দ্বিতীয় পাথর কেমন ক্রাইম ফিকশন?

সৈয়দ আবু মকসুদের বই, দ্বিতীয় পাথর, অবশ্যই একটি ক্রাইম ফিকশন। কিন্তু এটি কেমন ক্রাইম ফিকশন? প্রথাগত ক্রাইম ফিকশনের ক্রাইম, তার সমাধান বা ক্রাইম সংশ্লিষ্ট সংঘাত নিয়েই এই উপন্যাস কাজ করে নি কেবল। 

বইটি পড়তে গিয়ে আমার কার্ল গুস্তাব ইয়ুং এর একটা কথা মনে পড়েছে। তিনি একবার বলেছিলেন একজন সন্তানের জন্য সবচাইতে বড় বার্ডেন বা ট্রাজেডি হচ্ছে তার মা বাপের যাপন না করা জীবন। 

এটারে আমি এভাবে বুঝি, মা বাপ অনেক কিছু চান, অনেকভাবে জীবন যাপন করতে চান। হয়ত তারা ক্লাসে ফার্স্ট হতে চাইতেন, পারেন নি। হয়ত ক্রীকেটে ভালো হতে চাইতেন, পারেন নি। কেবল জিততে চাইতেন, পারেন নি। 

এই না পারা জীবনসমগ্র তারা সন্তানের উপর প্রযুক্ত করতে চান নানাভাবে। ফলে এটা এক বোঝা বা ট্র্যাজেডি হয়ে উঠে সন্তানের জীবনে। 

আবু মকসুদের বইতে প্রধান চরিত্র চারটি। দুইটি স্তরে তিনি গল্প বলে গেছেন। প্রথম স্তরে আমরা দেখতে পাই, প্রায় এই সময়কালের সমাজ। যেখানে একজন বয়স্ক পিতা, একজন বিখ্যাত পুলিশ অফিসার,  যার নাম আবু মকসুদ, তিনি তার ছেলে পিটারকে ক্রাইমের দুনিয়া থেকে ফেরাতে চান। এই স্তরে আরেক প্রধান চরিত্র পিটার, যে একজন ভালো ছেলে, কিন্তু  ঘটনাক্রমে ক্রাইমের অন্ধকারে চলে যায়। 

গল্প যত এগিয়ে যায় তত আমরা পিতা আবু মকসুদের অতীতের কাহিনী জানতে পারি। জানতে পারি কিশোর বয়স থেকেই তার অপরাধ জগতের প্রতি আগ্রহ ছিল। তিনি কয়েকবার জড়িয়ে পড়েছিলেন অপরাধ জগতের সাথে। কিন্তু তার বাবা তাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। 

পরবর্তীতেও অপরাধ জগতের প্রতি আকর্ষন তার কমে নি, বরং তীব্র হয়, আবু মকসুদ একজন ভালো পুলিশ অফিসার হন, অনেক ক্রাইম তদন্ত করেন সফলভাবে। একইসাথে এই কাজ ছিল তার নেশা ও পেশা। তার শিশুপুত্রের ব্যাপারে তিনি শুরু থেকেই কড়া ছিলেন। ছেলেকে চোখে চোখে রাখতেন। 

কিন্তু, তদন্ত করতে গিয়ে, বাজে ভাবে কিছু ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লে তার ছেলেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যায় বারেক শাফায়াৎ নামের একজন সন্ত্রাসী। ছেলেকে তিনি উদ্ধার করেছিলেন, কিন্তু সেই ঘটনা থেকেই পিটারের আগ্রহ জন্মে অপরাধ জগতের মানুষদের প্রতি। তাদের প্রতি একধরনের মোহ তার তৈরি হয়, এবং এই মোহের কারণেই ব্যাংক ডাকাতিতে অংশ নেয় সে। সেখানে তার হাতে একজন ব্যক্তি খুন হয় ঘটনাক্রমে। এরপর থেকে পিটার হয় পলাতক। আবু মকসুদ ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে চান, তখন ছেলের সাথে তার সংঘাতের শুরু। 

এই স্তরের কাহিনীর সমান্তরালে অন্য একটি কাহিনী বলে যান লেখক। পঞ্চদশ শতকের বাংলা। মুসলমান শাসন চলছে। এর মধ্যে ভাতুরিয়ার জমিদার গণেশ স্বপ্নে দেখলেন, দেবী চণ্ডী থাকে একটি লাল পাত্র দিয়ে বলছেন এটা রাজদরবারে বসিয়ে দিয়ে আয়। 

স্বপ্নের ব্যাখ্যায়, গণেশের স্ত্রী ফুলজান বলেন, দেবী বলছেন আপনি সুলতানকে সরিয়ে বাংলার ক্ষমতা দখল করুন। হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠা করুন। 

