৫ অক্টোবর ২০১৫ তে মারা গেলেন সুইডিশ লেখক, নাট্যকার এবং সোশ্যাল ক্রিটিক হ্যানিং মেঙ্কেল। তার বিখ্যাত ক্রাইম মিস্ট্রি সিরিজ কুর্ট ওয়ালান্ডার।
হ্যানিং বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। এবং রাজনীতিতে ছিলেন সক্রিয়। এছাড়া আফ্রিকায় তিনি অনেক জনহিতকর কাজ করেছেন। প্রচুর টাকা দান করেছেন মোজাম্বিকের উন্নয়নের জন্য।
ওয়ালান্ডার নিয়ে টিভি সিরিজ হয়েছে। সুইডেনে এবং ইংরেজিতে বিবিসিতে। বিবিসিরটা দেখা শুরু করি লেখকের মৃত্যুর খবর পড়ার পর। এর একটি কারন তার পলিটিক্যাল চিন্তা এবং কাজকর্ম ভালো লেগে যায়।
লেখক ওয়ালান্ডার নিয়ে বলেছেন, “আমি ক্রাইম স্টোরি লেখার জন্যই খালি লেখি নাই কারণ আমি সব সময়ই চাই নির্দিষ্ট কিছু জিনিস নিয়ে কথা বলতে।”
নিজেও এই ধরনের থ্রিলার লেখি নির্দিষ্ট কিছু জিনিস নিয়ে কথা বলার জন্য। সুতরাং, এই মিলের জন্য ওয়ালান্ডার দেখার আরো আগ্রহ জন্মে।
থ্রিলার বা মিস্ট্রি ধরনের উপন্যাস বইয়ে পড়ার চাইতে ফিল্মে দেখাটাই আমার কাছে ভালো লাগে।
ওয়ালান্ডারের ইংরেজি ভাষার সিরিজে ওয়ালান্ডার চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিখ্যাত অভিনেতা কেনেথ ব্রানা। শক্তিশালী এই অভিনেতার নাইট উপাধী আছে। তাই বিবিসির নিউজে তার নামের আগে স্যার লাগাতে দেখা যায়।
অন্য ডিটেকটিভ চরিত্রগুলোর (যেমন শার্লক হোমস) সাথে ওয়ালান্ডারের বেশ কিছু পার্থক্য আছে। ওয়ালান্ডার নিজেই কিছু সমস্যায় ভুগেন। তিনি প্রচন্ড এলকোহলসেবী, তার আত্মসন্দেহ, ডিমেনশিয়া ইত্যাদি দেখা যায়। যখন তিনি ছিলেন একজন যুবক পুলিশ অফিসার তখন প্রায় মারা পড়তে গিয়েছিলেন একজন অপরাধীর হাতে। তার স্ত্রী মোনা তাকে ছেড়ে গিয়েছে। তার মেয়ে লিন্ডা, যে পনের বছর বয়সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল সে তার সাথে থাকে। ওয়ালান্ডারের বাবার মানসিক কিছু সমস্যা আছে। তিনি একই ল্যান্ডস্ক্যাপ বার বার আঁকেন। প্রায় সাত হাজার বার তিনি এঁকেছেন একই ছবি। এই বাবার সাথেও ওয়ালান্ডারের বেশ শীতল সম্পর্ক দেখা যায় কারণ তার বাবা কখনো চান নি ওয়ালান্ডার একজন পুলিশ অফিসার হোক।
এইরকম পারিবারিক সমস্যার মধ্যে ওয়ালান্ডার তার পুলিশি কাজ করে যান। মাঝে মাঝে দেখা যায় অপরাধীদের পারিবারিক সমস্যাগুলোর সাথে তিনি তার সমস্যাগুলো মিলিয়ে ফেলেন।
অর্থাৎ ওয়ালান্ডার দারুণ মানবিক। এই মানবিকতাবোধ তাকে পীড়া দেয়।
লেখক হ্যানিং মেঙ্কেল মোজাম্বিকের রাজধানীতে ছিলেন দীর্ঘদিন। ওখানে একটি লোকাল থিয়েটারের আর্টিস্টিক ডিরেক্টর ছিলেন। তিনি লিখেছেন যে তার আফ্রিকায় যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের বাইরে গিয়ে পৃথিবীটাকে দেখা।
তার ওয়ালান্ডার সিরিজের উপন্যাসে দেখা যায় কলোনিয়ালিস্ট অর্থনীতি ভেঙে ফেলতে ভয়ংকর এক সাইবার ক্রাইম করার চেষ্টায় নিয়োজিত কতিপয় এন্টিকলোনিয়ালিস্ট। ওয়ালান্ডার ঘটনাক্রমে এদের প্রতিহত করতে পারেন। কিন্তু থিম নির্মানে এভাবেই বার বার উঠে এসেছে রেসিজম, কলোনিয়ালিজম ইত্যাদি।
