শহরের উপকন্ঠে অবস্থিত নদীটি ছিল প্রমত্তা। তার বিপুল জলরাশি এবং শক্তিশালী স্রোত প্রাচীনকালে কত যে প্রানহানি ঘটিয়েছে তার কোন লেখাজোকা নেই। কিন্তু এখন আধুনিক সময়। নদীটির তেজ কমে এসেছে যেন। অথবা অত্যাধুনিক সব নৌযানের সাথে সে পেরে উঠছে না।
লোকজন নদীপথেই ওপারে যায়। ওপারে শহর, এপারেও শহর। মাঝখানে নদী। এক পার থেকে আরেক পার দেখা যায় না। এতই বিশাল। এর উপর দিয়ে একটি সেতু নির্মানের কথাবার্তা চলছে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে। কিন্তু প্রকল্পটি মারাত্বক ব্যয়বহুল এবং নদীর এমন অবস্থা যে এতে সেতু নির্মান খুব একটা সহজ ব্যাপার হবে না বলে অভিমত দিয়েছেন দেশ বিদেশের ইঞ্জিনিয়ারেরা।
তবে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তেমন কোন বড় অসুবিধা হচ্ছে না সেতু না থাকায়। শহরের দু পাশ-ই প্রাচূর্য ও প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ন বলা যায়। নদীর ঘাটে অত্যাধুনিক সব নৌযান। নগরবাসীরা এসব নৌযানে করে নদী পারাপার হয়। গত বিশ ত্রিশ বছরের মধ্যে কোন নৌ দূর্ঘটনা হয় নি।
কিন্তু তবুও এই নদীর ঘাটে পুলিশ অফিসার অতুল কুমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছেন গত এক সপ্তাহ ধরে। সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ে নি। কিন্তু তিনি আশ্বস্ত হতে পারছেন না। তার মনে হচ্ছে এই নদীতেই কিছু একটা ঘটে চলেছে যার সাথে নগর সংস্লিষ্ট সামগ্রীক কিছু অস্বাভাবিকতার নিগুঢ় সম্পর্ক বিদ্যমান।
বড় বড় অত্যাধুনিক নৌযানগুলোতে সব সময়েই পুলিশি নজরদারি জারি রাখা হয়। কারণ এগুলো মাদক চোরাচালান করে। ছোট ছোট ট্যাবলেট। নাম ইয়াবা। শহরের কিছু বিত্তশালীর ছেলেমেয়েকে একবার এসব ট্যাবলেট খেয়ে রানীক্ষেত মুরগীর মত ঝিমাতে দেখা গিয়েছিল। সেবারই প্রথম মিডিয়া ও পুলিশের নজরে আসে বস্তুটি। তার পর থেকে এর উপর চলছে সাড়াশি অভিযান। বিত্তবানদের ছেলেমেয়ের ব্যাপারে রাষ্ট্র খুব সচেতন।
অতুল কুমারের টার্গেট এরকম মাদক চোরাচালানের নৌকাগুলোই। এগুলোতেই নিশ্চয়ই ঘটে চলেছে সেই ভয়াবহ ঘটনা। যা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট নিপুন কৌশলে গোপন করে রেখেছে নগরবাসীর কাছ থেকে। নগরবাসী পুরো ব্যাপারটা জানতে পারলে কী হবে চিন্তা করেই আৎঁকে উঠেন অতুল কুমার। নিশ্চয়ই এরা প্রতিবাদে ফেটে পড়বে, ভাঙ্গচুর করবে, আমরন অনশনে নামবে নিরাপত্তার দাবীতে। আর তখন পাহাড় সমান চাপ নেমে আসবে পুলিশ ডিপার্টমেন্টে। রাষ্ট্র চাপ দিবে, ইন্টারন্যাশনাল চাপ আসবে। আর মোটকথা অপরাধী সতর্ক হয়ে সরে পড়বে। জানা যাবে না এইসব হত্যা বা গুমের মোটিভ। ধরা যাবে না অপরাধীদের।
তবে স্বস্তির ব্যাপার হল নগরবাসী কিছুই জানে না। অতুল কুমার সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছাড়লেন। ঘড়ি দেখলেন। বাজে রাত দুইটা ত্রিশ মিনিট। অতুল কুমারের পরনে সাধারণ পোশাক। তাই পুলিশের লোক বলে কেউ তাকে সন্দেহ করছে না।
