১
ধরেন আপনার কাছে আছে একটি আংটি। সেই আংটির এক আশ্চর্য ক্ষমতা। এর মাধ্যমে যেকোন সময় অদৃশ্য হওয়া যায়। তখন আপনে কি করবেন? এখন যেমন ভালো মানুষের মত সমাজের নিয়ম কানুন মাইনা চলেন, যাদুর আংটির মালিক হইলে কি এইভাবে চলবেন? নাকী এর সুবিধা নিয়া সমাজের নিয়ম নীতি ভাইঙ্গা চলবেন?
এই প্রশ্নের সত্য উত্তর পাওয়ার উপায় নাই। কারণ যেহেতু এইরূপ কোন আংটির অস্তিত্ব নাই এবং তা আপনার হাতে নাই। এইরকম যাদুর আংটির উল্লেখ ছিল প্লেটোর রিপাবলিকে। যার দ্বারা নিজ ইচ্ছায় কেউ অদৃশ্য হইতে পারত। তখন সে সমাজের মোরাল কোড মাইনা চলত কি না, এই প্রশ্ন প্লেটোরেও ভাবাইছে।
এইটা একটা জটিল ইস্যু। অস্কার ওয়াইল্ডের একটা কথা আছে, মানুষরে মুখোশ দেও, সে তোমারে তার ট্রু ফেইস দেখাবে। এইখানে মুখোশ দেয়ার অর্থ হিসাবে অদৃশ্য হওয়ারে নেওয়া যাইতে পারে। অদৃশ্য হওয়া অবশ্য মুখোশের চাইতে আরেকটু বেশী।
স্লোভানিয়ান দার্শনিক স্ল্যাভো জিজেক আবার মানুষরে মুখোশ দেবার পক্ষপাতী। তিনি বলেন, মানুষের ট্রু ফেইস; মানব স্বত্তা ডিপ ইনসাইডে হইল ভয়ংকর। এর চেয়ে ভালো সে তার বিভিন্ন মুখোশ লইয়া থাকুক। অন্তত মুখোশের আইন্ডেটিটির মান সম্মানের জন্য সে কিছুটা ভালো হইয়া চলবে।
প্লেটোর বইয়ে বর্নিত যাদুর আংটি রিং অব জিজেস এর কথিত গল্প থেকে আগত। জিজেস ছিলেন লিডিয়ার মারম্যান্ড ডাইনেস্টির প্রতিষ্ঠাতা। এইজ জি ওয়েলসের উপন্যাস ইনভিজিভল ম্যানে অদৃশ্য হওয়া কিংবা জে আর আর টোলকিনের লর্ড অব দ্য রিংসের ওয়ান রিং এর কেরামতিও এই রিং অব জিজেস দ্বারা অনুপ্রাণিত। এর গল্পটা হইল এইরকম, লিডিয়ার রাজার অধীনে এক মেষপালক আছিলেন। তিনি জিজেসের একজন অনামা পূর্বপুরুষ। ভেড়া চড়াইতে গিয়া তিনি একদিন পাহাড়ের পাদদেশে এক গুহা দেখতে পাইলেন। গুহার ভিতরে প্রবেশ কইরা বুঝতে পারলেন এইটা আসলে একটা সমাধীশালা। এর ভিতরে তিনি ব্রোঞ্জের ঘোড়াসমেত এক মৃতদেহাবশেষ পাইলেন। মানুষের চাইতে বড় তার দেহ। হাতে একটা সোনার আংটি পরা। জিজেসদের সেই পূর্বপুরুষ আংটিটা নিয়া নিলেন। এবং হাতে পইরা বুঝতে পারলেন এর যাদুকরী ক্ষমতা আছে। এর দ্বারা যেকোন সময় অদৃশ্য হওয়া যায়। এই ক্ষমতা ব্যবহার কইরা তিনি রানীরে পটাইয়া বিবাহ কইরা ফেললেন এবং রাজারে খুন কইরা হইয়া গেলেন রাজা। এই গল্পটা একটা মিথ।
