গল্প তিন – শামশুজ্জামান নুরুর গল্প

শামশুজ্জামান নুরুর গল্প

দাদাবাবু আমি আপনার কাছে বড় আশা নিয়া আসছি। আমি জানি যে এই তল্লাটে কেবল আপনিই আছেন আমারে হেল্প করতে পারেন। আমি, আমার মনে হইছে দাদাবাবু, আমার জীবন সায়াহ্নে এসে গেছি। আমার মনে হইছে যে ওরা আমারে মাইরাই ফেলবে। আমার যাওয়ার কোন জায়গা নাই। আমি ভয়ে ভয়ে দিনাতিপাত করতেছি দাদাবাবু। আমার কিছু নাই আজ, আমার কেহ নাই। আমি আপনার কাছে আসছি বাঁচার জন্যে। আপনে কি আমারে…

  • আপনার নাম কি শামসুজ্জামান নুরু?

জি জি, আমার নাম…তবে আমার নাম শাসশুজ্জামান নুরু।

  • শামসুজ্জামান?

না না, শামশুজ্জামান। আমার পিতার নাম শামশির জাতক। আমি তার একমাত্র ছেলে শামশুজ্জামান নুরু। আপনি নিশ্চয়ই আমার কথা শুনছেন, আমি যতটুকু জানতে পারছি, ওরা আসছিল আপনার কাছে। দাদাবাবু, আপনি ওদের কথা কতটুকু বিশ্বাস করছেন আমি জানি নে, কিন্তু আমারো বলার মত অনেক কথা আছে। যেইগুলি আপনি জানতে পারলে হয়ত আমার অবস্থা বুঝতে পারবেন ও আমাকে একটা সমাধান দিতে পারবেন। সেই আশাতেই আমি…

  • আপনি আপনার কাহিনী শুরু করুন। সময় বেশি নেই।

জি, আমি, আমার পিতার নাম তো আগেই বলেছি। শামশির জাতক। তিনি ছিলেন গুরুদয়াল চৌধুরীর পিতা জনাব আখলাক চৌধুরীর একজন সাধারণ কর্মচারী। জায়গা জমির হিসাব তিনি রাখতেন। সেই সুবাধে আমার চৌধুরীদের বাড়িতে গতায়ত ছিল।

  • আচ্ছা।

আপনি নিশ্চয়ই চৌধুরীদের পুকুরের গল্প শুনেছেন। চৌধুরীদের বাড়ির সামনে বিশাল এক পুকুর ছিল। দাদাবাবু, সকল সময় সেই পুকুরে সবুজ শেওলা ভরে থাকত। আর আপনি এই কথা জানেন কি না আমি জানি না, ঐ পুকুরে কেউ নামত না ভয়ে। কারণ গুরুদয়াল চৌধুরীর মাতা জনাবা হাফেজা বেগম এক চন্দ্রগ্রস্থ রাতে নীল কাপড় পরিধান করে সেই পুকুরে ঝাঁপ দিয়াছিলেন। তিনি আর ওঠেন নাই। পরদিন সকালে সারা পুকুরে জাল টানা হইলেও তিনি উঠে আসেন নাই। এরপর চৌধুরীরা বড় বড় পাম্প আনয়ন করে পুকুর সেঁচা শুরু করেন, তিন দিন তিন রাত্র সেঁচার পরে পুকুরের তলানি দেখা যায়, কাদা কাদা। সমস্ত কাদাপানি খোজা হয়, গণ্ডায় গণ্ডায় মানুষ নামে খুঁজতে। কিন্তু হাফেজা বেগমরে পাওয়া যায় নাই। না জিন্দা না মুর্দা। সেই থেকে দাদাবাবু, ঐ ঘাটে কেহ নাহি না যায়। ভয়ে।

