ভাগ্য একটা রহস্যজনক জিনিস যা আমরা বুঝি না। মানে কীভাবে এটি কাজ করে। কেন কিছু মানুষ ভাগ্যবান হয় এবং কিছু মানুষ হয় না।
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ভাগ্য নিয়ে ভেবেছে, এবং ভাগ্যকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে। এইজন্য প্রায় সকল সমাজ ও সংস্কৃতিতে ভাগ্য গণনা, ভাগ্য বদলানোর পাথর, ভালো ভাগ্য ও খারাপ ভাগ্য বিষয়ক নানা ধারণা প্রচলিত আছে। যেমন, কালো বিড়াল দেখলে কোন সংস্কৃতিতে মনে করা হয় গুড লাক। কোন সংস্কৃতিতে ব্যাড লাক। যিশুর শেষ ভোজনে ১৩ জন লোক ছিলেন তাই ১৩ সংখ্যাকে আনলাকি ধরা হয়। রাতের বেলায় কাক ডাকলে কোথাও মনে করা হয় তা দূর্ভাগ্যের সাইন। এরকম অনেক ধারণা।
ভাগ্য বা লাককে ম্যাজিক তথা যাদুবিদ্যা ঘরানার জিনিস দিয়ে বুঝার চেষ্টা হলো একটা রহস্যজনক জিনিসকে নিয়ন্ত্রণ করার ও ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা মানুষের।
ওয়ারেন বাফেট তার সাকসেসের বেশিরভাগ ক্রেডিট দেন তার ভাগ্যকে। রাইট টাইমে রাইট জায়গায় জন্মানোকে। তিনি এর নাম দিয়েছেন অভারিয়ান লটারী। আপনি একটু ভাবলেই দেখতে পাবেন, কোন সমাজে, দেশে, পরিবারে কেউ জন্ম নিয়েছে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এই লাককে প্রভাবিত করার মতো কিছু এখনো মানুষের কাছে নেই।
অন্যান্য ক্ষেত্রে, আমাদের জীবনে ভাগ্যের বড় ভূমিকা থাকলেও, যারা সফল তারা মনে করে নিজেদের পরিশ্রমেই তারা সব অর্জন করেছে। ভাগ্যের অবদান তারা স্বীকার করতে চায় না। কারণ এতে তাদের ব্যক্তি ইগো আহত হয়।
একইভাবে যারা অসফল হয়, তারা ভাগ্যকে দোষারূপ করে। নিজেদের দোষ দেখতে পায় না। কারণ নিজেদের দোষ দেখলে দায়িত্ব নিতে হবে ও ব্যক্তি ইগো আহত হবে।
ভাগ্য নিয়ে কথা বলার সময়ে এই জিনিসটা প্রথমে বলে নিয়ে শুরু করা ভালো।
ভাগ্য বিষয়ক যেসব অযৌক্তিক ধারনা প্রচলিত আছে নানা সমাজে, যেগুলিকে কুসংস্কার বলা হয় (যেটি আমি বলতে চাই না) এগুলি কাজ করে এমন কোন নজির দেখা যায় নি বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণে।
ভাগ্য কীভাবে কাজ করে এটা নিয়ে প্রায় দশ বছরের একটা রিসার্চ প্রজেক্ট ছিল। এটাতে কাজ করেছেন অধ্যাপক রিচার্ড ওয়াইজম্যান ও তার সহকারীরা। ওয়াইজম্যান তার রিসার্চে পাওয়া বিষয়গুলি নিয়ে বই লিখেছেন দ্য লাক ফ্যাক্টর। এই বইটিতে বা তাদের রিসার্চে তারা এমন সব জিনিস পেয়েছেন যেগুলি নিম্নরূপ ক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করতে পারেঃ
১। লাক কীভাবে কাজ করে তা লজিক্যালি বুঝতে সাহায্য করতে পারে।
২। কীভাবে লাকি বা ভাগ্যবান হতে পারেন আপনি, এ ব্যাপারে।
৩। কীভাবে দূর্ভাগ্যের সাথে ডিল করা যায় এ নিয়ে দিক নির্দেশনা দিতে পারে।
একটা গল্প
