“বিশ্বাস” এবং “বিশ্বাসযোগ্যতা” – কারে বা কোন জিনিসরে বিশ্বাস করা যায়

কোন বিষয়ে “বিশ্বাস” কীরকম হবে 

মানুষের মতের পক্ষে যদি তার স্কিন থাকত, তাহলে অধিকাংশ মানুষই বুঝতে পারত তারা কত ভুল চিন্তা করে।

যেমন, কেউ ফেইসবুকে কোন মত দিছেন বা পত্রিকায় বা টিভিতে। এই মত রাইট হলে তার লাভ হবে, আর ভুল হলে তার লস হবে, এই স্কিন যদি থাকত।

এটা না থাকার ফলে প্রচুর স্টুপিড মত মিডিয়ায়, সমাজে ভাসতে থাকে।

একজন জুয়াড়ি জুয়া খেলে নিঃস্ব হইতে পারে, ইভেন তারে অর্থনৈতিক ভাবে স্টুপিডও বলা যায় অবস্থা বিচারে, কিন্তু সব সময়ই সে একটা সম্মানের দাবীদার। এই সম্মানটা হচ্ছে সে তার বিশ্বাসের পক্ষে রিস্ক নিতে পেরেছে। একজন স্কিন ইন দ্য গেইম ছাড়া তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর চাইতে তার জীবন মহিমাময়। 

মানুষের সিস্টেমটা হল, সে আগে কোন মত, পথ বা দলের পক্ষ নেয়। হয়ত জন্মসূত্রে বা সামাজিক পরিস্থিতিতে পড়ে এটিতে সে গিয়েছে। এরপর, এই মতের পক্ষে প্রমাণ খুঁজতে থাকে। যেখানে যা পায় এনে জড়ো করে। ফলে, কখনো সে তার মতের, পথের তথা চিন্তার ভুল দেখতে পায় না। স্কিন না থাকার কারণে, কাজ করতে গিয়ে যে দেখবে ভুল, সেই সুযোগও থাকে না।

ধরা যাক দুইজন বুদ্ধিজীবী কাল বৃষ্টি হবে কি না এ নিয়ে কথা বলছেন। 

বুদ্ধিজীবী এক ডেটা দেখে বললেন কাল বৃষ্টির সম্ভাবনা ৮০%। অর্থাৎ তিনি ৮০ ভাগ বিশ্বাস রাখেন। 

বুদ্ধিজীবী দুই ডেটা দেখে বললেন, কাল বৃষ্টির হবে ১০০%, তার বিশ্বাস ১০০ ভাগ। 

পরদিন সকাল হবার আগে আবার তাদের নতুন কিছু ডেটা দেয়া হল। প্রথম বুদ্ধিজীবী ডেটা দেখে বললেন, তিনি আগের অবস্থান বদলেছেন, এখন তিনি ৫০ ভাগ বিশ্বাস রাখেন কাল বৃষ্টি হবে। কারণ নতুন তথ্য তার আগের অবস্থানের বিরুদ্ধে দেখা যাচ্ছে। 

দ্বিতীয় বুদ্ধিজীবী নতুন তথ্য দেখে তার অবস্থান বদলালেন না। তিনি ১০০ ভাগ বিশ্বাসী। 

পরদিন বৃষ্টি হল না। 

চোখের সামনে প্রমাণ বাস্তব হলো, এবং ঘটনা ঘটে দেখিয়ে দিল বুদ্ধিজীবী দুই পুরাটাই ভুল ছিলেন। তার তখন না মেনে আর উপায় থাকল না। 

কিন্তু অধিকাংশ বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপের ক্ষেত্রে এমন দ্রুত ঘটনা ঘটে বুঝানোর সুযোগ থাকে না। আবার ঘটনা ঘটে বুঝানোর অপেক্ষায় থাকা একজন মানুষের জন্য ক্ষতিকর। যেমন, একদল কৃষক ১০০ ভাগ বিশ্বাস করলেন তাদের বাঁধ ভাঙবে না। কিন্তু বৃষ্টির পানিতে বাঁধ ভেঙ্গে গেল, তাদের ফসল তলিয়ে গেল। এক্ষেত্রে ঘটনা ঘটার অপেক্ষাতে থাকা ক্ষতি ঢেকে এনেছে, এটা প্রায় বাস্তব ক্ষেত্রেই হয়। 

