আকবর আলি খান বাংলাদেশের একজন বড় বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন সরকারের হবিগঞ্জ মহকুমার প্রশাসক ছিলেন কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুজিবনগর সরকারের হয়ে সক্রিয় কাজ শুরু করেন।
পাকিস্তানি বাহিনী যখন আক্রমণ শুরু করে তখন তিনি সরকারী পুলিশের অস্ত্র সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেন। মুজিবনগর সরকার তখনো প্রতিষ্ঠিত হয় নি। তাই অনেক সরকারী কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র দিতে অস্বীকৃতি জানান। এসময় মিস্টার খান নিজ হাতে আদেশ তৈরী করে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, খাদ্য ও অর্থ দেবার নির্দেশ দেন। তিনি ব্যাংক থেকে তিন কোটি টাকা উঠিয়ে ট্রাকে করে আগরতলায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কাছে পৌছে দেন। এরপর বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে যান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য। সেখানে নব গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের জন্য কাজ করেন।মুজিবনগর সরকারের তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন ১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ অর্থাৎ স্বাধীনতা পর্যন্ত।
স্বাধীন বাংলাদেশ পুননির্মানেও তিনি অনেক ভূমিকা রাখেন। অর্থনীতি, প্রশাসন ও বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে তার জানাশোনা অনেক। এমনকী বাংলাদেশ ও এর ইতিহাস নিয়েও তা গবেষণামূলক কাজ রয়েছে। এর মধ্যে একটি বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা যার কথা আমাদের প্রভাব বিদ্বেষ লেখাটিতে উল্লেখ করেছিলাম।
এছাড়াও মিথ্যার দশ পা দেখা বইটিতে আজব ও জবর আজব অর্থনীতি বইয়ের বুলশিট জাতীয় মিথ্যা নিয়ে একটি অংশ লেখা আছে।
আকবর আলি খানের আরেকটি চমৎকার বই পরার্থপরতার অর্থনীতি। তিনি অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রশাসন ইত্যাদির অনেক বিষয় খুব সহজ ও সুন্দর ভাবে লিখেছেন বইগুলিতে।
অর্থনীতির আধুনিক বইগুলি, বিশেষত বিহেভিওরাল ইকোনমিক্সের বইগুলির সাথে যাদের পরিচয় আছে তাদের জন্য আকবর আলি খানের বইগুলি হতে পারে আকর্ষনীয়। রকমারি ডট কম থেকে তার বইগুলি কেনা সম্ভব।
সম্প্রতি প্রথম আলো পত্রিকার সহকারী সম্পাদক মশিউল আলম আকবর আলি খানের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ন সাক্ষাৎকার, প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোতে ১ জানুয়ারী, ২০১৮ সালে তথা এই বছরের প্রথম দিনে।
বাংলাদেশের বড় সমস্যাগুলি কী কী তা এই সাক্ষাৎকারে এসেছে, এবং এর থেকে আমাদের দেশের ভবিষ্যত কী হতে পারে সে সম্পর্কেও ধারণা নিতে পারে পাঠক
এই সাক্ষাৎকার থেকে দুইটি বিশেষ পয়েন্ট আমি এই লেখায় তুলে ধরছি।
প্রশাসনে সমস্যাঃ ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া প্রশাসনিক ভিত্তির উপরই আমাদের প্রশাসন
এটাকে বড় সমস্যা হিসেবে দেখেছেন মিস্টার খান। তার মতে, “আসলে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলই এ দেশের প্রশাসনিক সমস্যা বুঝতে পারেনি। ব্রিটিশরা বাংলাদেশে যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল সেটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অনুপযুক্ত। আমাদের উচিত ছিল সেটাকে নতুন করে ঢেলে সাজানো, কিন্তু তা না করে ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া ব্যবস্থায় অল্পস্বল্প পরিবর্তন করে, সেটা অভিযোজন করে আমরা চালাতে গিয়েছি। এটা এভাবে চালানো সম্ভব নয়। শুধু তা-ই না, ব্রিটিশরা যে ধ্যানধারণার ওপরে কাজ করেছিল, সেসব ধ্যানধারণা থেকে এক শ বছর আগে যেসব কাজ করা হতো আমরা সেসব কাজ এখন করছি।”
তার এই কথা ঠিক ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এর সত্যতাও মিলেছে। এ নিয়ে এই ব্লগে যে কারণে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় না লেখাটিতে উল্লেখ করেছিলাম। উন্নয়ন বলতে অবশ্য কেবল আমি জিডিপি কেন্দ্রিক উন্নয়ন বুঝাই নি, প্রশাসনিক উন্নয়নও বুঝিয়েছি।
