আগে মানুষ বিয়া করলে স্বাক্ষী রাখতো দুইজনরে, এবং পরিবার, আত্মীয় পাড়া প্রতিবেশীরে। তারা দেখতেন যে কীভাবে বিয়ার কর্মকাণ্ড হচ্ছে।
কিন্তু এখন মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে স্বাক্ষী রাখে পাবলিকরে। অনেক অনেক জনগণ। তারা বিয়া হইয়া যাওয়া লোকদের ছবি দেখেন, তাদের অনুষ্ঠান দেখেন, তারা পরস্পররে কত প্রেম করেন, সেইটাও দেখেন। মৃত্যুই আমাদের পার্ট করবে বা আমাদের এই সম্পর্ক জন্ম থেকে জন্মান্তরে চলে যাবে, ইত্যাদি।
বিয়ার একটা স্বাভাবিক পরিণতি বিচ্ছেদ। বিয়া জিনিশটা আছে মানে, লজিক্যালি বিচ্ছেদও আছে। আগে যখন বিচ্ছেদ হইত, তখন পরিবার পরিজনই ব্যাপারটা নিয়া ভাবতেন ও কথা বলতেন। পাড়া প্রতিবেশীরাও বলতেন। যেহেতু এইটা সমাজের দেখায় একটা ফেইলার, তাই তারা নানাবিদ মুখরোচক আলোচনা করে নিজেদের রিসেন্টিমেন্ট নিবারণ করতেন। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার টনিক যেহেতু রিসেন্টিমেন্ট উদ্ভূত নানাবিদ কার্যাবলী, তাই তাদের এহেন কাজ মেনে নেয়া যায়। করে শান্তি পাইতেছে, নিজের হার্ড লাইফ আরেকটু টলারেবল হইতেছে, তাইলে করুক।
কিন্তু এখন, যেহেতু স্বাক্ষী পাবলিক, তাই বিচ্ছেদের ইস্যুগুলা পাবলিক ইস্যু হইয়া যায়। পাবলিকরা নানাভাবে ও ভঙ্গিমায় জিনিশটা নিয়া কথা বলেন যে, আরো অনেক অনেক মানুষের সামনে ঘটনাটা চলে যায়। যারা আগে এনাদের চিনতেন না, এদের বিয়ার খবরও জানতেন না, তাদের কাছেও বিচ্ছেদের খবর চলে যায়। এবং আম পাবলিকের রিসেন্টিমেন্টের উৎসব হিশাবে, একটা ছোট খাট উৎসবে রূপ নেয় ঘটনাটা।
এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী ওই দম্পতিই।
কারণ তারা বিয়ার সময় মাথায় রাখেন নাই যে, বিয়ার সম্ভাব্য পরিণতিদের মধ্যে একটা সম্ভাব্য পরিণতি বিচ্ছেদ। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল এসোসিয়েশন বলে ৪০-৫০% প্রথম বিয়া বিচ্ছেদে শেষ হয়। আমেরিকা ও বাংলাদেশের সমাজ ও কনটেক্সট ভিন্ন, কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশের ডেটা নাই তাই, আমেরিকানটা দিয়াই মানব প্রকৃতিরে বুঝার চেষ্টা এখানে। ৪০-৫০% প্রায় অর্ধেক সম্ভাবনা, কম না।
তারা এটা মাথায় না রাখার জন্য বেশি মানুষরে স্বাক্ষী রাখছেন ও তাদের সামনে বলছেন আমাদের এতো এতো প্রেম, আমরা এই প্রেমের টানেই একসাথে থাকব জন্ম জন্মান্তরে।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। প্রেম ও বিয়ায় জামাই বউয়ের সম্পর্কের এক ক্ষমতা সম্পর্ক আছে, এইখানে চুক্তিভঙ্গ, পারসোনালিটির ভিন্নতা ইত্যাদি সহ নানা কারণে অমিল হইতে পারে।
মেয়েরা এইটা বেশী চান যে পাবলিকলি দেখাইতে তাদের প্রেম। তাদের মনে হয়, এর মাধ্যমে কমিটমেন্ট শক্ত হয়।
মেয়েরা এইরকম পুরুষ চান, যে তার সাথে লং টার্মে কমিটেড, যে প্রভাইড করতে পারবে।
অন্যদিকে, পুরুষেরাও দীর্ঘ সম্পর্কের জন্য চান বিশ্বস্থ এবং লং টার্মে প্রভাইড করা যায়, কমিটেড থাকা যায়, এমন মেয়ে।
