‘গ্রোথ হ্যাকিং প্ল্যানস – আলাদ্দিন হ্যাপি’ বুক সামারি

উদ্যোক্তা, ডেভলাপার এবং গ্রোথ হ্যাকার আলাদ্দিন হ্যাপির “গ্রোথ হ্যাকিং প্ল্যানস” বইটি গ্রোথ হ্যাকিং বিষয়ে ভালো বইয়ের একটি। এটি আমি সম্প্রতি পড়লাম। বইটি’র সামারি বা নোট নিয়ে এই লেখাটি তৈরি করেছি।

 

১। কোন একটি প্রোডাক্ট মার্কেটে আনার আগে আপনাকে দেখতে হবে এর ক্রেতা আছে কি না। প্রোডাক্ট/মার্কেট ফিট পরীক্ষা না করে যখন কোন প্রোডাক্ট তৈরি করা হয়, পরে যদি ক্রেতারা না কিনে তাহলে এর পেছনে যে টাকা ও সময় ইনভেস্ট করা হলো, তার সবটাই জলে গেলো। সুতরাং, মার্কেট ফিট কি না তা পরীক্ষা করে নেয়া জরুরী, প্রোডাক্ট তৈরির আগেই।

২। গ্রোথ হ্যাকিং হলো নিয়মিত ও দ্রুততম উপায়ে বিভিন্ন হাইপোথিসিস ঠিক করা এবং তা পরীক্ষা করা। এটি একটি ট্রায়াল এন্ড এরর মেথড। একটি নিয়ত ক্রিয়েটিভ প্রসেস, যেখানে প্রচুর আইডিয়া তৈরি করতে হয় এবং এগুলি পরীক্ষা করে দেখতে হয় কেমন কাজ করে। একটা কাজ করলেও টেস্ট করা বন্ধ করা যাবে না। গ্রোথ হ্যাকিং শব্দটির প্রবক্তা শন ইলিসের মতে, গ্রোথ হ্যাকিং হলো টেস্ট/পরীক্ষা নির্ভর মার্কেটিং প্ল্যান। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটি টেস্ট না চালালে এটি গ্রোথ হ্যাকিং নয়।

৩। গ্রোথ হ্যাকিং এর জন্য বিভিন্ন চ্যানেল ব্যবহার করা যায়, বিভিন্ন চ্যানেলে কাজ করা যায়, এবং এগুলি ভালো ফলও দিতে পারে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ন হলো কোন একটি চ্যানেল ব্যবহার করেই মার্কেটিং প্ল্যান সাজানো, এবং সে অনুসারে ইউজারদের সাথে এনগেইজমেন্ট সর্বোচ্চ বাড়ানোর চেষ্টা করা। কোন চ্যানেল (ইমেইল, ফেইসবুক এড, টুইটার, রেফারেল মার্কেটিং, এমাজন, ইউটিউব অথবা অন্য কোন চ্যানেল) আপনি ব্যবহার করলেন তার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ন সে চ্যানেল থেকে আপনি কি ফায়দা হাসিল করতে পারলেন, ইউজার এনগেইজমেন্ট কতো বাড়ালেন। একসাথে অনেক চ্যানেলে কাজ শুরু করলে অনেক সময় সবগুলিতে যথেষ্ট ফোকাস দেয়া যায়, এবং এতে প্ল্যান ঠিকমত কাজ করে না।

৪। আউটসোর্সিং এর আইডিয়া আপনার পুরো প্রজেক্টের জন্য বাজে। কারণ যে ফ্রিল্যান্সারকে দিয়ে কাজটা করাচ্ছেন তার কাছে ‘যত দ্রুত কাজটা করে দেয়া যায়’ প্রবণতা থাকে। এর চাইতে আপনার এমপ্লয়ি বা কো-ফাউন্ডারদের কাছ থেকে অনেক বেটার আউটপুট আপনি পাবেন। তবে ছোট ছোট কাজের জন্য আউটসোর্সিং এ সমস্যা নেই অত।

৫। গ্রোথ হ্যাকিং আইডিয়া বের করতে হবে একেকটা ফ্রেমওয়ার্কের মতো করে। যেমন, একিউজিশন ফ্রেমওয়ার্ক। এখানে আপনি কীভাবে নতুন ইউজারদের আপনার সাইটে আনবেন বা ইমেইলের সাবস্ক্রাইবার করবেন সে নিয়ে আইডিয়া তৈরি করবেন। রিটেনশন ফ্রেইমওয়ার্কে আপনি আইডিয়া তৈরি করবে কীভাবে আপনার ইউজারদের হ্যাপি রাখা যায়, তারা যাতে ব্যবহার করা বন্ধ না করে দেয়। আরো আছে, রেভিনিউ ফ্রেমওয়ার্ক, যেখানে আপনি গ্রোথ হ্যাকিং আইডিয়া জেনারেট করবেন কীভাবে সাবস্ক্রাইবারদেরকে ক্রেতাতে রূপান্তর করা যায়।