তিনি সিগারেট হাতে একটি মাঝারি মটরচালিত নৌযানের দিকে তাকিয়ে আছেন। সেখানে একটু আগে ছোট একটা হাতাহাতি হয়েছে দুজন লোকের। পরবর্তীতে নৌযানের ভেতর থেকে তিন চারজন লোক এসে ঝামেলা মিটিয়ে এদের ভেতরে নিয়ে গেছে। নৌযানটি স্টিমারের মত, কিন্তু অনেক আধুনিক প্রযুক্তি এতে ব্যবহার করা হয়েছে। সামনের দিকে এর নাম জ্বলজ্বল করছে। কীর্তনখোলা।
নৌযানটি ছাড়বে মনে হচ্ছে। দুজন লোক ফিস ফিস করে কী যেন বলছিল বাইরের দিকে এক কোনে। অতুল কুমারের সন্দেহ দানা বেঁধে উঠল। ঘাটে এই মুহুর্তে খুব বেশি নৌকা নেই। তিনি একটু এগিয়ে যাবেন ঠিক করেছেন এমন সময় বিকট গানের চিৎকারে থমকে দাঁড়ালেন।
“চরণ ছেড়ো না গো, ছেড়ো না
নিতাই কাউরে ফেলে যাবে না”
গান আসছে তার পিছন দিকটা থেকে। অতুলবাবু বিরক্ত হয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখলেন এক লোক পুরনো আমলের এক কাঠের ছোট ইঞ্জিন নৌকায় বসে গান গাচ্ছে। লোকটি বৃদ্ধ। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। চুল কোকড়া, উষ্কখুষ্ক ও লম্বা।
অতুল বাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, গান থামাও মিয়া। এইটা গান গাওয়ার টাইম?
লোকটা আকস্মিক ধমকে গান থামিয়ে দিল।
অতুল বাবু ফিরে আগের নৌকাটার দিকে তাকাতেই দেখলেন সেটা ঘাট ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
কাঠের নৌকার লোকটা বলল, স্যার, আপনি কি ঐ নৌকায় উঠতে চাইতেছেন?
অতুল কুমার বড় নৌকাটির দিকে এমন মনযোগের সাথে দেখছিলেন যে বুড়ো লোকটির কথা শুনতে পেলেন বলে মনে হলো না।
অতুল বাবু হতাশ হয়ে পড়েছিলেন নৌকা ছেড়ে দেয়ায়। কিন্তু হঠাৎ তার মাথায় এক নতুন বুদ্ধি এল। তিনি কাঠের নৌকার মাঝির কাছে গিয়ে বললেন, বুড়া মিয়া, বইয়া রইছ ক্যান? ওই পাড়ে যাইবা?
লোকটি হেসে বলল, জি স্যার। এই কামই তো করি।
“কামাই ক্যামন অয়?”
“খুবই কম স্যার। লোকে উঠতে চায় না কাঠের নৌকায়। তাই রাইতে আসি। যখন নতুন নৌকা কম থাকে। তখন একজন দুইজন পাই।”
“ঠিক আছে। আমি তোমার নৌকায় উঠুম। তোমার কাজ অইব ঐ যে নৌকা গেল ওইটারে ফলো করা। পারবা তো?”
“জি স্যার। আপনে উঠেন।”
অতুল কুমার কাঠের নৌকায় উঠলেন এবং সে নৌকায় থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে সেই সন্দেহজনক নৌকাটিকে ফলো করতে লাগলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক ফলো করেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেখতে পেলেন না। কাঠের নৌকার মাঝি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সন্দেহজনক নৌকার কাছে কাছে নৌকা নিয়ে চলেছে।
এক ঘন্টার কিছু সময় পর মাঝি জিজ্ঞেস করল, স্যার, ঐ নৌকায় কী?
অতুল বাবু বললেন, কিছু না। আর এইটা জাইনা তোমার কাম কী?