এখন ধরা যাক, এই জিজেসের আংটি কেউ একজন সত্যি সত্যি পাইয়া গেলেন। সাধারণ চিন্তায় যেমন মনে হয়, তিনি তার ইচ্ছা অনুযায়ী অদৃশ্য হইয়া ইচ্ছা অনুযায়ী কর্ম কইরা বেড়াইবেন। সক্রেটিসের মতে (প্লেটোর রিপাবলিক গ্রন্থে), এই লোক অসুখী হইবেন দিন শেষে। কারণ তিনি তার প্রবৃত্তির কাছে আত্মসমর্পন করিয়াছেন।
একইরকম কথা সাইকোএনালিস্ট জ্যাক লাকানও বলে গেছেন। তার ফ্যান্টাসী তত্ত্ব অনুযায়ী বস্তুগত আকাঙ্খা মানুষরে হ্যাপি করতে পারে না। একই ধরনের কথা জোর দিয়ে বলেন বর্তমান সময়ের অন্যতম বড় একজন দার্শনিক পিটার সিংগার। তার মতে, জীবনরে অর্থপূর্ন করার জন্য বস্তুগত আকাঙ্খার মধ্যে তারে সীমাবদ্ধ না কইরা বড় কিছুর প্রতি মনোনিবেশ করতে। এথিক্যালি দায়িত্বপূর্ন জীবন যাপনের জন্য তিনি হেডোনিস্টিক তথা সুখবাদী বিলাশ ব্যসনের পরিবর্তে দান, প্রাণীদের জন্য কাজ এবং পরিবেশের জন্য কাজ করারে গুরুত্ব দেন।
আমাদের আংটি পরা মানব খালি যদি নিজের আকাঙ্খারে গুরুত্ব দিয়া চলেন, অদৃশ্য হইয়া খালি মনিকা বেল্লুচ্চির ঘরে চইলা যান; তাইলে শেষ পর্যন্ত তিনি অসুখী হইবেন। কিন্তু তিনি যদি তার আকাঙ্খার মধ্যে নিজেরে সীমাবদ্ধ না কইরা মানবতা, পরিবেশ ইত্যাদির উদ্দেশ্যে কাজ কইরা বড় কজের দিকে মনোনিবেশ করেন তাইলে তিনি অসুখী হওয়া থেকে বাঁচবেন।
আমার মনে হয়, আমাদের আংটি মানব প্রথমে কিছুদিন খেয়াল খুশিমত চলবেন। নিজের মনমতো আয়েশী কার্যকলাপ কইরা বেড়াইবেন। একসময় তিনি বিরক্ত হইয়া যাইবেন। তখন একটা জীবনরে একটা অর্থ দিতে তিনি মানবতা বা পরিবেশ ইত্যাদি নিয়া কাজ শুরু করবেন।
যেহেতু তিনি অদৃশ্য হইতে পারেন, অতএব সম্ভবত তিনি একজন রবিন হুড হইবেন। ব্যাংক ডাকাতি কইরা গরীবদিগকে বিলাইবেন। সম্ভবত তিনি খারাপ লোকদের শায়েস্তা করবেন। আমাদের ছোটকালে দেখা কার্টুন ক্যাপ্টেন প্ল্যানেট পরিবেশ নষ্টকারী ভিলেনদিগকে শায়েস্তা করত, সেইমত তিনিও হয়ত তার পাওয়ার ইউজ করবেন।
অন্যের ভালো করার খায়েশে তিনি অসদ উপায় অবলম্বন করবেন। অসদ উপায় বলতে সামাজিক নিয়মে যেইটা অসত হিশাবে গণ্য হয়। যেমন, রবিন হুডের ডাকাতি সামাজিক নিয়মে অসৎ কর্ম। অন্যের ভালো করতে গিয়া মানুষ অধিক অসদ উপায় অবলম্বন করে। এইটা মানুষের প্রকৃতি।
আমাদের আংটিমানব নিজের কাছে একজন সৎ মানুষ। যেমন, আমরা নিজেরা প্রত্যেকের কাছে একেকজন সৎ মানুষ। আংটিমানব অসততা করতে গিয়া এমনভাবে করবেন যেন তার নিজের কাছে বিদ্যমান সৎ রূপখানা পুরা ম্লান না হইয়া যায়।