উভয় পক্ষেই, শর্ট টার্মে কারো সাথে সেক্স করতে পারেন, কিন্তু তারা যখন নিশ্চিত জানবেন এরা শর্ট টার্মের জিনিশ, তখন কখনোই তাদের ব্যাপারে লং টার্মের চিন্তা বা কমিটেড হবার কথা ভাববেন না।
কারণ লং টার্মের কমিটমেন্ট রিসোর্স, এনার্জি, এবং আরো অনেক কিছু দাবী করে। মানুষ লং টার্মে কমিটেড হয় ফ্যামিলি তৈরি করতে।
বিয়া অবশ্যই লং টার্মের কমিটমেন্টের এক বড় স্টেপ।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা অত বড় না আগে যত বড় ছিল।
যেমন ধরেন, একজন ব্যক্তি পপুলার, সে বিয়া করল আরেক পপুলার মেয়েরে। তারা, ধরেন, কোন এক এডু টেক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছে, ছেলেটা ধরেন মালিক। তাদের পরস্পররে ভালো লাগছে, প্রেম হইছে ও বিয়া হইছে। এখন ম্যাকায়াভেলীর ভূত বলতে পারেন, পোলাটার স্ট্র্যাটেজি ভালো। এই মাইয়া এত ভালো রিসোর্স যে, এরে বিয়া করে নেয়াই কোম্পানির জন্য সবচাইতে বেটার। ওকে, গুড, কিন্তু এইখানে অন্যদিকে একটা সমস্যাও আছে। যেমন, প্রেম আর বিয়া এক না। বিয়ার পরে ওই ব্যক্তির ছোট খাট নানা দিক, দোষ ত্রুটি, ইমোশনাল বিভিন্ন বিষয়, ভালনারাবিলিটি কতো কিছু সামনে আসবে। তখন মানাইয়া নেবার যে জার্নি ঐটা ভিন্ন হবে, প্রেমের চাইতে।
প্রেম সাধারণত এক্সপেকটেশন বাড়ায়, যে আমি চারা লাগাইতেছি, একসময় ফল ধরবে, গোলা ভরে যাবে শস্যে। কিন্তু বিয়ার পরে দৈনন্দিন বাস্তবতায় ওই এক্সপেকটেশন ধাক্কা খাবে। স্বাভাবিক ভাবে যার এক্সপেকটেশন বেশি সে ধাক্কা বেশি জোরে খাবে।
সম্পর্ক ভাঙ্গার চান্স, এমনিতেই ৪০-৫০%।
এবং পপুলারদের ক্ষেত্রে অপশন বেশি। অপশন বেশি থাকলে অশান্তি হয়, তাদের মধ্যে টুরু লাভ না থাকলে ও তারা স্থিতধী না হইলে, নিশ্চয়ই কম্পেয়ার করবে। আগে একজন ১০ একজন ৫ নিয়া সুখী জীবন পার করে দিত। কারণ বিয়া হইত কাছাকাছি গ্রামে, আশপাশে আর বেশি অপশন ছিল না। কিন্তু অনলাইনের এই সময়ে এখন একজন ১০ একজন ৫ নিয়া ইজিলি বাস করতে পারবে না, কারণ সে দেখতেছে হাতের কাছেই ৭ ৮ ৯ আছে। পপুলারদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা বেশি কারণ অনেক ৮ ৯ ১০ তাদের কাছে আসার জন্য মুখিয়ে থাকতে পারে।
এছাড়া, আগেই বলছি লং টার্ম সম্পর্কে কমিটেড লোকদের চান মানুষেরা, এইজন্য যেসব লোকজন স্বামী হিশাবে ভালো বলে ফেসবুকে পরিচিত হবেন, তাদের দিকে অন্য মেয়েরা আকৃষ্ট হবেন। অনেক ডার্ক পার্সোনালিটির মেয়েরাও আকৃষ্ট হবেন।
ডার্ক ট্রায়াডের পোলা বা মাইয়ার টেন্ডেন্সি হচ্ছে, অন্যের সুখের সম্পর্ক ভেঙ্গে দেয়া। তারা চান কোন সম্পর্ক থেকে নারী বা পুরুষরে ভাগাইয়া নিতে, এতে তাদের আনন্দ হয়। সুতরাং, যত পিরীত পাবলিক হবে, তত এই রিস্ক থাকে।