বেটার ওয়ে হচ্ছে, ক্লিয়ার গুড এবং ব্যাডের বিভাজন না করে একটা সম্ভাব্যতার হিসাব রাখা। যেমন, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সেরা, এইটা এক মত। এটা ফিক্সড মত। কিন্তু সম্ভাব্যতা রাখার অর্থ হল, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সবচাইতে সেরা দল, আমি আমার বিশ্বাস ৮০% রাখলাম। এই ধারণা রাখলাম, এবং এরপর দেখলাম আফগানিস্থানের সাথে সিরিজ হারল বাংলাদেশ দল। 

তখন আমার কাছে নতুন তথ্য এলো, সেই তথ্যের আলোকে আমি আমার আগের পজিশন, বাংলাদেশ দল সেরা দল, একে দুইভাবে বিচার করতে পারি। 

১। আমি বিশ্বাস করেছি (৮০%) অতএব, বাংলাদেশ দল সেরা দল। (যেটি ভুল কারণ বাস্তবের ঘটনার সাথে মিলে না।) 

২। আমার ৮০% বিশ্বাস ছিল বাংলাদেশ দল সেরা দল, কিন্তু এইভাবে তারা হারল, এই নতুন প্রমাণ কি আমার বিশ্বাসের পক্ষে যায়? না বিরুদ্ধে যায়? 

আমি দেখলাম আমার অবস্থানের  বিরুদ্ধে যায়, তাই বাংলাদেশ দল সবচাইতে সেরা দল এই বিশ্বাসকে বদলে নিলাম, এখন হয়ে গেল ৬০%। 

এইভাবে নতুন তথ্যের সাপেক্ষে আমি আমার অবস্থান পুনঃবিচার করতে পারি। পক্ষে না গেলে অবস্থান পরিবর্তন করতে পারি। 

নতুন তথ্যের সাপেক্ষে নিজের অবস্থানরে বিচার করতে হলে প্রথমত ফিক্সড অবস্থানে না যেতে হবে, নতুন তথ্য প্রমাণের জায়গা রাখতে হবে, অবস্থানকে সম্ভাব্যতার হিসাবে বিচার করতে হবে।

কোন কিছু কিভাবে “বিশ্বাস” করার মত কি না বুঝা যেতে পারে 

ইন্টারনেটের কারণে আমাদের চারপাশে এখন প্রচুর তথ্য, অনেক মানুষের অনেক মতামত। মৌলিক সমস্যা হচ্ছে, এর মধ্য থেকে কোনটা আপনি বিশ্বাস করবেন? বা আপনার বিশ্বাস নির্মানে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হিসেবে নিবেন? 

ধরা যাক একজন ট্রেডিং শিখবেন। নানা জন নানা উদ্দেশ্য সামনে রেখে তাদের মতামত প্রকাশ করছে। ট্রেডিং শিখতে হলে ব্যক্তি কোন মতামতকে, কোন সোর্সকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করবেন? 

চিন্তা করলে দেখবেন, ইন্টারনেট বাদ দিলেও এই “বিশ্বাসযোগ্য” সোর্স বা ব্যক্তি চিনতে পারা মানুষের সবচাইতে বড় দক্ষতা। এর উপর অনেকাংশে নির্ভর করে তার কাজের সফলতা। 

একজন ব্যক্তি সব বিষয়ে জ্ঞানী হতে পারেন না। ফলে তাকে জ্ঞানের জন্য অন্য ব্যক্তিদের সাথে জ্ঞান আদান প্রদান করতে হয়, এবং এই করতে থাকার মাধ্যমে এক্সপোনেনশিয়াল হারে জ্ঞান বাড়তে থাকে। কিন্তু, এই ক্ষেত্রে, কার সাথে আপনি জ্ঞান আদান প্রদান করবেন? আপনি যে বিষয়ে জানেন তা তাকে বলবেন ও তারটা নিবেন?  সেই ব্যক্তির মতামত কীভাবে আপনার কাছে “বিশ্বাসযোগ্য” হয়ে উঠবে? 

