেন এই গ্রামে আর থাকবেন না।
রতনরে বাই বলতে যান। কিন্তু রতন বিস্মিত হইয়া যায়। সে ভাবে নাই পোস্ট মাস্টার এত কুইকলি চলে যাইবেন।
এই পর্যায়ে রতনের সাথে সাথে আমাদেরো খারাপ লাগে।
পরে, পোস্টমাস্টার যখন দয়া পরবশ হইয়া রতনরে কিছু টাকা দিতে যান। এইখানে যাইয়া সব কিছু ভাইঙ্গা পড়ে।
গল্প থেকে নিচের অংশ,
কিছু পথখরচা বাদে তাঁহার বেতনের যত টাকা পাইয়াছিলেন পকেট হইতে বাহির করিলেন। তখন রতন ধুলায় পড়িয়া তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “দাদাবাবু, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে কিছু দিতে হবে না; তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমার জন্যে কাউকে কিছু ভাবতে হবে না”– বলিয়া একদৌড়ে সেখান হইতে পলাইয়া গেল।
এই খানে পাঠকের আবেগে টান পরে। রতনের জন্য মায়া হয় আর পোস্টমাস্টাররে খারাপ লাগে। মনে হইতে থাকে রতন অন্যায়ের শিকার হইল।
কিন্তু আসলে তো মাস্টর তারে টাকাই দিতে চাইছেন। টাকা তো গুড জিনিস। টাকার একটা ভ্যালু আছে। আর এমনিতেই তো মাস্টর যাইতেছেন। টাকা দিলেও যাবেন না দিলেও যাবেন। তাইলে টাকা দেয়াটাতে সমস্যা কী হইল? আর টাকা দেয়ার কারণে আমাদেরই খারাপ লাগল কেন আর রতনই এইরকম করল কেন?
এই জায়গায় আমরা স্মরণ নিতে পারি সাইকোলজিস্ট ও মনস্তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ হিসাবে খ্যাত ড্যান আরিয়ালির। আরিয়ালির বিখ্যাত বই প্রেডিক্টাবলি ইর্যাশনাল। ঐ জায়গায় তিনি দেখাইছেন, কীভাবে আমরা মানুষেরা ইর্যাশনাল আচরণ কইরা যাই।
টাকা ভ্যালুর লজিক হিসাবে নিলে উক্ত গল্প পরিস্থিতিতে আমাদের ও রতনের খারাপ লাগাটা ইর্যাশনাল।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন আমরা আসলে দুইটা দুনিয়ায় বাস করি। একটা হইল সোশ্যাল ওয়ার্ল্ড, যেইখানে সোশ্যাল নর্ম কাজ করে। আরেকটা হইল মার্কেট ওয়ার্ল্ড, যেইখানে মার্কেটের নিয়ম ডমিনেট করে। বুঝার সুবিধার্থে তারা এই ভাগ করতে গেছেন।
আরিয়ালি এইটা নিয়া অনেক টেস্ট করছেন। দেখতে চাইছেন যে মানুষ কেমনে বিহেভ করে সোশ্যাল নর্ম এবং মার্কেট নর্মে, এবং দুইটারে একসাথে মিলাইয়া করে কি না।
একটা টেস্টে দেখা গেল, উকিলদের বলা হইল বৃদ্ধ লোকদের হেল্প করতে। ঘন্টা প্রতি ৩০ ডলার করে পাইবেন তারা। উকিলেরা করতে চাইলেন না। কিন্তু ফ্রি তে করতে বলা হইলে করতে চাইলেন।
এইটা তো ইর্যাশনাল বিষয়।
কিন্তু এইখানে যখন ঘন্টা প্রতি ৩০ ডলার দেয়া হইতেছে, তখন উকিল ভাবতেছে মার্কেটের হিসাবে। সে দেখতেছে তার মার্কেট ঘন্টা রেইট থেকে এইটা কম। ফলে সে না কইরা দিছে।
আর ফ্রিতে করতে বললে সে দেখতেছে এইটারে সামাজিক দায়িত্ব হিসাবে, চ্যারিটি হিসাবে, এইটা কইরা তার সেল ইস্টিম বাড়বে। তাই সে রাজী হইছে।
যদিও লজিক্যালি ৩০ ডলার নিলেও চ্যারিটি হইত। কারণ তার অরিজিনাল রেইট ৫০ ডলার হইলে, সে যে ৩০ নিতেছে বাকি ২০ ছাড়তেছে, এই ২০ চ্যারিটি হয়। কিন্তু তারা এইভাবে দেখবে না বিষয়টারে। কারণ সোশ্যাল নর্মের দুনিয়া মার্কেট দুনিয়ার লগে মিশ খাইয়া চলে না।