এখানে পয়েন্ট ছিল যে, যেসব দেশে মৃত্যুহার বেশী ছিল সেসব দেশে ব্রিটিশরা ভালো প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে নি। তারা ঐসব দেশে স্থায়ী নিবাস গড়তে চায় নি। তাই এই প্রশাসনে অনেক ফাক ফোকড় ছিল। পরে ব্রিটিশরা চলে যাবার পর এই বাজে প্রশাসনিক ব্যবস্থার উপরই যখন এইসব দেশ তাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা তৈরী করেছে তখন প্রশাসনে প্রচুর দূর্বলতা রয়ে গেছে।
আমাদের পোষাক শিল্প যেভাবে ধ্বংস হবে
ইউরোপ আমেরিকা আমাদের এখান থেকে পোষাক বানিয়ে নিয়ে যায়। এই তৈরী পোষাক খাত আমাদের অর্থনীতির তিন প্রধান পা এর একটি। মিস্টার খান তার সাক্ষাৎকারে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকদের কষ্টার্জিত রেমিটেন্স, তৈরী পোষাক খাত এবং বাংলাদেশের কৃষকদের বলেছেন বাংলাদেশের অর্থনীতির নিয়ন্তা। তার মতে,
৭৫ ভাগ অবদান এই তিনটি গোষ্ঠীর আর ২৫ ভাগ অবদান সরকারের।
এই তিন গোষ্ঠির মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স কমে যেতে পারে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক পালাবদল জনিত সংঘাত জন্ম নিলে। সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের তৎপরতা, বা ইরানের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ খারাপ ইংগিতই দেয়। এর ফলে ধ্বস নামতে পারে গৃহায়ণ খাতে, কমতে পারে দেশী শিল্প পণ্যের চাহিদা যারা ইনভেস্টর আছেন তারা ব্যাপারটি মাথায় রাখতে পারেন।
কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পান না, মধ্যস্বত্ত্বভোগীরাই লাভবান হয়, তা বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সমস্যা। এটি সমাধান না করার ফলে কৃষিতে লোকেরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। ভবিষ্যতে এমন অবস্থা চলতে থাকলে বানলাদেশের অর্থনীতির জন্য তা আশংকার বিষয়।
আর তৈরী পোষাক শিল্পের ক্ষেত্রে বিদেশীরা এখান থেকে পোষাক বানায় কম মজুরীর জন্য এটা হিসাবে রাখতে হবে। এই খাত থেকে আয় নির্ভর করছে বৈদেশিক বাজারের উপর। এই খাতে বাংলাদেশের জন্য বিপদজনক হলো পৃথিবীর আধুনিক প্রযুক্তিগত উন্নয়ন তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স জনিত অটোমেশন প্রযুক্তির আবির্ভাব।
মিস্টার খান তার মতো করে বলেন,
আর পোশাকশিল্প মূলত বৈদেশিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল; কিন্তু পোশাকশিল্পের একটা বড় সংকট অদূর ভবিষ্যতে আসবে। সেটা হলো পোশাকশিল্পে কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক সস্তায় নিজেদের মাপ অনুসারে পোশাক তৈরি করা সম্ভব। ইংরেজিতে এটাকে বলে ‘কাস্টোমাইজড ড্রেস’। এখন যে ধরনের পোশাক আমরা বিদেশে পাঠাচ্ছি, সেগুলো কতকগুলো বড় মাপের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়, যেগুলো সবার গায়ে লাগে না। সবার গায়ে লাগে এমন পোশাক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে উন্নত দেশে তৈরি করা সম্ভব। এর ফলে পোশাক খাতে যাঁরা বিদেশে কারিগরি পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করতে পারবেন না, তাঁরা বিপদের সামনে পড়বেন।
এ নিয়ে এই ব্লগে লিখেছিলাম বাংলাদেশের তৈরী পোষাক শিল্প যেভাবে ধ্বংস হবে লেখাটি। এই লেখাটি উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে কীভাবে ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবের ফলে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিন শিল্প ধ্বংস হয়েছিল। এছাড়াও এ পর্যন্ত যতো প্রযুক্তিগত বিপ্লব হয়েছে তার ফল অল্প কিছু লোকেরাই কুক্ষিগত করতে পেরেছে এবং বাকীরা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ। স্টিফেন হকিং এর মতো বড় বিজ্ঞানীও মনে করেন যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের এই বিপ্লবে অল্প লোকের এই লাভ কুক্ষিগত করার ক্ষমতা হবে আরো ভয়াবহ।
মেশিন যখন দক্ষভাবে ও স্বল্প খরচে পন্য বানাতে পারবে তখন কে বেশী খরচ করে মানুষের দ্বারা পোষাক তৈরী করাতে আসবে?
কেউ কেউ বলতে পারেন এমন হবে না। তারা চোখ কান বন্ধ রেখে এমন বলতেই পারেন। কিন্তু এই আশংকা অবশ্যই বড়সড় ভাবেই থাকবে। আগামী পাঁচ সাত বছরের মধ্যেই এর প্রভাব পড়তে শুরু করবে।