গল্পঃ পানির ফোঁটাযুক্ত সমস্যা

 

 

প্রতিদিন বিকেলে আমার বাসায় ফেরার পথে একটা বাড়ি পড়ত। এই রাস্তায় বিকেল ছাড়া অন্য কোন সময়ে আমি যেতাম না কখনোই। তাই আমার জানা ছিল না বিকেল ছাড়া অন্য সময়ে এই বাড়িটা এখানে থাকে কি না। তাই সে ব্যাপারে আমার স্পষ্ট কোন ধারনা নেই।
এই বাড়ির সামনে ছিলো সুন্দর করে সাজানো বাগান। প্রতিদিনই আমি দেখতাম একজন বয়স্ক মহিলা বাগানে চেয়ার পেতে বসে আছেন। তার হাতে কাচি। কাচি দিয়ে তিনি গাছের ডাল, পাতা ইত্যাদি কাটছেন।

যখন আমি বাড়িটার কাছাকাছি আসি তখন ভদ্রমহিলা তার চেয়ার ছেড়ে দ্রুত গেট খোলে আমার কাছে চলে আসেন। এবং তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন আমি দেখতে পাই। তার হাঁপানো দেখে আমি বুঝতে পারি যে তিনি জীবনে খুব বেশি পরিশ্রম করেন নি।

তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কি জানেন কোথায় টেপ সারানোর লোক পাওয়া যাবে?”

আমি যেহেতু কাজ শেষে বাসায় ফিরছি তাই আমি ক্লান্ত ছিলাম। আমি তাকে উত্তরে বলি, “জি না। আমার এরকম কারো সাথে পরিচয় নেই যিনি টেপ নিয়ে কাজ করেন।”

ভদ্রমহিলা অবুঝ ছোট বাচ্চাদের যেভাবে বড়রা বোঝান তেমনি করে আমাকে বলেন, “স্কচ টেপ না, পানির টেপ। লিক হয়ে পানি পড়ছে।”

আমি বলি আমি বুঝতে পেরেছি যে এটা পানির টেপ।

তখন ভদ্রমহিলা আশ্বস্ত হন। এবং আমাকে আবার বলেন, “পানির টেপ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে।”

আমার তখন কিছুটা আগ্রহ হয়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, “কেমন পানি পড়ছে?”

তিনি তখন মন খারাপ করা কন্ঠে উত্তর দেন, “অনেক পানি।”

আমি আরো স্পষ্ট হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, “কীভাবে পড়ছে বলেন? ফোঁটায় ফোঁটায় না বেশি?”

ভদ্রমহিলা এবার বলেন, “ফোঁটায় ফোঁটায়।”

তখন আমার মনে হয় এটা কোন সমস্যাই না। ফোঁটা ফোঁটা সমস্যাকে সমস্যা হিসেবে ধরা হয় না। পৃথিবীর অনেক লোকের বাড়িতেই ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ে টেপ দিয়ে। সে পানি পড়ার শব্দে মধ্যরাতে কারো কারো ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙার পর তারা প্রথমে বুঝতে পারেন না শব্দ আসছে কোথা থেকে। কিন্তু অল্প ক্ষনের মধ্যেই বুঝতে পারেন টেপ দিয়ে পানি পড়ছে।

তাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন যে পানির টেপ বন্ধ করে দেয়া উচিত। কিন্তু উঠতে পারেন না আলস্যের কারনে। কেউ কেউ আবার মনে করেন টেপ বন্ধ করে বাথরুমে মুত্র ত্যাগ করে আসা যাক- এইভাবে মনকে বুঝিয়ে তারা উঠেন এবং পানির টেপ বন্ধ করেন।

তারপর তারা ফিরে আসেন নিজেদের বিছানায়। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার শোনতে পান টেপ দিয়ে পানি পড়ার শব্দ। তাদের ক্ষেত্রে বলা যায় তাদের পানির টেপ নষ্ট হয়েছে এবং ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে। তাদের মধ্যে অনেকে ভাবেন কাল ভালো করে দেখে টেপ ঠিক করার লোক এনে ঠিক করাতে হবে। এদের মধ্যে কেউ কেউ পরদিন প্রাত্যহিক জীবনের কাজে অথবা জীবন যাপনের ঝামেলায় এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে টেপ দিয়ে পানি পড়া তথা পানির ফোঁটা সমস্যার কথা ভুলে যান। পরদিন রাতে তারা আবার শুনতে পান তাদের পানির টেপ দিয়ে পানি পড়ছে। ফোঁটায় ফোঁটায়।

এখন এই বাড়ির ভদ্রমহিলা এরকমই একজন হবেন যিনি পানির টেপের ফোঁটা সমস্যায় ভুগছেন।

আমি ভদ্রমহিলাকে বলি, “দেখুন ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়াটা আসলে কোন সমস্যা না। সমস্যা হল বেশি বেশি পানি পড়া। যেহেতু আপনার এখানে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে অতএব আপনার চিন্তিত হবার কারন নেই।”

ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন, “আপনি ব্যাপার টা বুঝতে পারছেন না…”

আমি বললাম যে আমি বুঝতে পেরেছি। আমি তাকে বুঝিয়ে বলার জন্য পৃথিবীর গ্র্যাভিটেশনাল শক্তি কীভাবে কাজ করে বুঝালাম। আমি তাকে চার ধরনের শক্তি – মহাকর্ষ শক্তি, তড়িৎচুম্বকীয় শক্তি, সবল তড়িৎচুম্বক শক্তি, দূর্বল তড়িৎ চুম্বক শক্তি ইত্যাদি সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ ব্যাখা দেই। তিনি বুঝতে পেরেছেন এমন ভঙ্গী করে মাথা নাড়েন।

তারপর আমি কিছুটা গর্ব অনুভব করতে থাকি  এটা ভেবে যে একজন চিন্তিত ভদ্রমহিলার ভুল ধারনা দূর করে তার দুশ্চিন্তা দূর করতে পেরেছি। আমার ভালো লাগতে শুরু করে কারন আমি জানি দুশ্চিন্তা এক ধরনের ভয়াবহ রোগ। ভদ্রমহিলার বিভিন্ন শারিরিক ও মানসিক সমস্যা হতে পারত এই পানির ফোঁটাযুক্ত দুশ্চিন্তার কারনে।

আমি কিছুটা হেসে তার দিকে তাকাই।

কিন্তু তিনি বিষন্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকান।

তিনি আমাকে শান্ত কন্ঠে বলেন, “সবই বুঝলাম, কিন্তু আমার যে বিশ বছর ধরে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে। পড়েই যাচ্ছে।”

আমি তখন অবাক হই।

এবং আমার মনে পড়ে বিশ বছর ধরে এই রাস্তায় বিকেলে আমি বাড়ি ফিরছি এবং প্রতিদিনই ভদ্রমহিলার সাথে একই ধরনের ব্যাক্যালাপের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি।

আমার তখন মনে হয় বিশ বছর অনেক সময়। বিশ বছরে মোট কয় ফোঁটা পানি পড়তে পারে আমি মনে মনে হিশাব করতে থাকি।

ভদ্রমহিলা আশাহত হয়ে তার আগের জায়গায় ফিরে যান আর আমি পানির ফোঁটার হিশাব করতে করতে বাসায় ফিরে আসি।

এইভাবে আমি পানির ফোঁটাযুক্ত সমস্যার মধ্যে পড়ে যাই এবং আর বেরোতে পারি না।