জীবন উপদেশমালা
১। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, আমাদের অর্জিত জ্ঞান যেন আমাদের জীবনের আনন্দের পথে বাঁধা না হয়ে দাঁড়ায়।
২। মানুষের লাইফের হ্যাপিনেসের বড় অংশ শারীরিক। একজনের লাইফস্টাইল, কী তিনি খাচ্ছেন, কী দেখছেন এগুলি তার হ্যাপিনেসে প্রভাব ফেলে। যদি দেখা যায় ওয়ার ফিল্ম, বা স্যাড ফিল্ম কারো জীবনে উদ্বেগ বাড়ায়, হতাশা বাড়ায়, তাহলে সচেতনে তার এগুলি এড়িয়ে চলা বেটার। কারণ তার লাইফের উদ্বেগ হতাশা তার পুরা জীবনে, তার কাজে, তার পরিবারে প্রভাব ফেলবে।
৩। সামাজিক মাধ্যমে আলাপ আলোচনা, মতামত প্রকাশে কোন সমস্যা নেই। প্রায় সময়ই এই প্রকাশ মানুষকে আনন্দ দেয়। কিন্তু, এই আলাপ আলোচনা ক্রিটিকগুলো তার লাইফে খারাপ প্রভাব আনতে পারে। যেমন, সে দেখল একজন সাহিত্য নিয়ে একটা ফালতু কথা বলেছে। এর উত্তরে সে ক্রিটিক করার তাগিদ অনুভব করবে। এই তাগিদ অনুভব করা একটা উদ্বেগের জন্ম দেয়, বিরক্তির জন্ম দেয়। বিরক্তি থেকে ভাল কিছু হবার সম্ভাবনা কম। উপরন্তু, প্রচুর প্রচুর মানুষের ফালতু, ইল্লজিক্যাল স্টুপিড ভিউ থাকতে পারে, সবগুলাকে সংশোধনের কাল্পনিক দায়িত্ব নেয়া মানে খুবই অযৌক্তিক এক বাজে প্রেশার মাথায় নেয়া। যা লাইফের কোয়ালিটি নষ্ট করে।
৪। হার্ডের মধ্যে থেকে কখনো নিজেকে চেনা যায় না। ভীড়ের মধ্যে নিজস্ব চিন্তার জায়গা নেই। ফেসবুকের উন্মুক্ত হোমপেইজ ভীড়ের মত অবস্থা তৈরি করে। কারণ এখানে প্রতিনিয়ত নানা ধরণের কথাবার্তা আসছে। আপনে একটা চিন্তা করছেন, তা স্থির ভাবে দীর্ঘক্ষণ করতে পারবেন না কারণ অন্য আরও কন্টেন্ট সামনে চলে এসেছে, সেগুলি আরও নানা চিন্তা আপনার ভিতরে পুশ করে ডিস্ট্র্যাক্ট করে দিয়েছে। এইজন্য, একটা ভালো উপায় ফেসবুকের হোমপেইজ বন্ধ করে দেয়া।
ফেসবুক একটা লুপের মত কাজ করে। কোন একটা ইস্যুতে আমরা দেখতে চাই কে কী বলল। কারণ আমরা এই বিষয়ের কোন কিছু মিস করতে চাই না। এই ফিয়ার অব মিসিং আউটকে কেন্দ্র করেই ফেসবুকের আকর্ষক ড্রাগ, যা মানুষকে ধরে রাখে।
এই লুপ থেকে মুক্তির উপায় কোন ভাবে এই প্রতিনিয়ত আসতে থাকা মতামত ও কমেন্ট থেকে মুক্ত থাকার পথ বের করা।
আমি বলছি না সবাই ফেসবুকে বাজে মত দেন। আর আমি খালি ভালো মত দেই। ভালো মন্দের হিসাব জাজমেন্টাল না এখানে, কোনটা আমার জন্য দরকারি তা বিবেচ্য। কারণ, আমার একটা গোল আছে, মিশন আছে, যেটা সবারই থাকে বা থাকা উচিত। সেটার জন্য দরকারি যারা, সেইসব কন্টেন্ট, চিন্তা ও মানুষের কাছে আমাকে থাকতে হবে।
