মানুষের সামাজিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ

সামাজিক সম্পর্কে একটা গিভ এন্ড টেইকের ব্যাপার আছে। সব সামাজিক সম্পর্কে থাকা মানুষেরা, সব বলতে এই যে আপনি আমার স্ট্যাটাস পড়তেছেন এখানে আমার সাথে আপনার এক সামাজিক সম্পর্ক আছে, তো, সব সামাজিক সম্পর্কে থাকা মানুষেরা মাথার মধ্যে একটা হিশাব রাখে, কত সে দিল এবং কত সে নিল। এই হিশাবটাই নির্ধারণ করে দেয় তার আচরণ কেমন হবে, এবং সামাজিক সম্পর্কে সে কেমন সাফল্য পাবে। সামাজিক সম্পর্কে যারা সাফল্য পায় না তাদের ক্ষেত্রে তাদের মাথার হিশাব এবং বাস্তবতার হিশাব আলাদা হয়।

বন্ধু বলতে যাদের ধরা হয়, সহপাঠী বা এলাকায় এক সাথে বড় হওয়া কতিপয় লোকজন, এদের সবার সাথে আপনার কথা বলতে ভালো লাগবে না, যদিও কোন অনুষ্ঠানে বা হাই হ্যালোতে বন্ধু-বন্ধু কথাবার্তা হয়। দেখা যাবে কয়েকজনের লগেই আপনার মিলতেছে বেশি, তাদের সাথেই কথাবার্তা বলেন। এটা কেন হয়, কেন সবার সাথে একইরকম হয় না?

এর সাধারণ ব্যাখ্যা, যেটা আমরা সকলেই বুঝি, ব্যক্তিত্বের মিল হয়। তাহেরি হুজুর থেকে নিয়া বলা যায়, ক্বলবে ক্বলবে মিল না হইলে…বন্ধুত্ব হয় না। কিন্তু এর আরেক ব্যাখ্যা হচ্ছে, এই লোকগুলার ক্ষেত্রে আমাদের মেন্টাল হিশাবে আমরা দেখি এরা যে পরিমাণ ভ্যালু নিচ্ছে, ঐ পরিমাণ বা তার বেশি আমারে ভ্যালু দিচ্ছে।

এখন ভ্যালু বলতে অনেক কিছু বুঝায়। সরাসরি কোন হেল্প, যেমন পড়ালেখায় হেল্প যেমন ভ্যালু, আপনারে গুড ভাইব দেয়, এইটাও একটা ভ্যালু। যেসব মানুষ নেগেটিভ ভাইব দেয়, ব্যাড ভাইব দেয়, মানুষেরা এদের এড়িয়ে চলে। এখন আমি বা আপনি কাউরে ফোন দিব না নিজে ডাউন ফিল করতে, ঠিক কি না?

যে সম্পর্কে একজন থাক ভ্যালু টেকার, এবং আরেকজন ভ্যালু গিভার এই সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হবে না। আমার এক ফ্রেন্ড একবার আরেক সহপাঠীরে নিয়া বলছিল, এ আমাদের মত লোকদের সাথে চলতে পারবে না। কারণ আমাদের মত লোক কিছুদিন তার সাথে চলেই দেখবে লস হইতেছে। তখন নিজে নিজেই সরে যাবে। এ চলতে পারবে তার মত আরেকজনের সাথে।

এই ইনসাইট হচ্ছে, ভ্যালু আদান প্রদানের। যে সম্পর্কে ভ্যালু টেকার তার সাথে ভ্যালু গিভাররা চলতে পারবে না। নিউট্রালরাও পারবে না।

কোন সম্পর্ক যদি হয় ভ্যালু নিউট্রাল, মানে দুইজনের কেউই ভ্যালু এড করে না, এই সম্পর্ক টিকবে কিন্তু নামে মাত্র টিকে থাকবে।