বিশ্বাসযোগ্যতা হচ্ছে আমরা ঐ ব্যক্তিকে কতোটুকু বিশ্বাস করব, এবং আমাদের বিশ্বাস তৈরি করতে তার মতামতকে কতোটুকু গুরুত্ব দিব। 

ধরা যাক ডোনাল্ড ট্রাম্প বললেন, করোনা সাধারণ রোগ, মাস্ক পরতে হবে না। আবার ডক্টর এন্থনি ফাউচি বললেন, করোনা মারাত্মক রোগ সবাই মাস্ক পরেন। 

আমরা এই দুই ব্যক্তির মধ্যে কাকে বিশ্বাস করব? করোনা বিষয়ে আমাদের “বিশ্বাস” তৈরিতে তাদের দুইজনের মতামতের মধ্যে কারটা কে গুরুত্ব দিব? 

উদাহরণ হিসেবে এগুলি বিশ্বাসযোগ্যতা বা কাকে আমরা বিশ্বাস করব, এই গুরুতর সমস্যার কিছু উপস্থাপন। চিন্তা করলে আপনি আরো অনেক খুঁজে পাবেন। 

আমরা সাধারণত গুরুত্ব দেই ডিগ্রি আছে কি তার, এই সিগন্যালের উপরে। ডিগ্রি আমাদের সিগন্যাল দেয় এই ব্যক্তি উক্ত বিষয়ে একাডেমিক পড়াশোনা করেছেন, নিয়মতান্ত্রিক ভাবে জ্ঞান অর্জন করেছেন। 

এই সিগন্যালের কিছু সীমাবদ্বতা রয়ে যায়। 

এইজন্য বেটার ওয়ে হলো, দেখা যে, যে ব্যক্তি ওই বিষয়ে কথা বলছে, উক্ত বিষয়ে তার কোন অর্জন আছে কি না, অর্থাৎ ট্র্যাক রেকর্ড। 

এবং দুই, সে জিনিশটা যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে কি না। 

কারো কাছ থেকে ট্রেডিং শিখতে হলে দেখতে হবে, ট্রেডিং এ তার ট্র্যাক রেকর্ড কেমন। সে ঐ বিষয়ে নিয়মিত ভালো করেছে কি না। 

দুই, সে তার প্রকৃয়া কত যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করতে পারে। 

বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে এই গ্রুপ সবচাইতে উপরে থাকবে। তারা তাদের চিন্তা লজিক্যালি উপস্থাপন করতে পারে, এগুলিকে কাজে লাগাতে পারে। ফলে, তাদের মতামত সর্বোচ্চ মূল্য পাওয়ার দাবী রাখে। 

আরেকদল থাকবে, যারা যৌক্তিভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না, কিন্তু তাদের ট্র্যাক রেকর্ড ভালো। 

আরেকদল, যাদের ট্র্যাক রেকর্ড ভালো না, কিন্তু জিনিশটা যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। 

এবং শেষ দল, যারা যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না, ট্র্যাক রেকর্ডও খারাপ। 

এই শেষ দল ছাড়া বাকি দুই দলকে কখনো কখনো বিশ্বাস করা যায়। 

কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আলাপে, আমাদের আদর্শ মান হওয়া উচিত, যে কাজটি করতে পারে ও পেরেছে, এবং লজিক্যালি ব্যাখ্যা করতে, সেই রেয়ার মানুষেরা। 

শেষ দল ছাড়া বাকি দুইদলকে প্রথম কথাতেই অবিশ্বাস করার সুযোগ নেই। কারণ অনেক মানুষ আছে যারা কাজটা করে ফেলতে পারে কিন্তু কীভাবে করছে জানে না। তাদের এই অভিজ্ঞতা মূল্যহীন নয়। 

যেমন, একজন ট্রেডার, দেখা গেল সে নিয়মিত ভাবে ভাল ট্রেড করছে। কিন্তু কিভাবে করছে জিজ্ঞেস করলে লজিক্যালি ব্যাখ্যা করতে পারে না। 

সে বলল, আগামীকাল টেসলার স্টকে আপট্রেন্ড হবে। তার এই কথা যাচাই না করে অবিশ্বাস করে ফেলা যাবে না। যেহেতু তার ট্র্যাক রেকর্ড ভাল তাই তার কথাটি যাচাই করে দেখতে হবে। 