এইক্ষেত্রে অন্যের উপকার করতে গিয়া অসদ উপায় সবচেয়ে ভালো। এতে তার নিজের কাছে থাকা সৎ চেহারা ম্লান হয় না, উলটা আরো পরিষ্কার হয়।
আংটিমানব যখন নিজের প্রবৃত্তির বশবর্তী হইয়া অসদ উপায় অবলম্বন করবেন, তখনো তিনি তারে র্যাশনালাইজ করবেন। একটা যৌক্তিক রূপ দিয়া নিজেরেই বুঝাইবেন এইটা করা ঠিক আছে; মনিকা বেল্লুচ্চির ঘরে তিনি যাইতেই পারেন রাত বিরাতে অদৃশ্য হইয়া। তার এই নিজের অসততারে র্যাশনালাইজ করা নির্ভর করবে তার ক্রিয়েটিভিটির উপরে। অর্থাৎ, তিনি বেশী ক্রিয়েটিভ হইলে বেশী বিশ্বাসযোগ্য গল্প তৈরী করতে পারবেন। এবং নিজেই তাতে দৃঢ় বিশ্বাস করতে পারবেন।
এই মনস্তত্ত্ব আরো ভালো বুঝতে শরনাপন্ন হওয়া যাইতে পারে ড্যান এরিইলি তার দ্য অনেস্ট ট্রুথ এবাউট ডিজওনেস্টি বইখানার।
২
কয়দিন আগে একজন উদ্যোক্তা আমার সাথে একটা এপ আইডিয়া শেয়ার করিলেন। এপটা এমন হবে যে আশেপাশে পুলিশ কই আছে তা ব্যবহারকারীরা জানতে পারবেন। জিপিএস এর মাধ্যমে ওইটা ট্র্যাক করা হবে। লোকে বিপদে পড়লে যাতে আশেপাশে পুলিশ কোথায় আছে তা জানতে পারে এবং তাড়াতাড়ি হেল্প নিতে পারে, এই কাজে এপ তারে সাহায্য করবে। সরকার এইটা সর্বস্তরে ব্যবহার করা শুরু করতে পারে।
আইডিয়া আমার পছন্দ হইল না। না হওয়ার পক্ষে আমি যুক্তি দিলাম যে এই এপ কাজ করবে না। কারণ অপরাধীও তা ব্যবহার কইরা জানতে পারবে পুলিশ কই আছে। পুলিশ আশেপাশে থাকলে সে ক্রাইম করবে না। প্ল্যান প্রোগ্রাম করে যেইসব ক্রাইম হয় সেইগুলাতে এই এপ বরং সহায়তা করবে।
এই আইডিয়ার মৌলিক সমস্যাটা হইতেছে সব মানুষরে সৎ এবং অসৎ এই দুই ভাগ কইরা দেখা। এইটা একটা দেখার ভুল। কারণ মোটাদাগে এমন সোজা সরল ভাগ নাই। দুইয়ের চাইতে অধিক ভাগ বিদ্যমান। আংশিক সৎ, কিছুটা সৎ, অল্প অসৎ ইত্যাদি অনেক ভাগ করা যাইতে পারে। আবার সেইসব ভাগেরা পরিবর্তিত হইতেও পারে। একজন লোক এক ঘটনায় সৎ হইয়া আরেক ঘটনায় অসৎ হইতে পারে, ক্রাইম করতে পারে। যদি এইরকম কোন ব্যবস্থা থাকত, দুনিয়ার লোকদের সোজা সৎ আর অসৎ আলাদা করা যাইত তাইলে এইরকম এপ কাজ করত। এই এপ বানাইয়া সিলিকন ভ্যালীতে চইলা যাওয়া যাইত। এবং আরো অনেক সমস্যার সমাধান হইয়া যাইত সম্ভবত।
এক লোকের দরজার তালা নষ্ট হইছিল। সে গেল তালা ঠিক করা লোকের কাছে। ইংরাজিতে যাকে বলে লকস্মিথ। লকস্মিথ আইলেন। তালা ঠিক করলেন। যাবার আগে তিনি ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলেন, আপনে কি জানেন লোকে ঘরে তালা লাগায় কি জন্যে?