এরপর  সুলতান প্রথম আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহকে সরিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসেন ভাতুরিয়ার জমিদার রাজা গণেশ। দেশে বিশৃঙ্খলা বিরাজিত হয়। 

মুসলমানদের শাসনে বিরক্ত ছিলেন রাজা গণেশ। তার সময়ে মুসলমানদের উপর নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে, তারা গিয়ে অভিযোগ জানিয়েছে একজন পীর শেখ নুর কুতুব আলমের কাছে। লেখক আবু মকসুদ নুর কুতুব আলমের আস্তানার যে বর্ণনা দিয়েছেন, এবং লোকজনের সাথে তার কথাবার্তার যে উপস্থাপনা দেখিয়েছেন, তা মনোমুগ্ধকর। 

দ্বিতীয় এই কাহিনীতে ঐতিহাসিক ঘটনার উপরে ভিত্তি করে গল্প নির্মান করা হয়েছে। পীর নুর কুতুব জৌনপুরের সুলতান ইবরাহিম শর্কির সাথে যোগাযোগ করেন। ইবরাহিম শর্কি বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে বাংলা আক্রমণ করেন। 

এই জায়গাতে আমরা আবার রাজা গণেশের স্ত্রী ফুলজানের চরিত্র দেখতে পাই প্রবলভাবে। ফুলজান প্রখর বুদ্ধিমতী এবং কূটকৌশলে দক্ষ একজন মহিলা, ঘটনাপ্রবাহে তার প্রভাব অনেক। তিনি স্বামীকে পরামর্শ দিলেন আত্মসমর্পনের। তার যুক্তি ছিল রাজ্যের অমাত্যরা এমনিতেই রাজার উপর তুষ্ট নয়। দেশে বিশৃঙ্খলা চলছে। এমতাবস্থায় যুদ্ধ মানেই লোকক্ষয় ও পরাজয়। 

তার চাইতে কেবল পরাজয় মেনে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। 

রাজা গণেশ পরাজয় স্বীকার করলেন।

কিন্তু পীর নুর কুতুব শর্ত দিলেন, তাকে মুসলমান হতে হবে, যদি তিনি রাজ্য শাসনে থাকতে চান। 

রাজা গণেশ এতে অস্বীকৃতি জানালেন। দেবী চণ্ডীর একনিষ্ট ভক্ত তিনি, কোনমতেই তার বিশ্বাস ছাড়বেন না। কোনমতেই এদের ধর্ম বিশ্বাস নেবেন না, যাদের তিনি ঘৃণা করেন। 

এখানেও ফুলজানের বিচক্ষণতার পরিচয় দেখা যায়। 

ফুলজান পরামর্শ দেন, যেন তাদের ছেলে যদুকে তিনি ইসলাম ধর্মে দিয়ে দেন। 

উপায় না দেখে গণেশ এতে রাজী হন। 

সুলতান ইবরাহিম শর্কি এবং পীর এতে সম্মত হন। পীরের হাত ধরে ইসলাম গ্রহণ করেন যদু। তার নাম হয় জালালউদ্দিন। তাকে ইসলামি আচার শিক্ষা দেবার কারণে কিছুদিনের জন্য পীর নিজের আস্তানায় নিয়ে যান। রাজা গণেশ কথা দেন, যদু ফিরে এলে তিনি তার হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। 

একসময় যদু ফিরে আসেন। 

উপন্যাসের কাহিনী এই অংশেই বেশি বিস্তার লাভ করেছে। রাজা গণেশ তার পুত্রকে ইসলাম ধর্ম থেকে আবার নিজের ধর্মে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছেন। কারণ তার ভাবনা ছিল, ছেলে ভেতরে হিন্দু থাকবে, এবং হিন্দু হয়েই দেশ শাসন করবে। 

কিন্তু এতে রাজী হচ্ছেন না জালালউদ্দিন। ফলে, এই জায়গায় পিতাপুত্রের সংঘাত শুরু হয়। 

দুই সময়ের কাহিনী একইসাথে এগিয়েছে। দুই সময়ের কাহিনীর প্যাটার্ন একই, এক পিতা তার পুত্রকে ফেরাতে চাইছেন, এবং এই কার্যক্রমে পিতা পুত্রের মধ্যে তৈরি হচ্ছে সংঘাত। 

দুই গল্প যেভাবে লেখক একইসাথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তা সুন্দর। দুই গল্প বলার ভঙ্গিতেও পার্থক্য আছে, যা সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়াবে না। গল্প কিভাবে বলা হচ্ছে তা সাহিত্যের একটা বড় গুরুত্বের জায়গা। দেখা যায় বর্তমান সময়কালের যে গল্প সেই ক্ষেত্রে লেখক সরল ও সরাসরি বাক্য ব্যবহার করেছেন। ঘটনাগুলি লজিক্যাল ওয়েতে ডেভলাপ হয়েছে। 

