জীবনের নীতি, সাফল্যের সূত্র ইত্যাদি বিষয়ে আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার

আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের আত্মজীবনীমূলক বই টোটাল রিকল। এই সাত বারের মিস্টার অলিম্পিয়া জেতা মহানায়ক তার বৈচিত্রময় জীবনের নানাদিক বইটিতে উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলে থাকেন তার জীবন কোন মুভি হলে কেউ বিশ্বাস করতো না।

বইটির শেষের অধ্যায়ে শোয়ার্জনেগার লিখেছেন জীবন নিয়ে তার নীতির কথা, আর্নল্ড’স রুল; এবং তার সফলতার সূত্র নিয়ে। সেই নীতি ও সূত্রগুলি নিয়েই এই লেখা।

শোয়ার্জনেগার নিজেকে ভালো রোল মডেল মনে করেন না। কারণ তিনি নিজেই নিয়ম ভাঙেন। একবার এক সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা ক্যামেরা দিয়ে জুম করে দেখেছি আপনার হোটেল রুমে কিউবান সিগার। একজন গভর্নর হয়ে আপনি আইন মানেন না কীভাবে?

শোয়ার্জনেগার অবলীলায় উত্তর দিলেন, আমি কিউবান সিগার খাই, কারণ এটি অসাধারন!

শোয়ার্জনেগারের এটিচিউড এমনই, এবং এজন্যই বরং তার আলাদা খ্যাতি। মোহাম্মদ আলী থেকে শুরু করে নেলসন ম্যান্ডেলাকে রোল মডেল ধরে তিনি কাজ করেছেন তার জীবনে। অতি উচ্চাকাঙ্খী ও সাকসেসের জন্য হাইলি মোটিভেটেড এই লোকটির ব্যক্তিগত সাফল্যের হিসাবে তার সাফল্যের তালিকা অনেক বড়। অস্ট্রিয়ান এক ফার্ম বয় থেকে আমেরিকায় এসে মিস্টার ইউনিভার্স, বিখ্যাত অভিনেতা এবং আমেরিকার সবচাইতে বড় স্টেইটের গভর্নর, যাকে তিনি টার্মিনেটরের সাথে মিলিয়ে বলেন গভর্নেটর; এগুলি সাফল্য হিসেবে অনেক বড়।

 

টোটাল রিকল বই

 

শোয়ার্জনেগারের সফলতার সূত্রঃ

সফলতার সূত্র একেকজনের জন্য আলাদা হতে পারে। আলাদা হতে পারে সফলতা কী, এই ধারনাও। একজনের কাছে যা সফলতা অন্যজনের কাছে তা অর্থহীন হতেই পারে। মানুষের জীবন ও জীবনের চাহিদা, এবং জীবনকে একজন কীভাবে দেখেন তা খুবই জটিল বিষয়। এবং যেকোন ধরণের সফলতার জন্য পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং সময়ের গুরুত্বও রয়েছে।

এইসব গুরুত্বপূর্ন জিনিস বিবেচনাতে রেখেই শোয়ার্জনেগারের সফলতার সূত্রগুলি উল্লেখ করছি এখানে। এগুলি তার ক্ষেত্রে কাজ করেছে বলে তিনি জানিয়েছেন তার বইয়ে।

 

১। আপনার লায়াবিলিটিকে এসেটে পরিণত করুন।

এটা আগেও হয়ত শুনে থাকবেন। আপনার যে জায়গায় সীমাবদ্বতা আছে, সেসব জায়গায় কাজ করুন। শোয়ার্জনেগার যখন হলিউডে অভিনয় করতে গেলেন এজেন্ট তখন বলেছিলেন এই একসেন্ট ও শরীর নিয়ে অভিনয় হবে না। শোয়ার্জনেগার এরপর দুই ক্ষেত্রেই কাজ শুরু করেন। পরে কোনান দ্য বারবারিয়ান ফিল্মের ডিরেক্টর বলেছিলেন শোয়ার্জনেগার ঐ চরিত্রের জন্য এত নিঁখুত ছিল যে আমাদের শোয়ার্জনেগার না থাকলে একজন শোয়ার্জনেগার বানাতে হতো।

এসেট ও লায়াবিলিটি নিয়ে অর্থনৈতিক দিক থেকেও একই কথা বলেছিলেন রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড বইতে রবার্ট কিওসাকি।

 

২। কেউ না বললে আপনার উচিত সেই না কে “হ্যা” হিসেবে শোনা।

 

“I love it when people say that something can’t be done. That’s when I really get motivated; I like to prove them wrong.”

