গল্প দুই – জোলেখা বানুর ঘটনাটি

জোলেখা বানুর ঘটনাটি

আমার নাম জোলেখা বানু। আমি এক্ষণে, আপনার সম্মুখে এসেছি কারণ আমি জানতে পেরেছি  যে নুরুন্নাহার আপনার কাছে এসেছিলেন এবং তিনি কিছু একটা আপনাকে বলেছেন।

– আপনি কি সেই প্রসঙ্গেই বলতে এসেছেন?

সেই প্রসঙ্গেই, তবে আমি আমার সমস্যা নিয়ে বলতে আসছি। এবং আমার কাহিনী বলতে গেলে নুরুন্নাহারের কাহিনীও আসবে, কারণ আমার কাহিনী তার সাথে যুক্ত, যেমন আমিও তার জীবনকাহিনীর সাথে জড়িত। আপনি কি বিষয়টা বুঝতে পারছেন?

– হ্যা, আঁচ করতে পেরেছি। নুরুন্নাহার তার গল্পে বলেছিলেন আপনারা একইসাথে ছিলেন কোন একটা মফস্বলে, এবং এরপর একসাথেই শহরে…

আপনি প্রথমে আমার কথা শুনুন শুরু থেকে। আপাতত নুরুন্নাহারের গল্প আপনাকে ভুলে যেতে আমি অনুরোধ করছি।

– ঠিক আছে। বলুন।

আমার জন্ম এক সাধারণ কৃষক পরিবারে। আমার বাবা ও মা ছিলেন দরিদ্র। তারা একদিন জঙ্গলাকীর্ণ রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে, রাত্রি নিশাকালে, যেদিন আকাশে আধখানা চাঁদ উঠেছিল, সেই দিন মাটিতে জ্বলজ্বল ফুটে থাকা এক পাখির বাসায় শিশু আমাকে পেয়েছিলেন বলে কথিত আছে। এর সত্য মিথ্যা আমি জানি না, কিন্তু এই গল্প ঐ অঞ্চলের অনেকেই বিশ্বাস করে থাকেন।

আমার বাবা বাহাদুর খান সাহেবের বাড়িতে কাজ করতেন, এবং সেই সুবাধেই ছোটকাল থেকে আমি খান সাহেবের বিরাট বাড়িতে যেতাম। সেখানেই খান সাহেবের ছোট মেয়ে নুরুন্নাহারের সাথে আমার পরিচয় ও বন্ধুত্ব।

খান সাহেবের এই মেয়ে ছোটকাল থেকেই অন্যদের থেকে আলাদা ও অদ্ভুত। কাচের বয়ামে ভরে ভরে সে অনেক অনেক ঝিকিমিকি রাখতো, যেগুলি মধ্য রাত্রে তাদের রঙ বদলাতো, এ আমি স্বচক্ষে দেখেছি।

আমাদের বন্ধুত্ব খুবই গাঢ় ছিল। আমরা একসাথে খেতাম, গোছল করতাম, ঘুরতে যেতাম ও নুরুন্নাহার তার সব অদ্ভুত গল্পাদি আমার সাথে করতো এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো সে আর কারো সাথে তেমন কোন কথা বলতো না।

নুরুন্নাহারের বিয়ে হয় একজন উকিলের সাথে, যার নাম গুরুদয়াল চৌধুরী, যিনি সর্বাবস্থায় তার কোর্ট কাছারি ও বই পুস্তক নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসতেন, এবং খরগোশ পুষতেন।

নুরুন্নাহারের সাথে তার স্বামীর বাড়িতে আমাকেও পাঠানো হয়, খান বাড়ির নিয়ম হিসেবে। ফলত, বিয়ের পরেও নুরুন্নাহারের সাথে আমার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক অক্ষুন্ন থাকে।

– এই সম্পর্ক কি কোনভাবে যৌন সম্পর্ক ছিল?

আমি তা বলব না। আমার গল্পে আপনি যা বুঝার বুঝবেন যৌন সম্পর্ক বলতে কী বুঝানো হচ্ছে, ও তার ব্যাপ্তী কতটুকু ধরা হচ্ছে, এর উপর নির্ভর করে আমাদের এই বিষয়টাকে বিচার করতে হবে বলে আমার ধারণা। অনেক সময় স্পর্শ কিংবা চাহনিও যৌন হয়ে উঠতে পারে, এবং প্রায়শই হয়ে উঠে, যেগুলি আক্ষরিক অর্থে সরাসরি যৌন কি না আমি জানি না।

– সেরকম কিছু কি আপনাদের মধ্যে ছিল?