বারনেট হ্যালজবার্গ জুনিয়র একজন ভাগ্যবান লোক। ১৯৯৪ সালের মধ্যে তিনি জুয়েলারির চেইন শপ দেন ও তার ব্যবসা খুবই সফল হয়। বাৎসরিক আয় ছিল প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার।
একদিন তিনি নিউ ইয়র্কের প্লাজা হোটেলের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তখন শুনতে পেলেন একজন মহিলা চিৎকার করে উঠলেন “মিস্টার বাফেট” নামে।
হ্যালজবার্গ কখনো বাফেটকে সরাসরি দেখেন নি। কিন্তু পত্রিকায় পড়েছেন কোম্পানিতে বাফেটের ইনভেস্টমেন্ট করার পদ্বতি নিয়ে। হ্যালজবার্গের বয়স তখন ষাট। নিজের কোম্পানি বিক্রি করে দেবার কথা ভাবছেন। তার মনে হলো বাফেট তার কোম্পানির ব্যাপারে আগ্রহী হবেন।
তিনি এগিয়ে গেলেন। ভদ্রলোকের সাথে কথা বললেন। দেখা গেল ইনি সত্যিই ওয়ারেন বাফেট।
একবছর পরে বাফেট হ্যাজলবার্গের চেইন শপ কিনে নেন। অর্থাৎ, সেই মিটিং সাকসেসফুল হয়েছিল।
কিন্তু এর শুরু হয়েছিল লাকে। একজন মহিলার চিৎকার শুনে হ্যাজলবার্গ সুযোগটি ধরতে পেরেছিলেন।
আরো একটা রূপক গল্প
একবার এক জায়গায় বন্যা হলো। বাড়িঘর ভেসে যাচ্ছে। সাহায্যকারীরা নৌকায় করে মানুষজনকে নিয়ে আসছে আশ্রয় শিবিরে। একজন লোক তার বাড়ির ছাদে উঠে বসে রইল। নৌকা গেল তাকে আনতে। লোকটি বলল, আমি ভালো মানুষ। আল্লাহ আমাকে সাহায্য করবেন।
সে নৌকায় উঠলো না।
পরে যখন আরো পানি বাড়ল, ছাদও ডুবে যাচ্ছে তখন হেলিকপ্টারে করে লোক গেল তাকে আনতে। তখনো লোকটি উঠল না। সে বলল, আল্লাহ আমাকে সাহায্য করবেন।
হেলিকপ্টার ফিরে গেল। লোকটি মারা গেল।
মরার পরে সে আল্লাহকে জিজ্ঞেস করল, আমি ভালো লোক ছিলাম। আপনি আমাকে সাহায্য করেন নি কেন?
আল্লাহ বললেন, একবার নৌকা পাঠালাম, আরেকবার হেলিকপ্টার, আর কী করতে পারি?
দুই গল্পের মেসেজঃ
একটাই। লাকি লোকেরা সুযোগ দেখতে পান, ও কাজে লাগান। আনলাকি লোকেরা সুযোগ দেখতে পান না ও কাজে লাগাতে পারেন না।
সাইকোলজিক্যাল রিসার্চে দেখা গেছে আনলাকি লোক যারা, তারা উদ্বিগ্নতায় ভুগেন। ফলে সুযোগ তাদের সামনে দিয়ে গেলেও তারা দেখেন না।
অন্যদিকে লাকি লোকদের মেন্টাল পিস থাকে, ফলে তারা সুযোগ দেখতে পান।
সুযোগ দেখা যদি লাক হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে এটি আসলে স্কিলের মত অর্জন করা সম্ভব। উদ্বিগ্নতা কমিয়ে, বা মেন্টাল পিস অর্জনের মাধ্যমে।
ওয়াইজম্যান তার রিসার্চ থেকে দেখেছেন যে লাকি মানুষের বেসিক চারটা মূলনীতি থাকে। তারা নিজের অজান্তেই কমবেশী এটা চর্চা করেন। এবং এগুলি চর্চার মাধ্যমে যে কেউ তার লাক বাড়াতে পারবেন।
চান্স অপরচুনিটি বা সুযোগ বাড়ানো।
লাকি মানুষেরা সুযোগ দেখা, কাজে লাগানোতে দক্ষ। আপনি এই দক্ষতা অর্জন করতে পারেন।
হার্ট, স্মার্ট, গাটস এন্ড লাক বইয়ের লেখক এনথনি জ্যান লাকি এটিচিউডকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন,
প্রথমত, আপনার হিউমিলিটি থাকতে হবে। এটা শক্তভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে অনেক কিছু বাকী রয়েছে জানার।