শোয়ার্জনেগার “না” কে ইগনোর করতেন। ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর থাকা কালে সোলার রুফ চালু এবং হেলথ কেয়ারে কিছু পরিবর্তন আনার প্রস্তাবে অনেকে তাকে না বলেছিলেন। কিন্তু তিনি তা করেন। তার কথা হলো অসম্ভব সম্ভব হয় তাকে সম্ভব করার চেষ্টার মাধ্যমে। এখানে চেষ্টা করায় ঝুঁকিও কম। কারণ সবাই তো আগেই ধরে নিয়েছে আপনি ব্যর্থ হবেন। তাই ব্যর্থ হলে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সফল হলেই তা হয়ে যাবে বিরাট ঘটনা।

 

৩। কখনোই ক্রাউডকে অনুসরণ করবেন না, যেখানে কেউ নাই সেদিকে যান।

“The worst thing I can be is the same as everybody else. I hate that.”

অন্যরা যা করছে তা কখনো করবেন না। অন্যদের অনুসরন নিম্ন মাঝারি ও মাঝারি ফলাফল নিয়ে আসে। কেরিয়ারের ক্ষেত্রেও একই কথা। যখন সব নতুন অভিনেতা ছোট ছোট পার্টে অভিনয় করার সুযোগ খুঁজছিল শোয়ার্জনেগার তখন প্রধান চরিত্র টার্গেট করেন। যখন অন্য রাজনীতিবিদের আস্তে আস্তে গভর্নরশীপের জন্য দাঁড়ায়, তখন তিনি প্রথমেই গভর্নরশীপের জন্য দাঁড়িয়ে যান।

“What is the point of being on this Earth if you are going to be like everyone else?”

 

 

৪। আপনি জীবনে যত যাই করেন, গুরুত্বপূর্ন কাজ হলো তা বিক্রি করা।

শোয়ার্জনেগার তার লক্ষ্য মিস্টার অলিম্পিয়া হয়ে গেলেন, সেটা তার জন্য যথেষ্ট ছিল না। কারণ এই খেলা তখন জনপ্রিয় নয়। তার সবাইকে বুঝাতে হয়েছিল এটা সম্পর্কে। কীভাবে ওয়েট ট্রেনিং কাজ করে, কীভাবে কেবল মাসল বিল্ডিং নয়, মানুষের জীবন আরো ভালো করতে সাহায্য করে এটি। তার মতে সেলিং বা বিক্রি খুবই গুরুত্বপূর্ন। আপনি যদি বিক্রি করতে না জানেন তাহলে আপনার গ্রেট কাজগুলি জনসমক্ষে যেতে পারবে না, এবং এর থেকে কোন ভালো ফল আপনি পাবেন না।

টোটাল রিকল বই থেকে নেয়া, খেলা বডিবিল্ডিংকে জনপ্রিয় করতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন শোয়ার্জনেগার।

 

 

শোয়ার্জনেগারের জীবনের নীতিঃ

যখনই কোন গ্রেট লোকের সাথে তার দেখা হতো, তিনি জেনে নিতেন তাদের জীবনের নীতি। কীভাবে তারা গ্রেট হলেন। সফলতার এবং ভালো জীবনের হয়ত হাজারো নিয়ম আছে, শোয়ার্জনেগার নিজেও তা মানেন, কিন্তু এইসব নীতিকে তিনি তার জীবনের নীতি বলে ভাবেন।

১। অহংকার যেন আপনার বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়।

গ্রেট বক্সার মোহাম্মদ আলী শোয়ার্জনেগারের একজন রোল মডেল ছিলেন। তারা একসাথে অনেক টিভি শো করতেন। একবার মোহাম্মদ আলী দাঁড়িয়ে শোয়ার্জনেগারকে বললেন, আমাকে ঠেলা দিয়ে দেয়ালের সাথে লাগাও দেখি, তোমার শক্তি পরীক্ষা হয়ে যাক।

শোয়ার্জনেগার তাকে ঠেলে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে দিলেন।

আলী অবাক হয়ে বলতে লাগলেন, আরে! এই বডিবিল্ডিং জিনিসটা আসলেই তো কাজের। দারুণ! দারুণ!