অন্যদিকে ঐতিহাসিক ঘটনানির্ভর কাহিনীর ক্ষেত্রে লেখক, দীর্ঘ বাক্য ও ভারী শব্দের আশ্রয় নিয়েছেন প্রায়ই। এবং ঘটনার বর্ণনা অনেকটা পরাবাস্তব বা যাদুবাস্তবতাময়। যেমন রাজা গণেশের স্বপ্নের কথাই ধরা যাক। রাজা গণেশ তার এই স্বপ্নের কথা ভুলতে পারেন নি। তিনি প্রায়ই এই স্বপ্ন বার বার দেখতেন। লেখক এখানে আব্রাহামিক ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা টেনে এনে বলেছেন, ইবরাহীম নবী যখন স্বপ্নে দেখলেন প্রিয় বস্তু কুরবানি দেয়ার কথা, তিনি প্রথম পশু কুরবানি দিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরও তিনি বার বার একই স্বপ্ন দেখছিলেন। এই ঘটনা বর্ননা করে লেখক রায় দেন, দৈব স্বপ্ন নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করার পরেও একই স্বপ্ন বার বার দেখার অর্থ হল, হয়ত নির্দেশটি ঠিকমত পালন হয় নি, বা ব্যক্তি এটি বুঝতে পারেন নি। 

এই সন্দেহ রাজা গণেশের মধ্যেও ছিল। আমরা তাকে দ্বিধাগ্রস্থ একজন লোক হিসেবে দেখতে পাই। দ্বিধার পেছনে এই বারংবার ফিরে আসা স্বপ্নের হাত ছিল। তার মনে হতে থাকে, তিনি হয়ত দেবীর নির্দেশ ঠিকমত পালন করতে পারেন নি। এই দ্বিধার যাতনা তাকে আচরণে হিংস্র করে তোলে। 

এছাড়া পীর নুর কুতুবের আস্তানার বর্ননা দিতে গিয়ে লেখক অলৌকিক অনেক ঘটনাকে সহজভাবে বর্ননা করেছেন, যেন এগুলি ঘটেই থাকে। পীরের আস্তানা যেন দৃশ্যজগতের ভেতরের বস্তু হলেও, বাইরে অবস্থান করে। পীরের চরিত্রটিও রহস্যময়। লেখক এইসব আবহ তৈরি করেছেন যাতে এই ধারণা দেয়া যায়, এই অলৌকিকতার প্রভাবেই যদুর ভেতরে ইসলাম ধর্ম এতোই পাকাপোক্ত হয় যে, তিনি পরে তা কোনভাবেই ছাড়তে রাজী হন নি। 

ইতিহাসের উপর নির্ভর করে নির্মিত গল্প ইতিহাস না, গল্পই। ইতিহাসের উপাদান সীমিত থাকে। একজন ঐতিহাসিক লোক কীভাবে চিন্তা করেছিলেন, কোন সিদ্ধান্ত কী ভেবে নিয়েছেন, তার মানসিক গড়ন কেমন ছিল তা বুঝা কঠিন, ঐতিহাসিক নথিপত্র কম থাকলে তো অসম্ভব। 

ফলে, এই স্তরের কাহিনী বর্ণনায় লেখক যাদুবাস্তবতার আশ্রয় নিয়েছেন। 

‘দ্বিতীয় পাথর’কে এক ক্রাইম ফিকশন হিসেবে পড়া যায়। আবার এর ভেতরকার কাহিনীগুলি এবং দ্বন্দ্বগুলিও বুঝা যেতে পারে। 

প্রথম স্তরের গল্পে পুলিশ অফিসারের ছেলে ক্রাইমে যেত না, যদি না পুলিশ অফিসার ক্রাইমের প্রতি এত অবসেশনে ভুগতেন। অন্যদিকে, দ্বিতীয় স্তরের গল্পে, রাজা গণেশের পুত্র যদু মুসলিম হত না, যদি না তিনি ক্ষমতা দখল করতেন ও নির্যাতন শুরু করতেন। এবং তিনি নিজেই তার ছেলেকে ওদের হাতে তুলে দিয়েছেন, আবার এরপর ছেলেকে নিজের বিরুদ্ধে ঠেলে দিয়েছেন। 

উপন্যাসের নামটির মধ্যে এক ইংগিত আছে। দ্বিতীয় পাথর, মানে দুইজন বাপের যাপন না করা দ্বিতীয় জীবনই, যা তাদের ছেলেদের অন্য এক পথে ঠেলে দিয়েছে, ও পিতা পুত্রের সংঘাত ডেকে এনেছে।