এই ব্যাপারে আমার মধ্যে আগে যেমন সংশয় ছিল এখনো তা রয়েছে। আমি আমার দিক থেকে যতোটা বুঝেছি আমাদের সম্পর্ক ছিল সহজ স্বাভাবিক ও মধুর। এই তিন শব্দের বাইরে অন্য কিছু দিয়ে আমি এই সম্পর্ককে প্রকাশ করতে পারি না।

– ছিল বলছেন?

হ্যা ছিল।

– তার মানে এখন নেই?

সেজন্যই তো আপনার কাছে আসা। তা না হলে হয়ত আপনার কাছে আসতে হতো না, এবং যে সমস্যায় আমি পড়েছি এর কোন অস্তিত্ব থাকতো না। যাইহোক, আমি আমার কাহিনীতে ফিরে যাই।

– যান।

নুরুন্নাহার তার স্বামীর ঘরে বেশ ভালোই ছিল, আমাকে সাথে নিয়ে। বাড়ির পেছনে বড় এবং গাঢ় একটি আম বাগান ছিল। গভীরের দিকে এই বাগানের আমগাছগুলি ছিল অনেক প্রাচীন, প্রায় শতাধিক কাল সম্ভবত একেকটার বয়স। আমি ও নুরুন্নাহার এই আম বাগান পছন্দ করতাম। আমরা এর ভেতরে, গভীর থেকে গভীরে গিয়ে সভ্যতার গোপন সব শব্দাবলী এবং দুর্বোধ্য সব মন্ত্রের উচ্চারণ যেন শুনতে পেতাম। আমাদের ভালো লাগতো সেই পরিবেশ।

সেই আম বাগানে অনেক খরগোশ ছিল। আমি ও নুরুন্নাহার প্রায়ই খরগোশদের তাড়া করতাম। একদিন খরগোশদের তাড়া করতে করতে আমরা বাগানের খুব গভীরে চলে যাই। শুনশান নিরবতার মধ্যে। আমরা অনেক অনেক অনেক খরগোশ দেখতে পাই ভেতরে। আর দেখতে পাই শামসুজ্জামান নুরুকে, যে আমার এই কাহিনীর এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, তখন তার বয়স ছিল দেখতে পঁচিশ বছরের মতো।

খালি গায়ে, হাতে লাঠি নিয়ে বসে সে খরগোশদের রাখালী করছিল, গভীর আমবাগানে।

সেদিন আমাদের অল্প কথাবার্তা হলো।

শামসুজ্জামান বলল সে এই বাগানে আসে অনেক দূর হতে, খরগোশদের দেখভাল করা তার গুরুদায়িত্ব। প্রতিদিন আমরা যে খরগোশদের তাড়া করি এটা সে জানে। অনেকদিন থেকে আমাদের সে পর্যবেক্ষণ করে আসছে।

প্রথমদিন কথা বলে শামসুজ্জামান নুরুকে আমার অমায়িক লাগল। আমরা অল্পক্ষণ কথা বলে চলে আসলাম।

এরপর দিন থেকে আমি নুরুন্নাহারের মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখতে পাই। সে যেন উদাস উদাস। আমার সাথেও ঠিকমতো কথা বলে না। এবং মাঝে মাঝে কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়, এবং আমি তাকে খুঁজে পাই না।

দিনে দিনে তার উধাও হওয়া বাড়তে লাগলো। আমি দেখলাম প্রতিদিনই দীর্ঘ সময় ধরে নুরুন্নাহার যেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে।

নুরুন্নাহার যখন নাই হয়ে যেত তখন আমি নানা স্থানে তাকে খুঁজতে থাকতাম। সম্ভাব্য যেসব স্থানে সে থাকতে পারে।

এমনই একদিন খুঁজতে খুঁজতে আমি আম বাগানে ঘুরছিলাম। হঠাত নীলাভ বর্ণের একটি খরগোশ আমার সামনে এসে লাফাতে থাকে। যেন সে আমাকে আহবান করছে তাকে ধরতে। একে ধরতে গিয়ে আমি বাগানের খুব গভীরে প্রবেশ করি, এবং শামসুজ্জামান নুরু ও নুরুন্নাহারকে আবিষ্কার করি, তারা পরস্পর নগ্ন হয়ে পরস্পরের ভেতরে প্রবাহমান। এমন অবস্থা দেখে আমি গায়ে একটা শিহরন অনুভব করলাম।