ফেসবুকে অবশ্যই ভালো অনেক লেখা মিলে। অনেক বুদ্ধিমান মানুষ আছেন। আমরা বিনামূল্যে তাদের লেখা পাই। কিন্তু, এর সাথে সাথে আরো অনেক জিনিশ পাই, যেগুলি আমাদের চিন্তা ও ফোকাসের জন্য ক্ষতিকর।
আপনার যদি কোন মিশন না থাকে, সচেতন গোল না থাকে তাহলে ফেসবুকে থাকা অন্যদের কন্টেন্ট আপনার মিশন ধরিয়ে দিবে। আপনে ঐ মিশনের যোদ্ধা হয়ে কাজ করবেন। একধরনের ছত্রাক (Ophiocordyceps unilateralis) আছে যেগুলি পিপড়ার দেহে প্রবেশ করে তাদের ব্রেইন নিয়ন্ত্রণ করে, তাদেরকে বাসা থেকে বের করে নিয়ে যায়। নিজ স্বার্থে প্রাণীটিকে ব্যবহার করে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, লিখিত ও অন্যান্য ধরণের কন্টেন্ট মানুষের ক্ষেত্রে একই প্রভাব ফেলে। এটা প্যাথেটিক বাস্তবতা। এই সামাজিক মাধ্যমের সময়ে তাই আমাদের ব্যক্তিগত সচেতনতা খুব দরকারী, আমরা কী চাই লাইফে, কেন চাই, এর জন্য কী করতে হবে, ইত্যাদি।
৫। আমাদের লাইফ আমরা কীভাবে লিড করব, সেটা আমাদের চয়েজের উপরে। যেমন, আমি কী পড়ব, কী ফেসবুকে লেখব, ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই অজুহাত দিতে পারি না এটা আমার ভাগ্য ছিল, বা আমি পরিস্থিতির শিকার। পরস্থিতি ম্যাটার করে, ভাগ্য ম্যাটার করে কিন্তু দিনশেষে আমাদের চয়েজই ঠিক করে দেয় আমরা এগুলিকে কীভাবে ডিল করব।
আমি ৬ ঘণ্টা নেগেটিভিটির মধ্যে থেকে নিজের লাইফে হ্যাপিনেস, স্যাটিসফেকশন আশা করতে পারি না, কারণ আমি নিজেই ৬ ঘণ্টা এর বিরুদ্ধে কাজ করে গেছি।
৬। যেখানে সমাজ আছে সেখানে স্ট্যাটাস গেইম আছে। স্ট্যাটাস হচ্ছে সামাজিক অবস্থান বিষয়ক কাল্পনিক ধারণা, যে অমুকের চাইতে আমার সামাজিক মর্যাদা বেশি ইত্যাদি। এইসব স্ট্যাটাস গেইম একটা অনস্তিত্ব। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়দের মধ্যে মানুষ এই গেইম খেলে। কে কার চাইতে বেশি টাকাওয়ালা, কার ছেলেমেয়ে পড়ালেখায় ভালো ইত্যাদি। এগুলির মাধ্যমে নিজেকে বড় ও অন্যকে ছোট করে যেতে চায়।
আমরা অনেকেই এগুলিকে ফালতু মনে করি ও এগুলি থেকে দূরে থাকি। কিন্তু আবার আমরাই সামাজিক মাধ্যমে ভিন্ন ভাবে একই গেইমের মধ্যে পড়ে যাই। কারণ সামাজিক মাধ্যম যেহেতু সমাজ, সেহেতু এখানেও স্ট্যাটাস গেইম তীব্রভাবে বিরাজ করে।
এই গেইমের মধ্যে পড়লে মানুষ অন্তঃসারশূন্য এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। যা লাইফের হ্যাপিনেস, স্যাটিসফেকশন নষ্ট করে।