এর কয়েকদিন পর আবার শোয়ার্জনেগারের সাথে দেখা হলো আলীর। এবার আলীর সাথে তার কিছু বক্সার বন্ধুবান্ধব। শোয়ার্জনেগারকে দেখে আলী উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। আবার তিনি দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে শোয়ার্জনেগারকে বললেন, ঐদিনের মতো আমাকে ধাক্কা দিয়ে দেয়ালে লাগাও তো।

মোহাম্মদ আলী

এবার শোয়ার্জনেগার দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। বন্ধুদের সামনে এভাবে পরাজিত হতে কেউ নিশ্চয়ই চাইবে না। নিশ্চয়ই এখানে কোন ফাঁদ আছে।

কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি ধাক্কা দিলেন, ও আগের দিনের মতো আলীকে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে ফেললেন। কোন ফাঁদ না দেখে নিজেই কিছুটা অবাক হলেন।

এদিকে উচ্ছসিত আলী বন্ধুদের বলতে লাগলেন, তোমাদের বলেছিলাম না! এই বডিবিল্ডিং জিনিসটা কাজের! দেখলে তো আজ!

শোয়ার্জনেগার আলীর নিরহংকারীতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এতো বড় চ্যাম্পিয়ন হয়েও তার অহেতুক অহংকার ছিল না। বরং, তিনি বডিবিল্ডিং এর ক্ষমতা দেখাতে সবার সামনে নিজের হেরে যাওয়া দেখালেন।

তার উদ্দেশ্য ছিল ওয়েট ট্রেনিং যে পা কোমড় শক্ত করে, এবং বক্সিং এ তা কাজে লাগতে পারে, এটি দেখানো। এর জন্য নিজের হেরে যাওয়াকে তিনি হিসাবেই নেন নি।

 

 

২। অভার থিংকিং করবেন না।

আপনি যদি মনে করেন কোন কাজের আগে অতিরিক্ত জ্ঞান আগে সংগ্রহ করবেন এবং পরে উপস্থিত মুহুর্তে প্রয়োগ করবেন, তা অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর হবে না। প্রথমত অতিরিক্ত এনালাইজ করতে করতে আপনি কেবল হয়ত রিসার্চই করতে থাকবেন, যাকে বলে প্যারালাইজ বাই এনালাইজ।

এছাড়া উপস্থিত মুহুর্তে মানুষ জানা জ্ঞান থেকে কাজ করে না পূর্ববোধ বা ইন্টিউশন থেকে কাজ করে, তা সাইকোলজিক্যালি মীমাংসীত নয়। অন্যে যা দেখে না তা দেখার উপায় বইতে সাইকোলজিস্ট গ্যারী ক্লেইন জানিয়েছিলেন, উপস্থিত সংকট মুহুর্তে মানুষের মধ্যে হঠাৎ ইনসাইট চলে আসে।

শোয়ার্জনেগার বলেন না যে আপনি মস্তিষ্ক ব্যবহার করবেন না। তা করবেন। কিন্তু কখনো আপনাকে দ্রুত খেলতে হবে। যে বক্সার প্রচুর জ্ঞান নিয়ে আসেন কখন পাঞ্চ করতে হবে, কখন ডাক করতে হবে ইত্যাদি, তিনি কিন্তু পাঞ্চ করার আগে সব ভেবে নিয়ে পাঞ্চ করেন না। এখানে চিন্তা করতে বসলে তিনি হেরে যাবেন।

অভারথিংকিং দুশ্চিন্তা আনে, এজন্য মানুষ রাতে ঘুমাতে পারে না চিন্তায়। শোয়ার্জনেগার এটা করতে বারন করেন। যেকোন বিষয়ে বেশী জ্ঞান অর্জন করুন যাতে উপস্থিত মুহুর্তে দ্রুত কাজ করতে পারেন, অভারথিংকিং বা দুশ্চিন্তা করার জন্য নয়।