বাকি থাকে, যারা ব্যাখ্যা করতে পারে কিন্তু ট্র্যাক রেকর্ড ভাল না। যেমন, একজন ট্রেডার মাইক্রো ও ম্যাক্রো ইকোনমিক নানা ইস্যু, এবং টেকনিক্যাল ফান্ডামেন্টাল বিষয়ে ভাল জ্ঞান রাখে, লজিক্যালি ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু তার ট্র্যাক রেকর্ড ভাল না। সে বলল আগামীকাল এস এন্ড পি ডাউন থাকবে, কারণ ইতিহাসে এর আগে কখনো তানা ১১ দিন মার্কেট গ্রিন থাকে নি। এ বিষয়ে সে তার লজিক্যাল ব্যাখ্যা দিল। 

এমতাবস্থায়, আমি যেহেতু তার জ্ঞান সম্পর্কে জানি, সে তার লজিক্যাল ব্যাখ্যা দিয়েছে, ফলে আমি তার কথা শোনা মাত্রই উড়িয়ে দিব না। যাচাই করে দেখব। 

কারণ, অনেক ক্ষেত্রে এমন হয়, একজন নিজের চিন্তা সম্পর্কে ক্লিয়ার থাকার পরেও কাজে সফল হতে পারে না, কারণ এই সফলতায় তার শারীরিক, মানসিক প্রভাব থাকে, এবং অনিশ্চয়তা তথা লাক এর অংশ কাজ করে। সেই বিবেচনায় আমি তার কথা উড়িয়ে দিব না। 

কিন্তু যদি দেখি তার ট্র্যাক রেকর্ড বাজে, কথাও অযৌক্তিক তাহলে তাকে নিয়ে সময় নষ্ট করার কিছু নেই। 

নিজের “বিশ্বাসযোগ্যতা” বিষয়ে 

আপনি নিজে কোন বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য কি না, তা মাপতে হলেও আদর্শ মানে মাপতে হবে। ঐ বিষয়ে আপনার ট্র্যাক রেকর্ড কেমন, মানে ওইটা আপনি পারেন কি না। এবং আপনি ঐটা যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন কি না। 

অনেক জিনিশ তত্ত্বে ঠিক থাকে, কিন্তু বাস্তবে এপ্লাই করতে গেলে বাস্তব অবস্থায় কাজ করে না। ফলে, থিওরি প্র্যাক্টিস করতে গেলে দেখা যায়, এর টেস্ট হয় যে এটি কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য। 

কোন জিনিশ আপনি বিশ্বাস করেন কি না, এটি বুঝার উপায়, আপনি এই মতের পক্ষে কী বাজি ধরতে রাজী আছেন। এই টেস্টে ফেললে দেখা যাবে, অনেক জিনিশ আপনি বিশ্বাস করেন বলে আপনার মনে হতো, কিন্তু আসলে আপনি বিশ্বাস করেন না। কারণ হয়ত বিষয়টা নিয়ে আপনার সন্দেহ রয়ে গেছে। 

আমরা আমাদের সম্পর্কে ভুল বিচার করি। নিজেকে বুঝতে পারা ও নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করতে পারা খুব কঠিন কাজ, কারণ নিজের সাথে আমাদের ইমোশন জড়িত। 

যেমন, ধরা যাক আমি ডুওলিংগোতে স্প্যানিশ শিখছি। আমি নিজেকে বললাম দিনে ৩০ মিনিট শিখব। দিনে ৩০ মিনিট আর এমন কি! 

কিন্তু কয়দিন পর ভুলে গেলাম। 

অনেক কাজের ক্ষেত্রে এমন আমাদের অনেকেরই হয়। 

এসব ক্ষেত্রে আপনি আপনার অবস্থান, “দিনে ৩০ মিনিট শিখব” একে বিশ্বাস না করে একে টেস্টে ফেলুন। 

বাজি ধরুন দিনে ত্রিশ মিনিট না শিখতে পারলে ১০০ টাকা হারাবেন। 

বন্ধুর সাথে বাজি ধরতে পারেন, সিরিয়াস বাজি, হারলে তাকে ১০০ টাকা দিতেই হবে। 

এটা এভাবে আরো ভালো হতে পারে, ৫ জনে একটা গ্রুপ করলেন, যে পাঁচজন মিলে স্প্যানিশ শিখছেন। ৩০ মিনিট মিস করলে ১০০ টাকা গ্রুপে দিতে হবে। এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে এতে কোন ছাড় দেয়া না হয়। 