নুরুন্নাহার ও নুরু দুজনই একসময় আমার উপস্থিতি টের পায়। তারা আমার দিকে তাকিয়ে হাসে ও আমাকে আহবান করে।

তারা বলে তোমার জন্য আমরা অনেক অপেক্ষা করেছি। আমাদের ধারণা ছিল তুমি নিজ থেকেই আমাদের খুঁজে পাবে। কিন্তু পেলে না। তাই আজ একটা খরগোশকে পাঠাতে হলো।

নুরুন্নাহার ও নুরু আমাকে তাদের মধ্যে টেনে নিয়ে গেল। তারা বললো, ত্রি ধারা স্রোত সব সময় সঠিক সমুদ্রে মিলিত হয়।

আমার মধ্যে দ্বিধা ও অস্বস্থি কাজ করছিল। কিন্তু বাগানের সেই পরিবেশে, সেই নিরবতা ও প্রাচীন গন্ধময়তাযুক্ত বাতাসে আমি আর আমার ভেতরে রইলাম না।

এই শুরু হলো, এবং এভাবেই চলছিল আমাদের দিন। আমার, নুরুন্নাহারের ও শামসুজ্জামান নুরুর।

তারপর একদিন নুরুন্নাহারের স্বামী গুরুদয়াল জিনিসটা খেয়াল করলেন, এবং সমস্ত কিছু তিনি জেনে ফেললেন হুট করেই।

আমার ধারণা, তিনি খরগোশদের কাছ থেকেই ব্যাপারটা সম্পর্কে অবগত হন। আগেই বলেছি তার পোষা খরগোশেরা ছিল, এবং খরগোশদের সাথে তাই তার একটা সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।

আর এদিকে নুরুন্নাহার অন্তঃস্বত্তা হয়ে পড়ে।

গুরুদয়াল চৌধুরীর পরিবার এটি মেনে নিতে পারে না। এই বাচ্চাকে নষ্ট করার ব্যবস্থা করা হয়।

সেই কাজটি করেন একজন ডাক্তার, যার নাম জোনাথন।

তিনি সমস্ত প্রক্রিয়া শেষে বলেন যে, নুরুন্নাহার একটি নীল খরগোশ প্রসব করেছে।

গুরুদয়াল চৌধুরী ও তার পরিবার বাচ্চাটিকে মাটি চাপা দিতে চাইলেন।

কিন্তু কৌশলে জোনাথন সাহেব সাংবাদিক ও প্রসাশনকে খবরটি জানিয়ে একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে, ক্লুরোফর্মের কাচের জারে বাচ্চাটিকে ভরে এলাকা ছেড়ে নাই হয়ে যান। তার উদ্দেশ্য ছিল রয়াল সোসাইটির কাছে এই আশ্চর্য বস্তুকে প্রদর্শন করা ও এ সংস্লিষ্ট গবেষণার পথ সুদৃঢ় করা।

নিজের বাচ্চাকে খুন করা হয়েছে বা সরিয়ে ফেলা হয়েছে, এটি জানার পর নুরুন্নাহার উদভ্রান্ত হয়ে যায়। সে বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র ভাঙতে থাকে এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করে গুরুদয়াল ও তার পরিবারকে।

নুরুন্নাহারকে খুবই শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়।

গভীর রাতে আমি সেই দড়ি কেটে তাকে মুক্ত করি, এবং আমি ও নুরুন্নাহার সেই রাতেই শামসুজ্জামান নুরুর খোঁজে আমবাগানের ভেতরে প্রবেশ করি।

আমবাগানের খুব গভীরে আমরা নুরুকে পাই, সে একটি ধবধবে শাদা বাঁশি হাতে বসেছিল।

নুরুন্নাহার তাকে সমস্ত বিষয় খুলে বলে।

এতে তার কোন বিকার হলো বলে আমার মনে হলো না।

এরপর, একরকম জোর করে নুরুন্নাহার শামসুজ্জামান নুরুকে নিয়ে, ও আমাকে নিয়ে তার বাচ্চাকে খুঁজে বের করতে শহরের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়।

-শহরে আসার পর আপনারা বাচ্চাকে খুঁজে পেয়েছিলেন বা জোনাথন সাহেবকে?

না, এখনো পাই নি।

– আপনারা তিনজন একসাথেই থাকতেন?

হ্যা, আমরা একসাথেই থাকতাম এতোদিন। কিন্তু খুবই অদ্ভুত ঘটনা যে, এই গত সপ্তাহে শামসুজ্জামান নুরু হারিয়ে গেছে। সে আর বাসায় ফিরে আসছে না।

 – এটাই কি আপনার সমস্যার কারণ?

