ফুকো-ফ্রয়েডঃ অন্য পৃথিবীর বিপদ

দুনিয়ার ভেতরেও অনেক দুনিয়া থাকে। যে বাস্তব পৃথিবীতে আমরা বাস করি, তার ভেতরের আরও পৃথিবী।

বাস্তব পৃথিবীকে বাইরের পৃথিবী, এবং ভেতরের পৃথিবীগুলিকে ভেতরের পৃথিবী দ্বারা বুঝিয়ে শুরু করি।

আমরা যদি বাইরের পৃথিবীকে এই ভেতরের পৃথিবীগুলি থেকে আলাদা করি, তাহলে প্রথম দেখায় আমাদের মনে হবে ভেতরের পৃথিবীগুলি আসলে বাইরের পৃথিবীর মতোই। কিন্তু একটু গভীরে গেলে আমরা দেখতে পাব তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম আছে। ভেতরের পৃথিবীগুলি বাইরের পৃথিবীর বিকৃত চিত্র, আমাদের জন্য অস্বস্থিকর, এবং ভীতিকরও কখনো কখনো।

একটি চিন্তা আমার মনে অনেক আগে আসতো, ধরা যাক একদিন কারো বাড়িতে  সে বাইরে থাকা অবস্থায় চলে এলো তার মতো দেখতে একজন লোক। তখন কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে?

বা আপনি জানতে পারলেন ঠিক আপনার মতো চেহারার একজন লোক আছে, একইরকম দেখতে, সে আপনার সব কিছু জানে, এবং আপনার সাথে প্রায়ই এসে দেখা করে। আপনি বিব্রত হন। সে আপনাকে ঝামেলায় ফেলে বা ঝামেলা থেকে উদ্ধার করতে চায়, এই দুই জিনিশই অস্বস্থিকর। মূলত, তার অস্থিত্ব, স্বাভাবিক হলেও অস্বস্থিকর।

অস্বস্থিকর কারণ সে আপনার আয়নাস্বরূপ। কিন্তু তার অস্তিত্বটি আয়নার ভেতরে নেই। আয়নার বাইরেই সে বিরাজমান। আয়নার ভেতরে থাকলে তা স্বস্থিদায়ক। যেমন আমরা যখন আয়না দেখি, এতে ভীতি উদ্রেক করে না সাধারণত। আয়নায় আমরা যা দেখি তা বাস্তবের চাইতেও বেটার। আয়নার জগত বাস্তবের জগতের একটি উন্নত রূপ, যেখানে, আমাদের মনে হয় যে, দুনিয়াবি বাস্তবতার কায় ক্লেশ ক্লান্তি নেই।

কিন্তু যখন আপনার সমরূপের ব্যক্তিটি আয়না ভেঙে বা  আয়নার জগত ছেড়ে আপনার সামনে এসে উপস্থিত হন, তখন সকল স্বস্থি হারায়। কারণ, আপনি জানেন সে আপনার সাথে একইতলে অবস্থান করছে, ও আপনি জানেন সে আপনার সকল কিছু জানে। এবং আপনার মনে হতে পারে সে আপনার ডার্ক সাইডের প্রতিনিধিত্ব করছে। করতেও পারে।

এখানে, আরও সমস্যা হলো, সে ভাবতে পারে, আপনি তার ডার্ক সাইডের প্রতিনিধিত্ব করে যাচ্ছেন।

ফলে কেউ কারো জন্য স্বস্থিজনক কিছু হবেন না।

দুনিয়ার জন্য তাই ভেতরের দুনিয়াগুলি স্বস্থিদায়ক হয় না, সব ক্ষেত্রে।

ফেইসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়াকে আমরা এরকম দুনিয়ার ভেতরের দুনিয়া হিসেবে দেখতে পারি। এবং এটা আসলে তাই।

ফেইসবুকে আমরা যে সামাজিকতা রক্ষা করি, তা প্রথম দেখায় আমাদের বাইরের জীবনের সামাজিকতাই। আমাদের এক্টিভিটি গুলি প্রাথমিক দেখায় বাইরের জীবনের সামাজিক এক্টিভিটির মতোই।

