স্ট্র্যাটেজি
স্ট্র্যাটেজির আসলে কোন এক সংজ্ঞা নাই। এবং স্ট্র্যাটেজি বিভিন্ন সেক্টরে বিভিন্ন ভাবে সংজ্ঞায়িত হতে পারে।
প্রথমত দরকার কিছু কোর ভ্যালু। ফাউন্ডেশনাল ভ্যালু। একজন মানুষ বা কোম্পানি এটা থেকে নড়বেন না, এরকম।
এরপর এর সাথে মিল রেখে, তার দীর্ঘকালীন লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি কিছু মূলনীতি নিলেন। এগুলির উপর ভিত্তি করেই তিনি তার কর্মপরিকল্পণা সাজাবেন, প্ল্যান করবেন, কাজ করবেন। এই মূলনীতিগুলির সমন্বিতরূপকে স্ট্র্যাটেজি বলা যায়।
যেমন, একজন মানুষের কোর ভ্যালু ধরা যাক স্বাধীনতা এবং ন্যায়পরায়ণতা।
তিনি দেখলেন স্বাধীন হতে হলে তার নলেজ দরকার, এবং ন্যায়পরায়ণ হতে গেলে তাকে ভালো এবং মন্দ, ন্যায় ও অন্যায় সম্পর্কে ইন ডেপথ জানতে হবে।
এজন্য তিনি স্ট্র্যাটেজি ঠিক করলেন, লাইফলং লার্নিং।
আর এই লাইফলং লার্নিং এর জন্য তিনি কিছু প্ল্যান-পরিকল্পণা করলেন নানা সময়ে।
স্ট্র্যাটেজির উদাহরণ
স্কলার, ও ট্রেডার নাসিম তালেবের ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজির নাম তিনি দিয়েছেন বারবেল স্ট্র্যাটেজি।
নাসিম তালেবের পুরা ইন্টেলেকচুয়াল জার্নি বুঝতে হলে তার ফ্র্যাজাইল, রোবাস্ট এবং এন্টি-ফ্র্যাজাইলের কনসেপ্ট বুঝতে হবে।
ফ্র্যাজাইল হলো এমন জিনিস যা হাত থেকে পড়লে ভেঙে যায় এমন। অর্থাৎ কঠিন পরিস্থিতিতে সামলাতে পারে না। যেমন, কাচের কাপ।
রোবাস্ট হলো এমন জিনিস যা কঠিন পরিস্থিতিতে ভাঙে না। কিন্তু কঠিন পরিস্থিতি থেকে সুবিধাও নিতে পারে না। যেমন স্টিলের কাপ।
আর এন্টি-ফ্র্যাজাইল হলো এমন জিনিস যা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়লে শক্তিশালী হয়ে উঠে। যেমন ক্যাপিটালিজম বা মার্কেট ইকনোমি। এখানে ধরা যাক কোন একটি কোম্পানির ব্যাংকরাপটসি হয়েছে। এটা মার্কেট ইকোনমির জন্য খারাপ না। এর মাধ্যমে বাজে কোম্পানি বাতিল হয় এবং ভালো কোম্পানির জন্য মেসেজ থাকে। এছাড়া প্রাকৃতিক অনেক সিস্টেম, যেমন হিউমেন বডি, এন্টিফ্রাজাইল। মাসলকে স্ট্রেস দিলে তা শক্তিশালী হয়ে উঠে।
ইনভেস্টিং এর ক্ষেত্রে, এমন কোন ইনভেস্টমেন্ট, যেখানে ঝুঁকিও আছে, কিন্তু এর তুলনায় রিটার্ন অনেক অনেক বেশি, এমন হলে তা এন্টি ফ্র্যাজাইল। যেমন সিকোয়া ক্যাপিটাল হোয়াটস আপে শুরুতে ইনভেস্ট করেছিল ৬০ মিলিয়ন ডলার। পরে ফেইসবুক হোয়াটস আপ কিনে নিলে সিকোয়া ক্যাপিটাল পায় তিন বিলিয়ন ডলার।
তালেবের বারবেল স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী আপনার ইনভেস্টমেন্ট পোর্টফোলিওতে ৯০% রাখবেন রোবাস্ট ইনভেস্টমেন্ট। মানে যেগুলার রিটার্ন কম, ঝুঁকিও কম।
১০% রাখবেন উচ্চ ঝুঁকি কিন্তু অনেক অনেক বেশি রিটার্ন আছে এমন জিনিসে।
আর ০% বরাদ্দ রাখবেন ফ্র্যাজাইল তথা ঝুঁকি আছে কিন্তু রিটার্নও কম এমন জায়গায়।
সকল সময় ও পরিস্থিতির জন্য স্ট্র্যাটেজি?
মানুষ হিসেবে আমাদের সমস্যা হলো, আমরা এমন একটা স্ট্র্যাটেজি চাই যা সকল সময়, সব পরিস্থিতিতে সেরা ফল নিয়ে আসবে। এইজন্য আমরা একটা অব্যর্থ স্ট্র্যাটেজি খুঁজি আর সফলদের কাছে এরকম একটা ‘হলি গ্রেইল” জিনিস পেতে চাই।
কিন্তু এটি ইর্যাশনাল, এবং মারাত্মক ভুল।
একবার একটা লোক তার ছেলের মুসলমানি করাবে। সকল কাজকর্ম সম্পন্ন, মুসলমানি করার জন্য হাজামও রেডি কিন্তু লোকটি কাজ শুরু করতে দিচ্ছে না। হাজাম এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললো, কী ব্যাপার, আপনে কাজ শুরু করতে দিতেছেন না কেন?
