একটা দেশ কেন খুব ধনী হয়, আর আরেকটা দেশ কেন গরীব থাকে, এই প্রশ্নের উত্তরের জন্যই অর্থনীতিবিদ্যার শুরু।
১৮ শতকে দেখা গেছিল দুনিয়াতে কিছু দেশ অতি ধনী হইয়া উঠছে, আর কিছু দেশ পুরাই ফকিন্নি থেকে ফকিন্নিতর অবস্থায়। এর কারণ কী হইতে পারে? এডাম স্মিথ লেখলেন অয়েলথ অব নেশনস। তিনি অনুমান করলেন ক্যাপিটালিজমের বিকাশের জন্য সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ, কিছু সংস্কৃতি এর অনুকূল আর কিছু এর প্রতিকূল। এর কয়েক দশক পরে কার্ল মার্ক্স একই মত রাখলেন যে, কালচারের কারণেই এশিয়ায় ক্যাপিটালিজম বিস্তার লাভ করতে পারে নাই।
১৯০৫ সালে ম্যাক্স অয়েবার জানাইলেন, প্রটেস্ট্যান্ট হার্ড অয়ার্কের নৈতিক শক্তিই হইল ক্যাপিটালিজমের স্পিরিট।
এইগুলা সবই অনুমান। মানে, তখন ডেটা ছিল না এগুলি পরীক্ষা করে দেখার। কারণ একটা কালচারের মরাল, বিশ্বাস, পারস্পারিক আস্থা, এইগুলা বের করা সহজ জিনিশ না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এইসব অনেক ডেটা বের করার উপায় বের হইতেছে, এবং ইতিহাসের সাথে মিলাইয়া মিশাইয়া অপেক্ষাকৃত বেটার অনুমান করার সুযোগ পাওয়া যাইতেছে।
কোন দেশ কেন ধনী হয়, আর কোন দেশ কেন ফকিন্নি হয়, এইটা আমার এক আগ্রহের জায়গা। এর উত্তর স্বাভাবিক ভাবে আমরা যেইটা শুনে আসি, আমাদের ধন সম্পদ সব ব্রিটিশ লুট কইরা নিয়া গেছে, তাই আমরা গরীব, এই উত্তররে একমাত্র উত্তর ভাবতে আমি নারাজ। ফকিন্নি অবস্থার অনেক কারণ থাকবে স্বাভাবিক। কারণ সমাজ হয় ডাইনামিক। সেই হিসাবে ব্রিটিশ কলোনিয়ালিজম, বা তার আগে মোগলরাও তো নিছে, তাজমহল নাকি বাংলার ট্যাক্সের টাকায় বানানো, যাই হোক, এগুলার প্রভাব থাকবে।
এর আগে একই বিষয়ের একটা লেখায় আমি দুইজন অর্থনীতিবিদের এই থিসিসটা নিয়া আলাপ করছিলাম যে, যেইসব দেশে মৃত্যুহার বেশি ছিল, রোগ শোক ছিল সেইসব এলাকায় উপনিবেশ স্থাপন করতে আসারা বসতি স্থাপন করতে চায় নাই স্থায়ী ভাবে। তাই তারা এমন প্রতিষ্ঠান বানাইছে যেগুলার মাধ্যমে যত পারা যায় তাদের দেশে সম্পদ নেয়া যায়, এমন। তারা ঐ অঞ্চলের সমাজের জন্য ভালো প্রতিষ্ঠান গড়তে চায় নাই। কারণ এখানে তো তারা থাকবে না। এই কারণে আফ্রিকা ভারতে বানাইছে বাজে প্রতিষ্ঠান। চেক এন্ড ব্যালেন্সের সুযোগ কম রাইখা। এবং এইসব দেশ স্বাধীন হইলেও এইসব প্রতিষ্ঠানের লিগ্যাসি ধইরা নিজেদের প্রতিষ্ঠান বানাইছে। ফলত তাদের দূর্নিতী ও ফকিন্নি দশা। পক্ষান্তরে নিউজিল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ায় ভালো প্রতিষ্ঠান বানাইছে, কারণ ওইখানে তারা স্থায়ী নিবাস গড়বে।
এখন, আমাদের এই দশা হইতে মুক্তি পাইতে হইলে, এই লজিক অনুযায়ী নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠানাদি বানাইতে হবে? শিক্ষা, আইন, বিচার, শাসন সব ক্ষেত্রেই।
কিন্তু আমরা কি সেইটা পারব?