শক্তিশালী সম্পর্ক হবে উইন উইন সম্পর্ক, যেখানে যুক্ত ব্যক্তিরা পরস্পর ভ্যালু এড করবে। এই ভ্যালু নানা রকমের হইতে পারে।

ভ্যালুটা আবার কনটেক্সট সাপেক্ষ। আপনি সাহিত্য অনেক জানেন ও বুঝেন, এই জ্ঞান সাহিত্যের সার্কেলে ভ্যালু এড করে আপনারে বিশেষ করতে পারে। কিন্তু টেকনোলজি বিষয়ক কোণ সার্কেলে এই নলেজ কোন ভ্যালু এড করবে না।

এখন, যদি কেউ তার মেন্টাল হিশাবে ধরে নেয়, সে অনেক ভ্যালু দিতেছে, কিন্তু বাস্তবে আসলে এই কনটেক্সটে এই ভ্যালুর মূল্য কম, বা এমনো হতে পারে বাস্তবে আসলে সে অতটা ভ্যালু এড করতেছে না যতটা সে ভাবতেছে, বরং অন্যরা বেশী ভ্যালু এড করতেছে, তখন এক অদ্ভুত সমস্যা হয়। তার আচার আচরণে কথাবার্তায় প্রকাশ পায় সে ভ্যালু দিতেছে এইরকম ভাইব। সে উলটা ভ্যালু দাবী করে। অন্যদের কাছে এটা আবার হয় টক্সিক ও বিরক্তিকর আচরণ। সে তাদের কাছে উলটা ভ্যালু টেকার হিশেবে বিবেচিত হয়।

গুড সামাজিক সম্পর্কের জন্য বাস্তব যেমন আছে ঐরকম দেখতে পারা জরুরী। এবং যেকোন সম্পর্কে ভ্যালু চাইলে নিজে ভ্যালু এড করতে হবে। তোমার বন্ধু একটা বাড়ি কিনছে, তোমার সাথে শেয়ার করলো, তুমি তোমার প্রাকৃতিক ঈর্ষা থেকে আগত কমেন্ট আটকাইতে পারলা না, নেগেটিভ ভাইব দিলা। এটা তোমার বন্ধুর মেন্টাল হিশাবে যুক্ত হইল। সে আরেকবার তোমারে নেগেটিভ ভাইব দিবে, বা এড়াইয়া চলবে।

এখন, সবাই সবরকম ভ্যালু দিতে পারবে না এটা ঠিক। কেউ দেখা যাবে খেলাধুলায় ভালো, কেউ পড়ালেখায় ভালো, কেউ হাসির কথা বলতে পারে, কেউ লয়াল বন্ধু – এইরকম একটা সার্কেল নানারকম ভ্যালু এড করা লোকদের নিয়ে ঘটিত হয়।

সাধারণ এইরকম সার্কেলেও ক্ষমতার উঁচা নিচা থাকে। যেমন হাই ভ্যালু এড করা একজন বা দুইজনরে কেন্দ্র করে কোন ফ্রেন্ড সার্কেল তৈরি হতে পারে। সেখানে অন্যান্য বন্ধুরা থাকে ছোট ছোট পার্শ্ব চরিত্রে। মূল ক্যারেক্টারেরাই কনভার্সেশন এবং ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটে যখন সময়ের ব্যবধানে, অনেকদিন পরে যদি দেখা যায় পার্শ্বচরিত্রে থাকা একজন সমাজে বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সে তখন হয়ে যায় হাই ভ্যালু এড করা পার্সন। এমতাবস্থায় এই ফ্রেন্ড সার্কেল একইভাবে ফাংশনাল থাকতে পারবে না। কারণ আগের হাই ভ্যালু এড করা বন্ধুরা, যারা কেন্দ্রে ছিল, তারা এটা মানতে পারবে না।

