আমাদের হিংসা

Time_Saving_Truth_from_Falsehood_and_Envy

ছবিটির নাম টাইম সেইভিং ট্রুথ ফ্রম ফলসহুড এন্ড এনভি। আঁকছেন আঠারো শতকের একজন সেরা চিত্রশিল্পী ফ্রান্সিস লিমোয়েন। তিনি যেইদিন আত্মহত্যা করেন তার আগের দিনে ছবিটা আঁকেন। এইখানে বর্শার মত জিনিস হাতে দাড়িওয়ালা যে লোক আছে সে হইল টাইম, তার কোলে যে মহিলা ইনি হইলেন ট্রুথ আর নিচে পইড়া আছে এনভি তথা হিংসা। পিছন দিকে আছে ফলসহুড। অথবা পিছনেরটা হিংসা আর সামনেরটা ফলসহুড হইতে পারে, কারণ সামনের পইড়া থাকা লোকটার হাতে মুখোশ দেখা যায়। ফলসহুডের মুখোশ থাকবে এটা স্বাভাবিকই। এই ছবিটিকে হিংসা বিষয়ক এই লেখার ফিচার ছবি হিশেবে রাখা হইল।

 

হিংসা বা অন্যের যা আছে তা পাওয়ার আকাঙ্খা মানুষের ভেতরে জন্মগতভাবেই থাকে। মানুষ হিসেবে আমরা মানবজাতির এক দীর্ঘ ইতিহাস বহন করে চলি। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা এক সময় বনে জঙ্গলে ছিল। তখন মানুষ প্রধান চাহিদা ছিল ফুড। এখনো ফুডই আমাদের প্রধান চাহিদা।

বনে জঙ্গলে থাকা সেই মানুষেরা যখন ফুড দেখত তখন তাদের মনে পড়ত এই ফুড না থাকলে তাদের কী হবে। ফুড না থাকা মানে মৃত্যু। আর বেঁচে থাকার আকাঙ্খা মানুষের প্রধানতম এক আকাঙ্খা, পুনরোৎপাদন তার একমাত্র মিশন। কারণ পুনরোৎপাদনের মধ্য দিয়ে সে বেঁচে থাকে দীর্ঘদিন।

ফলে ফুড সে সব সময় নিজের আয়ত্ত্বে রাখতে চাইত। ফুড মানে নিরাপত্তা, ফুড মানে লাইফ। ফুড মানে সন্তান্ত সন্ততি, ফুড মানে টিকে থাকা।

ফুড মানে নিরাপত্তা, ফুড মানে লাইফ। ফুড মানে সন্তান সন্ততি, ফুড মানে টিকে থাকা। Share on X

একই সময়ে তারা যখন দেখত ফুড অন্যের হাতে বা অন্যের দখলে তখন তার মনে হিংসার উদ্ভব হত। যার কাছে ফুড থাকবে সেই বেশীদিন টিকে থাকতে পারবে। এই বোধ এবং উপলব্ধি থেকেই তার মনে হিংসার উদ্ভব। এবং সে তীব্র ভাবে অনুভব করতে থাকত ঐ ব্যক্তির চাইতে বেশী ফুড করায়ত্ত্ব করার ইচ্ছা।

এখানে হিংসাকে খারাপভাবে দেখার উপায় নাই। তার বেঁচে থাকার ইচ্ছা এবং মরে যাবার ভয় থেকেই এই হিংসার উৎপত্তি।

এই হিংসার বশবর্তী হয়ে আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা যুদ্ধ করেছে, অন্যকে হত্যা করেছে। ফুড এবং নিরাপত্তা।

বর্তমান সময়েও এই অবস্থা বদলে যায় নি। এখনো পৃথিবীর চালনা শক্তি হিংসা এবং ফুড।

সাথে অন্যান্য চাহিদা যুক্ত হয়েছে। বন্ধুদের কেউ একজন ভালো চাকরি করেছে, তাকে দেখে একজন কেন হিংসা করবে?

[star_list]

  • এক- ঐ লোক বেতন বেশী পাবে, ভালো গাড়ি চালায়
  • দুই- ঐ লোক ভালো বিয়ে করতে পারবে, সুন্দরী মেয়ে (সুন্দর বলতে যা বুঝায় মানব সমাজে তা বাস্তবিক পক্ষে ‘সুস্থ সন্তান উৎপাদনে সক্ষম’ লক্ষণযুক্ত নারী।)
  • তিন- ঐ লোকের সুস্থ সন্তান হবে, তারা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা পাবে
  • চার- ঐ লোক টিকে থাকবে তার ছেলে, নাতি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে

[/star_list]

হিংসার শেষ গন্তব্য ওই টিকে থাকাতেই। কেউ পড়ালেখায় ভালো করছে, স্কলারশীপ নিয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে, তাকে দেখে অন্যেরা হিংসা করে ঐ কারণেই। কেউ সাহিত্য টাহিত্য করে পুরস্কার পাচ্ছে তাকে দেখে লোকে হিংসা করার পিছনের কারণও এই।

পুরস্কার খ্যাতি ইত্যাদিও এক ধরনের নিরাপত্তা। টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। তার সন্তানাদির টিকে থাকায় সাহায্য করবে। এমন ধারনা থেকে লোকে তাকে হিংসা করে।

কেউ ভালো চিন্তা করতে পারে তা দেখেও কিছু লোক হিংসা করতে পারে। যদি সে বুঝে চিন্তা করার ক্ষমতা ঐ ব্যাক্তিকে টিকে থাকায়, অধিক সম্পদ বা খ্যাতি আহরনে সাহায্য করবে।

হিংসার কারণেই লোকে অন্যের সাথে প্রতিযোগীতা করে। লোভের উৎপত্তির মূলে আছে হিংসা

হিংসা অন্যের ফুডকে অভার এস্টিমেট করে। ফুড বলতে এখানে নিরাপত্তা, সুখ, টিকে থাকার সম্ভাবনা। আমাদের সেই প্রাচীন পূর্বপুরুষ যিনি ঐ ঘন জঙ্গলে অন্যের হাতে ফুড দেখে ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন তার কথা মনে করা যাক। তিনি ঈর্ষায় কাতর হয়ে, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে ওই ব্যাক্তিকে এটাক করেছিলেন। কী যুদ্ধটাই না হলো তখন!

তাদের দুজনেই জখম হলেন মারাত্মকভাবে। মারা গেলেন সেখানেই দিন দুয়েকের মধ্যে।

কিন্তু সেই প্রাচীন লোকের সামনে হয়ত আরো ফুড প্রাপ্তির সম্ভাবনা ছিল। অথবা হয়ত তার যে ফুড ছিল তাতেই তিনি টিকে থেকে আরো সন্তান উৎপাদন করে তার জেনেটিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে যেতে পারতেন দীর্ঘদিন।

আমরাও প্রতিনিয়ত আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষদের মত এমন অবস্থার মুখোমুখি হবো। অন্যের হাতে বেশী ফুড আমরা দেখব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কী আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষদের মত ঈর্ষান্বিত হবো, নাকী হাজার বছরের বিবর্তনে যে বুদ্ধিমত্তা এবং অভিজ্ঞতা আমাদের গড়ে উঠেছে, তার আলোকে বিচার করব সমস্ত ব্যাপারটাকে।