প্রতিদিন একই সময়ে একই কাজ করা

এইরকম একটা গল্প আপনারা শুনে থাকবেন যে একজন লোক ছিলেন ভয়ানক পাপিষ্ট। হঠাৎ কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে তার বোধোদয় হয়, এবং তার মনে কৃত পাপের জন্য অনুশোচনার জন্ম নেয়। তিনি একজন বুজুর্গ ব্যক্তির কাছে যান, তার পাপের বিত্তান্ত খুলে বলেন এবং পাপ ছেড়ে একজন ভালো মানুষ হবার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেন।

তখন বুজুর্গ ব্যক্তি বলেন, তোমার পাপ এতই বেশী, যাই হোক, জিকির করো, ভালো পথে চলো, আর এই মরা গাছে প্রতিদিন পানি দিতে থাকো।

বুজুর্গ একটি শুকনো, মৃত গাছ দেখিয়ে কথাটা বললেন।

তিনি আরো যোগ করলেন, যেদিন দেখবে এই গাছ সতেজ হয়েছে, সবুজ ডালপাতা বেরিয়ে এসেছে এত অন্তঃস্থল থেকে, সেদিন বুঝবে তোমার গতজীবনের পাপ মার্জনা করা হয়েছে।

এরপর থেকে প্রতিদিন, সেই ভালো হয়ে যাওয়া লোকটি নিয়মিত গাছে পানি দিতে থাকলেন। এইরকম বছর বছর তিনি চালিয়ে গেলেন। প্রতিদিন এসে পানি দিয়ে যান আর দেখেন গাছটি সজীব হয়ে উঠল কি না।

একদিন তার আশা পূর্ন হলো। তিনি দেখলেন গাছের ভেতর থেকে হয়ে ডালপালা, সবুজ পাতা। সেদিন লোকটি নিজেও একজন পীর ব্যক্তিতে পরিণত হলেন।

এই গল্পটি অনেক সমাজেই হয়ত প্রচলিত, অল্প বিস্তর পরিবর্তন সমেত। এই ধরণের গল্পে আসলে কাহিনিটা মূল হয় না, যদিও প্রায় সবাই কাহিনিটাকে মূল ধরে নেন, এবং একটা অলৌকিকতার জয়গান গাইতে থাকেন। কিন্তু কাহিনির বাইরে এইসব গল্পের উদ্দেশ্য থাকে একটা মূলকথা বা মেসেজ মানুষকে দেয়া।

সাধারণভাবে মেসেজ আকারে বাক্য দিলে তা সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রচুর। কিন্তু গল্পাকারে এই মেসেজ থাকলে তা টিকে থাকে। আর এইসব গল্প সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়, পরিমার্জিত হয়। সময়ের ধারা এবং অজস্র মানুষের মুখে মুখে চলে আসতে আসতে এইসব গল্পে অহেতুক প্রায় সব কিছুই কাটছাট হয়ে যায়।

এই গল্পের মেসেজ ছিল যে, মানুষ কোন কাজ প্রতিদিন নিয়ম করে একই সময়ে করতে থাকলে তা এক ভিন্ন অর্থ নিয়ে উপস্থিত হয়। তা প্রচন্ড শক্তিশালী রূপ নিয়ে আসে, এবং মরা গাছকে জীবীত করে ফেলার মত অসম্ভবকেও সম্ভব করে ফেলতে সক্ষম হয়।

প্রতিদিন একইসময়ে একই কাজ মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাড়ায়। সাধারণত রিচুয়ালগুলি এমন হয়। কিন্তু রিচুয়ালের একটা আলাদা অর্থ থাকে। ধর্মীয় রিচুয়াল একজন পালন করেন কারণ ধর্মীয় দিক থেকে তার আলাদা একটি অর্থ আছে। তাই এগুলি আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাড়াতে পারে, কিন্তু যখন কাজটি হয় একেবারে অর্থহীন তখনো সেই কাজ মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতায় ভালো প্রভাব ফেলে।

তারকোভস্কির স্যাক্রিফাইস (১৯৮৬) ফিল্মে এমন বলা ছিল যে, ‘আপনি যদি প্রতিদিন সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে ট্যাপ থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে কমোডে ফেলে ফ্ল্যাশ করে দেন, প্রতিদিন করেন, তাহলে এটাও গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠে। প্রতিদিন একই সময়ে একই কাজ নিয়মিত করে কিছু একটা পরিবর্তিত হয়ে যাবে, পৃথিবী বদলে যাবে।’

সেলফ কন্ট্রোলের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক এক সাইকোলজির রিসার্চ জানাচ্ছে, যেকোন তুচ্ছ রিচুয়ালও সেলফ কন্ট্রোল বুস্ট করে।

তারা ৯৩ জন আন্ডারগ্র্যাড স্টুডেন্ট নিয়ে কাজ করেছেন। তাদের সবাইকে কম ক্যালরি খাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হলো। এরপর, ক্যালরি খাওয়া কন্ট্রোল করতে এক গ্রুপকে খাওয়ার আগে কিছু অর্থহীন রিচুয়াল করতে দেয়া হলো। অন্যগ্রুপকে বলা হলো, তারা যেন কম ক্যালরি খাওয়ার ব্যাপারটা মনে রাখে।

দেখা গেল, যাদের কিছু অর্থহীন রিচুয়াল করতে দেয়া হয়েছিল, তারা ক্যালরি খাওয়ার ব্যাপারে নিজেদের বেশী কন্ট্রোল করতে পেরেছে।

এভাবে তারা আরো কয়েকটি পরীক্ষা করেন। যার বিত্তান্ত এই প্রবন্ধে মিলবে।

রিচুয়াল বা এভাবে নিয়ম করে কোন কাজ করা আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে (যেমন কর্মক্ষমতা, উৎসাহ, ধৈর্য ইত্যাদি) কীভাবে প্রভাব ফেলে তা এখনো পরীক্ষা করে দেখা হয় নি।

কিন্তু, মানুষের প্রাচীন প্রজ্ঞা বলে যে, এটা কার্যকরী।