এইভাবে, যেকোন প্রেডিকশন নিয়ে বাজি ধরতে পারেন। 

জ্ঞান, দক্ষতা ও ডিমের সমালোচনা করতে মুরগি হতে হবে কি না 

আমার উপরোক্ত আলাপে, যখন বললাম যে বিশ্বাসযোগ্যতার আদর্শ মান হিসেবে ব্যক্তি ওই কাজ করতে পারে কি না, এবং লজিক্যালি ব্যাখ্যা করতে পারে কি না, এটা বিবেচ্য হবে, তখন প্রশ্ন আসে, যেটা কমন প্রশ্ন, তাহলে কি ডিমের সমালোচনা করতে হলে মুরগি হয়ে ডিম পেরে দেখাতে হবে? 

জ্ঞান প্রচার ও তার সাহায্যে দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়ে প্রচলিত ধারণা হল, ব্যাখ্যা দিয়ে সহজ ভাষায়, বিভিন্ন উদাহরণসহ বুঝিয়ে দিলে শিক্ষার্থীরা তা শিখে নিবে। এই থিওরি (ট্রান্সমিশনিজম) এর উপরেই শিক্ষা ব্যবস্থা স্থাপিত। 

[ ট্রান্সমিশনিজম কেন ভুল মডেল, কীভাবে ইফেক্টিভ রিডিং এ যাওয়া যায় এ নিয়ে আরেকটি লেখা প্রকাশ করেছিলাম, এটা পড়তে পারেন। 

কিন্তু  এটা পুরোপুরি সত্যি নয়। যেমন, ট্রেডিং এর ক্ষেত্রে, বাইসাইকেল চালনা বা সাঁতার শেখার ক্ষেত্রে, বা গল্প লেখার ক্ষেত্রে, বা ছবি আঁকার ক্ষেত্রে, ইত্যাদি অনেক উদাহরণ আমরা পাব, যেখানে স্টেপ বাই স্টেপ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেও বাস্তবে ব্যক্তি ওইটা করতে পারবে না। ঐ দক্ষতা অর্জনের জন্য তাকে কাজটি করে করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। 

তাই করাটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্ট। 

এখানে ভাষা শেখার উদাহরণ দেয়া যায়। স্কিল কেউ কাউকে শেখাতে পারে না, এটা নিজে শিখতে হয়। ইংরাজি বা অন্য কোন ভাষার স্কিলের ক্ষেত্রেও একই কথা। হাজার হাজার বই ভিডিও আছে, যারা শেখাচ্ছেন। কিন্তু শিখতে হলে এসব থেকে ব্যক্তিকে নিজে নিজেই শিখতে হয়, তাকে বাস্তব পরিবেশে ভাষা প্রয়োগ করে করে ভাষা অর্জন (এক্যুয়ার) করে নিতে হয়। অন্যথায়, শুধু থিওরি শেখাই চলতে থাকে, কিন্তু বাস্তব পরিবেশে কথা মুখে আসে না। 

সাহিত্য বা আর্টের সমালোচনার ক্ষেত্রে, দেখতে হবে ব্যক্তি ঐরকম কাজ ভালোভাবে করতে পারেন কি না। এটা প্রথম পয়েন্ট। দ্বিতীয় পয়েন্ট হল, তার মতামত যৌক্তিক কি না। 

দুইটা পয়েন্ট ঠিক হলে তিনি বিশ্বাসযোগ্য। 

আবার, সাহিত্য বা আর্ট সমালোচনার ক্ষেত্রে ধরা যাক ব্যক্তি ওইরকম আর্ট করেন না, কিন্তু ঐরকম আর্ট বিষয়ে, আর্টের নানা বিষয়ে লজিক্যাল মতামত দিয়েছেন। অর্থাৎ সাহিত্য সমালোচক হিসেবে তার ট্র্যাক রেকর্ড ভাল। সেই হিসেবে তার মতামত যৌক্তিক হলে তিনি দুইটা শর্তই পূরণ করেন। এখানে মনে রাখতে হবে সাহিত্য বা আর্টের সমালোচনা, আর্টেরই অংশ। এবং সাহিত্য আর্ট এসব আইডিয়া নির্ভর। 