 

 

৩। প্ল্যান বি এর কথা ভুলে যান।

 

এখানে নেপোলিয়ন হিল এর থিংক এন্ড গ্রো রিচ বই থেকে একটা কাহিনীর কথা বলা যায়।

২১০ বিসিতে জিয়াং ইয়্যু চী’ন ডাইনেস্টির বিরুদ্ধে তার সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হন। যখন রাতে সৈন্যরা ঘুমিয়ে ছিল তখন তিনি জাহাজ পুঁড়িয়ে ফেলেন, রান্না বান্নার তৈজসপত্র সব ধ্বংশ করে দেন। তিনি তার সৈন্যদের বুঝান, বাঁচতে হলে যুদ্ধ করে জিততেই হবে। বাঁচার আর কোন রাস্তা নাই।

তার সৈন্যরা একটানা নয়টি যুদ্ধে জিতেছিল।

পালানোর অপশন, বেঁচে থাকার অন্যান্য অপশন ধ্বংশ করে জিয়াং ইয়্যু যুদ্ধে সৈন্যদের মনযোগ বৃদ্ধি করেছিলেন।  বিভিন্ন অপশন, অযৌক্তিক বা উদ্ভট হলেও তা আমাদের ফোকাস নষ্ট করে।

এখানে জিন জিয়াং যা করেছিলেন তা হলো প্ল্যান বি না রাখা। প্ল্যান বি, বা আরো অনেক পরিকল্পনা থাকলে মূল কাজে গুরুত্ব কমে যায়। শোয়ার্জনেগার তাই প্ল্যান বি রাখার বিরুদ্ধে।

 

৪। অস্বাভাবিক হিউমার বা হাস্যরস দিয়ে আপনি অনেক কিছুই করতে পারেন।

 

একবার ২০০৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সাবেক মেয়র উইলি ব্রাউন ক্যালিফোর্নিয়া ডেমোক্রেটিক পার্টির ফান্ড তোলার জন্য এক পার্টি দিয়েছিলেন। এই ব্যক্তি শোয়ার্জনেগারের বন্ধু ও বিরোধী দলের। শোয়ার্জনেগার ঠিক করলেন ঐ পার্টিতে যাবেন, এবং তার বন্ধুও ভাবলেন এতে মজা হবে। বিরোধী দলের একজন বড় নেতা হঠাৎ পার্টিতে আসলে সবাই অবাকই হবে।

শোয়ার্জনেগার হঠাৎ উপস্থিত হয়ে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলেন। এই চমকে সবাই মজা পেল। কিন্তু স্টেইট এসেম্বলীর এক নতুন সদস্য টম আমিয়ানো বলে উঠলেন, কিস মাই গে এস!

শোয়ার্জনেগার রিপাবলিকান পার্টির, রিপাবলিকানরা রক্ষণশীল রাজনীতি করে, এবং আমিয়ানো আগে ছিলেন প্রফেশনাল কমেডিয়ান। শোয়ার্জনেগার সেদিন কিছু বললেন না। পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হলো।

শোয়ার্জনেগার তৈরী হয়ে রইলেন। কারণ আমিয়ানোর বিলে গভর্নরের সিগনেচার লাগবে সামনে।

কয়েক সপ্তাহ পরে আমিয়ানোর পক্ষ থেকে একটি বিল এলো, এক প্রস্তাব নিয়ে। গভর্নর শোয়ার্জনেগার তাতে ভেটো দিলেন, এবং এমনভাবে লিখলেন যাতে প্রথম অক্ষরগুলি উপর নিচে মিলালে হয় “আই ফাক ইউ”।

 

প্রথমে কেউ ধরতে পারে নি। তাই কিছু সাংবাদিককে বলা হলো, আপনারা কি গভর্নরের ভেটো মেসেজটা ভালোভাবে পড়েছেন কি? মানে উপর থেকে নিচে…

তখনই সবাই ব্যাপারটা ধরতে পারলো।

প্রেস সেক্রেটারীকে সাংবাদিকরা বললেন এটা ইচ্ছাকৃত কি না। প্রেস সেক্রেটারী জানালেন অবশ্যই না।