এমনিতে মেয়েদের এক সলিড রিজন থাকে, এই পোলা আমারে পাবলিকলি না স্বীকার করলে, হয়ত এর আরো অনেক মেয়ের লগে সম্পর্ক আছে। প্রেমের ক্ষেত্রে এইটা ঠিক, একটা সাইন হইতে পারে যে এই পোলা গুড না লং টার্মের জন্য। বাট, আপনি তো তার এক্টিভিটি দেখবেন। এটা এক অন্য আলোচনা, কীভাবে বুঝবেন সে লং টার্মের জন্য যোগ্য কী না, কিন্তু এইখানের মূল বিষয় হইল, বিয়া জিনিশটা পারিবারিক পরিমণ্ডলের ঘটনা, ওইখানের সবাই তো জানেই। এর পরে আর পাবলিক করার দরকার থাকে না নিত্য দিনের প্রেম।
অনেক সময় যারা নিত্য দিনের প্রেম পাবলিক করে, এটা সিগন্যাল দেয়, কোথাও কিছু ঠিক নাই। কারণ এপিয়ারেন্স হইল বিং ফর আদারস। এইখানে, তারা কেন তাদের প্রাইভেট লাইফ দেখানোর দায় বা চাপ ফিল করেন পাবলিকরে। এইটা আয়না দেখার মত। আয়নার সামনে দাঁড়াইয়া নিজের চেহারা দেইখা ব্যক্তি আশ্বস্থ হন যে, সব ঠিক আছে। কিন্তু এই সোশ্যাল মিডিয়ার পাবলিক আয়নার ভিন্নতা হইল, তিনি যেমনে দেখান এমনেই পাবলিক দেখেন, এবং পাবলিক সেই দেখা কল্পনা করে তিনি নিজেও পাবলিকের দেখাটা দেখেন ও আশ্বস্থ হন যে সব সুন্দর আছে। কিন্তু এই ইল্যুশন দীর্ঘদিন স্থায়ী হবে না।
আগেকার সময়ের দুইজন লোকের সংসার টিকাইয়া রাখতে যে স্ট্রাগলের মধ্য দিয়া যাইতে হইত, এখনকার লোকদের তার চাইতে বেশী স্ট্রাগলের মধ্য দিয়া যাইতে হয় বা হবে। পপুলারদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরো বেশি হবে।
তাই, ম্যাকায়াভেলীর ভূত যে বলছিলেন ভালো স্ট্র্যাটেজি, ঐটা মাইনাও আমি এর উলটা দিক তারে দেখাই। হাই সম্ভাবনা আছে এই ম্যারেজ ভেঙ্গে যাবে, ভাঙ্গার আগে তারা প্রচুর মানসিক চাপ অনুভব করবে, অনেক পাবলিক স্বাক্ষী এইজন্য বেশি চাপ। এবং এইটা ওই ব্র্যান্ডের জন্য খারাপ হবে। এইক্ষেত্রে তাদের জন্য ভালো হইতে পারে, ব্যবসার স্বার্থে, ওই সমস্যা উপনীত হলে সেপারেটেড থাকা ও পাবলিকরে না বলা। কিন্তু হয়ত এটা তারা করতে পারবে না, কারণ এইখানে ইমোশন জড়িত। এবং ঘৃণা জন্মাইয়া গেলে ব্যবসার লজিক কাজ করবে না।
এখন এই আধুনিক সমাজে, বিয়ারে শেষ স্থায়ী কমিটমেন্ট হিশাবে ভাবার সুযোগ নাই। বিশেষত, যারা চান না পাবলিক স্বাক্ষী থাকুক, ও তাদের নিয়া মক করুক ও চাপ দিক, তারা বিয়ারে আরেকটা বড় প্রেম হিশাবেই দেখতে পারেন। পাবলিক স্বাক্ষী থাকলে বিয়া টিকে যাবে, এইরকম কখনোই নয়। তাই পাবলিকরে সব দেখানোর মানে হয় না। পাবলিক তার নিজের হার্ড লাইফরে আরেকটু টলারেবল করতে বিনোদনের জিনিশ খুঁজে।
বিয়া টিকবে দুইজনের ভেতরকার আস্থা বিশ্বাস ও মানিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে। এই জায়গায় একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং, এবং সম্পর্কের ক্ষমতা সম্পর্ক বুইঝা কন্ট্রোল না করা, ম্যানিপুলেট না করা, সুস্থ ক্ষমতা সম্পর্ক রাখা, এই গুলা লং টার্মে জরুরী।
আগে যে এসোসিয়েশনের নাম দিলাম, তার বরাতে দ্বিতীয় বিয়ে নাকি ৬৭% বিচ্ছেদে শেষ হয়, এবং তৃতীয় বিয়ে ৭৫% ক্ষেত্রে, আনুমানিক। অর্থাৎ, যত বিয়া বাড়ে তত বিচ্ছেদের হার বাড়ে।