হ্যা, এই কারণে নুরুন্নাহার আবার উদভ্রান্তের মতো আচরণ শুরু করেছে। শামসুজ্জামান নুরু মায়াহরিণের মত তার রঙ বদলাতে পারে। আমার ধারণা সে একটা কিছু করবে এই শহরে।

– সেই একটা কিছু কী?

সেটি আমি বুঝতে পারছি না। এই না পারার দরুণ আমার ভেতরে নানা রকম উদ্বিগ্নতা ভর করেছে। আমি ঘুমাতে পারছি না। দিনরাত একেকটা ভয় এসে আমাকে তাড়া করছে। আর এদিকে নুরুন্নাহারের অবস্থাও খারাপ।

নুরুন্নাহার আমাকে পর্যন্ত অবিশ্বাস করা শুরু করেছে। তার এমন ধারণা হচ্ছে যে, আমি শামসুজ্জামান নুরুকে লুকিয়ে রেখেছি।

সেই ছোটকাল থেকে একটি নীল কাচের বয়াম ছিল নুরুন্নাহারের কাছে। তাতে ঝিকিমিকি পোকা। নুরুন্নাহার কেবল আমাকে সেই বয়াম ও বয়ামের ভেতরের পোকাদের রঙবাহার দেখতে দিত। কিন্তু নুরু হারিয়ে যাবার পর বা অদৃশ্য হয়ে যাবার পর, আমাকে দিচ্ছে না।

আমার এও মনে হচ্ছে নুরুন্নাহার বা নুরু আমাকে হত্যার পরিকল্পণা করছে। আমি দু চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে পারি না। চোখের পাতা বন্ধ করলেই দেখতে পাই নুরুন্নাহার ছুরি হাতে এগিয়ে আসছে বা নুরু দা হাতে এগিয়ে আসছে। তাই চোখ খোলা রাখতে হয় আমার। এই করতে করতে আমার চোখ ফুলে গেছে।

– আপনি কি কোন আওয়াজ শুনতে পান?

হ্যা, অনবরত একটা খসখস আওয়াজ। ভিজে মাটিতে চটি পায়ে কেউ হেঁটে যাচ্ছে এমন আওয়াজ। লতানো উদ্ভিদযুক্ত ঘন বনে মুষলধারে পড়ন্ত বৃষ্টির আওয়াজ। ফিস ফিস ফিস ফিস আওয়াজ। মধ্যরাতে নাম না জানা অভদুত ভীতিজাগানিয়া এক পাখির আওয়াজের মত আওয়াজ, অস্ফুট। এসব আমি শুনতে পাই। সকল সময়ে শুনতে পাই। আমার মনে হচ্ছে আমি তলিয়ে যাচ্ছি। আমি মরে যাচ্ছি। এমন অবস্থায় আমি বেঁচে থাকতে পারব না। আপনার কাছে আমি এসেছি সমাধানের জন্য।

আপনার কথা শুনে আমার যা মনে হচ্ছে, আপনি স্কিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছেন। ভয় পাবার কোন কারণ নেই। আমি ওষুধ দিচ্ছি। এগুলি নিয়ম করে খাবেন। তাহলে ভয় দুশ্চিন্তা এগুলি থাকবে না।

আর আরেকটি কথা আমি আপনাকে বলতে চাই, কাহিনিটি বলার সময়ে বলতে পারি নি, একদিন রাত্রে আমি বাইরে ছিলাম ও নুরুন্নাহার এবং নুরু ভেতরে ছিল ঘরের। বাইরে থেকে আমি ঘরে প্রবেশ করি, এবং হালকা পায়ে বেডরুমের দিকে যাই। গিয়ে দেখতে পাই, আপনি বললে বিশ্বাস করবেন না…

– আচ্ছা, আজ আপনার সময় শেষ। আগামী দিন এ ব্যাপারে কথা হবে। আর কথা নয়।

আপনি বিশ্বাস করুন…আমি যা দেখেছি…আমি দেখলাম বিছানায় দুটি খরগোশ…শাদা ধবধবে ও পরস্পরের ভেতরে প্রবাহমান…বিশ্বাস না হয়, আমি…আমি আপনাকে মোবাইলে দেখাতে পারব…আমি রেকর্ড করেছিলাম সেইদিন…

– আরেকদিন। আজ আমার সময় নেই। আপনি আসুন।

কিন্তু আপনি…

– আসুন আপনি। ওষুধগুলি ঠিকমতো খাবেন। আরেকদিন কথা হবে।