সহিংসতার ভূমিকাঃ পুরুষত্ব, সম্মান ও সহিংসতা

সহিংসতা অনেক সময় পুরুষত্ব এবং তৎসংস্লিষ্ট সম্মানের সাথে জড়িত থাকত। অনেক সমাজেই পুরুষের সম্মান তার ফাইট তথা যুদ্ধ করার, অন্য পুরুষকে যুদ্ধে হারানোর উপর নির্ভর করে। এটা যেমন ইউরোপিয়ান ইতিহাসে, তেমনি আমাদের সমাজেও আছে। গ্রামাঞ্চলে ডাকাডাকির মাইরের সাথে অনেকে পরিচিত থাকবেন। এক গ্রামের বা গোষ্ঠির লোক অন্য গ্রাম বা গোষ্ঠির লোককে মাইরে ডাকলে তারা যদি না যায় তাহলে তাদের সম্মান নষ্ট হয়।

আর নারীরা ইতিহাসে যেহেতু পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচীত হতো তাই নারীর উপর আক্রমণ পুরুষের উপরই আক্রমণ হিসেবে গণ্য হতো। নারীর উপর আক্রমণের মাধ্যমে সেই নারী যে পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচীত হতো তার পুরুষত্বকে আক্রমণ করা হতো, অনেক সময় বিশেষ অঙ্গভঙ্গী বা গালির মাধ্যমে। (এমন গালি এখনো আমাদের সমাজে এবং অন্যান্য অনেক সমাজে প্রচলিত আছে।) তখন সেই পুরুষ সম্মান পুনরোদ্ধারের জন্য ডুয়েল বা ছুরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো অনেক সময়।

পুরুষের সম্মান সহিংসতার সাথে যুক্ত ছিল, এবং ১৮০০ সালের দিক থেকে ইউরোপে এ ধারনার পরিবর্তন হতে শুরু করে। তখনই কেবল পুরুষ শান্ত-ভদ্র হয়েও সম্মানজনক হতে পারে এই ধারণা প্রচলিত হতে থাকে।

এছাড়া পৃথিবীর সব জায়গাতেই মানুষের প্রতিশোধ স্পৃহা ছিল আদি কাল থেকে। এই প্রতিশোধ আকাঙ্খা ছিল অনেক সহিংসতার মূলে। অনেক সময় প্রতিশোধ নেয়াটাই ছিল সম্মান রক্ষার জন্য প্রধান। যেমন, পরিবারের একজনকে খুন করেছে বা অন্য কোন ক্ষতি করেছে অন পরিবারের একজন। প্রতিশোধ নেবার জন্য এই পরিবারের লোক অন্য পরিবারের লোককে যেকোন উপায়ে প্রতিশোধ নিতে চাইত, অনেক সময় অপ্রস্তুত আক্রমণ বা পেছন থেকে আঘাতও বাদ যেত না। কিন্তু এই ধরণের আক্রমণ শেষপর্যন্ত ন্যায় বলে গণ্য হতো না এবং অসম্মানজনক হিসেবেই পরিচিত পেত সমাজে। ফলে পুরুষত্বের সম্মানের সাথে এক ধরণের ন্যায্য আক্রমণ যুক্ত হয়, যেখানে ফাইট হবে সামনা সামনি বা আমাদের গ্রামীন কথায় ডাখাডাখির মাইর।

ইউরোপের ডুয়েল ফাইট হতো দুইজন ব্যক্তির মধ্যে। তারা আগে অস্ত্র, নিয়ম নীতি বিষয়ে একমত হতেন ও রীতি মেনে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন। এই যুদ্ধ হতো সম্মান পুনরোদ্ধার বা প্রতিষ্ঠার জন্য।

ছুরি দিয়ে এ ধরণের ফাইট খুবই জনপ্রিয় ছিল সমগ্র ইউরোপে আধুনিক যুগের শুরুতে। ১৯ শতক পর্যন্ত এটি চলে। সাধারণ ওয়ার্কিং ক্লাস লোকজনের মধ্যে ছুরি দিয়ে ফাইট বেশী প্রচলিত ছিল।