  • আচ্ছা।

চৌধুরীদের বাড়ির পেছনে ছিল ঘন আমবাগান। আমার কাজ ছিল সেই আম বাগানে। আমি বাগানের বৃক্ষরাজিদের দেখাশোনা করতাম। গরমের দিনে ঐ পুকুর থেকে জল আনয়ন করে বৃক্ষাদির মূলে প্রক্ষেপনের ছলে মাটিতে ফেলে দিতাম। তাদের কতটুকু বৃক্ষদের শেকড়ে পৌছাইত, তাহা আমি আজো জানি নে।

তবে আশা করি যথেষ্ট পরিমাণে জল তারা পাইত। এই কারণে পানির অভাবে কোন গাছই মারা যায় নাই আমার হিশাবে।

কিন্তু দাদাবাবু, একদিন আমি একটা আশ্চর্য ঘটনা দেখতে পাই।

  • কী ঘটনা?

গুরুদয়াল চৌধুরী নুরুন্নাহার বানুকে যেদিন বিয়া করেন, এবং নুরুন্নাহার ও জোলেখা বানু যখন চৌধুরীদের বাড়িতে আসে, এর এক সপ্তাহ পরে।

আমি দেখতে পাই একটি আম গাছের চারা শুকাইয়া মরে গেছে। খুবই আশ্চর্য এই ঘটনা। কারণ এমন কখনো হয় না।

এরপরে, আমি পরপর কয়েক সপ্তাহে এমন ঘটনা দেখতে পাই। দেখতে পাই যে, আম বাগানের গহীনের দিকে একটা গাছ, দুইটা গাছ করে মরে শুকাইয়া যাইতেছে। চারা গাছগুলা। আমি যথেষ্ট পানি দিতে শুরু করছিলাম। তাও এই দশা হইতে লাগল।

  • তারপর?

আপনারে দাদাবাবু আমি আগে বলছি আমার বাপের কথা। আমার বাপ তখন বুড়া হইছেন। বিছানা থেকে উঠতে পারেন না এমন।

সারাজীবনের অভিজ্ঞতায় তার ভেতরে অনেক জ্ঞান ছিল নানা পৃথিবীর। দৃশ্য অদৃশ্য।

তিনি যখন আমারে দেখলেন বিমর্ষ, তখন জিজ্ঞাস করলেন আমার হইছে কী। আমি তারে সবিস্তারে বললাম আম বাগানে আচানক চারা গাছগুলির মইরা শুকাইয়া যাওয়ার কথা।

বাপ আমার নিরব হইলেন। তিনি অল্প কাশলেন। তার মুখে ও কপালে আমি দেখলাম চিন্তার ছায়া। তিনি আমারে বললেন, এইটা ভালো লক্ষণ নয় হে বাছাধন, ভালো লক্ষণ নাহি হয়। এইরকম ঘটনা আগে একবার ঘটছিল যখন গুরুদয়াল চৌধুরীর মা হাফেজা বেগম অদ্ভুদ সব কার্যাবলী শুরু কইরা দিছিলেন।

আমি আমার বাপরে জিজ্ঞাস করলাম, কী সেই অদ্ভুত ঘটনা যা হাফেজা বেগম শুরু করছিলেন।

আমার বাপ কিছু বললেন না এই ব্যাপারে। তিনি খুক খুক কইরা কাশলেন। অনেক সময় নিয়া ভাবলেন। তারপর বললেন আমারে, বাপ, তুমি ঐ বাগানে আর যাইও না। আমি হিসাব কইরা দেখলাম হাফেজা বেগমের সময়ে যা হইছিল, সেইরকম আরেকটা কিছু হইবার সময়ই এখন। যারা আগমনী বার্তা দিছিল তাদের আসার সময় হইছে এখন। এইগুলা বেশ ঝামেলার। তোমার ইচ্ছা হইলে বাপধন, তুমি অন্য কোন জায়গায় যাও গিয়া। তবে আমি জোর করি না। কারণ জিন্দেগী থেকে পলানো যায় না। এবং এইসব ঘটনারাশি থেকে পলানো অসম্ভব। অনেক অনেক মহাজাগতিক হিসাবের পরে এগুলা ঘটে। এবং এইসব ঘটনার কুশীলব বৃন্দ নির্ধারিত হয় ঐ জটিল হিসাবের পরম্পরায়, সম্ভাব্যতার আচানক সব রাহস্যিক তৎপরতার দ্বারা।

