বিচারিক সহিংসতা ও দর্শক বিষয়ে

 

গুজরাতের সুবাদারের দেয়া শাস্তি

 

এই ঘটনা আছে সৈয়দ মুজতবা আলীর পঞ্চতন্ত্রে। আঠারো শতকে একবার গুজরাতে দূর্ভিক্ষ দেখা দিল। পর পর কয়েকমাস বৃষ্টি না হওয়ায় এই অবস্থা। লোকেরা খাদ্যের আশায় আহমেদাবাদ যাচ্ছে, পিতামাতারা সন্তানদের বিক্রি করে দিচ্ছে এমন অবস্থা। গুজরাতের সুবাদার তখন আহমেদাবাদের সবচেয়ে ধনী শ্রেষ্ঠীকে ডাকিয়ে আনলেন পরামর্শের জন্য। শ্রেষ্ঠীরা জৈন ধর্মের লোক এবং ব্যবসা বাণিজ্য করে অনেক ধনী। ধনী শ্রেষ্ঠী এলে সুবাদার তার কাছে পরামর্শ চাইলেন। শ্রেষ্ঠী বললেন মালওয়া অঞ্চলে প্রচুর ফসল হয়েছে। অনেক গম পাওয়া যাবে। আমি তা আনতে পারব। কিন্তু দুইটা শর্ত মানতে হবে।

সুবাদার বললেন কী শর্ত।

শ্রেষ্ঠী জানালেন যেহেতু দুই প্রদেশে দূর্ভিক্ষ চলছে তাই মাল লুঠ হবার সম্ভাবনা আছে অতএব সাথে ফৌজ পাঠাতে হবে।

দ্বিতীয় শর্ত, গম আনার পর তিনি যে দামে বলবেন মুদিরা যেন সে দামে বিক্রি করে। কেউ বেশী দাম নিলে তাকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

সুবাদার সানন্দে রাজী হলেন।

শ্রেষ্ঠী তার সঞ্চিত অর্থ নিয়ে গেলেন গম আনতে। তার সাথে গেল ফৌজ। তিনি গম আনলেন নিরাপদেই। এবং এনে কেনা দামেই তিনি ছেড়ে দিলেন মুনাফা ছাড়াই। অনেক লাভ করেছেন জীবনে, এই দুর্ভিক্ষের কালে তার লাভ করার ইচ্ছা ছিল না। নির্দিষ্ট দাম বেঁধে দিলেন এবং যাতে কেউ মজুত করে রাখতে না পারে এজন্য হিসাব করে মুদিদের দিলেন গম। কিন্তু এত সতর্কতা স্বত্ত্বেও দু’জন মুদি বেশী দাম নিচ্ছিল। শ্রেষ্ঠী খবর পেয়ে চটে গেলেন। তিনি তাদের এই হীন কর্মের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেলেন সুবাদারের বাড়ি। গিয়ে বললেন, এদের বিহিত করুন।

সুবাদার আদেশ দিলেন মুদি দু’জনের পেট কেটে দেয়ার জন্য। পেট কাটা হল। তাদের নাড়ি ভুড়ি বের হয়ে গেল। এই অবস্থায় সুবাদার নির্দেশ দিলেন শহরের সবচেয়ে উঁচু দুই উটের পিঠে লাশ দুটি বেঁধে সারা শহর প্রদর্শনের জন্য। সমস্ত রাত ধরে এই কাজ করা হয়েছিল।

এটা করা হয়েছিল যাতে এই ধরনের কাজ আর কেউ করতে সাহস পায়। মুজতবা আলী তার লেখায় জানাচ্ছেন, ঐ ইতিহাসিক যিনি এই ঘটনা লিখেছিলেন তিনি জানিয়েছেন এরপর থেকে অধিক মুনাফার জন্য আর কেউ বেশী দাম নেয়ার সাহস পায় নি।

শারিরীক নির্যাতনের মাধ্যমে তথ্য বের করা

 

শারিরীক নির্যাতনের মাধ্যমে সন্দেহভাজন অপরাধীর কাছ থেকে সত্য বের করার পন্থা প্রাচীন গ্রীস ও রোমে প্রচলিত ছিল। মধ্যযুগের প্রথম দিকে, ৬ থেকে ১০ শতকের মধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তি সত্য না মিথ্যা বলছে তা প্রমাণের জন্য তাকে কঠিন কষ্ঠকর প্রক্রিয়ার ভেতর ফেলা হতো, অনেক সময় আগুনে বা পানিতে। এক্ষেত্রে ধারণা ছিল যে সে যদি সত্য বলে থাকে এবং অপরাধী না হয় তাহলে ঈশ্বর তাকে বাঁচাবেন। এইভাবে সত্য মিথ্যা বের করার চেষ্টা করা হতো। ১২১৫ সালের দিকে ক্যাথলিক চার্চ এই পদ্বতি বে আইনি ঘোষনা করে।