কিছু জায়গায়, বিশেষত ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে ওয়ার্কিং ক্লাস লোকদের মধ্যে খালি হাতে ফাইট জনপ্রিয়তা পায়। উনিশ শতকের শুরুর দিকে ইংল্যান্ডে নিম্ন বিত্ত লোকদের ফাইটে ছুরির ব্যবহার বন্ধ হতে খালি হাতে ফাইট শুরু হয়। তারা মনে করতো কোন ধরণের অস্ত্র ব্যবহার করে ফাইট হলো আন-ইংলিশ বা অ-ইংরেজসুলভ। এসব যুদ্ধের আগে প্রতিদ্বন্ধীরা পরস্পর হাত মেলাতেন। দর্শকেরা গোল বৃত্ত তৈরী করে তাদের ঘিরে রাখতেন। মারাত্মক ফাইট শুর হতো এবং কোন একজন চালিয়ে যেতে অসক্ষম না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকতো যুদ্ধ। ফাইট ক্লাব ফিল্মের ফাইট ক্লাবের ধারণা এই ইতিহাস থেকেই এসেছে।

উচ্চ শ্রেণীর লোকদের মধ্যে প্রচলিত হয় তরবারি দিয়ে ডুয়েল ফাইট। তারা ছুরি দ্বারা বা খালি হাতের ফাইটকে ডুয়েল এর সম্মান দিতে নারাজ ছিলেন। তারা মনে করতেন ভদ্রলোকের ডুয়েল হবে যখন উভয় প্রতিদ্বন্ধী প্রথামত অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ফাইট করবেন।

ডুয়েলের কথা আসলে কারো মনে পড়তে পারে তলস্তয় একবার তুর্গেনেভকে ডুয়েলে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। ফেব্রুয়ারী ৫, ১৮৯৭ সালে মার্সেল প্রাউস্ত সাহিত্য সমালোচক জিন লরেইনকে ডুয়েলে চ্যালেঞ্জ করেন। জিন লরেইন নিজে ছিলেন একজন সমকামী, তিনি অভিযোগ করেছিলেন প্রাউস্ট একজন সমকামী। আরো অভিযোগ করেন প্রাউস্তের প্লেজার এন্ড ডেইজ বইটির প্রকাশকের সাথে প্রাউস্তের যৌন সম্পর্ক আছে, তা না হলে বইটি প্রকাশ পেত না। এই অসম্মানের প্রতিবাদে, সম্মান উদ্ধারের জন্য প্রাউস্ত লরেইনকে ডুয়েলে চ্যালেঞ্জ করেন। পিস্তল দিয়ে ফাইট হয়। দুইজনই লক্ষ্যভেদ করতে ব্যর্থ হন। এবং এভাবেই প্রাউস্ত তার সম্মান পুনরুদ্ধার করেন।

এখানে ডুয়েলের সারকথাটা হলো, আমার সম্মানের জন্য আমি জীবনের ঝুঁকি নিতে পারি।

ডুয়েল যে সব সময় এভাবে কোন জখম বা হত্যা ছাড়া শেষ হতো এমন নয়। ১৭ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপে, ধারনা করা হয় ৩০০ থেকে ৫০০ মানুষ মারা যেত ডুয়েল ফাইটে।

এভাবে মারা গিয়েছিলেন রাশান বিখ্যাত কবি আলেকজান্দার পুশকিন। বলা হয়ে থাকে তিনি আধুনিক রাশান সাহিত্যের প্রতিষ্ঠাতা। আটাশটি ডুয়েলে তিনি লড়েছিলেন, কিন্তু জনুয়ারী ২৭, ১৮৩৭ সালের ডুয়েলে ফ্রান্সের সম্ভ্রান্ত লোক জর্জ চালস ডি’আন্তেসের গুলিতে মারাত্মক আহত হন।