আর যদি দেখা যায় ব্যক্তি নিজে ভালো লেখেন, আগে সমালোচনা করেছেন, এবং এখন যে মত দিয়েছেন তা যৌক্তিক, এই তিন পয়েন্টে মিললে এই বিষয়ে তিনি সর্বোচ্চ বিশ্বাসযোগ্য। 

মূল নৈতিক ভিত্তি এবং “বিশ্বাস” 

মূল নৈতিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে স্কিন ইন দ্য গেইম’কে। 

স্কিন ইন দ্য গেইমের সহজ প্রকাশ, যে রিস্ক নিবে রিওয়ার্ড সে পাবে। 

একজন রিওয়ার্ড নিয়ে নিবে, আর রিস্ক নিবে না, রিস্ক অন্যদের দিকে ঠেলে দিবে, এটা অনৈতিকতার ভিত্তি। 

এই সিম্পল নীতি সব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে দেখা যায়। 

ধরা যাক, ট্রেডিং এ, আপনি ১০০০ টাকার রিস্ক নিলেন, যেখান থেকে ট্রেড সাকসেসফুল হলে ৫০০০ টাকা লাভ হতে পারে। এই ক্ষেত্রে, যদি দেখা যায় এমন হয় যে, লস হলে এটা আপনাকে দিতে হবে, আর লাভ হলে আরেকজন লাভ নিবে এটা এথিক্যাল না। কারণ এই সিস্টেমে আপনি সারভাইভ করবেন না, এবং আপনার ত্যাগের মাধ্যমে অন্যজন ফুলে ফেঁপে উঠবে। 

আমরা বাস্তবে যে সিস্টেমে বাস করি সেখানে তথ্যের এসিমেট্রি থাকে, অর্থাৎ, দুই পক্ষ সমান তথ্য জানে না। মালিক পক্ষ একটা নিয়ম করল, তারা কী ভেবে এটা করেছে শ্রমিক পক্ষ পুরোপুরি জানতে পারবে না। মটিভেশনাল স্পিকার কথা বলছে, সে নিজে এটা বিশ্বাস করে কি না, তার উদ্দেশ্য কী শ্রোতারা পুরোপুরি জানতে পারবে না। এভাবে, সকল ক্ষেত্রে তথ্যের অসাম্যতা থাকে, কখনো ইস্যুটা সিরিয়াস, আর কখনো হয়ত সাধারণ। 

এমনও ইস্যু হতে পারে যেখানে বড় লাভ ক্ষতি বা সারভাইভাল নির্ভর করে। 

ধরা যাক, আপনি এবং একজন অপরিচিত লোক একটা জঙ্গলে আটকা পড়েছেন। এবং একটা ভয়ানক ভল্লুক এগিয়ে আসছে। আপনি অপরিচিত লোকটির চাইতে দূর্বল। আপনি লোকটিকে বললেন, এখন কী করা যায়? ভল্লুক তো আসছে, তার পদশব্দ শোনা যায়? 

আপনাদের কাছে দুইটা অপশন আছে। 

এক, আপনি ও লোকটি মিলে ডালপালা নিয়ে ভল্লুকের বিরুদ্ধে ফাইট করতে পারেন। 

দুই, দুইজনই ঝেড়ে দৌড় দিতে পারেন। 

আপনি যখন লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, সে তখন তার জুতার ফিতা শক্ত করে বাঁধছিল। কোন কথা বলল না। 

আপনি তখন বললেন, ভল্লুক খুব দ্রুত দৌড়ায়। আপনি কি ভাবছেন দৌড়ে ভল্লুকরে হারাইয়া দিবেন? 

লোকটা তখন আপনার দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলল, কে বলছে আমি ভল্লুকরে হারাইতে যাচ্ছি? আমার আপনারে হারাইলেই হবে। ভল্লুক আপনারে খাব আর আমি বেঁচে যাব। 

লোকটার জন্য এটাই বেস্ট স্ট্র্যাটেজি। কারণ দুইজন মিলে যুদ্ধ করে ভল্লুকরে হারানো যাবে না। তার চাইতে সে দৌড়ে আপনারে হারালে, ভল্লুক আপনারে খেতে থাকলে তার বাঁচা প্রায় নিশ্চিত। 

এখন, আপনি কী করবেন? একা কি ভল্লুকের সাথে ফাইট করবেন, নাকি দৌড় দিবেন? 

