ডায়োজিনিস অব সিনোপের কিছু গল্প প্রচলিত আছে। তিনি একেবারে সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তার পরিধেয় বলতে একটা ক্লক ছাড়া তেমন কিছুই ছিল না। ব্যবহার্যের মধ্যে ছিল লাঠি আর এক পানির পাত্র। একবার এক ছোট শিশুকে হাত দিয়ে পানি খেতে দেখে তিনি সেই পাত্রটি ফেলে দিয়েছিলেন, এবং বলেছিলেন এক ছোট শিশু সাধারণ জীবন যাপনে আমাকে হারিয়ে দিল।
এসব অনেক আগের গল্প। যখন এথেন্সে প্লেটো ছিলেন, এরিস্টটল ছিলেন এবং আলেকজান্ডার ছিলেন রাজা। আলেকজান্ডারকে নিয়েও ডায়োজিনিসের সাথে একটি গল্প আছে। এরিস্টটলের এই ছাত্রের শ্রদ্ধা ছিল দার্শনিকদের প্রতি। তিনি জানতেন ডায়োজিনিসের কথা, বিতর্কিত হিসেবে ডায়োজিনিস পরিচিত ছিলেন। একবার আলেকজান্ডার এলেন ডায়োজিনিসের সাথে দেখা করতে। এথেন্সে বিরাট পাইপের ভেতরে থাকতেন ডায়োজিনিস।
আলেকজান্ডার বললেন, আমি রাজা আলেকজান্ডার, আপনার জন্য কী করতে পারি?
ডায়োজিনিস বলেছিলেন, আমার সামনে থেকে সরে দাঁড়াও, তোমার জন্য আমার গায়ে রোদ এসে লাগছে না।
আলেকজান্ডার পরে বলেছিলেন আমি আলেকজান্ডার না হলে ডায়োজিনিস হতে চাইতাম।
এইসব গল্প নিয়ে এই সাইটে একটি লেখা প্রকাশিত আছে, এবং গল্পগুলি আমার গ্রীক উইট বইতেও আছে, পড়া না থাকলে পড়ে ফেলতে পারেন, কারণ ডায়োজিনিসের জীবন দর্শন আলোচনায় এই গল্পগুলিই ব্যবহার করব।
ডায়োজিনিস ছিলেন সিনোপের বাসিন্দা। তার বাবা ছিলেন মিন্ট মাস্টার, অর্থাৎ মুদ্রা বানাতেন। তিনি বা তার বাবা অথবা তারা দুজন মিলে, মুদ্রায় খাঁদ মিশিয়ে সিনোপের মুদ্রা ডি-বেইজ করেছিলেন, ও এই দুর্নীতির শাস্তি হিসেবে সিনোপের নাগরিকত্ব হারান, অর্জিত সম্পদ হারান ও সিনোপ থেকে বিতাড়িত হন। তৎকালীন সিনোপ গ্রীক পন্থী ও পারস্য পন্থী দুইভাগে বিভক্ত ছিল, এবং খুব সম্ভবত ডায়োজিনিসের এই মুদ্রা জাল করার উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক।
বলা হয়ে থাকে, ডায়োজিনিস গিয়েছিলেন ডেলফির মন্দিরে। ওরাকল নাকি তাকে বলেছিল, মুদ্রার ভ্যালু ধ্বসিয়ে দাও বা মুদ্রাকে চ্যালেঞ্জ করো।
সিনোপ থেকে বিতাড়িত হয়ে ডায়োজিনিস মনে করতে থাকলেন তিনি ডেলফির ওরাকলের কথা ভুল বুঝেছিলেন। ওরাকল তাকে হয়ত সত্যিকারের মুদ্রাকে ধ্বসিয়ে দিতে বলে নি। বরং বলেছে যে পলিটিক্যাল ব্যবস্থা ও সংস্কার রীতি আছে, এগুলিকে চ্যালেঞ্জ করতে।
ওই সময়ে এথেন্সে সক্রেটিসের এক ছাত্র এন্টিস্থিনিস তার দর্শন প্রচার করতেন। ডায়োজিনিস সেই দর্শনে আকৃষ্ট হন। তিনি এন্টিস্থিনিসের শিষ্য হতে যান। কিন্তু এন্টিস্থিনিস রাজী ছিলেন না, এক পর্যায়ে লাঠি দিয়ে আঘাত করে তাড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু তাও লেগে থাকেন ডায়োজিনিস।