ভদ্রলোক বললেন, কেন আবার! চোরের হাত থেকে নিজের জিনিসপত্র বাঁচানির জন্য।
লকস্মিথ বললেন, না। দুনিয়াতে এক ভাগ লোক আছে ধরেন সৎ, এরা যেকোন অবস্থাতেই সৎ থাকবে। আরো এক ভাগ লোক আছে এরা অসৎ। আপনি তালা লাগান আর যাই লাগান না কেন, তারা অপরাধ কইরা যাবে। তালা মূলত লাগানি হয় বাকী আটানব্বই ভাগ লোকের জন্য। তাদের এই মেসেজ দিবার জন্য যে এইখানে তালা লাগানো আছে, চুরি করা মহাপাপ।”
এই লকস্মিথের কথাটা বুঝার আছে। জেন শিক্ষা হইল মানুষের মাঝে সৎ আর অসৎ অংশ আছে। কোন সিদ্ধান্তের কালে দুইটার ফাইট হয়। যে জিতে সে হয় সিকান্দর, মানে আলেকজান্ডার। সিকান্দর মানে যে আলেকজান্ডার এইটা জানছিলাম বাংলার শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস পইড়া। সুলতান ইলিয়াস শাহ দিগ্বিজয়ী হইয়া উপাধী নিছিলেন সিকান্দর উস সানি বা দ্বিতীয় আলেকজান্ডার। এই হিসাবে নায়ক ওমর সানির নামের অর্থ দাঁড়ায় দ্বিতীয় ওমর।
৩
মানুষের ভিতরে অসততা কীভাবে ক্রিয়া করে এইটা একটা চিন্তার বিষয়। কেন কিছু মানুষ অসৎ হয়? এই বিষয় নিয়া ব্যাপক গবেষনা কইরাই বই লেখছেন জনাব ড্যান আরিইলি। সেইখানে তিনি অসততার মুখোশ উন্মোচন করার চেষ্টা নিছেন। উপরিউক্ত লকস্মিথ সাহেবের গল্পটা সেখানেই পাওয়া।
মানুষের অসৎ কর্মের একটা তত্ত্ব হইল, মানুষ ক্রাইম করার আগে একটা যৌক্তিক আলোচনা কইরা দেখে এতে তার লাভ বেশী না ক্ষতি বেশী। হর্ষবর্ধন গোবর্ধনের একটা গল্প পড়েছিলাম একদা বাংলা সহপাঠে। হর্ষবর্ধন তার ভাই গোবর্ধনকে বলতেছেন বাগান করার জন্য। অলস গোবরা বলে বাগান করার কী দরকার! আম টাম ইত্যাদি ফল তো বাগানো থেকেও খাওয়া যায়। হর্ষবর্ধন জিগান বাগানোটা আবার কি? গোবর্ধন ব্যাখ্যা করে, ধরো অন্যের বাগানে আম ধইরা আছে। সেইগুলাকে আও আও বললেই তো আসবে না। কাছে যেতে হবে, উঠতে হবে গাছে। ছুরি দিয়ে কাটতে হবে। এই সমস্ত প্রক্রিয়াটাই বাগানো।
এই ঘটনার কথাই চিন্তা কইরা দেখা যাক। গোববর্ধন যদি অন্যের বাগান থেকে ফল বাগাইতে যায় তাইলে সে কি ভাববে? প্রথমে সে চিন্তা কইরা দেখবে এতে তার লাভ কী। লাভ এখানে আম। পরে সে ভাববে ধরা পড়ার সম্ভাবনা কেমন। ধরি তার আম খাওয়ার ইচ্ছা তীব্র এবং ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম, তাইলেই সে আম বাগাইতে যাবে। ধরা পড়ার সম্ভাবনা আম খাওয়ার ইচ্ছা বা আম পাইয়া যে লাভ হবে তার চেয়ে বেশী হইলে সে আম বাগাইতে যাবে না। এইটাই যৌক্তিক পর্যালোচনা। এই তত্ত্বখানা দিয়াছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ গেরী বেকার।
বেকার একদিন যাইতেছিলেন মিটিংএ। দেরী হইয়া যাইতেছে। তিনি গাড়ি পার্ক করতে গিয়া দেখলেন লিগ্যালি পার্ক করতে গেলে আরো দেরী হইয়া যাবে। হয়ত তিনি মিটিং মিস করবেন। ফলে ইল্লিগ্যালি পার্ক কইরা তিনি গেলেন মিটিংএ। এরপরে তিনি ভাবলেন এইটা নিয়া। তিনি গাড়ি ইল্লিগ্যালি পার্ক কইরা ফাইন দিবার রিস্ক নিছেন মিটিং এর জন্য। কারণ ফাইনে তার যে লস হবে তার চেয়ে বেশী লাভ হবে মিটিংএ যোগ দিয়া।
