মীনা কার্টুনে মীনার মা আম কেটে রাজুরে আমের টুকরা ও আমের বড়া দিয়ে দেন। আর মীনারে এক টুকরা।
মীনা এতে আপত্তি জানায়। “মা রাজু তো আমার থেকে বেশি পাইলো।”
মীনার মা সেই আপত্তি খারিজ করে দেন এভাবে, “তো বেশি পাইয়া থাকে।”
মীনার দাদী জানান, “জানোনা অমনই তো হইয়া থাকে।”
এই ‘অমনই তো হইয়া থাকে” মানে এটা কোথায় হইয়া থাকে বলে বুঝাইলেন মীনার বা দাদী?
সারা দুনিয়াতেই এমন হয়। এইটাই দুনিয়ার নিয়ম। এই জিনিসই বুঝাইলেন।
মীনার চুপ মাইরা যাইতে হইল।
আইফোন চারে একটি সমস্যা দেখা গিয়েছিল। একভাবে ধরলে কল ড্রপ হয়ে যেত। এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলো। সিইও স্টিভ জবস প্রেস কনফারেন্স করবেন। সবাই মনে করেছিল তিনি অবশ্যই ক্ষমা চাইবেন।
কিন্তু তিনি তা করলেন না।
বললেন যে, “আমরা পারফেক্ট না। ফোনও পারফেক্ট না। আমরা সবাই এটি জানি। কিন্তু আমরা আমাদের ইউজারদের হ্যাপি করতে চাই।”
জবস কনফারেন্সের পরবর্তী অংশে সমাধানের প্রস্তাব উপস্থাপন করলেন। কিন্তু তিনি সরি বলেন নি।
সবাই আশা করে গিয়েছিল তিনি ক্ষমা চাইবেন। ক্ষমা চাইলে আইফোন ফালতু জিনিস তৈরি করে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেত।
স্টিব জবস এটি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি টেবিল ঘুরিয়ে সব স্মার্টফোনের সমস্যায় চলে যান।
এই কনফারেন্সের পর অনেক সমালোচনা হয়েছিল তার ক্ষমা না চাওয়ায়। আবার মিডিয়ায় অনেক আলোচনাও শুরু হয়েছিল অন্যান্য স্মার্টফোনের সমস্যা নিয়ে।
এই যে আর্গুমেন্টকে উঁচা জায়গায় নিয়ে গিয়ে টেবিল ঘুরানোর চেষ্টা, স্কট এডামস এর নাম দিয়েছেন হাই গ্রাউন্ড ম্যানোভার। তার লেখা থেকেই আমি এই জিনিসটির ব্যাপারে জানতে পারি। কিন্তু এটি তার আবিষ্কার না। অনেক মানুষ ইতিহাসের নানা সময়ে এটি ব্যবহার করেছেন।
আপনারা হয়ত সাংবাদিক করণ থাপারের সাথে নরেন্দ্র মোদির ইন্টারভিউটি দেখেছেন। যে ইন্টারভিউতে প্রায় তিন মিনিটের মাথায় মোদি ওয়াক আউট করে চলে যান। অক্টোবর ২০০৭ সালের ইন্টারভিউতে পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া গুজরাত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিক। তার তীক্ষ্ণ প্রশ্নে মোদি কী উত্তর দিবেন বুঝতে পারেন না। এবং ওয়াক আউট করেন বিব্রত হয়ে।
করণ তীক্ষ্ম প্রশ্ন করার জন্য বিখ্যাত। তার ইন্টারভিউ এর ধরণ বিষয়ে এই লিংক থেকে কিছু বুঝা যেতে পারে। অমিতাভ বচ্চনকে একবার এমন কিছু প্রশ্ন করেন তাতে অমিতাভ ইন্টারভিউ শেষে “ঝিঁকে মেরে বউকে শেখানোর” ধাঁচে উত্তেজিত হয়ে পড়েন বউ জয়া বচ্চনের উপরে, এবং এর মাধ্যমে করণের উপর তার ক্ষোভ দেখিয়ে দেন।