এই যুদ্ধের হেতু ছিলেন পুশকিনের স্ত্রী, নাটালিয়া গঞ্চারভা। তিনি দেখতে অনেক সুন্দরী ছিলেন। তার সাথে ডি’আন্তেস সম্পর্ক করতে চাচ্ছেন বুঝতে পেরে ক্রোধান্মত্ত পুশকিন তাকে ডুয়েলে আহবান করেন। ডুয়েল হয় নর্ত সেইন্ট পিটার্সবুর্গের চেরানায়া রেকা নামক জায়গায়। বিশ পেস দূরত্ব থেকে প্রতদ্বন্ধীরা গুলি ছুঁড়ছিলেন। প্রথম গুলি ছুড়েন ডি’আন্তেস, আঘাত করে গিয়ে পুশকিনের পাকস্থলিতে। পুশকিন গুলি ছুঁড়েন, এবং সেটাও ডি’আন্তেসের গায়ে লেগে, আর এতেই খুশিতে চিৎকার করে ওঠেন পুশকিন। কিন্ত পরে দেখা যায় ডি’আন্তেসের জখমটা মারাত্মক ছিল না। পুশকিনেরটা মারাত্মক ছিল। একদিন পরে তিনি মারা যান।

আর তার মৃত্যুর পর ডি’আন্তেসের নাটালিয়ার সাথে সম্পর্ক তৈরীতে আর কোন বাঁধা থাকলো না। তাদের সম্পর্ক হয়। তাদের দিক থেকে দেখলে এটা বেশ রোমান্টিক সৌভাগ্যই।

আর নাটালিয়ার কাছে ডি’আন্তেসের এই ঝুঁকি গ্রহণ আকর্ষণীয় ছিল ধরা যায়, যদি বিবর্তনীয় মনোবিদ্যার দৃষ্টিতে দেখি আমরা।

পুরুষের সহিংসতার অনেক ব্যাখ্যা থাকতে পারে, এবং একে দেখার একটি ভঙ্গি বিবর্তনীয় মনোবিদ্যা হতে পারে। আমোজ জাহাবি নামে একজন ইজরাইলি বায়োলজিস্ট ১৯৭৫ সালে একটি রিসার্চ পেপার প্রকাশ করেছিলেন, যাতে তিনি বলেন পুরুষ প্রাণীরা বিপদজনক ঝুঁকি নিয়ে বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীকে আকৃষ্ট করতে চায়। এটা তার এক সিগনালিং।

যেমন, পুরুষ ময়ুরের লম্বা সুদৃশ্য লেজ থাকায় তার কোন সুবিধা নেই। উপরন্তু এটি বিপদজনক। সে শিকারী প্রাণীর চোখে বেশী পড়বে। তার চলাফেরা, লাফ দেয়া, দৌড় ধীর হবে। কিন্তু এই লেজ দেখেই স্ত্রী ময়ুর তার দিকে আকৃষ্ট হয়। স্ত্রী ময়ুর বুঝতে পারে, এই ময়ুরের বড় লেজ আছে এবং তা নিয়ে সে সদর্পে টিকে আছে। অর্থাৎ তার জীন ভালো। এর দ্বারা ভালো সন্তান উৎপাদন সম্ভব। বার্ড অব প্যারাডাইজের ক্ষেত্রেও একই বৈশিষ্ঠ্য দেখা যায়। তারা নিজেরা ঝুঁকি নিয়ে বিপরীত লিঙ্গকে সিগনাল দেয়, দেখো এগুলো করেও আমরা টিকে থাকতে পারি। আমাদের জীন ভালো। আসো আমরা একত্রে মিলিত হয়ে সন্তান উৎপাদন করি ও আমাদের ভালো জীন ছড়িয়ে দেই।

পুরুষের ভায়োলেন্স এবং আত্মবিধ্বংসী কাজ করতে প্রবৃত্ত হওয়া এই ধরণের আদি সিগনালিং প্রবণতা দ্বারা অবচেতনভাবে প্রভাবিত, জাহাবির কাজের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানী জ্যারেড ডায়মন্ড এই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। এখানে একটা জিনিশ বুঝার আছে, অধিকাংশ আত্মবিধ্বংসী কাজ (যেমন সিগারেট খাওয়া, কোকেন বা অন্য মাদকাসক্তি) কেন লোকে কন্টিনিউ করে তার কথা বলা হচ্ছে না। কন্টিনিউ করে কারণ এইসব রাসায়নিকের আকর্ষক ক্ষমতা আছে তাই। কিন্তু খারাপ জিনিস, ক্ষতি করবে জেনেও প্রথমে লোকে কেন শুরু করে, কেন ঝুঁকিপূর্ন কাজ সে খুঁজে, তার ব্যাখ্যা দিতেই জ্যারেড ডায়মন্ড আদি সিগনালিং প্রবণতার অবচেতন প্রভাবের কথা বলেন। মাদক গ্রহণ বা আত্মবিধ্বংসী কাজকে নিজের উপর করা সহিংসতার মধ্যে রাখা যায়।