একটা দেশ কেন ধনী হয়, এই নিয়া রবার্ট পুটনাম সাহেবের এক থিসিস আছে। তিনি উত্তর ইতালি আর দক্ষিণ ইতালির ডেটা নিয়া এই ব্যাখ্যা দিলেন যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর হইতে পারস্পারিক বিশ্বাসটা জরুরী। তিনি বললেন, সুশীল সমাজ অয়েলথ তৈরি করে, অয়েলথ কখনো সুশীল সমাজ তৈরি করতে পারে না।
একই ধরণের অবস্থায় মধ্যে থাকলে, উত্তর ইতালিতে মানুষ অন্য মানুষরে বিশ্বাস করে বেশি। দক্ষিণ ইতালি ফিউডাল, মাফিয়া, তারা ফ্যামিলিরে বিশ্বাস করে আর বাইরের সবাইরে অবিশ্বাস করে। এইজন্য উত্তর ইতালি যখন উন্নত হইছে, ওয়েলদি হইছে, দক্ষিণ ইতালি হইতে পারে নাই।
এখন আপনে হয়ত ভাবতেছেন, এই পারস্পারিক আস্থার ব্যাপারটা অয়েলথে কেমনে প্রভাব ফেলে।
এক জায়গায় লোক যদি সবাই সবাইরে বিশ্বাস করে তাইলে তারা সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। সেই সম্পর্কের এক রূপ হইল ভালো সরকার ব্যবস্থা। ভালো সরকারের একটা মূল জিনিশ সরকারী দল ও বিরোধী দল, দুই দলই জানবে তারা দিন শেষে এক দলে, সেইটা দেশের দল। তারা অন্য দেশের লগে হাত মিলাইয়া দেশের ক্ষতি করবে না বা অন্য দলের সরকার প্রধানরে মাইরা ফেলবে না।
এইভাবে মানুষেরা যখন সামগ্রিক কর্মকান্ডে বিশ্বাস ও আস্থার প্রতিফলন দেখাইতে থাকবে তখন ইকোনমিক একটিভিটি চালাতে পারবে তারা সহজে, এবং এইভাবে অয়েলথের ক্রিয়েশন।
এইটা না থাকলে তারা প্রথমে দেখবে ব্যক্তি স্বার্থ। এক সরকারী কর্মকর্তা যদি ভাবে অফিসের সবাই ঘুষ খায়, তাইলে সেও খাবে, সবাই খাইতেছে সেই হিসাবে। স্বার্থ ও নিজেরটাই তার কাছে হবে প্রধান।
পারস্পারিক আস্থা না থাকলে সমাজে বড় বিজনেস প্রতিষ্ঠান গইড়া উঠে না। আর ব্যবস্থা বড় না হইলে ইকনমি অব স্কেলের সুবিধা মানুষ পায় না। মানে, বড় প্রতিষ্ঠান কম দামে জিনিশ দিতে পারে, নতুন প্রযুক্তি আয়ত্ত্ব করতে পারে ইত্যাদি। বাংলাদেশে সম্ভবত এই কারণে নিজস্ব কোন ব্র্যান্ড হয় না।
বাংলাদেশে মানুষ বিদেশী ব্র্যান্ডরে বেশি বিশ্বাস করবে, এইটা আমার অনুমান। চেইন শপ হিসাবে স্বপ্ন আর ওয়ালমার্ট রাখলে বা কসকো রাখলে ওয়ালমার্ট ও কসকোতেই যাবে শিক্ষিত মিডলক্লাস।
সংগঠন গড়তে, ভালো প্রতিষ্ঠান গড়তে যে পারস্পারিক আস্থা তথা সোশ্যাল ক্যাপিটাল লাগে, তা বাংলাদেশে কম। আকবর আলি খান তার গবেষণা পুস্তক বাংলাদেশের স্বত্বার অন্বেষাতে দেখিয়েছিলেন, ভৌগলিক কারণই এর জন্য দায়ী। বাংলাদেশের গ্রামগুলি উন্মুক্ত গ্রাম, সংগবদ্ধ গ্রাম নয়। এ কারণে মানুষের মধ্যে আস্থা বিশ্বাসের অভাব ও তৃণমূল সংগঠন গড়ে উঠে না।
এই গুরুত্বপুর্ণ বই থেকে কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করছি,
রিচার্ড কারচেস্টার নামে একজন ব্রিটিশ প্রশাসক ১৮৭৪ সালে লিখেছেন,
এর প্রায় ৭০ বছর পর আখতার হামিদ লিখেন একই কথা,
ছবিগুলা কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশের। বিস্তারিত কথাবার্তা বইয়ে আছে। সময় না থাকলে, “উত্তরলেখ” বা শেষের অংশটা পড়লেই এই লেখার আলোচ্য পয়েন্ট বিষয়ে কথাবার্তা মিলবে।
সংগঠন বিষয়ে বা বাঙালি কেন সংগঠন করতে পারে না, এ নিয়ে দেশের একজন প্রখ্যাত সংগঠক আব্দুল্লাহ আব্য সায়ীদ একটা বই লিখেছেন, সংগঠন ও বাঙালি নামে। এটি কোন গবেষণা পুস্তক না, লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাজাত উপলব্ধি। কিন্তু যেহেতু তার জ্ঞান ও সাংগঠনিক কাজের অভিজ্ঞতা আছে, তাই এই আপাত পর্যবেক্ষণ সঞ্জাত লেখাটির মূল্য আছে। এ বিষয়ে যারা গবেষণা করবেন ভবিষ্যতে, তারা বইটিকে উপেক্ষা করতে পারবেন না। বইয়ের সূচি নিম্নরূপ,
যাইহোক, গরিবী প্রসঙ্গে, পুটনাম ও তার শিষ্যদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী আমরা আগাইলে, আকবর আলি খানে আরো বিস্তারিত পাই ও রিলেট করতে পারি। দেখতে পারি যে, আমাদের পারস্পারিক আস্থার অভাবের একটা ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক কারণও আছে। এবং এই আস্থা, বিশ্বাস না থাকার কারণে আমরা সংগঠন-প্রতিষ্ঠান গড়তে পারি না, বা সহযোগিতামূলক কার্যক্রম চালাইয়া যাইতে পারি না। একজন অপরজনরে বিশ্বাস না করলে তারা সহযোগীতামূলক কাজ করতে পারে না। জন্ম নেয় অবিশ্বাস, সন্দেহ, এবং স্বার্থপরতা ও বিদ্বেষ। আর মানবদলের অর্থনৈতিক উন্নতির মূলে থাকে সহযোগীতামূলক কর্মকাণ্ড, এবং তার ফলেই আসে ইনোভেশন।