করণের মত সাংবাদিকের সামনে লাইভ ইন্টারভিউতে পড়লে তা হ্যান্ডেল করা সহজ কিছু না। বিজেপি পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজিস্ট প্রশান্ত কিশোর এই ভিডিওটিকে মোদিকে ত্রিশবার দেখিয়ে দেখিয়ে শেখাতে চেয়েছেন কীভাবে টাফ প্রশ্ন হ্যান্ডেল করতে হয় ইন্টারভিউতে, বিবিসিতে এ সম্পর্কে বলেছেন করণই।
মোদি কীভাবে এই ইন্টারভিউ হ্যান্ডেল করতে পারতেন, এটি বলতে গেলে হাই গ্রাউন্ড ম্যানোভারের কথা আসে। মোদি যদি এটি যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করতে পারতেন তাহলে হয়ত তার ওয়াক আউট করতে হতো না।
এখানে তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মানুষের ন্যাচার এবং তাদের পলিটিক্যাল এজেন্ডা মুসলিমরা কীভাবে ক্ষতি করছে জঙ্গীবাদের মাধ্যমে ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথা বলে টেবিল ঘুরাতে পারতেন।
মোদি খুব উঁচুমানের পারসুয়েডর না ট্রাম্পের মতো। বক্তৃতায় ভালো, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত নন।
ট্রাম্পকে আটকানোর জন্য একবার সিএনএনের সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, পোপ যে ক্যাপিটালিজমের সমালোচনা করেছেন এ নিয়ে তার মন্তব্য কী।
ট্রাম্প প্রশ্নের ফাঁদটি ধরতে পারলেন। ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে তিনি বলতে পারবেন না। আবার পোপের বিরুদ্ধে বললেও হবে না। মোদির মত প্রশ্নের উত্তর না দেয়ার পথে হেঁটে নিজেকে দূর্বল প্রমাণ করলেন না।
তিনি টেবিল ঘুরিয়ে নিয়ে আসলেন আইসিসকে। তিনি বললেন, পোপকে তিনি বলবেন যে আইসিস তার জন্য ছুটে আসছে, ভ্যাটিক্যান দখল করে নেবার পরিকল্পণা করছে।
এটি হাই গ্রাউন্ড ম্যানোভার না হলেও টেবিল ঘুরিয়ে নিজের এজেন্ডা ভিত্তিক কথা বলার উদাহরণ।
এই ভিডিওটিতে দেখানো হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প কীভাবে প্রশ্নের উত্তর দেন তার এক বিশ্লেষণ।
ট্রাম্প যখন মুসলিমদের ট্রাভেল ব্যান করছেন, তখন প্রশ্ন করা হলো এক ধর্ম লক্ষ করে এভাবে বৈষম্য করা আন-আমেরিকান কি না।
ট্রাম্প ২২০ শব্দে যে উত্তর দিলেন তা একই সাথে হাই গ্রাউন্ড ম্যানোভার, রিপিটেশন এবং সোশ্যাল প্রুফ, তিনটি পারসুয়েশনের শক্তিশালী টেকনিক দক্ষভাবে ব্যবহারের উদাহরণ হয়ে উঠল।
একবারো তিনি মূল প্রশ্নটির উত্তর দানের দিকে গেলেন না।
আপনি যখন কোন কিছু কিনতে যাবেন যেখানে দরদাম করা যায়, সেখানে ইগোর বশবর্তী হয়ে যদি দরদাম না করেন তাহলে লস আপনার। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ইনসাইটটি হলো, যে ব্যক্তি বিক্রি করছেন তিনি এটি দিনে একশো বার বা তার বেশি বার করছেন। তার কাছে এটা খেলা, স্ট্র্যাটেজির অংশ। আপনি তার কথামতো দামে কিনে নিলে তিনি বিজয়ের হাসি হাসবেন। এই জিনিস মনে রাখলে আপনিও তার সাথে খেলায় নামবেন। তখন আর দরদাম করতে ইগোতে লাগবে না।