আমি বাপের কথা কিছুই বুঝলাম না তেমন। যেরকম তার আরো অনেক কথা আমি বুঝতাম না। তবে তার কথা যে গুরুতর কিছু এইটা আমি বুঝতে পারছিলাম।

আর আরো বুঝতে পারলাম যেইদিন বিকালে, অন্ধকার গহীন আমবাগানে আমি দুইটা বৃহৎ ময়াল সাপরে দেখি, পরস্পর জড়াজড়ি করে তারা কামকলার চর্চা করে যাইতেছে। দেখে আমি বিস্মিত হইলাম কারণ এত বড় সর্পরা এই বাগানে কীভাবে আসলো, এবং এই অদ্ভুত কামলীলায় তারা এখানে মত্ত কেন।

তবে দাদাবাবু, আমি কিছুই আপনার কাছে লুকাব না। সেই সর্পদের কামলীলা দেখতে দেখতে, বিশ্বাস করেন দাদাবাবু, আমি জানি না কেন যেন আমার ভেতরে একটা পাশবিক শক্তির অনুভূতি আমি টের পাইতে লাগলাম। আমি টের পাইলাম আমার বাড়া মহাশয় ফুলে ফেঁপে আইফেল টাওয়ারের আকৃতি ধারণ করতে উদ্যত।

এবং একটা চুম্বকীয় আকর্ষণ যেন ঐ ময়াল সর্পদ্বয়ের লীলাখেলায়। আমি চোখ না ফেরাইয়াই রইলাম, আর হস্তমৈথুন করতে শুরু করলাম ঐ জায়গাতেই। আর যখন আমার বীর্য উর্বরা ধরনীপৃষ্টে পতিত হইল ঠিক তখনই দাদাবাবু, ময়াল সর্পদ্বয় মাথা ঘুরাইয়া আমার দিকে তাকাইল। তাদের জ্বলজ্বল চোখ।

এরপর আমি নারী কন্ঠের অদ্ভুত হর্ষপূর্ণ শব্দমালা শুনতে পাই।

আমার মাথা ঘুরাতে থাকে। জ্ঞান হারানোর আগে আমি দেখতে পাইতেছিলাম যে, ময়াল সর্পদ্বয় দুইটা রমনীতে রূপান্তরিত হয়েছেন।

দাদাবাবু আপনি নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এরা কারা? নুরুন্নাহার ও জোলেখা বানু, একেবারে খালি গাত্র, নগ্ন।

  • আচ্ছা। তারপর?

তারপর দাদাবাবু আমার বিপদের শুরু। এটা বললে মিথ্যা বলা হবে যে, উল্লিখিত দুই রমনীর নগ্ন রূপ দেখে আমি আকৃষ্ট হই নাই। কিন্তু সেই আকর্ষণ এত তীব্র ছিল না যে আমি তাদের প্রেমে পড়ে যাব।

প্রথম প্রথম কয়েকদিন গহীন আমবাগানে আমিই অপেক্ষা করতাম। তারা আসতো, এবং আমাকে আমন্ত্রণ করতো তাদের সাথে কামলীলায়।

কিন্তু, এইভাবে কিছুদিন চলার পরে একটা পর্যায়ে আমি বুঝতে পারি আমি এদের খেলার পুতুলে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছি। তাদের কথামতো আমাকে আসতেই হতো। এবং এই দুজনের মধ্যে এত সব অদ্ভুততা ছিল যে আমি এদের বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এছাড়া, গুরুদয়াল চৌধুরীর সাথে আমার ছোটকাল থেকেই ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি আমাকে ছোটভাইয়ের মত স্নেহ করতেন।

