মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » পেলের জুতা

পেলের জুতা

১৯২৪ সাল। জর্মন দুই ভাই এডলফ ড্যাসলার আর রুডলফ ড্যাসলার। দুইজনে মিলে একটা জুতার কোম্পানি দিলেন তাদের আম্মার লন্ড্রি রুমে। জর্মনীতে তখন এই কোম্পানিই খেলোয়াড়দের জুতা তৈরি শুরু করে।

কোম্পানি বানানির কিছু পরেই এডলফ জুতার মধ্যে স্ক্রু স্পাইক লাগানো শুরু করলেন। এবং একজন স্প্রিন্টার জেসি ওয়েনকে সেগুলি ১৯৩৬ সালের অলিম্পিকে পরতে কনভিন্সও করে ফেললেন।

জেসি ওয়েন ৪ তা গোল্ড মেডাল জিতলে এইসব জুতার বিক্রি অনেক বেড়ে যায়।

কোম্পানি বড় হতে থাকে আর দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। ১৯৪৩ সালে আমেরিকান সেনারা রুডলফকে নাৎসি বাহিনীর সদস্য অভিযুক্ত করে ধরলো। ধরিয়ে দিয়েছিলেন তার ভাই এডলফ।

১৯৪৮ সালে ভাইয়েরা ডেসলার শো কোম্পানি ভেঙ্গে আলাদা হয়ে যান। তৈরি করেন নিজেদের আলাদা জুতার কোম্পানি।

এডলফ নিজের নামের প্রথম ও শেষাংশ মিলিয়ে তার কোম্পানির নাম দেন এডি-ডাস।

রুডলফ একইভাবে চেষ্টা করেন রুডা নাম দিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুমা নামে সেটল হন।

একি শহরের দুইদিকে দুই ভাইয়ের জুতার দোকান। দুই ভাই এখন প্রতিদ্বন্ধী।

দুইজনই সফল ভাবে ব্যবসা চালাতে থাকেন। তীব্র প্রতিজ্ঞাবদ্ধভাবে যে তারা আর কখনো এক সাথে ব্যবসা করবেন না।

কিন্তু ১৯৬০ সালে একটা ব্যাপারে তাদের একটা চুক্তি করতে হয়। তখন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় পেলে।

এডিডাস ও পুমা একসাথে বসে চুক্তি করলো তারা কেউ পেলেরে স্পন্সর করবে না।

তার কারণ পেলের খ্যাতি তখন চূড়ায়। তারা গেইম থিওরি মতে, এমন স্টেপ নিল যাতে দুইজনারই লাভ হয়। কারণ পেলেরে স্পন্সর করলে দুইজনে দামাদামি শুরু করবে ফলে অনেক টাকা যাবে, কেউ ছাড় দিতে চাইবে না। এর চাইতে ভালো দুইজনই যদি ঠিক করে ফেলে তারা পেলের ধারে যাবে না। এই চুক্তির নাম ছিল পেলে প্যাক্ট।

১৯৭০ সাল তখন। ব্রাজিল বিশ্ব কাপ জিততে যাচ্ছে। আর এই প্রথম বিশ্ব কাপ টিভিতে দেখছে দুনিয়ার মানুষ। উন্মাদনা লোকদের মাঝে। আর এইদিকে পেলের খ্যাতি তুঙ্গে।

গেইম থিওরিতে , ব্যক্তি স্বার্থের চাইতে গ্রুপ স্বার্থ দেখলেই মঙ্গল, যেইটার কারণেই পেলে পেক্ট করছিল পুমা ও এডিডাস। কিন্তু এইখানে কিছু সমস্যা থেকে যায়। আপনি জানবেন না প্রতিপক্ষ আসলে কী করবে, চুক্তি কতটুকু মানবে। ফলে আপনার অবিশ্বাস হয় আর আপনি চুক্তি ভেঙ্গে ফেলেন। এমন হয়।

এটাই হল হিউমিনিটির সমস্যা। ট্রাস্ট এর।

এইক্ষেত্রেও একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ঘটল।

ব্রাজিল পেরুর কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের আগে পুমার এক লোক গেল পেলের কাছে।

গিয়া বলল, বস আমাদের জন্য একটা কাজ করতে পারবেন?

পেলে জিজ্ঞেস করলেন, কী কাজ?

একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে লোকটা বলল, ইয়ে…কাল খেলা শুরুর সময়, মানে মাঝমাঠে বল কিক মারার আগে আপনে মাঝমাঠে যাবেন, অফিশিয়ালদের বলবেন জুতা বান্ধার টাইম দিতে, এরপর আপনার পুমা জুতার ফিতাখান বানবেন বইয়া।

পেলে বললেন, আমার লাভ কী?

লোক বলল, ২৫ হাজার ডলার আপাতত। আর সামনে লাখ লাখ ডলারের চুক্তি তো আছেই বস। টোটাল এক লাখ বিশ হাজারের চেক আপনার থাকবে। (বর্তমানের মুদ্রাস্ফীতি হিসাবে ১০ লাখ ডলার প্রায়।)

পেলে রাজী হলেন।

খেলায় বল কিকের আগে নিচা হয়ে তিনি জুতার ফিতা বানলেন। কোটি কোটি দর্শক দেখলো ফুটবলের বরপুত্র পুমা পরে খেলেন। ক্যামেরায় ভেসে উঠলো জুতায় থাকা পুমার লগো। এই ক্যামেরাম্যানরেও পুমা টাকা দিয়েছিল ঠিকভাবে যাতে জুম করে সেইজন্য।

যা চাইছিল পুমা, সরাসরি স্পন্সর না করেই তা পেয়ে গেল।

পেলের খ্যাতির সাথে সাথে পুমার জুতার বিক্রিও বছর বছর বাড়তে থাকলো।

আর এদিকে এডিডাস ও এডলফ ড্যাসলার একে মনে করলেন চুক্তিভঙ্গ হিসেবে। ফলে দুই কোম্পানির প্রতিদ্বন্ধীতা আরও তীব্র হলো।

এখনো নাকি তাদের শহরে দোকানদাররা যারা এক ব্র্যান্ডের সমর্থক তারা অন্য ব্র্যান্ডের জুতা পরে আসা ব্যক্তিকে সার্ভ করে না। এটা কিছু ক্ষেত্রে সত্যি হতেও পারে।

তবে শেষ কথা, দুই কোম্পানিই আজ মাল্টি বিলিয়ন ডলারের। সেই দুইভাইয়ের কোম্পানি, যারা তাদের মায়ের লন্ড্রিতে শুরু করেছিলেন, এম্বিশন, ডিটারমিনেশন আর ক্রিয়েটিভিটি নিয়ে।

1 thought on “পেলের জুতা”

  1. থট যে বিজনেসের আরেক শক্তি লেখাটা সেটাই প্রমাণ করে,আমাদের ম্যান পাওয়ার আছে অনেক ক্ষেত্রে দক্ষ ম্যান পাওয়ারও আছে তবে সমস্যা হল সবক্ষেত্রে এমন পাওয়ারফুল থট পাওয়া যায় না আর যা-ও পাওয়া যায় তার কতগুলো ক্লিয়ার থট সেটা এক বিরাট প্রশ্নই বটে!

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং