আগামীর বিশ্ব বাণিজ্য এবং সুপারপাওয়ার আমেরিকার ভবিষ্যত

১৯৪৪ সালের ১ জুলাই আমেরিকা ও মিত্রশক্তির শত শত সদস্য মিলিত হয়েছিলেন নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রেটন উডস হোটেলে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। এখানে আলোচনার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ব ব্যাংক, দ্য ইন্টারনেশনাল মনেটারি ফান্ড এবং দ্য ইন্টারনেশনাল ব্যাংক ফর রিকন্সট্রাকশন এন্ড ডেভলাপমেন্ট।

তখনকার সময়ে সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবাহিনী ছিল আমেরিকার। অন্যান্য দেশের সদস্যরা ভেবেছিলেন হয়ত আমেরিকা নিজ স্বার্থ দেখে কিছু শর্ত আরোপ করবে এবং ইউরোপকে নিজেদের উপনিবেশে পরিণত করতে চাইবে। কিন্তু তাদের অবাক করে দিয়ে আমেরিকা বলল, তাদের দেশে অন্য সব দেশ পণ্য রপ্তানী করতে পারবে, সেই দরোজা খুলে দিবে তারা। এবং আন্তর্জাতিক নৌবাণিজ্যের পথ নিরাপদ রাখতে তারা নিজেদের ব্যয়ে নিরাপত্তা দিবে। এই প্রস্তাব অন্য সদস্যদের মানতে কোন আপত্তি ছিল না। ১৯৪৪ সালের ২২ জুলাই তারিখে ব্রেটন উডস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

এই চুক্তিই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বের আশ্চর্য অর্থনৈতিক উন্নতির মূলস্তম্ভ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের উদ্ভব, জাপান-কোরিয়ার বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নয়ন, এবং অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের অবতীর্ন হওয়া- এ সব কিছুর ভিত্তিভূমি তৈরী করে দিয়েছে এই চুক্তি।

পিটার জেইহান তার বইয়ে বলেছেন, এই ব্রেটন উডস মুক্ত বাণিজ্যের সময়কাল এখন একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছে। এই চুক্তি শেষ হয়ে গেলে একটি নতুন ওয়ার্ল্ড অর্ডার বা জগত বিণ্যাস দেখা যাবে।

অনেক দেশ ব্রেটন উডস মুক্ত বাণিজ্যের সুযোগে রপ্তানী নির্ভর বাণিজ্যের মাধ্যমে আমেরিকায় রপ্তানী করে প্রভূত লাভবান হয়েছে। এরকম কয়েকটি দেশ চীন, আয়ারল্যান্ড, সিংগাপুর, জার্মানী, দক্ষিণ কোরিয়া। অর্থনৈতিক শক্তি হলেও এরা মিলিটারীতে বড় ইনভেস্ট করে নি, না করেই রপ্তানী সুবিধা পেয়ে গেছে।

কিন্তু যে আমেরিকা নৌ বাণিজ্য পথের নিরাপত্তা দিচ্ছে, দেখা যাচ্ছে তাদের রপ্তানী খুব কম। ২০১৪ সালে তা হলো গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্টের মাত্র ১১%। কিন্তু বাণিজ্য পথের নিরাপত্তা দিতে তাদের খরচ হয় বছরে ১৫০ বিলিয়ন ডলার নৌবাহিনীতে, এবং ৩০ বিলিয়ন ডলার নৌ সেনাদের পেছনে।

স্ট্র্যাটেজিস্ট পিটার জেইহান মনে করেন, আমেরিকানরা তাদের লাভ ক্ষতির হিসাব পুনর্মূল্যায়ণ করবে, এবং অচিরেই ব্রেটন উডস চুক্তি থেকে সরে দাঁড়াবে।

এই চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ালে আমেরিকার ক্ষতি হবে কি না দেখা যাক।

একটা দেশের সফলতা বা উন্নতির জন্য তিনটা জিনিসের দরকার হয়।

১। ব্যালান্সড যোগাযোগ ব্যবস্থা – নিজেদের দেশের ভেতরে মানুষ ও পণ্য পরিবহনের উন্নত ব্যবস্থা থাকতে হবে। যেটা আমেরিকার আছে।

২। ডিপওয়াটার নেভিগেশন – গভীর সমুদ্র পথে ব্যবসা করা এবং বাইরের শত্রু থেকে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষমতা। এটাও আমেরিকার আছে।

৩। শিল্পায়ণ – ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালাইজেশন একটি দেশের উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ন। আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত মেশিনাদির আবিষ্কার পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে আরো ভালো করে তুলেছে। প্রযুক্তিগত সুবিধার সদ্ব্যবহার ভূ-প্রাকৃতিক ভাবে দূর্ভাগা দেশকেও উন্নত করে তুলতে পারে।

আমেরিকা পৃথিবীতে সবচাইতে ভালো জিওগ্রাফিক সুবিধা পেয়েছে ভাগ্যগুণে। এই ভূ-প্রাকৃতিক সুবিধাই তাদের ক্ষমতার মূলভিত্তি। ১২ টি নেভিগেবল নদী বয়ে গেছে আমেরিকার উপর দিয়ে যার মোট দৈর্ঘ্য ১৪,৬৫০ মাইল। সবচাইতে বড় নদী মিসিসিপির দৈর্ঘ্য ২১০০ মাইল যা চীন বা জার্মানীর সব নদীর মিলিত দৈর্ঘ্যের চেয়ে বেশী। আরব বিশ্বে নেভিগেবল নদীর দৈর্ঘ্য মাত্র ১২০ মাইল।

সবচাইতে বড় এবং সেরা প্রাকৃতিক সমুদ্র বন্দর বা পোতাশ্রয়ও আমেরিকায়।

আলাক্সা কিনে, হাওয়াই দ্বীপ দখলে নিয়ে, পুয়ের্তো রিকোর উপর সরাসরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং কিউবার উপর ১৮৯৮ সালের স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধে কার্যকরী প্রভাব খাটিয়ে আমেরিকা নিজেদের সমুদ্র পথের নিরাপত্তা করেছে সুসংহত।

২০০ বছর ধরে পৃথিবীতে ব্যবহৃত পেট্রোলিয়াম আসছে মাটির নিচে থাকা খনি থেকে। কিন্তু নন পোরাস রক ফর্মেশনে বা শেলে পৃথিবীর প্রায় ৯০ ভাগ পেট্রোলিয়াম মজুত আছে।

হরাইজন্টাল ড্রিলিং এবং হাইড্রলিক ফ্র্যাকচারিং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আমেরিকা বিশ্বের সবচাইতে বেশী তেল গ্যাস উৎপন্নকারী দেশ হয়ে উঠেছে।

২০২০ সালের মধ্যে সম্ভবত দক্ষিণ আমেরিকার আর বাইরে থেকে কোন তেল গ্যাস নিতে হবে না।

ব্রেটন উডস চুক্তিতে আমেরিকা নৌ পথের নিরাপত্তা দেয় নিজের জন্য নয়, তার মিত্রদের জন্য মূলত। কিন্তু এই অবস্থা আর চলতে পারে না পরিবর্তীত বিশ্ব ব্যবস্থায়। কিছু দেশ ব্যবসা করে যাবে কিন্তু নিজেদের নিরাপত্তা দিবে না, এমন বিষয় কখনো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না বলেই প্রতিভাত হয়, ঐতিহাসিক বিবেচনা আমলে নিয়ে দেখলে।

এই সময়ে পৃথিবী শান্তিপূর্ন অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেখেছে। মিলিটারী শক্তির প্রতিযোগিতার চেয়ে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতাই হয়েছে মূল বিষয়। কিন্তু আমেরিকা এই বিশ্ব বাণিজ্যের রক্ষা কর্তার ভূমিকা থেকে অবসর নিবে, এবং এর ফলেই হবে এই বিশ্ব বাণিজ্যের অবসান। ইউরোপ-এশিয়ায় এনার্জি নিয়ে ক্রাইসিস শুরু হবে, আরব দেশগুলি প্রত্যক্ষ করবে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত দূর্যোগ।

২০২০ সালের মধ্যে শুরু হবে বিশৃঙ্খলা এবং নতুন বিশ্বে নিম্নোক্ত ছয় ধরণের রাষ্ট্র দেখা যাবে।

১। ব্যর্থ রাষ্ট্রঃ আধুনিক রাষ্ট্র যেগুলি অক্ষত থাকতে পারবে না, যেমন গ্রীস, কার্জিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, তুর্কেমেনিস্তান এবং ইয়েমেন।

২। বিকেন্দ্রী রাষ্ট্রঃ এদের কেন্দ্র ক্ষমতা কমে যাবে। কেন্দ্রের ক্ষমতা ধরে রাখতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। চীন, বলিভিয়া, ক্যামেরুন, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, রাশিয়া, সুদান ইত্যাদি

৩। অধঃপতিত রাষ্ট্রঃ এদের সরকারের ক্ষমতা থাকবে কিন্তু সমাজের অন্যান্য উপাদানগুলি দূর্বল হয়ে উঠবে। আলজেরিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, হাঙ্গেরি, ভারত এবং সৌদি আরব এমন দেশ।

৪। স্থায়ী রাষ্ট্রঃ ডেনমার্ক, পেরু, ফিলিপাইনস, ফ্রান্স, সুইডেন তাদের বর্তমান উন্নতির অবস্থা ধরে রাখতে পারবে, এবং এর জন্য যা দরকার তা করতে পারবে।

৫। রাইজিং স্টারসঃ আর্জেন্টিনা, অষ্ট্রেলিয়া, এঙ্গোলা, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, উজবেকিস্তান এবং আমেরিকা। এরা টেকসই। যেকোন খারাপ বিশ্ব বাণিজ্যের অবস্থা এরা সামলে নিতে পারবে। এদের অধিকাংশেরই ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থা খুবই ভালো।

৬। এগ্রেসিভ পাওয়ারঃ এঙ্গোলা, জার্মানী, জাপান, তুরস্ক, সৌদি আরব, উজবেকিস্তান – এরা উপরের গ্রুপের পাঁচে থাকলেও এদের আলাদা বৈশিষ্ট্যের অন্য আরেকটি গ্রুপ এদের জন্য। এরা প্রতিবেশীদের আক্রমণ, দখন এবং নতুন মিত্র তৈরী করে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক পরিবর্তনের প্রবণতাযুক্ত।

 

আমেরিকা তার মিত্রদের মধ্যে যুক্তরাজ্যের সাথে মিত্রতা বজায় রাখবে। ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসের সাথেও ভালো মিত্রতার সম্পর্ক রাখতে চাইবে। এই তিন দেশ ইউরো জোনের বাইরে কাজ করে।

এশিয়ায় আমেরিকার বড় স্বার্থ আছে থাইল্যান্ডের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার এবং মিয়ানমারের সাথে নতুন সম্পর্ক তৈরী করার। দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের সাথে মিত্রতা রাখার ক্ষেত্রে বড় কোন স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ আমেরিকার নেই, তবে তা হবে পুরনো ওয়াদা আমেরিকা কেমন রাখে মিত্রদের ক্ষেত্রে তার এক পরীক্ষা।

ব্রেটন উডস চুক্তিতে সবচাইতে লাভবান হওয়া একটি দেশ জার্মানী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হবার পরেও এই চুক্তির সুবিধা কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়েছে। ব্রেটন চুক্তি শেষ হলে, রপ্তানী তথা বৈদেশিক বাজারে যাওয়া ও কাচামালের নিশ্চয়তার জন্য জার্মানী যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে, যেহেতু এই কারণেই গত ছয়বার দেশটি যুদ্ধ শুরু করেছিল।

২০১৫ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ব্রেটন চুক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দূর্বল হবে, তাদের মধ্যে অনৈক্য বাড়বে। চিনের উন্নতি শিথিল হবে। আমেরিকা ১৫ বছর বাজার স্থিতিশীলতা, স্বাভাবিক অর্থনৈতিক উন্নতি এবং সহজেই এনার্জি রিসোর্স প্রাপ্তির সুবিধা উপভোগ করবে। জেইহানের কথায়, ‘আসতে থাকা পৃথিবীতে আমেরিকার বাকী বিশ্বের সহযোগীতার তেমন কোন দরকার হবে না। ২০১৪ সালে আমরা সুপারপাওয়ার হিসেবে আমেরিকার শেষ দেখছি না, বরং তার সুপারপাওয়ার হিসেবে শুরুটার শেষ দেখছি মাত্র।’

এই ছিল পিটার জেইহানের এক্সিডেন্টাল সুপারপাওয়ার বইটির বক্তব্য। বইটি ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়। পিটার জেইহান ১২ বছর কাজ করেছেন জিওপলিটিক্স বিশ্লেষণ ফার্ম স্ট্রাটফোরে। এরপর নিজের ফার্ম জেইহান অন জিওপলিটিক্স প্রতিষ্ঠা করেন।

 

*আমেরিকা বলতে ইউনাইটেড স্টেইটস অব আমেরিকা বুঝানো হয়েছে এই লেখায়।