৬। রিটেনশন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন। ইউজাররা আপনার সার্ভিস বা প্রোডাক্ট ব্যবহার করা যদি বন্ধ করে দেয় তাহলে নতুন নতুন অনেক ইউজার এনেও আপনার কোন লাভ হবে না।

রিটেনশন রেইট সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে, যদি তা আশানুরূপ থাকে তবেই নতুন ইউজার আহরনের দিকে যান।

রিটেনশন রেইট বাড়াতে ইউজারদের খুশি রাখুন এবং তাদের চাওয়ার চাইতে বেশি তাদের দিন। চাওয়ার চাইতে বেশি দিয়ে খুশি করার এক উপায় হলো, কম প্রমিজ করা। বেশি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে, আরো বেশি দিয়ে খুশি করতে হবে, যা ব্যয়বহুল।

(এটি গুরুত্বপূর্ন সাইকোলজিক্যাল জিনিস। পলিটিক্যাল সাইন্সে একটা থিওরী আছে যেসব দেশে খারাপ অবস্থা থাকে সেখানে বিপ্লব হয় না সচরাচর, কিন্তু যখন কোন দল অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসে যে তারা খারাপ অবস্থা বদলাবে ও তা পূরণে ব্যর্থ হয় তখনই মানুষের মনে ক্ষোভ জাগ্রত হয়। তখনই বিপ্লবের বা বিদ্রোহের সম্ভাবনা প্রচুর বেড়ে যায়।)

 

৭। কোন একটি নিখুঁত প্রোডাক্ট তৈরির চেষ্টা করার চেষ্টা হলো ভুল। এর চাইতে শুনুন কাস্টমাররা কী চায়। সেই অনুসারে প্রোডাক্ট বানান। আপনার কাছে যা সেরা মনে হয় তা কাস্টমারদের কাছে অপছন্দের হতে পারে।

 

৮। গ্রোথ হ্যাকিং হচ্ছে একটি টিমওয়ার্ক। আপনার পুরো টিমের এ সম্পর্কে জানাশোনা ও আগ্রহ থাকতে হবে। কেবল আপনি যদি এর গুরুত্ব বুঝেন এবং আর কেউ জানে না বিষয়টি সম্পর্কে তাহলে আপনি অনেক ভালো আইডিয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। তাই আপনার টিমকে এ সম্পর্কে জানান ও আগ্রহী করে তুলুন।

 

৯। গ্রোথ হ্যাকিং একজনের জন্য নয়, পুরো কোম্পানির বিষয়। গ্রোথ হ্যাকিং কেবল মার্কেটিং নয়। আপনি এমন একটি পদক্ষেপ নিলেন যাতে এমপ্লয়ীদের কর্মক্ষমতা ও হ্যাপিনেস দ্বিগুণ বেড়ে গেল, এটি গ্রোথ হ্যাকিং। আপনি এক সাধুকে এনে আপনার কোম্পানির ছাদে বসিয়ে দিলেন, এতে আপনার কোম্পানির রেভিনিউ ও কর্মচারীদের বিভেদ দূর হয়ে গেল, এটাও গ্রোথ হ্যাকিং। হটমেইল প্রতি ইমেইলের নিচে “PS: I Love You. Get your free email account at Hotmail.”  লিখে দেওয়ায় ১৮ মাসে ১২ মিলিয়ন নতুন ইউজার পায় বাড়তি কোন খরচ ছাড়াই, এটাও গ্রোথ হ্যাকিং।

 

১০। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করুন। কোম্পানির প্রতিটি সদস্যের মনে এটি গেঁথে দিন। এবং এর দিকে লক্ষ্য রেখেই আইডিয়া জেনারেট করতে করতে, টেস্ট করতে করতে এগিয়ে যান। ফোকাস হচ্ছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন।

 

১১। ট্রায়াল এন্ড এরর বা এক্সপ্লোর করা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন। এর মাধ্যমেই মানব সভ্যতা নতুন জিনিস উদ্ভাবন করেছে। শিশুরা এভাবেই শেখে। সরাসরি ঠিক উত্তরের জন্য যে স্কুলের পড়ালেখা তা মানুষের ক্রিয়েটিভিটি নষ্ট করে দেয়।