১২ শতকে ক্রিমিনাল কোর্টে রোমান আইন প্রযুক্ত হয়। এ সময় ঐশ্বরিক নির্দেশের চাইতে সত্য কী তা জানতে আগ্রহী ছিল, ফলে ঐশ্বরীক নির্দেশ প্রাপ্তির জন্য ব্যক্তি শাস্তি দানের প্রক্রিয়া আরো কমে যায়।

১৬ শতকের দিকে সব ইউরোপিয়ান রাজ্যে সম্ভাব্য অপরাধীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সত্য বের করার জন্য নির্যাতন করা হতো।

কিন্তু বিচারকেরা একসময় বুঝতে পারলেন এসব নির্যাতনের মাধ্যমে অপরাধীকে মিথ্যা অপরাধ স্বীকার করিয়ে নেয়া সম্ভব। ফ্রান্সে ১৭৮০ সালে অকার্যকারীতার কারণ দেখিয়ে এ ধরণের নির্যাতন বন্ধ করা হয়। কিন্তু এই নির্যাতন একবারে সরাসরি বন্ধ হয় নি। ইউরোপের অন্যত্র চলতে থাকে। ভলতেয়ার ও ব্যাকারিয়ার মত চিন্তকেরা এর বিরোধীতা করেন। যারা যুক্তি দিয়েছিলেন, যদি প্রমাণ থাকে তাহলে নির্যাতন করার দরকারই নেই, আর যদি প্রমাণ না থাকে তাহলে সন্দেহভাজন লোকটিকে নির্যাতন করা অনায্য হয়।

 

জন সম্মুখে শাস্তি দেয়া

 

জনসম্মুখে শাস্তি, বিশেষত মৃত্যুদন্ড দেয়া অনেক সংস্কৃতিতেই প্রচলিত ছিল। প্রাচীন রোমে শহর চত্বরে দিবসের মধ্যভাগে অপরাধীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হতো জনসম্মুখে। অনেক সময় অপরাধীকে হিংস্র জন্তুর সামনে ছেড়ে দেয়া হতো, অনেক সময় আগুনে পুড়ানো হতো, কোন সময় গ্ল্যাডিয়েটরদের সাথে যুদ্ধে নামানো হতো তাদের।

 

ছবিঃ তৃতীয় শতকের মোজাইক ছবিতে হিংস্র জন্তু দ্বারা মৃত্যুদণ্ড, উইকিমিডিয়া কমনসের সৌজন্যে।  

 

হিংস্র জন্তুর সামনে অপরাধীকে ছেড়ে দেয়া হয়ত আরবেও প্রচলিত ছিল, এজন্য THE SUBTLE RUSE: THE BOOK OF ARABIC WISDOM AND GUILE, THIRTEENTH CENTURY  তে একটি গল্প আছে।

এক সুলতানের ছিল এক সৎ উজির। তিনি ত্রিশ বছর ধরে সুলতানের সেবা করে আসছেন নিষ্ঠার সাথে। তার সৎ স্বভাবের জন্য কিছু লোক তার শত্রু হয়ে উঠল। তারা সুলতানের কাছে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করতে লাগল।

একসময় সুলতান অভিযোগকারীদের বশে চলে গেলেন। তিনি ভাবলেন ওদের অভিযোগ সত্য। তিনি উজিরকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করলেন।

তখন প্রাণদন্ড হতো, সুলতানের হিংস্র কুকুরদের খাঁচায় দন্ডিত ব্যক্তির হাত পা বেঁধে ছেড়ে দেয়া। কুকুরেরা শরীরের অংশ খুবলে নিত।

উজিরকেও খাঁচার সামনে নেয়া হলো। তখন উজির বললেন, আমার একটা শেষ অনুরোধ সুলতান। আমাকে দশ দিনের সময় দিন। আমার কিছু পাওনাদার আছেন। তাদের ঋণ শোধ করতে হবে। আমার বাচ্চাদের জন্য অভিভাবক ঠিক করতে হবে। আমাকে মাত্র দশ দিন সময় দিন।

সুলতান উজিরের কথায় রাজী হলেন। তাকে দশ দিনের সময় দেয়া হল।

উজির তার বাড়িতে গিয়ে সঞ্চয়ের একশো স্বর্ণমুদ্রা নিলেন এবং তা দিলেন সুলতানের কুকুর রক্ষণাবেক্ষনকারীকে। দিয়ে বললেন, এই দশ দিন কুকুরগুলিকে দেখাশোনা করার দায়িত্ব আমাকে দিন।