যারা দক্ষ সেলসম্যান, যেমন ট্রাম্প, তাদের কাছে ইন্টারভিউও এমন খেলা। তারা ধরে নেন এই খেলায় প্রশ্নকর্তা তারে হারাতে নানা পন্থা অবলম্বন করবে। সেগুলি সম্পর্কে সতর্ক থেকে নিজস্ব কিছু স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে নিয়ে এই খেলায় প্রশ্নকর্তাকে হারাতে হবে।
ফলে তারা বোকার মত কথা বলছেন বা প্রশ্নের উত্তরে উত্তরটি ঠিকঠাক দিচ্ছেন কি না এটা বিষয় নয়। বিষয় হল কেন প্রশ্নকর্তা এই প্রশ্ন করেছেন। এর কী উত্তর তিনি আশা করেন ও তার মাধ্যমে কোন ফাঁদে ফেলে কী ক্ষতি করতে চান। এবং এটিকে এড়িয়ে গিয়ে এখান থেকে কীভাবে সুবিধাটা আদায় করে নেয়া যায়।
সংযুক্তিঃ
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী আফসান চৌধুরী কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে বলতে গিয়ে যে স্ট্যাটাস দিয়েছেন (Every South Asian state has done a Kashmir to its minorities, so why not India ?) এটি অসচতন হাই গ্রাউন্ড ম্যানোভার।অসচেতন বললাম কারণ আফসান চৌধুরীকে আমার ভারতপন্থী বলে মনে হয় নি তার কথাবার্তায়। বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবীদের সমস্যা হল তারা এমন কথা বলেন, যেটি তাদের এজেন্ডার বা মূল অবস্থানের বিরুদ্ধে চলে যায় অনেক সময় এটা বুঝতেও পারেন না। এক্ষেত্রে এটি হয়েছে।
যেমন বামদেরই আমি প্রথম দেখেছি পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুকে কাশ্মীরের সাথে মেলাতে। কিন্তু এই জিনিস তো করার কথা বাংলাদেশী ভারতপন্থী ও বিজেপী পন্থীদের। তারা কেন করবেন! কিন্তু করেছেন।
যারা নিজের কথা নিজেদের অবস্থানের পক্ষে যাবে আর কোন কথা বিপক্ষে যাবে এটা বুঝতে পারেন না, তারাই প্রকৃত শিশু। বাংলাদেশ কচিকাচার দেশ।
যাইহোক, আফসান চৌধুরীর স্ট্যাটাসটির সমালোচনা করে বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার লিখেছেন। যেই লেখাটিতে মূল পয়েন্ট (হাই গ্রাউন্ড ম্যানোভার) তিনি ধরতে পারলেও নিজের মতপন্থীদের সমর্থন পেতে ‘সেকুলার-লিবারেলদের’ আক্রমণ করেছেন। যা বাজে, কিন্তু নিজের সমর্থক গোষ্ঠীর অন্ধ সমর্থনের জন্য ভালো। বাজে কারণ সেকুলার লিবারেল একটা অস্পষ্ট টার্ম। যেকোন ইস্যুতে সব সেকুলার লিবারেলের ভিউ এক হবে না।
কাল্পনিক এই সেক্যুলার লিবারেলদের শত্রুরা একাট্টা হয়ে এখন ঢিল ছুঁড়বে। দেখবেন এই পোস্টে গালাগালি এত হয়েছে যে মজহারকে কমেন্টে বলতে হয়েছে গালাগালি রিমুভ করতে।
অন্ধ সমর্থন পাওয়ার একটি টেকনিক হলো যাদের অন্ধ সমর্থন পেতে চান তাদের শত্রুদের ঢিল ছুঁড়তে তাদের সাহায্য করুন। মজহার এটিই করেছেন তার লেখায়।