দার্শনিক নাসিম তালেব তার স্কিন ইন দ্য গেইম বইতে লিখেছেন, “যেসব জিনিস বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বলে তারা উদ্ভাবন করেছে এগুলি আসলে টিংকারিং করে আবিষ্কার করা। পরে তারা এগুলিকে ফর্মূলায় ফেলেছে। আমি আমার এন্টিফ্র্যাজাইল বইতে দেখিয়েছি ট্রায়াল এন্ড এরর, টিংকারিং, অভিজ্ঞতা এবং কাজ করতে করতে আমরা যে জ্ঞান অর্জন করি তা যুক্তির মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানের চাইতে অনেক ভালো। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এসব আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে।”

 

মার্কেট ফিট ফ্রেমওয়ার্ক

 

উকমার্সের এক্স প্লাগিনের মার্কেট ফিটনেস টেস্ট

 

প্রথমে আপনি ধরা যাক ১০০ ইমেইল সাবস্ক্রাইবার সংগ্রহ করলেন।

 

সাবস্ক্রাইবার সংগ্রহের পর, তাদের প্রথম ইমেইলে বলবেন, “ উকমার্সের কোন সমস্যাটি আপনি সমাধান করতে চান বা চান যে এটি সমাধান করা হোক?”

 

দেখবেন কোনটি বেশি জনপ্রিয় হলো।

 

এরপরের ইমেইলে তাদের বলবেন আপনি যে এক্স প্লাগিন দিয়ে কীভাবে সমস্যাটির সমাধান করতে পারবেন। বলবেন এর দাম হবে ৫০ ডলার।

 

এরপরের ইমেইলে বলবেন “এক্স প্লাগিন” কেন গুরুত্বপূর্ন হবে, কীভাবে তাদের কাজকে সহজ করবে।

 

এরপরের ইমেইলে আপনি বলবেন, আপনি প্লাগিনটি আপনি তৈরি করবেন মিনিমাম ৪০ জন্য ক্রেতা আগে কিনে নিলে। এই মিনিমাম নাম্বার আপনার মোট সাবস্ক্রাইবার সংখ্যার উপর নির্ভর করে। প্রি-সেলে দাম হবে ৫০% কম। যদি মিনিমাম নাম্বারের চাইতে কম লোক কিনেন, তাহলে আপনি প্লাগিনটি তৈরি করবেন না। টাকা ফিরিয়ে দিবেন।

 

আপনি মিনিমাম সংখ্যার প্রি সেল পেলে, আপনার প্রোডাক্টটি মার্কেট ফিট হয়ে গেলো। আগে প্রোডাক্ট তৈরি করে ক্রেতা না পাবার চাইতে এটি হলো অনেক ভালো পদ্বতি। এখানে আপনার লস জিরো। পক্ষান্তরে আগে প্রোডাক্ট তৈরি করে ফেললে, পরে না চললে, লস অনেক।

 

যদি মিনিমাম টার্গেটের প্রি সেল না হয় তাহলে আপনি পরবর্তী প্রোডাক্টে যাবেন। একইভাবে টেস্ট করবেন।

 

 

১২। দ্রুত, এবং অনেক গ্রোথ হ্যাকিং আইডিয়া টেস্ট করাকে বলে হাই টেম্পো টেস্টিং। সপ্তাহে ৩-১৫ টি টেস্ট। যত বেশি টেস্ট তত বেশি গ্রোথ।

 

১৩। হাই টেম্পো টেস্টিং ফ্রেমওয়ার্কের পার্ট চারটা।

 

১। কে পি আই এনালাইসিসঃ গ্রোথ হ্যাকিং এর জন্য ডেটা সংগ্রহ করা দরকারি। তা না হলে কোন টেস্ট কেমন কাজ করল তার তুলনা করতে পারবেন না। কীভাবে ইউজাররা আসছে, কীভাবে তারা ক্রেতায় পরিণত হচ্ছে, তারা কোন রিজিয়ন থেকে আসছে, তাদের বয়স কেমন ইত্যাদি নানা সেগমেন্টে আলাদা করে ডেটা পাওয়া যায়। ডেটা এনালাইসের টুলদের মধ্যে গুগল এনালিটিক্স ভালো ও ফ্রি।

 

একজন ইউজারকে সাইটের প্রোডাক্ট পেইজে নিয়ে আসা একিউজিশন।

 