এইটা যৌক্তিক পর্যালোচনা বা যৌক্তিক অপরাধের সিধা মডেল।
ড্যান আরিয়ালি তার অসততার মুখোশ উন্মোচনের বইয়ে এই তত্ত্বের সমালোচনাই কইরা গেছেন। মানে এইটারে ভুল প্রমান করার চেষ্টা করছেন। এর জন্য অসংখ্য পরীক্ষা এবং তার ফলাফল উপস্থাপন কইরা দেখাইছেন মানুষের অসততা অত ইজি বিষয় না। মানুষের অসততার প্রবণতা খালি যৌক্তিক লাভ-ক্ষতির বিচারের উপরে নির্ভর করে না।
আইয়ালি অর্থনীতিবিদ বেকারের লাভ-ক্ষতি হিসাব তত্ত্বের বিপরীতে দাঁড় করাইছেন আরেকখানা তত্ত্ব। তার নাম দিছেন ফাজ ফ্যাক্টর। আমরা আমাদের সম্মানী সৎ মানুষ হিশাবে দেখতে চাই। আবার চিটিং বা অসদ উপায় অবলম্বন কইরা যতটা পারা যায় ততটা বাগাইতে চাই। এই দুই জিনিস ক্রিয়া করে আমাদের মধ্যে। তাই সুযোগ থাকলেও আমরা এমনভাবে অসদ উপায় অবলম্বন করি না যাতে আমাদের কাছে আমাদের সৎ চেহারা ম্লান হইয়া যায়। একটা ব্যালেন্স আমরা রাখি যাতে নিজেদের কাছে নিজেদের সৎ চেহারাখানা অটুট থাকে। এইটা ফাজ ফ্যাক্টর তত্ত্বের মূলকথা। এখানে আমরা বলতে মানুষেরা বুঝানি হইতেছে।
আমরা নিজেদের অসৎ কর্মরে র্যাশনালাইজ করতে চাই। এর জন্য যতটা পারা যায় দূরে থাইকা কাজ সারতে পারলে ভালো হয় আমাদের জন্য। যেমন, ঘুষ নিবার ক্ষেত্রে খামে ভইরা টাকা নেয়া এবং টেবিল নিচ দিয়া নেয়ার একটা রীতি আছে বলে শুনেছি। এইটার কারণ হইল, সরাসরি হাতে হাতে টাকা একটা অসংকোচের সৃষ্টি করে। যিনি ঘুষ নিতেছেন তিনি নিজেরে নিজের কাছে সৎ রাখার ক্ষেত্রে খাম এবং টেবিলের নিচ দিয়া নেয়ারে বেশী পছন্দ করেন। এটা যদি এমন হয় সরাসরি ব্যাংকে পাঠাইয়া দেয়া কিংবা বাড়িতে উপহারাদি পাঠানো, তাইলে সেটা তার পক্ষে আরো সহজ হবে।
কতটা মানি পাওয়া যাবে কিংবা ধরা পড়ার চান্স কত সেইটা অসততার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে না বলে মত দিছেন এরিইলি। এক্সপেরিমেন্ট কইরা পাইছেন। তবে এখানে সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবেশের লগে যুক্ত বিষয়াদি নেগলেক্ট করা হইছে, ফলে তা শুধুমাত্র মানব প্রকৃতির পরীক্ষাই হইছে। প্রকৃতিগতভাবে মানুষের ভেতরে অসততা কেমন ক্রিয়া করে তার পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং সেই সম্পর্কিত মত বলা যায় বইয়ের বক্তব্যকে।
কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট এর কালে মানুষ অসৎ হইয়া পরে বা তার সম্ভাবনা বেশী। এই ক্ষেত্রে সে নিজের স্বার্থজনিত কারণে এক পক্ষে বায়াজড হইয়া পড়ে। নিজে কোন অর্থনৈতিক বা অন্য সুবিধা পাইলে প্রকৃতিগতভাবেই ঐ প্রতিষ্ঠান বা লোকের প্রতি মানুষের সমর্থন চলে যায়।
