এই লেখা দুইটা ভাইরাল হওয়া ধর্ষনের কাহিনী নিয়ে। প্রথমত, এমসি কলেজের রেপ। সেখানে একজন স্বামীর ও স্ত্রী বেড়াতে গিয়েছিলেন, কিছু ছাত্রলীগ নেতা স্ত্রীকে ধরে নিয়ে রেপ করে। এই গল্পই আমরা জানি। এখন আরও নানা দিক বের হচ্ছে এবং আরও হবে হয়ত সামনে। কিন্তু মূল কাহিনী এটাকেই ধরেছি আমি। দ্বিতীয় কাহিনী নোয়াখালীর রেপ ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ঘটনা।
এক
ধর্ষনের আমরা একটা এনালাইসিস এইভাবে করতে পারি যে, এইটা যেহেতু একটা পাওয়ার ক্রাইম, এর দুইটা রূপ আছে। প্রথমত সরাসরি ধর্ষন। আরেকটা সিস্টেমিক ধর্ষন। এমসি কলেজের ঘটনায়, অনেকে জানাইছেন, এরা প্রেমিক প্রেমিকা হইলে ঘটনাটা ওত লাইম লাইটে আসত না। যেহেতু প্রেমিক নিজেই তার শরমের ভয়ে জিনিসটা নিয়া আগাইত না। আমি মনে করি এখানেই প্রকৃত ভয়াবহতা।
যে প্রেমিক প্রেমিকারা ঘুরতে পারতেছে না। প্রেমিকের সামনে থেকে প্রেমিকারে তুলে নেয়া আর হাজবেন্ডের সামনে থেকে ওয়াইফরে তুলে নেয়ার মাঝে কোন পার্থক্য নাই, একটা সুস্থ মস্তিষ্কের লোকের এতে দ্বিমত থাকার কথা না। কিন্তু সমাজ এখানে পার্থক্য করার জায়গা রাইখা দিছে।
এটাই সিস্টেমিক ধর্ষনের দরজা। প্রেমিক প্রেমিকারে পার্কে বা অন্যত্র হেনস্থা করার যে চর্চা ও চল সমাজে আছে, ইভেন আইনের লোকেরাও এটা করেন, সমাজে এর সমর্থন আছে, এইগুলাই এমসি কলেজে ঘটে যাওয়া ধর্ষনের জায়গা করে দিছে। আরেকটা তো আছেই, ক্ষমতাসীন দলের অন্যায় ক্ষমতা চর্চা। যেটা নিয়া প্রায় সবাই বলতেছেন, আমি আর না বলি। সিস্টেমিক রেপ এখানে, সিস্টেম যে রেপের জায়গা করে দিতেছে। এক সামাজিক সমর্থন, প্রেমিক প্রেমিকারে পাইলে উত্যক্ত করো, আর দুই ক্ষমতায় থাকা দলের অন্যায় ক্ষমতার চর্চা।
দুই
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ এলাকায় একজন নারীর সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। পরে তার স্বামী ঘরে এসেছিল। এলাকার ক্ষমতাবান করা কিছু যুবক এতে ক্ষিপ্ত হয়। তারা তাকে দুশ্চরিত্রা অপবাদ দিয়ে, বিবস্ত্র করে নির্যাতন করে এটি ফেসবুকে ভাইরাল করার জন্য। এবং পরদিন মহিলাটিকে এলাকা ছাড়া করে।
এই ঘটনা বুঝতে হলে আমাদের দেখতে হবে, একজন নারীর ঘরে স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষ প্রবেশ করলে এলাকা কীভাবে রিয়েক্ট করে তার উপরে।
আপনারা খোঁজ খবর নিলে জানতে পারবেন, সেসব ক্ষেত্রে নারীকে হেনস্থা করা হয়, “নৈতিক দায়িত্ব হিসেবেই”। মনে করা হয়, সমাজকে কলূষমুক্ত রাখতে এটা করা উচিত। আজ যারা ফেসবুকে ভিডিও দেখে, টাইমলাইনে কান্নাকাটি করে হাঁটু পানি করে ফেলছেন, তাদের বেশীরভাগেই এই জিনিশ সমর্থন করবে।
গ্রাম বাংলায় এই শালিসি অত্যাচার চলে আসছে। একটা বিখ্যাত উদাহরণ দেই, সংশপ্তক উপন্যাস থেকে। নাটক হবার কারণে এই ঘটনা অনেকেরই পরিচিত। শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনা গ্রাম বাংলার, এবং সমগ্র বাংলাদেশের সমাজে থাকা নারী, এবং যৌনতা বিষয়ক ধারণা থেকে তৈরি হওয়া। ধর্ষকেরা ভিডিও করে ভাইরাল করার কথা বার বার বলছিল কেন? কেউ খুন করতে গেলে ভিডিও করে না, বা ভাইরাল করতে চায় না, কারণ সে অন্যায় করতেছে জানে। এখানে, ধর্ষকেরা নিশ্চিত ছিল ন্যায় করতেছে তারা। নৈতিক দায়িত্ব পালন করতেছে। যেমন সংশপ্তকের রমজান মনে করেছিল এবং সবার সামনে হুরমতিকে ছ্যাকা দিয়েছিল কপালে। যেমন আরও অনেক রমজানেরা করে আসছেন শত বছর ধরে। আগেকার সময়ে তাদের “নৈতিক” হবার আকাঙ্ক্ষা কম ছিল, বা দুনিয়াব্যাপী প্রচারণার সুযোগ ছিল না। নিজ এলাকাতেই প্রচার করে তুষ্ট থাকতে হত এদের। কিন্তু আধুনিক, রক্ত গরম এমন বিচারকেরা পেয়েছেন দুনিয়াব্যাপী তাদের নৈতিক কাজটি প্রচারের সুযোগ। তারা জানেন তাদের কাজের সমর্থকেরা আছেন। দুশ্চরিত্রা নারীকে শাস্তি দেয়ার সমর্থকেরা আছেন। ফলে তারা ভাইরাল করতে চেয়েছে নিজেদের কাজকে।
এই যে জন সমর্থন, সমাজে নৈতিক হিসেবে এমন অন্যায়কে দেখা হয়, এটা নারীকে নির্যাতনের, এবং ধর্ষনের শিকার হবার পথ তৈরি করে।
এটাই সিস্টেমে থাকা ধর্ষন। এর মীমাংসার দিকে না গিয়ে, একেক ঘটনায় কান্নাকাটি করে হাঁটুপানি গলাপানি করে কোন লাভ নেই।
বরং, আপনারে ঠিক করতে হবে, কোন নারীর বাসায় তার প্রেমিক আসল ধরা যাক রাতে, যার সাথে তার বিয়া হয় নাই, সে ক্ষেত্রে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে?
সমাজরে কলূষমুক্ত করার দায়িত্ব নিয়ে, আপনি নারীটিকে বিচারের মুখে ফেলবেন, বা তার বিচার হোক এটা কি মনে করবেন, নাকি, এতে যদি কোন সরাসরি কারো ক্ষতি না হয়ে থাকে তাহলে মাথা ঘামাবেন না? বা যদি কেউ তারে এলাকার বিচারের মুখে ফেলতে যায়, আপনার ভূমিকা কী হবে?