পুরুষত্বের সাথে যুক্ত সহিংসতার নানা রূপ আছে এবং নানাবিদ ব্যাখ্যায় এটি জটিল। গান্ধীকে গুলি করে খুন করা নথুরাম গডসে কোর্টে বলেছিল যে, গান্ধীরে সে খুন করছে কারণ গান্ধীর রাজনীতি নারীদের মত।

গডসের এই কারণ দেখানো, এবং এই কারণের জন্য গান্ধীরে খুন করার মত সহিংস আচরণও এক ধরণের পুরুষাত্বিক সহিংসতা। অথবা আমরা যদি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের পুরুষত্বের দিকে তাকাই, তিনি একবার একটা কুকুরকে এমনভাবে গুলি করেছিলেন যে যাতে কয়েকদিন সে যন্ত্রণা পেতে পেতে মারা যায়। এই ঘটনা তিনি গর্ব ভরে বলে বেড়াতেন। তিনি বউদের প্রহার করতেন। এসব ছিল তার কাছে এক ধরণের পুরুষত্বের প্রকাশ।

গডসের জীবন দেখলে দেখা যায় ছোটবেলায় তাকে মেয়ে হিসেবে বড় করা হয়েছিল। এর ফলেই সে এক ধরণের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগত তার পুরুষত্ব নিয়ে এবং মূলত তার পুরুষত্ব প্রমাণের জন্যই উগ্রবাদের দিকে আকৃষ্ট হয়।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ক্ষেত্রে, তার মা তাকে ছোটবেলায় ইচ্ছে হলে মেয়েদের পোষাক পরাতেন। মেয়েদের মতো পালন করতেন। তাকে কোলে নিয়ে পিস্তলের গুলি ফুটাতেন। এসব পরে হেমিংওয়ের ভেতরে তার পুরুষত্ব নিয়ে নিরাপত্তাহীনতা তৈরী করে বলে ধারণা করেন হেমিংওয়ের বায়োগ্রাফার ম্যারী বি ডিয়ারবর্ন।

স্বাভাবিক পুরুষত্ব এমনিতেই সহিংসতার জন্য দায়ী, প্রাচীনকাল থেকে, যেহেতু তখন সম্মানের সাথে যুক্ত ছিল সহিংসতা। এর মধ্যে অতি অবদমিত করে রাখা পুরুষত্ব আরো বেশী সহিংস হয়ে দেখা দিতে পারে। যেমন আমরা দেখতে পাই ডেভিড ফিঞ্চার পরিচালিত, চক পলানিউকের উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত ফাইট ক্লাব ফিল্মে।

ফাইট ক্লাবে আমরা প্রথমে যে এডওয়ার্ড নর্টনকে দেখি সে হতাশ ও বিষন্ন। সে তার জীবনে কোন মজা পায় না। তার হতাশা ও বিষন্নতার কারণ তার স্বাভাবিক পুরুষত্বরে দমিয়ে রেখেছিল ক্যাপিটালিজম ও কনজিউমারিজম। অবদমিত থাকতে থাকতে একসময় এই পুরুষত্ব তার শক্তি দিয়ে অতি-পুরুষাত্বিক একটা রূপ তৈরী করে। সেই রূপই আমরা দেখি কাল্পনিক ব্র্যাড পিটের মধ্যে। তারা উনিশ শতকের শুরুর দিকে ইংল্যান্ডে যেমন খালি হাতে ফাইট হতো তেমন ফাইট করার একটা ক্লাব তৈরী করে। ঐ নিয়মেই একসাথে ফাইট করতে থাকে। ফাইট ক্লাবের ফাইট এবং যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম এই অতি-পুরুষাত্বিক রূপেরই ক্রিয়া এবং এর প্রতিক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত আমাদের নায়ক এডওয়ার্ড নর্টনের অবস্থা আরো কাহিল থেকে কাহিলতর হতে থাকে।