ক্রিয়েটিভ লোকের ক্ষেত্রে অসৎ হইবার চান্স বেশী। কারণ তার নিজের অসততার পক্ষে সুন্দর গল্প বানাইবার ক্ষমতা বেশী থাকে। এইসব গল্পগুলা অনেক সময় পজেটিভ ভাবে অনুপ্রাণিত করে, বিশ্বাস জন্মায় কোন বড় কাজ করার। অনেক ক্ষেত্রে এর প্রভাব নেগেটিভ। বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের দারুণ একটি কথা হইল, “নিজেরে বোকা বানাইয়েন না, সেইটাই আপনার জন্য সবচেয়ে সহজ।” নিজেরে আমরা প্রায়সই বোকা বানাইতে থাকি।
যেমন, একজন ভিক্ষুকরে কিছু টাকা দেয়া বা সেই টাকা দিয়া খাবার কিইনা দেওয়ার মধ্যে মূলত কোন পার্থক্য নাই। কিন্তু খাবার কিইনা দিলে দাতার মনে একটা ভালো লাগার তৈয়ার হয়, সে নিজেরে বেশী দয়ালু ভাবতে থাকে। এইটা যদিও ভুল (কিন্তু পজেটিভ), নিজেরে সে ভুলভাবে দয়ালু ধইরা নেয়, পরবর্তীতে সে আরো কিছু দয়ার্দ্র কাজ করতে পারে।
এইভাবে (সেলফ সিগনালিং এর মাধ্যমে) ছোট অসততা বড় এবং বেশী অসততার দিকে নিয়া যায়। যেমন, ফেইসবুকে একটা স্ট্যাটাস চুরি আপনারে বড় চুরির দিকে নিয়া যাইতে পারে।
চিন্তা করেন আপনার একটা দোকান আছে। সেখানে কিছু কর্মচারী আছে। একজন গরীব বৃদ্ধ কর্মচারী একদিন অল্প কিছু টাকা চুরি করে ফেলল। অতঃপর সে ধরা পড়ল। তারে মানবিক অবস্থা বিচার কইরা আপনি মাপ কইরা দিবেন না উপযুক্ত ব্যবস্থা নিবেন?
মানবিক দিক বিচার করলে আপনে তারে মাপ কইরা দিতে পারেন। অল্প কিছু টাকাই তো। কিন্তু এইটা আপনার ব্যবসার জন্য ভালো হবে না। প্রথমত, অল্প চুরি বৃদ্ধ কর্মচারীরে আরো বড় চুরির দিকে নিয়া যাইতে পারে। দ্বিতীয়ত, দোকানের অন্য কর্মচারীরা চুরিতে উৎসাহীত হইয়া পড়তে পারে। মোটকথা, আপনার দোকানের সিস্টেম ভাইঙ্গা পড়ার সম্ভাবনা বেশী।
তাই ব্যবসার সৎ কাঠামো এবং শৃঙ্খলা ঠিকাইয়া রাখতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়াই হবে আপনার জন্য যুক্তিযুক্ত।
অন্য লোকরে অসদ উপায় অবলম্বন করতে দেখলে লোকের অসততা বাড়ে। আবার নিজেদের অসততার মাধ্যমে অন্য কেউ লাভবান হইতেছে এমন হইলেও অসততার পরিমাণ আরো বাইড়া যায়। তখন লোকের মধ্যে এই অসততাকে র্যাশনালাইজ করার আরো মোক্ষম যুক্তি তৈয়ার হয়। একটা রবিন হুডিও ভাব আসে।
অসততারে দমাইয়া রাখারও কিছু উপায় আছে। এর মধ্যে অনেকগুলা আছে যাদের ইর্যাশনাল বলে ধরা হয়। যেমন, রিলিজিয়াস বিধিনিষেধ স্মরণ করাইয়া দেয়া। এইগুলা মারাত্মক প্রভাব ফালায় অসততা দূরে রাখতে। এর সেক্যুলার ভার্শন হইতে পারে শপথ করানি। দরজায় তালা দেয়াও এমনই এক পদক্ষেপ। মানুষকে স্মরণ করাইয়া দেয়া। ড্যান এরিইলি প্রস্তাব দিছেন ট্যাক্সের ফর্মে বা অন্য কোন চুক্তিপত্রে যেখানে তথ্যে অসততা অবলম্বন করার উপায় আছে, সেখানে উপরে সিগনেচারের ব্যবস্থা রাখলে অসততার পরিমাণ কমবে। যেহেতু খালি পেইজে আগে