লোকটা, তার নাম মবারক ছিল, সে বললো, হাজাম সাহেব, কালো বিড়াল আনতে একটা লোক পাঠাইলাম, সে এখনো আসে নাই, তাই অপেক্ষা করতে হইতেছে। কালো বিড়াল পাওয়া কঠিন।
হাজাম অবাক হয়ে বলল, কালো বিড়াল কেন?
লোকটি বলল, মুসলমানি করানোর আগে ধামা দিয়ে কালো বিড়াল চাপা দিয়ে রাখতে হয়।
হাজাম জিজ্ঞেস করল, তাতে কী হয়?
লোকটি বলল, ক্ষত দ্রুত শুকায়। আমার আব্বারে এটা করতে দেখছি।
হাজাম বিরক্ত হয়ে উঠে গেল লোকটির বৃদ্ধ বাপের কাছে। আবার তার মনে এটাও ছিল যে, গোপন কিছু জানা যায় কি না, যেটা মুসলমানি করানো পেশায় কাজে লাগে। সত্যি সত্যি যদি এটা ক্ষত দ্রুত সরায় তাহলে তো কাজের জিনিস।
সে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ধামা দিয়ে কালো বিড়াল চেপে রাখার কারণ কী?
বৃদ্ধ বললেন, কারণ আছে একটা, উপকার আছে।
কী উপকার?
বৃদ্ধ এবার স্পষ্ট কিছু বলতে পারেন না।
বললেন, আমি আমার বাপরে দেখেছি এটা করতে। ক্ষত দ্রুত শুকায়।
ঘটনাক্রমে এই বৃদ্ধের বাপও বেঁচে ছিলেন। অতিশয় বৃদ্ধ হয়েছেন তিনি। নাছোড়বান্দা হাজাম তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কালো বিড়াল ধামা দিয়ে চেপে রাখার কারণ কী মুসলমানির সময়? এতে কী উপকার হয়? ক্ষত দ্রুত শুকায় নাকি?
বৃদ্ধ বললেন, আরে না! আমার ছেলের মুসলমানির সময় আমাদের পোষা কালো বিড়াল ঝামেলা করছিল। তাই ওটাকে ধামা দিয়া চাইপা রাখছিলাম।
এই গল্পে, যে জিনিসটা বুঝাতে চাইলাম, তা হলো, একই স্ট্র্যাটেজি সকল সময়, সকল পরিস্থিতিতে কাজ না করতে পারে, এবং অনেক সময় সমস্যাটি হলো এমন কোন সমাধান যা, যে সমস্যার সমাধান করতে জন্মেছিল, তার পরেও রয়ে গেছে। উপকারীতা হারিয়ে এখন নিজেই সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
এই গল্পে ধামা দিয়ে বিড়াল চাপা দেয়া এক সময়ের সমাধান ছিল। ওই সময় কাজে দিয়েছে।
কিন্তু পরবর্তীতে মানুষের প্যাটার্ন দেখে ব্যাখ্যা দেবার যে মনস্তাত্ত্বিক ভূল, এর কারণে আরো দুজন লোক একে সমাধান হিসেবে নিয়ে নিয়েছে। এবং এটি কীসের সমাধান, কীভাবে কাজ করে, এই পরিস্থিতিতে কাজ করবে কী না, করলে কীভাবে করবে, এসব নিয়ে ভাবে নি। বরং একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে কীসের জন্য এটি করা হয়। অর্থাৎ, সমাধান থেকে তারা সমস্যা বের করেছে এবং সেটির সমাধান এটি করছে ভেবে খুশি থেকেছে।
এভাবে আগের দিনের সমাধানটিই পরবর্তী দিনে সমস্যা হয়ে উঠেছে।
প্রতিদিনের জীবনে আমরা এমন অনেক জিনিসের সম্মুখীন হই। এমন অনেক স্ট্র্যাটেজির, ও সমাধানের। যেগুলি একসময় উপকারী ছিল। ওই সময়ের কোন সমস্যার সমাধান করেছিল। কিন্তু এখন কোন কাজে লাগছে না, কিন্তু আমরা মনে করছি কাজে লাগছে। সেই কাজটাও আমরা কাল্পনিক ভাবে তৈরি করছি।
ট্রেডিং এ এবং অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে মাথায় রাখা দরকার, কোন স্ট্র্যাটেজিই সকল সময়ে সকল পরিস্থিতিতে কাজ করবে, এমন সাধারণত হয় না।
স্ট্র্যাটেজি ও গাইডলাইনের ক্ষেত্রে বুঝা দরকারী যে, এগুলি কোন পরিস্থিতিতে কাজ করে ও কোন যুক্তিতে কাজ করে।
অন্ধভাবে এগুলিকে অনুসরণ করা আসলে, বেটার আউটকাম নিয়ে আসবে না।