জিওগ্রাফি অব জিনিয়াস

 

এরিক ভেইনার তার বই জিওগ্রাফি অব জিনিয়াসে এই খোঁজ নিছেন যে, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কেন দেখা যায় যে, কোন সময়ে কোন কোন জায়গায় জিনিয়াসেরা জমা হন।

দেখা গেছে এটা হইছে প্রাচীন গ্রীসের এথেনসে, চীনের হংজুতে, ফ্লোরেন্সে, এডিনবার্গে, কলকাতায়, ভিয়েনায়, এবং সিলিকন ভ্যালীতে।

তাই বইটা হইল এইসব এলাকার বিশেষত্ব কী ছিল তা নিয়া বিশ্লেষণ। এর ফলে জিনিয়াসদের বিষয়েও কিছু পয়েন্ট উইঠা আসছে যে, কারা জিনিয়াস বা কেন জিনিয়াসেরা জমা হোন কোন জায়গায়।

ফ্লোরেন্সের জিনিয়াসেরা জমা হইছিলেন মেডিসি পরিবারের সহায়তায়। তারা নতুন চিন্তা, ইনোভেশনরে খুবই সম্মান দিতে শুরু করেন। বাগানে কাজ করতেছিল ১৪ বছরের এক বালক, লরেঞ্জো মেডিসি মুগ্ধ হয়ে তার পৃষ্টপোষকতা করতে থাকেন, সেই পরে হন মিকেলেঞ্জেলো।

যেসব শহরে জিনিয়াসেরা জমা হইতেন, দেখা গেছে ঐগুলা খুব উন্নত ছিল না। নোংরা, ছোট শহর ছিল এথেন্স যখন সেইখানে জিনিয়াসদের বিস্তার হয়। তখন পার্সিয়ান ও পলিনেশিয়ান যুদ্ধের মাঝামাঝি শান্তিকালীন সময়ে। ঐ সময়ে আর্কিটেক্ট, ভাস্কর, দার্শনিক ও কবিরা জমা হইতে থাকেন এথেন্সে। একটা থিওরি আছে, যে জায়গায় জিনিয়াসেরা থাকেন, সে জায়গায় আরো জিনিয়াসেরা আসেন। এরে বলে ম্যাগনেটিক থিওরি অব জিনিয়াস বা জিনিয়াসদের চুম্বক তত্ত্ব। এথেন্সে এইটা হয়। বাইরের সাথে ব্যবসার ফলে নতুন নতুন জিনিস এথেন্স আয়ত্ত্ব করতে থাকে। পয়েনেশিয়া থেকে অক্ষর, বেবিলন থেকে গণিত, মিশর থেকে মেডিসিন ও ভাস্কর্যবিদ্যা। ব্যবসার কারণে তাদের গতায়ত ছিল ঐসব এলাকার লোকদের সাথে।

অপেননেস অর্থাৎ অন্য এলাকার ক্রিয়েটিভ আইডিয়াগুলা নেয়া, চিন্তাগুলা নিয়া খেলা করতে পারা, এগুলা ইনোভেটিভনেস এর স্ফুরণ ঘটায় ও জিনিয়াসদের পরিবেশ তৈরি করে।  জ্যারেড ডায়মন্ডের বরাতে এটা বলা যায় যে, যারা বদ্ধ থেকেছে, অন্যদের থেকে আইডিয়া নেয় নি, এরা পিছিয়ে পড়েছে ইতিহাসে।

আমি একটা লেখা লেখছিলাম আমাদের প্রভাব বিদ্বেষের কারণ সম্পর্কে। এটা হইল এটা কোর এন্টি-জিনিয়াস তথা প্রো-স্টুপিডিটি অবস্থান কোন কোন এলাকার মানুষদের। যেহেতু তারা কমবুদ্ধির তাই ওপেন থাকার বদলে অন্য এলাকার আইডিয়া নিয়া রিলাক্ট্যান্ট থাকে। যে বাল বুঝছে, ঐ বালই বুঝছে। অন্য কিছু আনলে বলবে এইটা পশ্চিমা, ওইটা জাপানি। কথায় এমন মনে হয়, সে ভাবে সে যেইটা বলতেছে ওইটা একান্তই তার উর্বর মস্তিষ্কের বানানো।

চীনের হংজুতে জিনিয়াস ক্লাস্টার হইছিল তাদের জ্ঞানী সম্রাটদের আনুকূল্যে। এডিনবার্গের গোল্ডেন এইজে, যেইসময় এডাম স্মিথেরা, ডেভিড হিউমেরা ছিলেন অগ্রগণ্য, তাদের স্ফুরণের মূলমন্ত্রটা ছিল, “নিশ্চয়ই আরো বেটার কোন পন্থা আছে” এই স্পিরিট।