সিগনেচার নেয়া সমীচিন হয় না তাই তিনি উপরে নিচে দুইবার সিগনেচার নেয়ারও প্রস্তাব দিছেন। যেমন, স্বাক্ষীরে কাঠগড়ায় আগেই শপথ করাইয়া নেয়া হয়, যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য ছাড়া মিথ্যা বলিব না। এই শপথ তারে অসততা থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করবে। যদি স্বাক্ষী দিবার পরে শপথের চল থাকত, যাহা বলিয়াছি সত্য বলিয়াছি, সত্য ছাড়া আর কিছু মুখে আনি নাই; তাইলে স্বাক্ষীর অসততার হার বাড়িয়া যাইত।
আরেকটা উপায়ে অসততা বেশ বড় মাত্রায় কমানি যায়, তা হইল বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা। অর্থাৎ, সুপারভিশনের ব্যবস্থা করা। যাতে লোকেরা বুঝতে পারে কেউ একজন তাদের উপর চোখ রাখতেছে। বা সত্যি সত্যি তাদের উপর চোখ রাখা, পর্যবেক্ষণে রাখা।
এই অসততা বিষয়ক বইটা ইন্টারেস্টিং। যদিও এর ফাইন্ডিংস গুলা নিয়া কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন। পরীক্ষাগুলার সীমাবদ্বতা বিচারে নিতে পারেন। কিন্তু এর সামগ্রিক চিন্তা অসততা নিয়া নয়া ভাবে ভাবনার কিছু সুযোগ কইরা দেয়। এবং নিজেদের আচরনরে সৎ করতে সাহায্য করতে পারে। নিজের ছোট বড় অনেক আচরনের সৎ এবং অসত দিক নিয়া নয়াভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
সব মানুষই নিজেরে মনে করে সৎ। কেউ কেউ অবশ্য নিজেরে মনে করে দরবেশ। অসততার পক্ষে সবারই নিজস্ব জাস্টিফিকেশন বা র্যাশনালাইজেশনের প্রচেষ্ঠা থাকে। তারা অসত আচরনরে সে র্যাশনালাইজ করে মনে মনে তুষ্ট থাকে এবং আরো অসততার দিকে যায়। এই বই তাদের র্যাশনালাইজ করার চিন্তার ইর্যাশনালিটি নিয়া ভাবতে সাহায্য করতে পারে।
রোমানরা যখন ক্ষমতার শীর্ষে ছিল তখন তাদের যেসব জেনারেল বিশাল যুদ্ধে জিততেন তারা লুঠের মাল দেখাইতে দেখাইতে শহরের রাস্তায় মার্চ কইরা যাইতেন। তারা সোনালি আর রক্তবর্ন মেশানো কাপড় পড়তেন। মাথায় থাকত জয়ের মুকুট। মুখে লাল রঙ। তাদের একটি সিংহাসনে কইরা নিয়া যাওয়া হইত। চারিদিক থেকে জয়ধ্বনি উঠত তাদের নামে। মজার এবং গভীর তাৎপর্যপূর্ন বিষয় হইল এই জেনারেলের পাশে পাশে যাইত এক দাস। এত আয়োজন, চারিদিকের এত প্রশংসা আর জয়ধ্বনি দেইখা জেনারেলের মনে যাতে অহেতুক গর্বের উদয় না হয় এইজন্য সে জেনারেলের কানের কাছে বইলা যাইতে থাকতো, “মেমেন্টো মরি।” অর্থাৎ, নিজের মরনশীলতারে স্মরণ করুন।
যারা রিলিজিয়াস টেক্সট মানবেন না তাদের জন্য অসততা জন্য সাবধান করানির একটা আধুনিক রূপ প্রস্তাব করছেন ড্যান আরিইলি। সেটা হইল, “নিজের ভ্রমশীলতারে স্মরণ করো” বা “নিজের যুক্তিহীনতারে স্মরন করো”। অযৌক্তিক আচরণ করা মানুষের স্বভাব। ভ্রমে পতিত হওয়া মানুষের প্রকৃতি। এর থেকে বাঁচতে এইটা স্মরণ রাখা দরকার যেকোন সময়ে আপনে ভ্রমে পতিত হইতে পারেন।