আমি চাইলাম এখান থেকে বের হতে। আমি তাদের বললাম আমার মনোবাসনার কথা। কিন্তু এই দুই নারী আমাকে বের হতে দিলো না।

আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন এর পরে কী হলো।

নুরুন্নাহার গর্ভবতী হয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বাস করুন দাদাবাবু, ঐ সন্তান আমার নয়। কারণ আমি কখনোই নুরুন্নাহারের যোনিতে আমার বাড়া দেই নাই। এইটা আপনার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হইতে পারে, কিন্তু এইটাই সত্য দাদাবাবু।

নুরুন্নাহার গর্ভবতী হবার পরে সবাইকে জানাল, এবং অত্যাশ্চর্য ব্যাপারটা হলো গুরুদয়াল চৌধুরীও একইভাবে কখনো নুরুন্নাহারের যোনিগর্তে স্বীয় বাড়া প্রবেশ করান নাই বলে জানতেন। ফলে এই বাচ্চা কার বা কীভাবে নুরুন্নাহার গর্ভবতী হলো এ নিয়ে সংশয় দেখা দেয়।

শেষতক যখব ব্যথা উঠে তখন জোনাথন সাহেবকে আনা হলো। জোনাথন সাহেব জানালেন অদ্ভুত কীসব জিনিস প্রসব করেছে নুরুন্নাহার। এই কথা জানাজানি হবার পরে জোনাথন সাহেব ওই বস্তু নিয়া উধাও হয়ে গেলেন।

আর এদিকে নুরুন্নাহার ও জোলেখা বানু আমার কাছে আসলো। আমাকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে বের হলো জোনাথন সাহেবকে খুঁজতে। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত তারা জোনাথন সাহেবকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর আমাকে কয়েদ করে রেখেছে।

  • কয়েদ করে? আপনি নিজ ইচ্ছায়…?

না না দাদাবাবু। আমার কখনো ইচ্ছা ছিল না। এরা আমাকে জোর করে রেখেছে। দাদাবাবু আপনি হয়ত জানেন ফেমডমের কথা, এরা আমার উপর এইসব করে বেড়াচ্ছে, কিন্তু এগুলিতে আমার আগ্রহ নাই। আমি তো এদের পছন্দ করি না। আমি পালাতে চাই। কিন্তু নানা ভাবে তারা আমাকে আটকে রাখছে। তারা আমাকে মেরে ফেলবে।

  • কেন মেরে ফেলবে?

দাদাবাবু, আমি তাদের অনেক কথা জানি। আমি জানি যে তারা রাতে রাতে ময়াল সাপ হয়ে যায়। আমি জানি যে একটি কাচের জারে রাখা অদ্ভুত সব রশ্মির সাহায্যে তারা কীসব কথাবার্তা বলে, এবং রাতের আধারে তখন সমস্ত রুমের ভেতরে অলৌকিক সব রঙ নেমে আসে। বিশ্বাস করেন দাদাবাবু, এইগুলা সব সত্যি কথা। আমি নিজ চোখে দেখেছি। এবং ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আপনি আমাকে বাঁচান।

  • হুম। ঠিক আছে। আমি আজ আপনাকে একটা ওষুধ দিচ্ছি। এটা রাতে খাবেন। পরবর্তী এপয়ন্টমেন্টের সময় ও তারিখ আপনাকে ফোন করে জানানো হবে।

কিন্তু দাদাবাবু আমার যে আরো অনেক কথা বাকি ছিল, জোনাথন সাহেবের সাথে আমার যে দেখা হয়েছিল, এবং ঐ বস্তুটা…

  • আজ আর না শামশুজ্জামান। অন্যদিন।

কিন্তু দাদাবাবু…

  • আজ আর নয়। এখন চলে যান। পরবর্তী এপয়ন্টমেন্টের বিষয়ে আপনাকে জানানো হবে।