কুকুরের রক্ষণাবেক্ষনকারী এতে সম্মত হল।

উজির দশদিন পরম মমতার সাথে কুকুরদের দেখাশোনা করলেনদশ দিন শেষ হল। শাস্তির দিনে উজিরকে বেঁধে খাঁচায় নিক্ষেপ করা হলো সুলতানের সামনে।

কিন্তু দেখা গেল কুকুরগুলি তাকে আঘাত করছে না। বরং তার পাশে এসে লেজ নাড়ছে। এতে অবাক হয়ে সুলতান জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কি উজির?

উজির তখন বললেন, সুলতান, ওদের আমি মাত্র দশদিন ভালোভাবে সেবা করেছি। তাই তারা আমার সাথে এমন আচরন করছে। আর আপনাকে আমি ত্রিশ বছর নিষ্ঠা ও সততার সাথে সেবা করে গেছি। আর আপনি আমার সাথে কী আচরন করছেন? আমার শত্রুদের কথায় আপনি আমাকে প্রাণদন্ড দিয়েছেন।

উজিরের কথায় সুলতান নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। তিনি উজিরকে মুক্ত করেন এবং পুরস্কৃত করলেন। আর মিথ্যা অভিযোগকারীদের শাস্তি দিলেন

রোমান সাম্রাজ্যের পতন এর পর থেকে ১৫ শতক পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডের হার ছিল খুব কম। মধ্যযুগের বেশীরভাগ সময়েই সম্পত্তির বিপরীতে অপরাধকে মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধের চাইতে গুরুত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সাধারণ খুন বা এ ধরণের অপরাধে আলোচনার মাধ্যমে ভোক্তভোগী পরিবার এবং আইন অথিরটিকে অর্থ দিয়ে নিস্পত্তি করার সুযোগ ছিল।

তবে পিতা মাতা হত্যা বা দেশদ্রোহীতা বা দেশের রাজা বা কর্তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ইত্যাদি কিছু অপরাধের জন্য বরাদ্দ ছিল কঠোর শাস্তি। একটি চাকার ভেতর ব্যাক্তিকে ভাঙা হতো জনসমক্ষে। এই শাস্তি ১৭৮৭ সালের আগ পর্যন্ত ফ্রান্সে এবং জার্মানীতে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত চালু ছিল।

ছবিঃ কিং এরিকের প্রিয় জর্জ পিটারসনকে ভাঙা হচ্ছে, ১৫১৭ সালে। জ্যান লুইকেন, ১৬৯৮। Rijksmuseum এর সৌজন্যে।

 

জনসম্মুখে মৃত্যুদণ্ড কেন ? 

 

মৃত্যুদণ্ড দেখতে শত থেকে হাজার লোক সমবেত হতো। ১৮ শতকে ইংল্যান্ডের লন্ডনে মৃত্যুদণ্ড দেখতে জড়ো হয়েছিল আনুমানিক ১০০,০০০ জন লোক।

ছবিঃ ১৭২৪ সালে একজন চোর জ্যাক শেপার্ডের মৃত্যুদণ্ড পরবর্তী মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে জনতা। দ্য ব্রিটিশ লাইব্রেরীর সৌজন্যে।

 

জনতার সম্মুখে মৃত্যদণ্ড দেয়া হতো অপরাধীর অপরাধের গুরুত্ব বুঝাতে, রাষ্ট্র ও ঈশ্বরের প্রতি সম্মান ও আনুগত্য অনুপ্রাণিত করতে, এবং জনতার যেসব দলের  প্রতিশোধস্পৃহা জাগ্রত হয়েছে তাদের সেই স্পৃহা মেটাতে।

এখানে দোষী দল এবং প্রতিশোধ আকাঙ্খী দল, দুই দলই একটা ব্যাপারে সম্মত ছিল যে শাস্তি প্রক্রিয়ায় যে শাস্তি দিচ্ছে সে শাস্তি দিচ্ছে প্রতিশোধ আকাঙ্খী দলের পক্ষ হয়ে। ভোক্তভোগী পরিবার যদি তাদের প্রতিশোধ স্পৃহা ভুলে অপরাধীকে ক্ষমা করে দেয় তাহলে শাস্তি প্রয়োগকারীও শাস্তি দিবে না। এই ব্যাপারে সম্মত হওয়াটাই ছিল এই শাস্তি প্রক্রিয়ার ভিত্তি, এবং এজন্য শাস্তি যে দিচ্ছে তাকে তার সহিংসতা ক্ষমা করে দেয়া হতোএই সম্মতিতে না আসলে শাস্তি প্রক্রিয়াটি ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা ছিল।