এন্টিস্থিনিস ছিলেন সিনিক দার্শনিক। তিনি যে সন্যাস জীবনের দর্শন প্রচার করতেন, তার নাম দেয়া হয়েছিল সিনিক দর্শন। এই দর্শনের যে মডেল, তাতে এটা স্বাভাবিক বিষয়ই যে, শিষ্য সহজে গ্রহণ করতে চাইবেন না গুরু দার্শনিক। অতি আগ্রহীদের বাছাই করতেই সম্ভবত এটা।
ডায়োনিজিস এন্টিস্থিনিসের কাছ থেকে নিয়েছিলেন সক্রেটিসের শিক্ষা, মানুষের লাইফে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হইল ভার্চ্যু, গুড লাইফের জন্য ভার্চ্যু ছাড়া আর কিছু লাগে না।
ডায়োজিনিসের দর্শনের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, সহজ জীবন। তার পাইপে জীবন যাপনের গল্প, পরিধেয় ও জিনিশপত্র যে কম ছিল, তিনি যে একটা বাচ্চার হাতে পানি খাওয়া দেখে পানির পাত্র ফেলে দেন, এগুলা সহজ জীবনের শিক্ষা, জীবন থেকে অপ্রয়োজনীয় জিনিশ বাদ দেয়ার শিক্ষা। নানা দেশে ও অঞ্চলে এই লাইফের শিক্ষা দিয়ে গেছেন অনেক জ্ঞানী।
এই সহজ লাইফস্টাইল অর্জন আবার সহজ না, উচ্চ আত্মনিয়ন্ত্রণ না থাকলে সম্ভব না। আত্ম নিয়ন্ত্রণকে, সেলফ ট্রেইনিংকে সিনিকেরা নিয়ে গিয়েছিলেন সর্বোচ্চ স্তরে। সিনিক দর্শনের প্রভাবে পরবর্তীতে স্টয়িক দর্শন তৈরি হয়, তারাও আত্মও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটা নেন, কিন্তু মাঝারি মাত্রায়।
ডায়োজিনিসের একটা গল্পে দেখা যায়, তিনি ডাল দিয়ে খাইতেছেন দেখে একজন দার্শনিক বললেন, তুমি যদি ডাইনোসিয়াসের দরবারে গিয়া দেখা করতা তাহলে এইভাবে ডাল খাইতে হইত না। উত্তরে ডায়োজিনিস বলেন, তুমি যদি ডাল দিয়া খাইতে পারতা তাহলে ডাইনোসিয়াসরে তোমার প্রশংসা করতে হইত না।
এই গল্পে মিলে কেন ডায়োজিনিস সহজ লাইফের দিকে গেছেন। তার স্বাধীনতার জন্য।
তত্ত্ব ভিত্তিক, সংজ্ঞা ভিত্তিক যে দর্শন চর্চা ডায়োজিনিস সেই পথে হাঁটেন নাই। ডায়োজিনিস যুবক বয়েসে মুদ্রা ব্যবস্থা শিখেছেন, তিনি অশিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু নিজের চিন্তা তিনি বইয়ে লিখেন নাই।
তার কথা ছিল মানুষের অধিক জানার বা অধিক তত্ত্বালোচনার কিছু নাই। মানুষের সমস্যার সমাধান তার মধ্যেই আছে, অন্য কোথাও নাই। এই উপলব্ধিতে আসতে পারলেই মানুষ চারপাশ থেকে তার সমাধান খুঁজে নিবে ও সমাধান করতে কাজটা শুরু করবে।
গল্পে দেখবেন, প্লেটো লেকচারে বলতেছেন, মানুষ হইল দ্বিপদ, পালকহীন প্রাণী।
ওইসময়ের মানুষেরা মেনে নিলো।
ডায়োজিনিস পালক ছাড়াইয়া এক মোরগরে নিয়ে গিয়ে বললেন, এই হইল প্লেটোর মানুষ।
এই কাজ তিনি তো যুক্তি দিয়ে করতে পারতেন। কিন্তু করেন নাই।
বা ডায়োজিনিসের বিখ্যাত গল্প, একবার তিনি এগোরায় গেলেন দিনের বেলায় হারিকেন হাতে।
মানুষ জিজ্ঞেস করল, কী হইছে আপনার, কী খুঁজেন?