লজিক্যালি আপনার জন্য বেস্ট স্ট্র্যাটেজি হয়, লোকটা যা করে সেটা করা। কারণ দৌড়ে আপনি ভল্লুকরে হারাইতে পারবেন না। ফলে, সে দাঁড়াইয়া ফাইট করতে থাকলে আপনিও তা করতে পারেন তার সাথে, অর্থাৎ সহযোগিতা। আর সে যখন ভাগতেছে, তখন আপনারও উচিত ভাগা। এতে আপনার বাঁচার সম্ভাব্যতা বাড়ে। 

বিশ্বাসের আলাপে এই গেইমের কথাটা আসল, কারণ, যদি এমন হয়, লোকটি আপনাকে বলছে আমাদের সকলের উচিত ভল্লুক আসলে ফাইট করা। এটা বীরত্ব। আমাদের উথ্রেডের মত বীর হইতে হবে। 

ইত্যাদি বলে সে আপনারে বুঝাল। আপনি তা বিশ্বাস করে ফেললেন। ডালপালা নিয়ে টারজানের মত যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিলেন। 

কিন্তু আপনি দেখলেন ভল্লুক আসার সাথে সাথে লোকটি দৌড় দিল। আপনি তখন ভল্লুকের খাবারে পরিণত হয়ে গেছেন। 

সে রিস্ক আপনার দিকে ঠেলে দিয়ে লাভ নিয়ে চলে গেল। এবং এই জিনিশ আপনার সরাসরি ক্ষতি করল। 

আমাদের সমাজে যত জায়গায় সিস্টেমে অনৈতিকতা আছে, সেখানে খুঁজলে দেখা যাবে, সকল সময় লাভ কিছু লোক নিচ্ছে, যারা লস হলে লস নেয় না। লস সাধারণ মানুষের দিকে, এমপ্লয়ীদের দিকে, বা দুর্বলদের দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু লাভ হলে, সুনাম হলে সবটুকু তারা নিয়ে নেয়। 

আধুনিক এই তথ্য অর্থনীতি সময়ে জ্ঞান ও কর্মকে আলাদা করে বিবেচনা করা হয়। এই জিনিশ প্রচলিত হয়ে যাবার পরে এমন সব মতামত বা তত্ত্ব আমরা দেখি, যারা এগুলি দিচ্ছেন তাদের ওই কাজ সম্পর্কে আইডিয়া নেই, তাদের কর্মের সাথে এর মিল নেই। অথবা ওইখানে তাদের কোন স্কিন নেই। মহাভারতে গঙ্গাপুত্র দেবব্রত যখন ফিরে এলেন তখন একবার তার পিতা শান্তনু জিজ্ঞেস করেছিলেন বশিষ্ট মুনির কাছ থেকে তিনি কী শিখেছেন। দেবব্রত উত্তর দেন, বশিষ্ট শিখিয়েছেন জ্ঞান ও কর্ম হচ্ছে হাঁসের দুই ডানার মত, এই দুই ডানার সাহায্যেই সে উড়ে। এক ডানা ভেঙে গেলে হাঁস যেমন উড়তে পারে না। 

আধুনিক বর্তমান ব্যবস্থায় একজন বিদ্যার্থী বা মানুষ হচ্ছেন, জঙ্গলে আটকে পড়া ঐ দূর্বল লোকটির মত। তাই তাকে খেয়াল রাখতে হবে প্রতিষ্ঠান, অথরিটি বা যিনি মতামত দিচ্ছেন, তিনি কী করছেন। যদি শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বলা হয় কর্ম ছাড়াই জ্ঞান হবে, সেই ক্ষেত্রে তাকে নিজ বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাদের এই মত তিনি নিবেন কি নিবেন না। যদি দেখা যায় যে মতামত দিচ্ছে, সে মতামতের মত করে নিজের ক্ষেত্রে কাজ করছে না, স্বেক্ষেত্রে সতর্ক বিবেচনা করে দেখতে আপনার মত বা বিশ্বাস নির্মানে তার ঐ মতামত আপনি নিবেন কি না। কারণ দিনশেষে ভোক্তভোগী আপনি হবেন।