কিন্তু, গভীরে গেলে দেখা যায়, সমাজের সাথে, সামাজিক এক্টিভিটির সাথে এর অনেক পার্থক্য রয়েছে। এবং অনেক পার্থক্যই অস্বস্থিকর।

মানুষের মস্তিষ্ক যেভাবে ইভলভ হয়েছে, বনজঙ্গলের শিকার সংগ্রহ সমাজ থেকে কৃষিভিত্তিক সমাজের পরে, সে অনুযায়ী আমাদের মস্তিষ্ক সামাজিক সম্পর্ক ও এক্টিভিটির জন্য তৈরি। ফলে, নতুন পরিবর্তিত সামাজিক এক্টিভিটি যা ফেইসবুক বা  ইউটিউবে একজনকে মেইন্টেইন করে চলতে হয়, এর সাথে তাল মেলানোর জন্য তার মস্তিষ্ক ইভলভ হয় নাই।

পতিতালয় প্রায় সব সমাজেরই অংশ। এর ভেতরকার ব্যবস্থা ও জীবন যাপন বাইরের সমাজের মতোই। কিন্তু গভীরে গিয়ে দেখলে, পতিতালয়ের বাস্তবতা সমাজের জন্য অস্বস্থিকর। মানুষ যেভাবে সামাজিক হিসেবে তৈরি  হয়েছে, সেখানে পতিতালয়ের বাস্তবতায় বাস করা তার জন্য স্বস্থিদায়ক নয়। সব মানুষ পতিতালয়ের বাস্তবতায় বাস করতে পারবে না, ঐ পরিবর্তিত সম্পর্কের জন্য তার মস্তিষ্ক তৈরি হয় নাই।

বা মানসিক হাসপাতালের বাস্তবতায় সব মানুষ বাস করতে পারবে না।

এই অন্য পৃথিবীগুলি সমাজে বিদ্যমান থাকলে, আলাদাভাবে ছিল। যেমন, পতিতালয়, জাহাজ, সিমেটারি, মানসিক হাসপাতাল ইত্যাদি। কিন্তু টেকনোলজিক্যাল পরিবর্তনের কারণে এখন ইন্টারনেট প্রযুক্তিভিত্তিক সোশ্যাল দুনিয়া হয়ে পড়েছে সর্ব ব্যাপী।

অন্য পৃথিবীর এমন সর্ব ব্যাপী বিস্তার আগে হয় নি।

এখন অন্য পৃথিবীতে বাস করছে মানুষ অধিক হারে। প্রায় সবাই ফেইসবুক, ইউটিউব ব্যবহার করছে। এর সামাজিকতা করছে, এবং এলগোরিদম/ কোড ভিত্তিক নতুন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে।

আগের অন্য পৃথিবীগুলির চাইতে এই কোড ভিত্তিক অন্য পৃথিবী অনেক বেশি অদ্ভুত, বিচিত্র ও অস্বস্থিকর।

একশো, দুইশ বা তার বেশি মানুষের সাথে প্রতিদিন যোগাযোগ করার জন্য মানুষ তৈরি না।  এমনকি তার কোন সৃষ্টিশীল কাজে এত মানুষের কুইক প্রতিক্রিয়ার জন্যও সে তৈরি না। এইসব প্রতিক্রিয়া মানুষের উপর একটি প্রভাব ফেলে, এবং এটি যেহেতু সহজাত না তাই সে এর জন্য নানা সমস্যায় পড়ে।

এই কারনে দেখা যাচ্ছে, যারা ইউটিউবার হয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিল, তারা ভেবেছিল এটা তাদের ড্রিম জব, তারা মারাত্মক হতাশা-অবসাদে ভুগছে। ( লিংক )

একই জিনিস আমাদের তথাকথিত ফেইসবুক-ইউটিউব সেলিব্রেটিদের ক্ষেত্রে হচ্ছে বা হবে।

—-

দার্শনিক মিশেল ফুকোর হেটারোটোপিয়া  ও সাইকোলজিস্ট সিগমুন্ড ফ্রয়েড ডাবল বিষয়ক চিন্তার উপর ভিত্তি করে এই বিশ্লেষণ।