ডায়োজিনিস বলেন, একজন সৎ লোক খুঁজি।
এই কাজও তিনি এইভাবে না করে লেকচারে করতে পারতেন, তর্ক করে বুঝাইতে পারতেন যে সমাজে সৎ লোক কমে গেছে, ইত্যাদি।
কিন্তু তর্ক না করে কাজটা করতে গেছেন।
ডায়োজিনিস বলেছিলেন, ওরাটরেরা ন্যায় বক্তৃতা দিতে কতো চিন্তিত, কিন্তু ন্যায় কাজ করার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ নাই।
তত্ত্বালোচনার নলেজ এবং কাজ, এই দুইয়ের মধ্যে ডায়োজিনিসের দর্শন প্রেফার করে কাজরে।
সম্ভবত ডায়োজিনিস বুঝতে পারছিলেন যে, তত্ত্বালোচনা প্রায় ক্ষেত্রেই মানুষের কাজটা না করতে পারার অজুহাত, এবং অর্থহীন, কারণ এটি মানুষরে কাজ করার ফিল দিয়ে দেয়, ফলে কাজটা করা তার হয় না। একসময় হয়ত সে ভাববে, এত আলোচনায়, তর্ক বিতর্কে তো কাজের কাজ কিছু হইল না।
ডায়োজিনিস সক্রেটিসের গুড লাইফ ও ভার্চ্যুর শিক্ষাকেই ধরেছিলেন, আর কিছু ধরেন নাই। ফলে আর কোন আলোচনা, তর্ক তার বিষয় ছিল না। তার বিষয় ছিল “ট্রুথ” যেটা ওই গুড লাইফের জন্য দরকার। তার যে ছবি প্রতিষ্ঠিত, তা সব কিছু বাদ দিয়ে চলা এক বুড়ো লোকের, যে ট্রুথ ছাড়া আর কিছু বুঝে না। ইতিহাসে তার ছবি কত বড় হিসেবে উপস্থাপিত হবে না ছোট হিশাবে থাকবে এ নিয়ে তার কোন ভাবান্তর নেই। তার জীবন ইচ্ছাকৃত ভাবেই ছোট হিশাবে থাকার জীবন, মাটির কাছাকাছি।
তবে, এই জায়গায় প্রশ্ন করতে পারেন কেউ, তাহলে ওইসব গল্পের ব্যাপারে কী বলবেন, যেখানে তিনি প্লেটোকে ট্রল করতেন, পাবলিককে ট্রল করতেন। এগোরায় খাওয়া খারাপ হিসেবে পরিচিত ছিল। ডায়োজিনিস এগোরায় গিয়ে খাচ্ছিলেন। মানুষ এতে তাকে ডগ বলে খ্যাপালে, তিনি তাদের দিকে প্রস্রাব করতে শুরু করেন। বা এগোরায় গিয়ে সবার সামনে তিনি মাস্টারবেট করতেন। এগুলা কেন?
এইসব, মানুষরে তার স্বাধীনতা বুঝাতে। মানুষ যে সংস্কৃতি রীতি নিয়ম কানুন তৈরি করেছে, এর মাধ্যমে দৃশ্য অদৃশ্য কিছু বিধিনিষেধ তৈরি হয় একজন মানুষের জীবনে। মানব সভ্যতার পরিক্রমার হিশাবে, একসাথে শৃঙ্খলার সাথে থাকতে এগুলার উদ্ভব, এমন বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এটা সর্বক্ষেত্রে সত্য এমন নয়। কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে আইন ও রীতি সব সময়ই ক্ষমতাবানদের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এছাড়া পপুলার ডিমান্ড তৈরি করে রীতি, ও সংস্কার। ডায়োজিনিস সিনিক দর্শনের অনুসারী ছিলেন, এই ধারার দার্শ্নিকেরা এগুলা মানতেন না। সিনিক শব্দের অর্থ কুকুর, ডায়োজিনিসের শিষ্য সিনিক দার্শনিক ক্র্যাটিস, এবং তার বউ দার্শনিক হিপার্শিয়া সর্বসমক্ষে সেক্স করতেন, এটা ছিল তাদের সিনিক লজ্জাহীনতার প্র্যাক্টিস।
সিনিকদের অনেক প্র্যাকটিস পরবর্তীকালে স্টয়িকেরা নিয়েছেন। স্টয়িক দর্শন যার মাধ্যমে শুরু হয়, সেই সিটিয়ামের জেনো ছিলেন ক্র্যাটিসের শিষ্য। প্রথম শিক্ষা হিসেবেই ক্র্যাটিস থাকে লজ্জার ভয় কাটিয়ে উঠার শিক্ষা দেন। জেনোকে বলেন এক পাত্র ডালের স্যুপ নিয়ে বাজারের মধ্য দিয়ে যেতে। এই কাজ করতে জেনো লজ্জা পান, তিনি কাপরে লুকিয়ে পাত্রটি নিয়ে যাচ্ছিলেন। ক্র্যাটিস বাজারে গিয়ে সবার সামনে লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে ওই পাত্র ভেঙ্গে ফেলেন। এতে ডাল গড়িয়ে পড়তে থাকে জেনোর শরীরে। লজ্জায় জেনো দৌড়ে পালিয়ে যেতে থাকেন। তখনক্র্যাটিস বলে উঠেন, লজ্জা পাচ্ছো কেন! কিচ্ছু হয় নি, আমার ছোট্ট পয়েনিশিয়ান!
১। সহজ জীবন। প্লেজার বা আনন্দ উপভোগের জন্য নয়, বরং ভার্চ্যু অর্জনের জন্য।
২। তত্ত্বালোচনা নয়, কাজ। ফিলোসফি জীবনে ধারণ করার জন্য। পরবর্তীকালের স্টয়িক দার্শনিক এপিকটেটাস যেমন বলেছিলেন, তোমার ফিলোসফি ব্যাখ্যা কইর না, জীবনে ধারণ করো।
৩। বড় হওয়ার ইচ্ছা নয়, মাটির কাছাকাছি থাকো। ন্যাচারের সাথে জীবন যাপন।
৪। সামাজিক সংস্কার, রীতি, আইন, পপুলার ডিম্যান্ড ‘সত্য’ নয়। এগুলারে প্রশ্ন করার মাধ্যমেই জীবনে স্বাধীনতা আসে।