সাইন্স ফিকশনঃ কৌতুহল

এই ‘বুদ্ধিমান’ প্রজাতিটি নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। বুদ্ধিমান এদের বলা যায় কি? আমাদের এখানে কেউ বলে না অবশ্য, বরং এদের নাম নির্বুদ্ধিতার সমার্থক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে এখানে। কিন্তু কেন যেন আমি এদের ব্যাপারে প্রচণ্ড কৌতূহল অনুভব করি। সেই অনেকদিন আগে থেকে, যখন আমি ছোট ছিলাম, আর আমাদের এখানে উৎসব হলে এই প্রজাতিটির নানা বুদ্ধিহীন আচরণ নিয়ে মজা করা হতো।

তখন আমি মহাবিশ্বের অন্যান্য বুদ্ধিমান প্রাণী সম্পর্কে খুবই কম জানতাম। কিন্তু পরবর্তীতে যখন এ নিয়ে রিসার্চ করা শুরু করলাম, তখন এ বিষয়ে জ্ঞান বাড়ল। আর আমি ঠিক কী কারণে জানি না, এই অদ্ভুত প্রজাতিটি সম্পর্কেই বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। এদের নিয়েই আমি কাজ করেছি আমার জীবনের বেশিরভাগ সময়।

আমাদের গ্রহের বাইরে মহাবিশ্বের অন্যত্র বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব নিয়ে যে রিসার্চ একাডেমী রয়েছে, রু-ই, সেটি আমাদের গ্রহ নিরাপত্তা ইউনিটের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন ও গোপন একটি অংশ। প্রতিনিয়ত আমাদের সবচাইতে প্রতিভাবান বিজ্ঞানীরা, গবেষকেরা এই ইউনিটে কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের টিকে থাকা নির্ভর করছে এই একাডেমীর কাজের সফলতার উপরে এটা আমরা ভালোভাবেই জানি।

রু-ই এর আজ গোপন এক জরুরী মিটিং ডাকা হয়েছে। আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সরাসরি একাডেমীর চেয়ারম্যানের কাছ থেকে। আমন্ত্রণ পত্র দেখেই আমার সন্দেহ হলো আসলে কী নিয়ে আলাপ হবে।

এমনিতে রু-ই এর ত্রৈমাসিক মিটিং হয়। সেখানে খুব গুরুত্বপূর্ন ভাবে আমি উপস্থিত থাকি সব সময় এটা আমি কখনোই বলব না। কারণ আমি যাদের নিয়ে কাজ করছি, একাডেমীর হিসাবে এরা চূড়ান্ত গর্দভ অস্তিত্ব। ফলত, অন্যান্য বুদ্ধিমান অস্তিত্বদের নিয়ে কাজ করা গবেষকেরা বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। এটা স্বাভাবিক বলেই আমি মনে করি, ও সব সময় স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছি।

আমি যে এদের নিয়ে কাজ শুরু করি এতে অনেকেই নাখোশ হয়েছিলেন। পরিবারের লোকজনের কথা বাদ দেই। আমার একজন প্রিয় অধ্যাপক বলেছিলেন, তোমার মত ব্রাইট ছেলে এদের নিয়ে কী কাজ করবে? এদের নিয়ে কাজ করার মত কিছু নেই। এদের প্রায় সব কিছুই আমরা জানি। এরা কখনো আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। এদের নিয়ে কাজ করে তাই কোন লাভ নেই। তুমি চাইলে আরো গুরুত্বপূর্ন জিনিস নিয়ে কাজ করতে পারো।

অনেকে বুঝিয়েছিলেন আমাকে। কিন্তু আমি সম্পূর্ন ভিন্ন আঙ্গিকে বুঝার চেষ্টা করেছি। এদের নিয়ে আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছে এদের নির্বুদ্ধিতার জন্যই। বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আমাদের যে রিসার্চ লব্ধ জ্ঞান আছে তাতে আমি বুঝতে পেরেছিলাম মহাবিশ্বের বুদ্ধিমান প্রাণী যারাই আছে, গড় বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে তাদের একদল খুব এগিয়ে এবং একদল খুব পিছিয়ে এমন কখনোই নয়। এমনকি আমার গবেষণার বিষয় যে প্রজাতি, তাদের গড় বুদ্ধিমত্তা আমাদের গড় বুদ্ধিমত্তার চাইতে যে খুব কম এটা আমি মনে করি না। কিন্তু তবুও কেন তারা এমন বোকার মত আচরণ করছে, এটাই ছিল আমার আগ্রহের জায়গা। এটা জানতেই আমি কাজ করে গেছি।

রু-ই এর মিটিং এ সিনিয়র সব বিজ্ঞানীরা উপস্থিত হয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট এর বক্তব্যের আগে একটা স্বয়ংক্রিয় ব্রিফিং এলো যান্ত্রিক কণ্ঠে।

সেটি জানাল, আমি যা আশংকা করেছিলাম সেটাই। ঐ গ্রহ থেকে আবার কিছু রেডিও সিগনাল এসেছে। এবার তারা তাদের আরো কিছু তথ্য ছড়িয়ে দিয়েছে।

ব্রিফিং এর পর চেয়ারম্যান আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আপনি তো এদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন। এবার বলুন কী করা যায়? এরা এমন করছে কেন?