ধরেন, আপনার বন্ধু আপনার গাড়ি নিল ইউজ করতে। এক ঘন্টা পরে আইসা আপনার হাতে ৩০ ডলার দিয়া বলল, এইটা রাখো, গাড়ির জন্য। আপনে অপমানিত ফিল করবেন ভদ্রলোক হইলে। কারণ এই টাকা দিয়া সে আপনার করা সামাজিক উপকাররে অস্বীকার করলো, আপনারে বড় হইতে দিল না। কিন্তু বন্ধু যদি পরদিন আপনারে নিয়া রেস্টুরেন্টে খাওয়ায় সেইটা আপনার খারাপ লাগবে না, কারণ ঐটা সোশ্যাল নর্মের দুনিয়াতেই পড়ে।
পোস্টমাস্টার গল্পে, মাস্টর যদি বলতেন রতন বাড়ি যাইতেছি, তোমারে মাঝে মাঝে দেখতে আসব, এইরকম সামাজিক কিছু, তখন মাস্টর আর আমাদের কাছে ভিলেন হইতেন না। রতনেরও এত দুঃখ লাগত না, আর আমাদেরো খারাপ লাগত না।
রবীন্দ্রনাথ এইখানে গল্পকার হিসাবে তার মাস্টার স্ট্রোক দেওয়াইছেন মাস্টররে দিয়া টাকা বাইর করাইয়া। যদিও আবেগের শট হইছে, তথাপি এই কারণেই গল্পটা পাঠকের আবেগের দুনিয়ায় একটা নাড়াছাড়া দিয়া যাইতে পারছে, এবং এখনো পড়লে আপনে রিলেট করতে পারতেন।
কারণ এখনো সোশ্যাল নর্মের দুনিয়ার মার্কেট দুনিয়া ঢুকাই দিলে আপনার খারাপ লাগবে ও অস্বস্থি হবে।
এর কাউন্টার বা এন্টি থিসিস গল্প বলা যায় শহীদুল জহিরের ভালোবাসা গল্পরে। ওই গল্পটা তার নির্বাচিত গল্পের প্রথম গল্প।
ওইখানে বস্তির এক ফেমিলির কথা আছে। বুড়া হাফিজদ্দি, তার বউ আবেদা ও তাদের মাইয়া। হাফিজদ্দি একদিন একটা ফুল নিয়া আসে। তার বউ আবেদা এইটা নিতে চায়। কিন্তু আন রোমান্টিক হফিজদ্দির তো এত তেল নাই বউরে ফুল দিবে। সে সাবধান কইরা যায় কেউ যেন ফুলে হাত না দেয়।
বাট, আবেদা ফুল একবার চুলে দেয়। হাফিজদ্দি পরে আইসা রাগারাগি করে কারণ সে ফুলে চুল পাইছে।
তখন পাঠক হিসাবে আমাদের টেনশন হয় হাফিজদ্দি কী করবে। কারণ তার স্বভাব চরিত্রে তারে আবেগহীন মনে হয়, মনে হয় তার কাছে সোশ্যাল নর্মের কোন মূল্যই নাই। পোস্ট মাস্টারের মত সে কবিতাও লেখে না, শিক্ষিতও না।
বাট, পোস্ট মাস্টার টাকা দিয়া যে আকস্মিকতাটা করছিলেন, হাফিজদ্দিও একই জিনিস কইরা বসে। উলটাভাবে।
সে তার বউ আবেদারে ফুল দিয়া দেয়।
বলে, ‘ফুলটা তরে দিয়া দিলাম যা’
পোস্টমাস্টারে যেমন আমরা ভাইঙ্গা পড়ছিলাম মাস্টরের টাকা দেয়ায়, হাফিজদ্দির ফুল দেয়ায় উলটা ভাবে জাইগা উঠি।
মিউজিক থিওরির যে টেনশন ও রিলিজের কনসেপ্ট আছে, এই দুই গল্পেই উলটাভাবে জিনসটা আছে। রিলিজ হয় এই দুই লাইনেই, টাকা দেয়ায় ও ফুল দেয়ায়।
আবেদার রিয়েকশন খেয়াল কইরেন এর পরে।
লেখক লেখেন, “হাফিজদ্দির গলায় কোন বাহুল্য কোমলতা ছিল না। আবেদারও সময় ছিল না তক্ষুণি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বসার। তবু আবেদার বুকের ভেতরটা কেঁপেছিল কী এক সুখে। হঠাত-ঝরা বৃষ্টির পর পোড়া চরাচরের মত আবেদার মনে হয় কি আরাম বৃষ্টির এই অনাবিল জলে ভেজায়।“