লোকটা হেসে বলল, কাম বিশেষ কিছু নাই। তয় স্যার জানতে ইচ্ছা হইল। আপনে যেইভাবে দেখতেছেন। স্যার, একটা কথা বলব?
অতুল বাবু সামনের নৌযানটির দিকে তাকিয়ে থেকেই বললেন, বলো।
লোকটা বলল, আমরা এখন নদীর মাঝখানে চইলা আসছি। আমি একটু রেস্ট নিমু।
অতুল বাবু বললেন, রেস্ট নেন। তবে বেশি না। পাঁচ মিনিট। বেশি হলে ঐ নৌকা দূরে চইলা যাবে।
লোকটা বলল, পাঁচ মিনিটেই হবে স্যার। চা খামু খালি।
অতুল বাবু এবার লোকটার দিকে ঘুরে তাকালেন। নদীতে এতক্ষণ থাকতে থাকতে তার নিজেরও চা খাওয়ার কথা মনে হয়েছিল। ঘুম ঘুম করছে কিছুটা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, চা আছে নাকী?
লোকটা গলুই থেকে নেমে ছইয়ের ভেতর গিয়ে ফ্লাস্ক বের করে বলল, জি স্যার। রাইতে নাও বাইতে হয়। চা না হইলে কি চলে। আপনে খাইবেন?
অতুল বাবু বললেন, হ্যা। দাও আমারে এক কাপ।
লোকটি দুই কাপ চা নিল। এক কাপ অতুল বাবুকে দিয়ে নিজের কাপ নিয়ে গলুই এ চলে গিয়ে গান ধরল,
চরণ ছেড়ো না গো ছেড়ো না
নিতাই কাউরে ফেলে যাবে না
ও দয়াল নিতাই কাউরে ফেলে যাবে না
অতুল বাবু চা খেতে খেতে সন্দেহজনক নৌযানটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার বিশ্বাস এই নৌযানেই মাদক সংস্লিষ্ট মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণে প্রায় রাতে সংঘটিত হয় হত্যাকান্ড। এরা মেরে লাশ এই খরস্রোতা নদীতে ফেলে দেয় ভারী কোন বস্তু বেঁধে। ফলে লাশের কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না। আর শহরে বাড়ে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সংখ্যা। গত বছর থেকে প্রতি মাসে বেড়েই চলেছে। এজন্য পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্ট প্রায় দিশেহারা। সমস্ত ব্যাপার গোপন করে চালানো হচ্ছে তদন্ত। অতুল বাবুর মনে হচ্ছে তিনি আজ রহস্য উদঘাটনের দ্বারপ্রান্তে পৌছে গেছেন।
মাঝির গান অদ্ভুত মনে হচ্ছে। ঠান্ডা বাতাস। সামনের নৌকাটিকে তার ঝাপসা মনে হতে লাগল। অতুল বাবুর হাত থেকে নৌকাতে পড়ে গেল চায়ের কাপ। তিনি ঢলে পড়লেন নৌকায়।
যে নৌযানকে তিনি অনুসরন করে এসেছিলেন তা ছুটে চলেছে। তিনি যে নৌকাটিতে ছিলেন তা দাঁড়িয়ে আছে মাঝনদীতে। মৃদু ঢেউয়ের সাথে কাঁপছে। মাঝি গান গেয়ে চলেছে “ চরণ ছেড়ো না গো ছেড়ো না…”
অতুল কুমার ঢলে পড়ার পর মাঝি ছইয়ের ভেতর গিয়ে ভারী কয়েকটি পাথর এনে শক্ত দড়ি দিয়ে অতুল কুমারের সাথে বাঁধল। এরপর ভাবলেশহীন ভাবে তার নিথর দেহ ফেলে দিল মাঝনদীতে। পাথরের ভারে অতুল কুমার খুব দ্রুত নদীতে তলিয়ে গেলেন।
মাঝি নৌকা ঘুরিয়ে পাড়ের দিকে চলল। আগের মত গান গাইতে গাইতে,
“চরণ ছেড়ো না গো, ছেড়ো না
নিতাই কাউরে ফেলে যাবে না”
—
(অনেক আগে লেখা গল্প। কোথাও প্রকাশিত হয় নি।)