সাধারণত জনতা, নিরবে শাস্তি প্রক্রিয়া দেখত, বা যে শাস্তি প্রদান করছে তাকে গালাগালি করতো অপরাধীকে ভুল বিচারে শাস্তি দেয়ার জন্য, অথবা অপরাধীকে গালিগালাজ করতো, তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করত, গোবর ইত্যাদি ছুঁড়ে মারত অপরাধীর প্রতি।

খ্রিস্টানিটি শেখায় ব্যথা বা পেইন ব্যক্তিকে ঈশ্বরের নিকটবর্তী করে। এর জন্য জনতা অপরাধীর শাস্তির সাথে একাত্মতা অনুভব করতে পারতো, আর পেইনের উপর এমন মাহাত্ম্য আরোপ এটি জন সম্মুখে শাস্তির একরকম ন্যায্যতা দিত।

মিশেল ফুকো থেকে প্রাপ্ত ধারণা মতে জনসম্মুখে শাস্তি প্রদানের কারণ ছিল দর্শকদের একই অপরাধ থেকে বিরত রাখা ও সমাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখা। ১৭৫০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে অন্য সব শাস্তির প্রায় সব কারাগারে বন্দি করে রাখায় রূপান্তরিত হয়। ফুকোর মতে এটা হয়েছে এনলাইটনমেন্টের প্রভাবে।

 

ধর্মীয় সহিংসতা

 

মধ্যযুগের প্রায় সময় এবং আধুনিক যুগের শুরুর দিকে ইউরোপের সহিংসতা ছিল মূলত ধর্ম অবিশ্বাসীদের প্রতি। যাদের বিশ্বাস ছিল অফিসিয়াল চার্চের রীতি ও নিয়মের সাথে সাংঘর্ষিক।

মধ্যযুগের প্রথমদিকে ইহুদিদের উপর নির্যাতন ছিল কম। কিন্তু মধ্যযুগের মাঝামাঝি দিকে প্রচুর বেড়ে যায়। এর কারণ ছিল,

১১ শতকে মুসলিম, ইহুদি, অবিশ্বাসী, সমকামী এরা খ্রিস্টান সমাজে বিপদজনক হিসেবে পরিচিত হয়। খ্রিস্টানরা ইহুদিদের মনে করতে থাকে খ্রিস্টানিটি এবং খ্রিস্টের শত্রু হিসেবে।

প্রথম ক্রুসেড শুরু হয় ১০৯৫ সালে যখন পোপ দ্বিতীয় আরবান ডাক দিলেন তার কথায় “নীচ জাতি” মুসলিমদের জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত করতে হবে। কখনো ইহুদিদের বিরুদ্ধে আক্রমণকেও ক্রুসেড বলা হতো। এ সময় নতুন ধারণা চালু হয় খ্রিস্টানিটি শত্রুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা মহান গুণ। জেরুজালেমে বা এর বাইরে কোথাও ইহুদি ও মুসলিমকে আলাদা করে দেখা হয় নি, উভয়ই ছিল শত্রু। ইংল্যান্ড (১২৯০) স্পেন(১৪৯২) ফ্রান্স(১৩০৬) পর্তুগাল(১৪৯৭) থেকে ইহুদিদের বিতারণ করা হয়।

এই সময়ে চার্চ নন-কনফরমিস্ট খ্রিস্টানদেরও হুমকি মনে করতে থাকে। দক্ষিণ ফ্রান্সে কাথার ক্রুসেডে ১২০৯ থেকে ১২২৯ সালের মধ্যে ১৫-২০,০০০ তথাকথিত অবিশ্বাসীদের হত্যা করা হয়েছিল।

এইসব ধারণা সমূহ প্রবর্তীত হবার সাথে সাথে খ্রিস্টানিটি আরেকটি জিনিসের প্রবর্তন হয়, এবং তা হলো শয়তানের ছবি। ১৪০০ সালের দিকে খ্রিস্টান দুনিয়ায় শয়তানের ছবি খুবই প্রচলিত হয়ে পড়ে, এর আগে যা ছিল খুবই দূর্লভ। সম্ভবত, বাইরের দুনিয়ায় খ্রিস্টানিটি তাদের শত্রু তৈরীর সাথে সাথে ধর্মীয় চিন্তার জগতেও তার এক রূপ প্রদান করে এই সময়ে।