৭। মানুষ মেডিটেশন করে মাইন্ডকে শান্ত করার জন্য। নিজের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। আমাদের মাথায় প্রতিনিয়ত নানা ধরণের চিন্তার উৎপত্তি হয়। এইসব চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেইনকে চিন্তাহীন রাখা, এবং এর মাধ্যমে ফোকাস বাড়ানো মেডিটেশনের একটা উদ্দেশ্য। এই জিনিশ সহজ না। অনেক সাধনায় অর্জিত হয়।
চীনা একটি প্রবাদই আছে, যে লোক একটানা তিন মিনিট মনযোগ দিয়ে কিছু ভাবতে পারে তার পৃথিবী শাসন করার ক্ষমতা আছে।
শান্ত মাইন্ড ছাড়া আমরা ফোকাস রাখতে পারব না।
ফেসবুকের উন্মুক্ত টাইমলাইন এন্টি মেডিটেশন। আপনি যে জিনিশ মেডিটেশনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে চান, সেটা ফেসবুক উলটা বাড়িয়ে দেয়। আপনাকে নতুন নতুন অহেতুক চিন্তার জিনিশ দেয়।
যদি একে মাংকি মাইন্ড বলেন, তাহলে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বান্দর আপনার মাথায় দিয়ে দেয়। ফলে মাইন্ডের শান্তি, ফোকাস এগুলি হয় বহুদূরের ব্যাপার। আপনে এই অবস্থায় যে জিনিশ আপনার কাজের, আপনার জন্য ম্যাটার করে তাতে মনোযোগ দিতে পারবেন না।
আর প্রতিদিন এই প্র্যাকটিসের ভেতর দিয়ে গেলে আপনার ফিজিওলজি, চিন্তার প্রক্রিয়া বদলে যাবে। তখন মনোযোগের স্প্যান আরো কমবে। আপনার কাজ করার ও জীবন যাপনের মূল যন্ত্রটিকে আপনে এভাবে অহেতুকভাবে ধ্বংস করেন ধীরে ধীরে।
৮। উপরে স্ট্যাটাস গেইমের কথা বলেছি। এখানে একটা প্রশ্ন করা যায়। সমাজে যদি সামাজিক মর্যাদার ধারণা না থাকে তাহলে সমাজ কীভাবে কাজ করবে? তাহলে কি সবাই সমান হয়ে যাবে?
না। সবাই সমান হয়ে যাবে না। সমাজে সবাই সমান হয় না। সম্মান মর্যাদা, শ্রদ্ধাবোধ এগুলি সমাজের জন্য দরকারি। যারা এসবের যোগ্য তারা তা পাবেন। এর জন্য প্রতিযোগিতা অর্থহীন।
তাহলে সমাজে সামাজিক সম্পর্ক কেমন হবে, সবাই সমান না হলে?
হবে, সমান্তরাল, কিন্তু সমান না। হায়ারার্কিক্যাল বা ভার্টিক্যাল হবে না।
কারণ বিদ্যা, বুদ্ধি, অর্জনে কেউ এগিয়ে থাকতে পারে। সে উপদেশ পরামর্শ দিতে পারে। তার কাজের জন্য সে সামাজিক মর্যাদা পেতে পারে। কিন্তু তার অর্থ এই দাঁড়ায় না, হায়ারার্কিতে সে উপরে অবস্থান করে। কারণ তার পরামর্শ উপদেশ ইত্যাদি অন্য মানুষ যখন গ্রহণ করবে তখন তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা, পরিস্থিতি ইত্যাদি বিবেচনা করেই করবে। আর বুদ্ধিমান ব্যক্তি যে উপদেশ পরামর্শ দেন, তা নিজের লাইফের প্রেক্ষিতেই দেন। ফলে, এখানে হায়ারার্কির জায়গা থাকে না। হায়ারার্কির জায়গা থাকত যদি দুইজনের লাইফ একই হতো।