এর পরে এক প্রেস কনফারেন্সে শোয়ার্জনেগারকে একজন সাংবাদিক বললেন, আমরা চিঠিটি একজন গণিতবিদকে দেখিয়েছি। তিনি বলেছেন এই জিনিস একসিডেন্টাল হবার সম্ভাবনা দুই বিলিওনে একবার।

শোয়ার্জনেগার বললেন, আপনি ঐ বিশেষজ্ঞদের গিয়ে জিজ্ঞেস করেন অস্ট্রিয়ান এক ফার্ম বয়ের আমেরিকায় আসা, সর্বকালের সেরা বডিবিল্ডার হওয়া, মুভি স্টার হওয়া, কেনেডি পরিবারে বিয়ে করা, ও আমেরিকার সবচাইতে বড় স্টেইটের গভর্নর নির্বাচিত হবার সম্ভাব্যতা কতো? এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আসেন আগামী প্রেস কনফারেন্সে।

উপস্থিত সাংবাদিকেরা হাসলেন।

কিছুদিন পরে টম আমিয়ানো জানিয়েছিলেন, আমি তার সাথে যা করেছি, তিনিও তার উত্তর দিয়েছেন, ঠিক আছে ব্যাপারটা।

পরবর্তীতে এক বছর পর আমিয়ানোর আরেকটা বিলে একইভাবে শোয়ার্জনেগার উপর নিচ করে লিখে দেন “ইউ আর ওয়েলকাম।”

 

৫। দিনে ২৪ ঘন্টা আছে।

 

৭/৮ ঘন্টা ঘুমানোর পর বাকী সময় কী করেন? একবার ক্যালিফোর্নিয়ার এক ইউনিভার্সিটি ক্লাসরুমে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন শোয়ার্জনেগার। এক ছাত্র উঠে অভিযোগ জানাল।

“গভর্নর বাজেট ক্রাইসিসের কারণে আমার টিউশন ফী দ্বিগুন হয়ে গেছে। এটি আমার জন্য খুবই বেশী। আমার অর্থনৈতিক সাহায্য দরকার।”

শোয়ার্জনেগার বললেন, বুঝতে পারছি এটা কঠিন। কিন্তু খুবই বেশী বলতে কী বুঝাচ্ছো?

“এখন আমাকে পার্ট টাইম কাজ করতে হয়।”

“এতে সমস্যা কী?”

“আমার তো পড়ালেখা আছে!”

শোয়ার্জনেগার বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা এভাবে দেখি। তুমি কয় ঘন্টা ক্লাস করো?”

ছাত্র জানাল, “এক দিন দুই ঘন্টা, অন্যদিন তিন ঘন্টা।”

“এবং দিনে কয় ঘন্টা পড়ালেখা করতে হয় তোমার?”

“তিন ঘন্টা দিনে।”

“আচ্ছা, আমরা তাহলে দিনে ছয় সাত ঘন্টার হিসাব পেলাম। বাকী সময় তুমি কী করো?”

“আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?”

“দিন তো ২৪ ঘন্টার। তুমি কি আরো ক্লাস নেবার বা আরো বেশী কাজ করার কথা ভাবছো? নিজের জীবন অপচয় করার চাইতে?”

ক্লাসের সবাই এই কথা শুনে ধাক্কা খেল।

ছাত্রটি বলল, “আমি আমার জীবন অপচয় করছি না!”

“হ্যা তুমি করছো। কারণ তুমি কেবল ছয় ঘন্টার কথা বলছ। ঘুমানোর জন্য আরো ছয় ঘন্টা গেলেও তোমার কাছে অনেক সময় থাকে, ১৮ ঘন্টা। ৪ ঘন্টা পার্ট টাইম কাজ করার পরেও তোমার ঘুরে বেড়ানোর জন্য বা মজা করার জন্য সময় থাকে। তাহলে তুমি অভিযোগ করছো কেন?”