ডাইনি অপবাদে মানুষ হত্যা মধ্যযুগের ইউরোপে ঘটা আরেক বড় নৃসংসতা। মূলত অবিশ্বাসী বা হেরেটিকসদের শাস্তির মাধ্যমেই এর উৎপত্তি হয়। ডাইনি বলা হত তাদের যারা শয়তানের সাহায্যে বিভিন্ন ক্ষমতা অর্জন করে ও মানুষের ক্ষতি করে

ডাইনি নিধনের সমকাল ছিল ১৫০০-১৭০০। ১৫৮০, ১৫৯০ এ এবং ১৬২০ থেকে ১৬৩০ এর মধ্যে ডাইনিদের বিচার শাস্তি ও হত্যা প্রক্রিয়া খুবই বেড়ে যায়। ধর্মীয় বিভক্তি, পূনর্গঠন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়কালে এর শুরু। মর্মান্তিক হলো, এই ডাইনি নিধনই আবার রেনেসান্স ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লব শুরু হবার পেছনে ছিল।

ছবিঃ অলাউস ম্যাগনাস। ডাইনিদের শাস্তি বিষয়ে। ১৫৫৫। উইকিমিডিয়া কমনসের সৌজন্যে।

 

সাধারণত কৃষকেরাই অন্য কৃষকদের বিরুদ্ধে ডাইনি বলে অভিযোগ করত। তাদের সন্দেহ হতো তাদের প্রতিবেশী হয়ত ডাইনিবিদ্যার সাহায্যে কোন সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে বা ক্ষতি করছে। ইংল্যান্ড এবং উত্তর আমেরিকায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হতো ডাইনিদের। যেসব ডাইনিদের বিরুদ্ধে শয়তানের সাথে চুক্তি এবং খামারের পশুপাখি হত্যার অভিযোগ থাকত তাদের ক্ষেত্রে আগে হত্যা করে পরে পুড়ানো হত। আর যেসব ডাইনিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকত যে তারা শয়তানের আদেশে সদ্য জন্মানো শিশুকে হত্যা করেছে বা করতে চেয়েছিল তাদের ক্ষেত্রে হত্যার আগে দীর্ঘ সময় ধরে কষ্ঠকর শাস্তি দেয়া হত। অনেক ক্ষেত্রে গরম সাঁড়াশি দিয়ে তাদের দেহের মাংস আলাদা করা হতো।

 

দর্শকদের বিষয়ে

 

হিংস্র মৃত্যুদণ্ডের সহিংসতা দেখা দর্শকদের ব্যাপারেও বুঝার আছে। মানুষ কেন এইসব সহিংসতা দেখতো বা দেখে?

বা আমাদের দেশে লোকে গনপিটুনি দেখে কেন, বা তাতে অংশ নেয় কেন?

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রায় সব জায়গাতেই লোকেরা হিংস্র শাস্তি দেখতে যেত, এবং সেইসব শাস্তি জনসমক্ষে দেয়ার পেছনে তাদের নিজস্ব কিছু কারণও ছিল। কিন্তু সাধারণ লোকেরা কেন এগুলো দেখতে যেত? আমরা কি প্রকৃতিগত ভাবেই সহিংসতা বা অন্যকে নির্যাতন দেখে মজা পাই? আধুনিক কালে ভিডিও গেইম এবং ফিল্মে আমরা সহিংসতা দেখি এবং উপভোগ করি। বা বিভিন্ন পশুর লড়াই আমরা উপভোগ করি। যেমন আমাদের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত আছে মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই। এটা কেন? কেন আমরা এমন সহিংসতা পছন্দ করি?

যখন আমরা কোন সহিংসতা উপভোগ করি, তখন শেষপর্যন্ত আমরা যে সহিংসতাটি করে যাচ্ছে সেই ব্যক্তি বা প্রাণীতে রূপান্তরিত হই। যেমন, পাবলো এক্সোবার নিয়ে নির্মিত টিভি সিরিজ (নারকোজ) দেখতে দেখতে আমরা যখন তার করা সহিংসতা দেখি, তখন এক পর্যায়ে আমরা ঐ সহিংস আচরণ করা পাবলো এস্কোবার হয়েই দেখি। ফলে সহিংসতা দেখতে দেখতে উপভোগ করাটা সব সময় দূর থেকে উপভোগ করা থাকে না, বরং আমরা এর সাথে জড়িত হয়ে পড়ি।

আর কম্পিউটার গেইম খেলার সময় এই জড়িত হওয়াটা হয় আরো গভীর। আমরা ঐ চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করি, এবং তার করা সহিংসতা সরাসরি আমাদের করা সহিংসতাই হয়।