লেখকের জীবনের সাথে ওয়ালান্ডারের বিভিন্ন ঘটনার মিল খুঁজতে চান অনেকে। লেখকের মা এবং বাবার বিচ্ছেদ হয়েছিল যখন তার বয়স দুই বছর। মা ছাড়া বড় হয়েছেন তিনি। এই সময়ে তার সঙ্গী ছিল বই। এছাড়া তার বাবা ছিলেন একজন বিচারক। তাই, বিভিন্ন অপরাধ সংস্লিষ্ট ঘটনা সম্পর্কে তিন নিয়মিত জানতে পারতেন।
ওয়ালান্ডার অপেরার খুব ভক্ত। গাড়িতে তাকে প্রায়ই বিখ্যাত অপেরা গায়কদের গান শুনতে দেখা যায়। ওয়ালান্ডার এক সময় স্বপ্ন দেখতেন পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিয়ে অপেরাতে যোগ দেয়ার। ওয়ালান্ডারের এই অপেরা প্রীতির উৎস লেখক হ্যানিং মেঙ্কেলের দাদা। লেখকের দাদা ছিলেন একজন কম্পোজার। দাদার ক্লাসিক্যাল মিউজিক প্রীতি নাতির তৈরী ফিকশনাল ক্যারেক্টারের মধ্যে গিয়ে স্থিত হয়েছে। ওয়ালান্ডারকে দেখা যায় মোজার্ট শুনতে শুনতে নিসঙ্গ রাত কাটিয়ে দিতে।
লেখক বিয়ে করেছেন চার বার। শেষবার ১৯৮৮ সালে বিয়ে করেছিলেন বিখ্যাত সুইডিশ ফিল্ম নির্মাতা ইংমার বার্গম্যানের মেয়ে ইভা বার্গম্যানকে। একবার তিনি বলেছিলেন যে, “এর মাধ্যমেই বুঝা যায় আমি আশাবাদী লোক।”
ওয়ালান্ডারকেও একইভাবে প্রেমে ব্যর্থ হতে দেখা যায়।
প্রথম ওয়ালান্ডার সিরিজের উপন্যাস “ফেইসলেস কিলার” যখন প্রকাশিত হয় তখন লেখকের বয়স ৪৩। তার এই সিরিজ অনেক জনপ্রিয় হয়ে পড়ে। বিভিন্ন এড্যাপ্টেশন হয়। এবং লেখক একজন মাল্টিমিলিওনিয়ারে পরিণত হন। তখনো তিনি তার বামপন্থী রাজনৈতিক চিন্তাধারা থেকে সরে আসেন নি।
তিনি ছিলেন ইসরায়েলের তীব্র সমালোচক। ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের টু স্টেট সল্যুশনকে প্রতারণাপূর্ন বলে আখ্যায়িত করেন।
গাজায় ইজরাইলি অবরোধ ভাঙতে একটিভিস্টদের “গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা” তে হ্যানিং মেঙ্কেলও ছিলেন। গাজা ফ্লোটিলা রেইডে ইজরাইলি ডিফেন্স ফোর্সের গুলিতে নয়জন মারা যায়। হ্যানিং মেঙ্কেলকে ইজরাইলি বাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে সুইডেনে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
বিবিসিতে কেনেথ ব্রানার করা ওয়ালান্ডার এবং সুইডিশ ওয়ালান্ডারের মধ্যে লেখকের মতে সুইডিশ ওয়ালান্ডারই তার কল্পিত চরিত্রের বেশি কাছে যেতে পেরেছে।
গল্পগুলোকে কিছুটা স্লো মনে হতে পারে।
সাহিত্যমানের দিক থেকে ক্রিটিকেরা বলেছেন ওয়ালান্ডার ডিটেক্টিভ ধারার স্টাইলিস্টিক ধরন থেকে বের হতে পারে নি। মানে সাধারণত থ্রিলার লেখকেরা যে কিছু পর পর খুন ইত্যাদি দিয়ে থ্রিলারে সাসপেন্স তৈরী করেন তা থেকে ওয়ালান্ডার মুক্ত নয়।
সাহিত্যমানের কথা বাদ দিলেও বলা যায়, এই ধরণের থ্রিলারের ক্ষেত্রে ওয়ালান্ডার চরিত্র হিসেবে ব্যতিক্রমধর্মী। এবং সোশ্যাল ইস্যু উঠে আসার দরুন কৌতুহলউদ্দীপক।