আমি বললাম, কৌতূহল থেকে আমার মনে হয়।

কৌতূহল থেকে? কেবলমাত্র কৌতূহল?

আমার তাই মনে হয়।

কিন্তু এটি কীভাবে সম্ভব তাই আমাদের মাথায় ঢুকছে না। তারা কি বুঝতে পারছে না এটি বিপদজনক?

কৌতূহল যখন বেশি হয় তখন বিপদের ভয় থাকে না।

এখন আমরা কী করব, আপনি আমাদের পরামর্শ দিন?

আমি বুঝতে পারছি না। তবে আমি পরামর্শ দিব এমন কিছু যাতে করা না হয় যাতে ওদের ক্ষতি হয়।

আমাদের নিরাপত্তার ব্যাপারটি কি আমরা ভাবব না?

আমি বিশ্বাস করি ওরা আমাদের নিরাপত্তার জন্য কখনো হুমকি না।

এটা আপনি কেবল মনে করেন। মনে করা দিয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয় না। হতে পারে এদের এইসব সিগনালের অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে। এরা হয়ত আমাদের ক্ষতিই করতে চায়। কেউ এইভাবে দুঃসাহসিক কাজ করতে থাকলে বুঝতে হবে এক সে বোকা, দুই, সে সব জেনে বুঝেই করছে কারণ নিজেকে রক্ষা করার কায়দা তার জানা আছে। হয়ত এরা এমন কোন প্রযুক্তি বের করেছে যার কথা আমরা জানি না।

এমন কখনো হবে না। এদের সব তথ্যই আমাদের সার্ভারে আছে। প্রতিনিয়ত আপডেট হচ্ছে। যেহেতু এরা কোন সিগনালই লুকানোর চেষ্টা করে না, এমনকি এমন কোন নিরাপত্তা ইউনিটি ওদের নেই, তাই ওদের প্রায় সব কিছুই আমরা জানি। আমি নির্ধিদ্বায় বলতে পারি এরা আমাদের ক্ষতি করবে না।

আপনি দীর্ঘদিন এদের নিয়ে কাজ করেছেন। আপনার এদের প্রতি মায়া জন্মে গেছে। হতে পারে এটাও ওদের কৌশল। এই বিশাল মহাবিশ্বে কাউকে আমরা বিশ্বাস করতে পারি না – এই কথাই আমাদের নিরাপত্তার মূল সূত্র ভুলে যাবেন না।

আমি ভুলে যাই নি।

তাহলে আমাদের বাস্তবসম্মত পরামর্শ দিন। একজন বিজ্ঞানী হিসেবে নিরাপত্তার কাজে অবদান রাখতে আপনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

আমি আমার প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে যাই নি কখনো।

তাহলে বলুন আমরা কী করব। যখন কোন জিনিশ আমাদের জন্য ক্ষতিকর কি না এ বিষয়ে ফিফটি ফিফটি সম্ভাবনা থাকে, তখন নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের স্টেপ নিতেই হবে। এত বড় একটা জায়গা আমরা ছেড়ে গেলে হয়ত আমাদের সভ্যতাকে অনিরাপদ করে তুলবে। এমন একটি সিদ্ধান্ত হতে পারে আত্মঘাতী।

আমি সব বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি আসলে এ বিষয়ে আর কিছুই বলতে পারছি না।

এইরূপ কথাবার্তা হলো আমার চেয়ারম্যানের সাথে, সর্বসমক্ষেই। তিনি জানালেন নিরাপত্তা ইউনিটের মূল সদস্যদের নিয়ে আলোচনা হবে। এরপর যে সিদ্ধান্ত হয় তা নিয়ে আবার বসবেন বিজ্ঞানীদের সাথে।

আমি আঁচ করতে পারছিলাম কী হতে চলেছে।

এই প্রজাতিটি, যাদের নিয়ে আমি কাজ করছি, তাদের আমি নিজেই যে একশভাগ বুঝতে পেরেছি তা কখনো বলি না। তাই চেয়ারম্যান বা অন্যান্যদের আশংকাকে একেবারে ভুয়া বলে উড়িয়ে দিতে পারি না।

ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় প্রজাতিটি খুবই কৌতূহলী। ওদের মিথের গল্পগুলিতে রয়েছে কৌতূহলের জয়গান। ওদের সভ্যতাই দাঁড়িয়ে আছে কৌতূহলের উপরে। নিছক কৌতূহলের জন্যই এরা এমন ভয়ংকর কাজ করে চলেছে, এটা আমার মনে হয়। আমি আমার গবেষণা প্রবন্ধগুলিতে ওদের মিথের গল্প, ধর্ম বিশ্বাস ইত্যাদি সামনে এনে দেখিয়েছি ওরা কৌতূহলের কারণেই এমন করে আসছে।

চেয়ারম্যানের সাথে নিরাপত্তা টিমের মূল সদস্যদের মিটিং হলো। এরপর চেয়ারম্যান আবার বসলেন আমাদের নিয়ে। তিনি বললেন, এবার সিদ্ধান্ত হয়েছে আমরা মেজর স্টেপ নিব।

বলে তিনি হালকা থেমে আমার দিকে তাকালেন। সারা কক্ষে নীরবতা।

আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। আমার আশংকা সত্যি বলে প্রমাণিত হলো।

চেয়ারম্যান বললেন, এদের সিগনাল আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সিগনাল আমাদের রাডারে ধরা পড়েছে, অতএব আমরাও এদের কাছে বা অন্যান্যদের কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়তে পারি। আর এভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়া মানে বিপদ। যেকোন সময় নেমে আসতে পারে আঘাত।

যেই গ্যালাক্সি থেকে ওরা আমাদের সিগনাল পাঠাচ্ছে ঐ গ্যালাক্সিতেই আমাদের হিসাব মতে ১০০ বিলিয়নের বেশি স্টার রয়েছে। সেইসব স্টার ঘিরে রয়েছে গ্রহরা। এদের মধ্যে প্রচুর প্রচুর গ্রহে বুদ্ধিমান অস্তিত্ব বিদ্যমান, তার সরাসরি প্রমাণ রয়েছে আমাদের কাছে।

এছাড়া বাইরের মহাবিশ্বে স্টারের সংখ্যা অগণন। বুদ্ধিমান অস্তিত্বের সংখ্যাও অগণিত। এগুলি খুবই প্রাথমিক কথাবার্তা, আপনারা সব জানেন। আমাদের নিরাপত্তার এত আয়োজন, সব এই দূর্বোধ্য প্রতিবেশীদের কাছ থেকে নিজেদের লুকিয়ে রাখার জন্য। আমাদের বিশ্বাস আমাদের প্রতিবেশীরাও এভাবে নিজেদের লুকিয়ে রাখছে নিরাপত্তার স্বার্থে। কারণ ‘যাকে আমরা চিনি না, বুঝি না, সে বিপদজনক’ – এটাই হলো নিজেদের নিরাপদ রাখার মূলকথা এই বিশাল অনন্ত মহাবিশ্বময় বাস্তবতায়।

এই গ্রহের প্রাণীরা নিজেদের সিগনাল ছড়িয়ে দিয়েছে স্বইচ্ছায়। এমন আর কেউ কখনো করে নি। আমরা জানি অন্যরাও হয়ত এই সিগনাল পেয়েছে।

এরা হতে পারে বোকা, বুঝতে পারছে না কী বিপদজনক কাজটাই না করে যাচ্ছে। অথবা খুব চালাক।

অনেক আলোচনার পর, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে এদের উপর আঘাত করব। আপনাদের মতামত হ্যাঁ এবং না ভোটের মাধ্যমে জানিয়ে দিন।

চেয়ারম্যান তার বক্তব্য শেষ করলেন।

বিজ্ঞানীরা ভোট দিচ্ছিলেন।

হ্যাঁ জয়যুক্ত হলো। একটা ভোটই পড়েছিল না তে। সেটা আমার ভোট।

থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্রে সজ্জিত আমাদের সামরিক যান ছুটল ঐ গ্রহের দিকে।

ঐসময় আমি আমার বইটা হাতে নিলাম। বইয়ের শুরু হয়েছিল ঐ গ্রহটির একটি কাহিনী দিয়ে।

ঈশ্বর যখন ওদের বানিয়েছিলেন, একজনকে, ও তার সঙ্গীকে, তাদের বলে দিয়েছিলেন একটি গাছের ফল না খেতে। কিন্তু নানা কারণে লোকটি তার কৌতূহলের কাছে পরাজিত হয়। সে ফল খেয়ে ফেলে। পরিণামে তারা প্রক্ষিপ্ত হয় ঐ গ্রহে। এইভাবে তাদের শুরু হয়েছিল বলে ঐ গ্রহের বিরাট অংশ মনে করে। কৌতূহল থেকে আসা শাস্তির মাধ্যমে তাদের শুরু হয়েছিল, শেষও হলো কৌতূহলের কারণে।