ইউজারটি যখন আপনার প্রোডাক্টটির পেইজে গিয়ে এর মূল্য বুঝতে পারবে, সেটা হলো এক্টিভেশন অবস্থা।

 

এরপর হলো রিটেনশন। ইউজার বার বার আসবে।

 

রেভিনিউ হলো এর পরের অবস্থা যখন ইউজার ক্রেতায় পরিণত।

 

রেফারার হলো পরের ধাপ যখন ইউজার আরেকজনকে রেফার করবে প্রোডাক্টটি।

 

 

২। জেনারেটিং আইডিয়া ফ্রেইমওয়ার্কঃ এর জন্য প্রচুর পড়তে হবে। গুগল ব্যবহার করে অন্যের ব্যবহার করা আইডিয়া, কেইস স্টাডি দেখতে হবে। সাইকোলজিক্যাল দিক গুলি নজরে আনতে হবে। আইডিয়া জেনারেটে কোম্পানির সবাইকে যুক্ত করতে হবে।

 

৩। রিটেনশন ফ্রেইমওয়ার্কঃ ইউজারকে খুশি রাখা ও ধরে রাখার আইডিয়া বের করা ও সে অনুসারে ট্রায়াল করে যাওয়া।

 

৪। এক্টিভেশন ফ্রেইমওয়ার্কঃ রিটেনশনের পরের ধাপ। এখানে আপনি তাদের ইমেইল সংগ্রহ করবেন। এই প্রসেসটা যত সহজ রাখা যায় ততো ভালো।

 

৫। রেভিনিউ ফ্রেমওয়ার্কঃ এই ধাপে জিনিসটি বিক্রি করবেন। আইডিয়া হবে বিক্রি করাকে ত্বরান্বিত করার দিকটি মাথায় রেখে। এই ধাপে প্রাইসিং এর ক্ষেত্রে এনকোরিং, স্কারসিটি, অথরিটি বা ক্রেডিবিলিটি ইত্যাদি পারসুয়েশন টেকনিকের ব্যবহার করে আইডিয়া তৈরি করতে হবে।

 

১৪। এ/বি টেস্টিং গুরুত্বপূর্ন। ধরা যাক, আপনি আপনার প্রোডাক্টের সাবস্ক্রিপশন ফি বাড়াতে চান। আপনার কাস্টমার পাঁচ হাজার জন। ধুম করে দাম না বাড়িয়ে প্রথমে ১০০ জনের কাছে দাম বাড়িয়ে দেখুন কী প্রতিক্রিয়া হয়। এরপর ৩০০ জনের কাছে। এভাবে যদি দেখা যায় পজেটিভ তবেই দাম বাড়ান। নাহলে হঠাৎ অনেক কাস্টমার হারাবেন।

 

১৫। এই বইতে অনেক কেইস স্টাডি আছে। যেমন, আপনি যদি বলেন একজন বন্ধুর সাথে শেয়ার করে কোন সার্ভিস আনলক করার কথা তাহলে সবার সাথে শেয়ার করার কথা বললে যে শেয়ার হয় তার চাইতে ২৫০% বেশি শেয়ার হয় দেখা গেছে।

 

১৬। বিহেভিওরাল ইকোনমিক্সের ফাদার ফিগার ড্যানিয়েল কায়নেম্যান ও আমোস টিভার্স্কির একটি বিখ্যাত রিসার্চে দেখা গেছে মানুষ পজেটিভ ফ্রেমিং বেশি পছন্দ করে।

যেমন,

 

২০০ জীবন বাঁচান

৩৩% চান্স আছে মোট ৬০০ জন লোকই বাঁচবে, ৬৬% সম্ভাবনা কেউ বাঁচবে না।

 

৪০০ লোক মরবে

৩৩% সুযোগ কেউ মরবে না, ৬৬% চান্স যে সব ৬০০ জনই মারা যাবে।

 

ফলাফল-

৭২% লোক পছন্দ করেছে পজেটিভ ফ্রেমিং। যদিও দুইটার আউটকামই সেইম। পজেটিভ ফ্রেমিং ২.৫ গুণ বেশি পারসুয়েসিভ।

 

বুক সামারি বা নোট সমাপ্ত।

 

এরকম, বা আরো ছোট আকারে পঠিত বইয়ের সামারি আমি নিউজলেটারেও দিতে চাই। আপনি তা আপনার ইমেইল বক্সে পেতে চাইলে সাবস্ক্রাইব করে রাখুন।