এরপর শোয়ার্জনেগার ব্যাখ্যা করলেন তিনি একসময় দিনে পাঁচ ঘন্টা ওয়ার্ক আউট করতেন, এরপর ৪ ঘন্টা অভিনয় শিখতেন ক্লাসে, কয়েক ঘন্টা কাজ করতেন কনস্ট্রাকশনে, এরপরও কলেজে যাওয়া এবং হোমওয়ার্ক করা ছিল।

শোয়ার্জনেগারের এই উপদেশ স্টোয়িক দার্শনিক সেনেকার সময় বিষয়ক উপদেশের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেনেকা প্রায় একই রকমের উপদেশ দিয়েছিলেন তার বন্ধুকে পত্র মারফত।

 

৬। রেপস রেপস রেপস।

 

“There are no shortcuts—everything is reps, reps, reps.”

জিমে কোন ব্যায়াম কয়েকবার করে করা হয়, এবং প্রতিবার করাকে একেকটা রেপ বলে। যেমন বাইসেপ কার্ল, বারোবার রেপ করে আপনি এক সেট ধরতে পারেন। শোয়ার্জনেগারের মতে এই রেপ অনুশীলন সব কাজের জন্য দরকারী। আপনি এক্সপার্ট হলেও দরকারী।

২০০৭ সালে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবেলা বিষয়ে জাতিসংঘে তিনি বক্তব্য দেন। সেই বক্তব্যের পাতাটি এমনঃ

এখানে উপরে যে দাগগুলো আছে তা হলো তিনি কতোবার বক্তব্যটি নিজে অনুশীলন করেছেন তার সংখ্যা। একইভাবে দাগ দিয়ে তিনি ছোটবেলায় তার জিম এক্সারসাইজের হিসাব রাখতেন।

নভোচারী ক্রিস হ্যাডফিল্ড তার বইতে (বই  An Astronaut’s Guide to Life on Earth) লিখেছিলেন, “আপনি যদি এক্সেলেন্ট হতে চান কিছুতে, তা গিটার বাজানো বা জেট বিমান চালনা যাই হোক না কেন, এক্ষেত্রে অতিরিক্ত প্রস্তুতি বলতে কিছু নেই। সব সময়ই নিয়ে আরো প্রস্তুত করার ও আরো উন্নত করার জায়গা রয়ে যায়।”

The last three or four reps is what makes the muscle grow. This area of pain divides the champion from someone else who is not a champion. That’s what most people lack, having the guts to go on and just say they’ll go through the pain no matter what happens.

শোয়ার্জনেগারের এই উক্তিই প্রণিধানযোগ্য। রেপেটিশনের শেষের কয়েকটিতে আপনার মাসল সরাসরি পেইন অনুভব করে। তখন মনে হতে পারে মাসল ছিঁড়ে যাচ্ছে। তখনো যদি আপনি আরো দুইটি তিনটি রেপ করতে পারেন, তখন সাক্ষাৎ পেইনের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। কিন্তু এই রেপগুলিই মাসল গ্রো করতে সাহায্য করে।

রেসিস্টেন্স ট্রেইনিং এর কথা বাদ দিলেও বলা যায়, অন্য ক্ষেত্রে ডিসকমফোর্টই মানুষকে শক্ত হতে সাহায্য করে। এজন্য প্রাচীন গ্রীসের স্টোয়িকেরা ভলান্টারী ডিসকমফোর্ট এর চর্চা করতেন।

 

৭। নিজের মা বাবাকে দোষ দিবেন না।

 

আমি সম্প্রতি দ্য গুড প্লেইস সিটকমের প্রথম সিজন দেখলাম। দৃশ্যপট পরকালে। এখানে একই নামের দুই চরিত্র ছিল। একজন খারাপ একজন ভালো ছিল দুনিয়াতে। খারাপ চরিত্র তার খারাপ হওয়া নিয়ে বলছিলো, “আমি দুনিয়াতে খারাপ হবো না তো কি, আমার মা বাবা ছিল ফাউল। আমি ছোট থাকতে তারা আমাকে ফেলে একে অন্যকে ডিভোর্স দিয়েছে…ইত্যাদি।”

তখন দুনিয়াতে যে ভালো কাজ করেছে ও ভালো ছিল সে বলছিলো, “আসলে আমারো খারাপ ছোটকাল ছিল। আমার মা আমাকে বাক্সে ভরে বাংলাদেশের একটা ট্রেনে ফেলে গিয়েছিল…ইত্যাদি।”