দেখা গেছে যে বিভিন্ন ক্লাব, জিনিয়াসদের মধ্যে বিতর্ক এইগুলা খুবই কমন ছিল এইসব এলাকায়। প্রচুর ক্লাব ছিল এডিনবার্গে। অদ্ভুত সিক্স ফিট ক্লাবের মত নামধারী ক্লাব, যেখানে ছয় ফিট লম্বা লোকেরাই কেবল যাইতে পারতেন। কলকাতায় ছিল আড্ডা।

কলকাতার জিনিয়াস ক্লাস্টার ধরা হইছে, বেঙ্গল রেনেসাকালীন সময়রে, ১৮৪০ থেকে ১৯২০। স্কটিশ ডেভিড হেয়ার হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। জগদীশ চন্দ্র বসুর বিজ্ঞানযাত্রা, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত প্রলিফিক রাইটার। রবীন্দ্রনাথ ৬৭ বছর বছরে ছবি আঁকা শুরু করেন আর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় ৩০০০ ছবি এঁকে ফেলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাছন রাজা দ্বারা বিস্মিত হয়েছিলেন। হাছন রাজা সিলেটের মরমী কবি। রবীন্দ্রনাথ হাছন রাজার যে বিস্ময়টা নিয়া কয়েকটা গুরুত্বপূর্ন বক্তৃতায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, সেটা হইল “আমা হইতেই আসমান জমিন” এই ধারণা। একই ধারণা রবীন্দ্রনাথের চিন্তার কেন্দ্রে ছিল, এই কারণে তিনি লেখেন “আমার স্পর্শে পান্না হলো সবুজ”, এবং আইনস্টাইনের সাথে আলাপকালে নিজের মত করে আপেক্ষিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, আসলে মানুষের সচেতনতা ছাড়া তো সৌন্দর্য বিরাজ করে না।

হিন্দু শাস্ত্রে জিনিয়াস হইলেন একটা প্রদীপের মত। প্রদীপ অন্ধকার ঘর আলোকিত করে। ওইখানে থাকা নানা বস্তুরে দৃশ্যমান কইরা তুলে। বস্তুগুলা আগে থেকেই ছিল ওইখানে। জিনিয়াস তা দেখাইয়া দেন।

ভিয়েনায় জিনিয়াস ক্লাস্টার হইছে দুই পিরিয়ডে। ১৮০০ সালের প্রথম দিকে, বেথোভেন মোজার্টদের কালে। তখন এথেনস, কলকাতার মত ভিয়েনাও নানা এলাকার লোকের আসা যাওয়ায় মুখর ছিল।

ভিয়েনার দ্বিতীয় জিনিয়াস ক্লাস্টার ফ্রয়েডদের সময়ে, বিশ শতকের শুরুতে। প্রায় সময় জিনিয়াসেরা থাকেন মার্জিনিজালাইজড। কারণ যারা হালুয়া রুটির ভাগ পাইতে থাকে এরা অবস্থা বদলাইতে চায় না। ফ্রয়েড ভিয়েনায় খুব গ্রহণযোগ্য ছিলেন না, তারে এর জন্য পরিশ্রম করতে হইছে। অনেক সময় দেখা যায় জিনিয়াসেরা থাকেন বহিরাগত, যেমন ফ্রয়েড ছিলেন ভিয়েনায়, নিজেরে প্রমাণ করতে তাদের পরিশ্রম করতে হয় বেশি।

জিনিয়াসদের আরেক বিষয়, তারা মাল্টি ডিসিপ্লিনারি। মানে এক ফিল্ডের জিনিস অন্য, প্রায় অসম্পর্কিত  ফিল্ডে ইউজ করতে পারেন। যেমন গ্যালিলিও তার ভিজুয়াল আর্টের দক্ষতা কাজে লাগাইছিলেন, আলো ছায়ার হিসাব কইরা তিনি আবিষ্কার করছিলেন জুপিটারের চাঁদ। এইভাবে ফ্রয়েড অনেক করছেন, তার থিওরিগুলা বানাইতে। বর্তমানের জিনিয়াসেরা এইটা করে যাচ্ছেন, যেমন একাডেমিক ফিল্ডে ড্যানিয়েল কায়নেম্যান।

আরো একটা জিনিস পাওয়া যায় এরিক অয়েইনার বা ভেইনারের এই বই থেকে, জিনিয়াসেরা একবার ফেইল করলে আবার শুরু করেন ও নানাভাবে শুরু করেন। এটাই, সিম্পল শুনতে হইলেই, এটাই তাদের বড় এক বিশেষত্ব। প্রতি ট্রাই তাদের কিছু জিনিস শেখায়, ও তারা আবার শুরু করেন।

আমার ধারণা, সাকসেস ও ফেইলার নিয়া পুরা ভিন্ন একটা ভিউ থাকে তাদের, অন্য মানুষদের থেকে।