তাই দেখা যায় পার্শ্বচরিত্রে থাকা ব্যক্তি সফল হলে পুরানো বন্ধুদের ত্যাগ করে। কারণ সে আর আগের ব্যক্তি নাই, এখন তার ব্যক্তিত্ব বিকশিত হয়ে গেছে। সে নিজেই এখন অনেক বেশি ভ্যালু এড করতে পারে। তাকে ঘিরেই নতুন নতুন সার্কেল গড়ে উঠে।

কিন্তু ফ্রেন্ড সার্কেলে কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তি যদি সমাজে আরো বেশি ভ্যালু এড করা ব্যক্তিতে পরিণত হয়, এবং তার ওই সার্কেলের বন্ধুরা ভ্যালু এড করার দিক থেকে যার যার মাপে থাকে, তাহলে তাদের সম্পর্কের ডায়নামিকস সাধারণত ভাঙ্গে না।

সামাজিক সম্পর্কে সাফল্য চাইলে এই মাইন্ডসেট রাখতে হবে, ভ্যালু এড না করে ভ্যালু কখনো নিবেন না।

যেমন একটা লেখা আপনার লাইফে ভ্যালু এড করছে, আপনি যদি লেখকরে তা জানান বা লাইক দেন, এইগুলা পালটা ভ্যালু দেয়ার প্র্যাকটিস। বেশীরভাগ মানুষ এটা করে না।

এইটা সিম্পল উদাহরণ, লাইফের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তারা এমন।

এই মনোভাব আরেক খারাপ ও ভয়ংকর মাইন্ডসেট তৈরি করে, যেইটা হইতেছে মনে মনে ধরে নেয়া আপনে ডিজার্ভ করেন। একটা ভালো চাকরী, গুড লাইফ, বন্ধুত্ব, ফেইম, মানুষের ভাল ব্যবহার ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন এইগুলার জন্য নিজেরও দিতে হয় তা মাথায় থাকে না। যখন বাস্তবতায় পায় না, তখন হতাশ হয় এবং এংরি হয়, যেন এইগুলা হইলেই সে পেয়ে যাবে।

আরেকটা ইন্টারেস্টিং এবং পাওয়ারফুল ম্যানিপুলেশনের গেইম এই লোকেরা খেলে। এইটা মানব সভ্যতায় ডাল ভাতের মত কমন। সব জায়গায় একইরকম খারাপ না। যেমন আপনি হয়ত শুনেছেন আপনার মা বা বাপ তর্কের এক পর্যায়ে বলছেন, তর জন্য এই করলাম, সেই করলাম, এত কষ্ট করলাম। সাধারণত তর্কে হেরে যাবার কালে। এইটা বলে তারা কী করতে চান?

একটা অপরাধবোধ দিতে চান। এর মাধ্যমে ম্যানিপুলেট করে তাদের মতে বা যেটা নিয়ে তর্ক হচ্ছে, ঐখানে নিজেদের মত মানাইতে চান। এটা সাধারণ, সামান্য খারাপ, এবং ভয়ংকর খারাপ ভাবে পিতামাতারাও সন্তানের উপর প্রয়োগ করতে পারেন।

প্রায় প্রতিটা রোমান্টিক সম্পর্কে দেখা যায় পার্টনারেরা বিভিন্ন সময়ে এটা পরস্পরের উপর প্রয়োগ করছেন। আমি তোমার জন্য এই করছি সেই করছি। এসব ক্ষেত্রে খেয়াল করতে হবে, কোন কথাটার দিকে ম্যানিপুলেট করতে তিনি এই অপরাধবোধ দিতে চাইতেছেন, ও দিয়া ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করতেছেন।

“আমি ডিজার্ভ করি” এই মেন্টালিটি তৈরি হইয়া গেলে এই গিল্ট, “তোমার জন্য এত করলাম কী দাম দিলা তুমি তার” প্রদান করে ম্যানিপুলেশনের প্রবণতা বেড়ে যায়। কারণ তখন মানুষের গ্র্যাটিচ্যুড হ্রাস পায়।