এই কমেডি সিরিয়ালের এই দৃশ্যে মেসেজটা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে মা বাপা এবং অন্যদের উপর দোষ না দিয়ে নিজের দিকে দেখো।

শোয়ার্জনেগার শক্তভাবে একই কথা বলেন। তার বাবা ছিলেন অস্ট্রিয়ার পুলিশ অফিসার। ছেলেদের কড়া শাসন করতেন। শোয়ার্জনেগারের জিম তিনি পছন্দ করতেন না। মৌখিক গালাগালি ও প্রহার করতেন ছেলেকে। এক পর্যায়ে শোয়ার্জনেগার অস্ট্রিয়া ছেড়ে চলে আসেন আমেরিকায়। তিনি বলেন তার বাবা ওরকম না হলে তিনি হয়ত আমেরিকায় আসতেনই না। এবং তার মিস্টার ইউনিভার্স, হলিউড স্টার, বা গভর্নর হওয়া হতো না। ফলে বাপের খারাপ ব্যবহারই তাকে তৈরী করেছে।

কোনান দ্য বারবারিয়ান ফিল্মের এক ডায়লগ তার পছন্দের। কোনানের ছোটবেলায় তার মা বাবাকে হত্যা করে যাদুকর তুলসা ডুম। পরবর্তীতে কোনান বড় হয়ে প্রতিশোধ নিতে যায়। তখন যাদুকর এই কথা বলে, “আমি না হলে কে তোর বাবা? কে তোকে বেঁচে থাকার শক্তি দিয়েছে? আমিই তর সকল কিছুর উৎস!”

অর্থাৎ, যাদুকর এখানে বুঝাল সে কোনানের মা বাবাকে ঐভাবে না হত্যা করলে কোনান এরকম শক্তিশালী বীর হতো না।

শোয়ার্জনেগার এখানে বুঝাতে চান প্রতকূল অবস্থায় ও আঘাতে বসে থাকলে চলবে না। বরং একে শক্তিতে রূপান্তরিত করে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা নিতে হবে। এবং নিজের ব্যর্থতার দায়িত্ব নিজে নিতে হবে।

 “Every time he hit me. Every time he said my weight training was garbage, that I should do something useful and go out and chop wood. Every time he disapproved of me or embarrassed me, it put fuel on the fire in my belly. It drove me and motivated me.”

 

৮। পরিবর্তন করতে সাহসের দরকার।

 

এক্ষেত্রে শোয়ার্জনেগার রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ এর উদাহরণ দেন। তার কাছে গর্বাচেভ নেলসন ম্যান্ডেলার মত বড় নায়ক। সাহস থাকার কারণেই যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তিনি বেড়ে উঠেছিলেন তা পরিবর্তন করতে সক্ষম হন।

শোয়ার্জনেগারের কথায়, এই দুই নেতা যখন বিপুল ক্ষমতা পেয়েছিলেন পৃথিবীকে নাড়িয়ে দেবার, তখন তারা ধ্বংস বাদ দিয়ে তৈরীতে তা কাজে লাগিয়েছিলেন।

 

৯। নিজের বডি ও মাইন্ডের যত্ন নিন।

প্রাচীন গ্রীকেরা অলিম্পিক শুরু করেছিল এবং তারা শ্রেষ্ট কিছু দার্শনিকও দিয়েছে। আপনাকে সেরা শারীরিক মেশিন বানাতে হবে এবং সেরা চিন্তা করার মতো মাথাও বানাতে হবে। প্লেটোর এই কথা শোয়ার্জনেগার অন্য আরেকজনের কাছ থেকে শুনেছিলেন এবং তা আত্মস্থ করে নেন।

“You have to build the ultimate physical machine, but also the ultimate mind”

বডিতে মনযোগ দেয়া তার কাছে সমস্যা ছিল না। পরে তিনি ঠিক করে বুদ্ধিমান হবেন ও মাইন্ডকেও ট্রেইন করবেন। তার কথায় স্পঞ্জের মত তিনি চারপাশের বিষয়গুলি থেকে শুষে নিয়ে শিখতে শুরু করেছিলেন, এবং এর মধ্যে বই তো আছেই।

