তারপর গল্প শুরু হইল মবিনুদ্দিনরে দিয়া। মবিনুদ্দিন হচ্ছেন মধ্যবয়স্ক, পয়সাওয়ালা লোক যিনি এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ব্যবসা কইরা এত টাকা কামাইছেন যে তারে সমাজের বিচারে কওয়া যায় একজন সফল মানুষ। মবিনুদ্দিন হইলেন পত্রিকায় ফিচার নিউজ হওয়ার মত সফল মানুষ। তার টাকা, বাড়ি, গাড়ি, স্ত্রী , পুত্র কন্যাদির কথা বলব না। না বললেও কোন কোন পাঠকের মনের মধ্যে ইতিমধ্যে আইসা গেছে মবিনুদ্দিনের ছোট ছেলে হিরুইন খায়, বড়টা গাঁজা খায় আর মাইয়া সীসা টানে। আর মবিনুদ্দিনের স্ত্রী ইয়াবাখোর এবং পরকীয়াসক্ত। মবিনুদ্দিন ও লোজ ক্যারেক্টারের। এইসব ধারনা কারো মনে যদি আইসা থাকে তাহলে তাদের উদ্দেশ্য কইরা বলি আপনাদের ধারনা ভুল। মবিনুদ্দিনের মেয়ে ছেলে স্ত্রী সম্পর্কে আমি যদিও খুব বেশি একটা জানি না তবুও বলি যে আমি এইটুকু জানি তারা আপনাদের এই ধারনার মত না। অবশ্যই না।
মবিনুদ্দিন শান্ত স্বভাবের লোক। তিনি সহজে রাইগা যান না। সহজে হতাশ হন না। এই দুই গুণ তাকে তার সম্পদ অর্জনের যাত্রাপথে অনেক সাহায্য করছিল।
তিনি আইজ সকালে বাইর হইছেন। অফিসে যাইবেন। কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে তার দীর্ঘজীবনে এই প্রথমবারের মত তিনি দেখলেন তার ড্রাইভার আসে নাই। নিজে গাড়ি চালাইতে গিয়া দেখলেন গাড়ি স্টার্ট নেয় না। তখন মবিনুদ্দিন (তার সময়জ্ঞান অত্যন্ত তীক্ষ্ণ) একটি রিকশা নিলেন।
এই রিকশা নেয়াটা মবনুদ্দিনের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল অথবা সবচেয়ে বড় আশির্বাদ হইয়া আইসাছিল আসলে। কারণ সেদিন তিনি প্রথম আস্তে আস্তে চাইরদিকে তাকাইয়া তাকাইয়া অফিসে যাইতেছিলেন। এই অবস্থায় মাজারের কাছে যেইখানে দুনিয়ার উদ্বাস্তু ছন্নছাড়া মানুষেরা , মাথায় অনেককাল আগের পুরনো জটা নিয়া ঘুইরা বেড়ায় তার পাশ দিয়া গেলেন তিনি।
তারপর দেখলেন একটা লোক দুই হাটুর মাঝখানে মুখ লুকাইয়া বইসা আছে। এই দৃশ্য দেইখা মবিনুদ্দিন যেন মবিনুদ্দিন হইয়া উঠলেন। লোকটা বইসা আছে এমনভাবে যেন মনে হয় পুরা পৃথিবী তার ওইখানে আইসা থমকে আছে। যেন মনে হয় তার হাটুর ভিতরে লুকানো মুখ হইল পৃথিবী। যেন মনে হয় সেই হইল এই পৃথিবীর প্রথম প্রধান এবং একমাত্র আদিসত্তা। মবিনুদ্দিন তার ভিতরে শিরায় শিরায় রক্তের চলন অনুভব কইরা কাইপা উঠলেন। গরম তাজা রক্ত যাইতেছে তার ভিতর দিয়া। যাইতেছে বার বার স্বীকার কইরা ঐ যে দূরে বইসা আছে লোকটা, হাটুতে মুখ গুইজা সে মানুষ না কোন। সে একজন বিশেষ শব্দের আবহ যার রেশ কাটতে না কাটতে মানুষেরা ভুলে যায় কি হইছিল এইখানে।
মবিনুদ্দিন রিকশা থামাইয়া লোকটার দিকে তাকাইয়া রইলেন। তার পা ভেদ কইরা শিকড় গজাইল যেন। রিকশাওয়ালা তাড়া দেয়ায় তারে টেকাটুকা দিয়া মবিনুদ্দিন তাকাইয়া রইলেন হাটুতে মুখ লুকাইয়া বইসা থাকা লোকটির দিকে।
চুম্বক যেমনে আকর্ষন কইরা নেয় চুম্বকীয় পদার্থরে তেমনি মবিনুদ্দিন লোকটির দিকে আকৃষ্ট হইলেন। তিনি তার পাশে গেলেন। তখন মবিনুদ্দিনের রক্তে নতুন উন্মাদনার সৃষ্টি হইল। তার মনে হইল তিনি অনেক অনেকদিন পরে পাইছেন ফিরে নতুন জীবন। তিনি ছোট বাচ্চাদের মত লোকটারে অনুকরণ কইরা বইসা পড়লেন।
তার বইসা পড়ার পর তারে কিংবা তার মনোজগতরে ধরার মত কোন শক্তি আর কারো রইল না। সুতরাং তার ভিতরে কি ঘটতেছিল সেইসব অজানা রইল।
মবিনুদ্দিনরে দিয়া আসলে গল্পের শেষ না। মবিনুদ্দিনরে দিয়া গল্পের শুরু। তিনি গল্পের প্রথম ক্যারেক্টার। এরপর আরো অনেক লোক যাদের নাম দেয়া যাক মবিনুদ্দিন১, মবিনুদ্দিন২, মবিনুদ্দিন৩………………………………………………………………
আসতে লাগলেন এবং বইসা পড়তে থাকলেন।
কোন এক শহরে আপনে যদি যান, এবং যদি কোন মাজার দেখতে পান এবং সেইখানে যদি জটাধারী উদ্বাস্তু লোকেরা থাকে তাহলে একটু নিরালে খুজলেই হয়ত পাইয়া যাইবেন সারিবেধে বইসা আছেন মবিনুদ্দিনেরা। সবাই দুই হাটুতে মুখ লুকাইয়া। তাদের দেইখা আপনার মনে হইতে পারে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য এইখানে ভীড় করছে। আপনার মনে হইতে পারে এই লোকগুলো একেকজন হইল একেকটা পৃথিবী। পৃথিবীর মতই একা আর নিসঙ্গ। মনে হইতে পারে আপনার এরাই হইতেছে পৃথিবীর সর্ব উৎকৃষ্ট শিল্প, শৈল্পিক ব্যর্থমানুষ।
তবে যাই মনে হোক, তাকাইয়েন না খুব বেশি। চোখ ফিরাইয়া চইলা যাইয়েন। নয়ত হয়ত আপনেও অনুভব করতে পারেন দেহের ভিতরে শিরায় উষ্ণ প্রস্রবণ……আহবান রক্তের।
ছবি ক্রেডিটঃ ART.com