দ্বিতীয়ত, ইন্টেলেকচুয়াল কিউরিওসিটি। আপনার কিওরিসিটি থাকতে হবে।
তৃতীয়ত, অপটিমিজম, আশাবাদ যে আপনি আরো ভালোভাবে পারবেন।
এর মাধ্যমে আপনি তৈরি করতে পারেন একটি লাকি নেটওয়ার্ক। লাকি নেটওয়ার্ক একই ধরণের আরো অনেক মানুষের সাথে অনেস্ট ও লং টার্ম সম্পর্ক। এতে আপনার লাকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ও আপনি আরো আরো একই লাকি এটিচিউডের মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারেন। সেটা আপনার কেরিয়ারে বা ব্যবসায় প্রচুর পজিটিভ প্রভাব নিয়ে আসে।
চান্স অপরচুনিটি এতে বাড়ে।
লাইফ সম্পর্কে একটা রিলাক্সড ভিউ আপনাকে মেন্টাল পিস এনে দেয় ও সুযোগ দেখতে সাহায্য করে।
লাকি মানুষেরা তাদের ইনটিউশন বা গাট ফিলিংসকে গুরুত্ব দেন। গাট ফিলিং বা ইনটিউশনের পাওয়ার বাড়াতে ক্লিয়ার থিংকিং এবং ডিস্ট্র্যাকশন এড়িয়ে চলা গুরুত্বপূর্ন।
লাকি মানুষেরা মনে করেন তারা লাকি। তারা আশা করেন সামনে ভালো জিনিস ঘটবে।
এমনকী, খারাপ জিনিস বা দূর্ভাগ্যের মধ্যেও তারা পজিটিভ কোন একটা জিনিস বের করেন।
তারা মনে করেন যে দূর্ভাগ্য লং রানে গুড লাকে পরিবর্তিত হবে। ব্যাড লাক নিয়ে হা হুতাশ তারা করেন না।
এই বেসিক চারটা মূলনীতি দেখা গেছে লাকি লোকজনের ভেতরে। এবং এই এটিচিউডই আসলে দিনশেষে তাদের লাকি করে।
চমৎকার একটা নীতি আছে, যাকে বলে লিটলউডের সূত্র। গণিতবিদ লিটলউড পরিসংখ্যানিক ভাবে মানুষের জীবনে মিরাকল ঘটার সম্ভাবনা নিয়ে সূত্রটি দেন।
সূত্রটি বলে, মিরাকলের সম্ভাবনা মিলিয়নে একটা, এবং এইজন্য মানুষের মাসে একটা মিরাকল ঘটবে।
এই মিরাকলকে আমরা গ্রেট চান্স ধরে নিতে পারি।
লিটলউডের হিসাব ছিল এমন, একজন লোক যতক্ষণ সজাগ ও সচেতন থাকে ততক্ষণ সেকেন্ডে একটা করে ইভেন্ট প্রত্যক্ষ করবে। সে ৮ ঘন্টা জাগ্রত থাকবে ধরে নিয়েছেন লিটলউড। সুতরাং ৩৫ দিনে হবে ১ মিলিয়ন ইভেন্ট।
স্ট্যাটিস্টিক্যাল পয়েন্ট হলো এখানে বিশাল বড় সংখ্যার নিয়ম। যখন স্যাম্পল সাইজ অনেক বড় হয় তখন যেকোন ধরণের অস্বাভাবিক জিনিস ঘটে যেতে পারে। এই মূলনীতি অন্যান্য ফিল্ডেও প্রযোজ্য। এজন্য অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে, যেসব নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ইস্যু হয়, তা বড় সংখ্যার নিয়মে ফেলে দেখতে হবে। প্রচুর প্রচুর ইভেন্টের মধ্যে হিসাব করলে এদের ঘটমানতাকে তেমন অস্বাভাবিক মনে হবে না।
লিটলউডের ল খুবই কৌতুহলউদ্দীপক। কারণ এই সময়ে আমাদের ইভেন্ট প্রত্যক্ষ করা অনেক বেড়ে গেছে ইন্টারনেটের কারণে। ফলে বেড়ে গেছে মিরাকলের সম্ভাবনাও।
অতএব,
হাম্বল থাকা, ওপেন থাকা জানার ক্ষেত্রে, উইথ জেনুইন কিওরিওসিটি, এবং ঘটতে থাকা মিরাকলের ব্যাপারে চোখ কান খোলা রাখাই লাকি হবার শর্ত। উই মাস্ট বিলিভ ইন ম্যাজিক।