টোটাল রিকল থেকে নেয়া। পড়ালেখা করছেন শোয়ার্জনেগার।

ক্লিন্ট এস্টউড শ্যুটিং এ, ডিরেক্টিং এ থাকাকালেও ব্যয়াম করতেন। রাশান প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেভেদেভ প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততার পরেও দুই ঘন্টা দিনে এক্সারসাইজ করতেন।

এত ব্যস্ত লোকেরা জিমের জন্য সময় বের করতে পারলে অন্যদের সমস্যা হবার কথা না।

 

১০। স্টে হাংরি।

হাংরি থাকেন সফলতার জন্য, নিজের মার্ক রেখে যাবার জন্য, এবং সফল হতে থাকলে বা হয়ে গেলে অন্যকে সাহায্যের জন্যও হাংরি থাকার পরামর্শ দেন শোয়ার্জনেগার।

শোয়ার্জনেগার বলেন তার বাবা বলতেন “Be useful. Do something”. এটি তার কাছে গুরুত্বপূর্ন কথা মনে হয়। আপনি যদি ভাবেন আপনার ট্যালেন্ট আছে ও স্কিল আছে তাহলে তা ব্যবহার করে আশপাশের মানুষের জীবনকে ভালো করুন।

 

 

সারমর্ম বা শেষকথাঃ

কোন কাজে সাকসেস বা সফলতার জন্য নিজের চেষ্টার চাইতেও সাধারণত আরো অনেক ফ্যাক্টর জড়িত থাকে। এছাড়াও সাসকেস একেকজনের কাছে একেকরকম হতে পারে। কিন্তু শোয়ার্জনেগারের এসব নীতি অনেকের জন্যই প্রযোজ্য হতে পারে নিজের কাজটিকে আরো ভালোভাবে করার জন্য।

শোয়ার্জনেগারের আলাদা বা ইন্ডিভিজিউয়াল হওয়ার চেষ্টা, লোকে যা করে তার উলটা করার সাহস ইত্যাদি কিংবদন্তী পর্যায়ের। সব সময় প্রচলিত নিয়ম মেনে খেলেই জিততে হয় এমন নয়, নিয়মকে কেয়ার না করেও জেতা যায়। তবে সেক্ষেত্রে নিজে ভোক্তভোগী হবার সম্ভাবনা থাকে, এবং এই ঝুঁকি নিয়েই নিয়ম ভাঙতে হয়, উলটা হাঁটতে হয়।

আরেকটা জিনিস পরিশ্রম। যে ব্যক্তি পাঁচ ছয় বছর ধরে দিনে ৪/৫ ঘন্টা সময় ব্যয় করে নানা ধরণের বই পড়ছে, জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করছে সে অন্য আরেকজন যে এসব করে নি তার চাইতে বেশী জানবে, স্বাভাবিক ভাবে ভালো থিংকার হবে। এটা তার পরিশ্রমের ফল। পরিশ্রম তাই গুরুত্বপূর্ন এদিক থেকে, এবং অন্যের অর্জন দেখার সময় তার পেছনের পরিশ্রমটাও দেখতে হবে।

 

উপদেশ বিষয়েঃ

উপদেশ আছে অনেক এই লেখায় তাই উপদেশ বিষয়ে নাসিম তালেবের বেড অব প্রকাস্টেসে উল্লেখ করা কথাটি স্মরণ করা যায়, “যখন আমরা বুঝতে পারি কোন কাজে ব্যর্থ হতে চলেছি তখন অন্যদের উপদেশ খুজি যাতে ব্যর্থ হলে তাদের দোষ দেয়া যায়।”

সুতরাং, উপদেশ সরাসরি না নিয়ে আমার মনে হয় আমার শোয়ার্জনেগারের কথাগুলি থেকে একটা বা দুইটা ইনসাইট নিতে পারি। বিশেষত অহংকার বিষয়ে তার নীতিটি মেনে চলার মতো, এ ব্যাপারে কোন তর্ক থাকার কথা নয়।

“You have to remember something: Everybody pities the weak; jealousy you have to earn.”

 

** ইংরাজি লাইনগুলি আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের উক্তি।