এই উপন্যাসটি কয়েক বছর আগে অনন্যা ম্যাগাজিনের ঈদ সংখ্যার জন্য লেখছিলাম, সেইখানেই প্রথম প্রকাশ হয়। কভারটি করেছিলেন একজন প্রকাশক, তার নাম এখন মনে পড়তেছে না। তিনি এটা নিয়া বই করতে চাইছিলেন। কভারের জন্য তারে ধন্যবাদ।
স্মৃতির ছায়া
মুরাদুল ইসলাম
অধ্যায়-এক
সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৭
সময় সকাল নয়টা ত্রিশ মিনিট। মধ্যবয়স্ক ডিটেক্টিভ হাসনাত তার সহকারী বিমল দাসকে নিয়ে সিপকফি নামে একটি কফিশপে বসে কফি খাচ্ছেন। বিমল সদ্য জয়েন করেছে, ছয়মাস হলো। ডিটেক্টিভ হাসনাত গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করছেন দীর্ঘদিন।
এ পর্যন্ত কোন তদন্তকর্মে তিনি ব্যর্থ হন নি। কিন্তু সেটা তার চরিত্রের মূল আকর্ষনীয় বিষয় নয়। মূল বিষয়টা হলো তার একরকম উদাসীনতা এবং ভিন্ন পদ্বতিতে কাজ করার চেষ্টা। শুরুতে এজন্য তাকে অনেক ভুগতে হয়েছে। কিন্তু সিনিয়র অফিসার হয়ে যাবার পর স্বাধীনতা পেয়েছেন নিজের মতো কাজ করার। তার প্রতিভার ব্যাপারে ডিপার্টমেন্টের কারো কোন সন্দেহ নেই।
হাসনাত তার মোবাইলে একটি গেইম খেলছেন। ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস।
এই কফি পান শেষ করেই তারা একটি খুন হয়ে যাওয়া জায়গায় যাবেন। খুবই অস্বাভাবিক ভাবে এক যুবক ছেলে মারা গেছে।
বিমল বললো, স্যার, আপনার কী মনে হয়?
মোবাইলের দিকে চোখ রেখেই হাসনাত জবাব দেন, কোন বিষয়ে কী মনে হয়?
মানে আজকের এই মার্ডারটা বা মৃত্যুটা বিষয়ে।
কিছুই মনে হইতেছে না এখনো। কারণ এখনো এই নিয়া ভাবি নাই।
আমার স্যার মনে হচ্ছে প্রেম ঘটিত ব্যাপার স্যাপার।
মোবাইল থেকে চোখ তুলে বিমলের দিকে তাকালেন ডিটেক্টিভ হাসনাত। সরাসরি চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলেন, এমন মনে হওয়ার কারণ?
উৎসাহ পেয়ে বিমল বলতে থাকে, ছেলেটার বয়স দেখেন স্যার? এমন বয়সে প্রেম ঘটিত সুইসাইড হওয়ার চান্সই বেশী। এই মাসে আমি আরো দুইটা এমন কেইস দেখছি।
ডিটেক্টিভ হাসনাতের মুখে স্পষ্ট বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠল। তিনি ঠান্ডা স্বরে বললেন, বিমল, তোমারে আগেও বলছি, এই ধরনের ফালতু পূর্বানুমান সরাইয়া রাখবা নতুন তদন্তের আগে। এগুলা তদন্ত কইরা সত্য বাইর করতে বাঁধা দেয়। ইয়াং পোলাপানের প্রেম ঘটিত সুইসাইড বেশী হইতে পারে, তাই বইলা আগে থিকা এমন ধারনা কইরা গেলে তো হয় না। আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, বহুকাল আগের কথা, আমার এক বন্ধু ছিল মোকসেদ, হালায় একদিন ধুম কইরা মইরা গেল সুইসাইড খাইয়া। ফ্যানের সাথে গেছিল ঝুইলা। কী মর্মান্তিক! দেইখা দুই রাইত ঘুমাইতে পারি নাই।
বিমল জিজ্ঞেস করলো, উনি কেন সুইসাইড করেছিলেন?
হাসনাত জবাদ দেন, তোমার কথা মত ভাবলে প্রেম ঘটিত সুইসাইড। যেহেতু মোকসেদ বয়সে তখন ইয়াং। কিন্তু ঘটনা তেমন আছিল না। মোকসেদ পিরীতে বিশ্বাসই করত না। একদিন সমাজবিজ্ঞান ক্লাসে কী নিয়া ভাবতে ভাবতে তার মনে হইছিল লাইফ ইজ মিনিংলেস। এরপর এই চিন্তা আর সে দূর করতে পারে নাই। দিন রাইত খালি এই নিয়া ভাবত। ক্লাস করা ছাইড়া দিল, বিছানায় শুইয়া থাকে দিন রাইত। কোন কিছুতেই উৎসাহ পায়, কিছু কইলে বলে, কী হইব কইরা! মানে পুরা ভ্যাবদা মাইরা গেল, বুঝলা?
জি স্যার, তারপর?
এরপর আর কী, খায় না, রাইতে ঘুমায় না। সিগারেট খাইতে থাকে ধুমাইয়া। এখন ভাবলে মনে হয় ওইটা হয়ত কোন মানসিক রোগ আছিল ডিপ্রেসন টাইপের, আর দার্শনিক ভাবে দেখলে অয় একজিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিস; এর মানে বুঝো তো?
জি….মানে, না স্যার।
মানে এই যে আমাদের একজিস্টেন্স…বলতে গিয়ে থেমে গেলেন ডিটেক্টিভ হাসনাত। মনে হলো তিনি নিজেই বোধহয় খেই হারিয়ে ফেলেছেন এবং একজিস্টেন্সের মিনিং খুঁজে পাচ্ছেন না। কয়েক মিনিট নিরব থাকার পর গলার স্বর বদলে গেল। তিনি বললেন, থাক, ঐটা তোমার বুঝার দরকার নাই, জিনিসটা বেশ ইয়ে টাইপ। মোকসেদের কথায় ফিরি, সে তো এইমত ছিল, জীবনের অর্থহীনতা নিয়া হা হুতাশে; তারপর একদিন মইরা গেল, সুইসাইড।
বিমল বলল, এটা তো স্যার রেয়ার কেইস, এমন হয় না।
হাসনাত বললেন, কইছে তোমারে রেয়ার কেইস! এইরকম আমি আরো দেখছি, এই বিশ বছরের গোয়েন্দা জীবনে। তুমি তো সেইদিনের পোলা, কী বুঝবা। মানুষের লাইফ বড় জটিল বিমল। বাইরে থিকা দেখলে মনে হইব প্রেম পিরিতি, সম্পত্তি আত্মসাৎ ইত্যাদি নিয়া খুন জখম মার্ডার। কিন্তু তলাইয়া দেখলে মানবমনে তুমি যা পাইবা তা হইল অস্তিত্বের সংকট…একজিজটেনশিয়াল ক্রাইসিস।
বিমল হয়ত ঠিকমত বুঝলো না। হাসনাতের সব কথা সে ঠিক বুঝতে পারে না। কিন্তু বলল, জি স্যার…
হাসনাত বললেন, এখন কও মোকসেদ কী কামডা ঠিক করল? এইভাবে মইরা গিয়া?
দ্বিধান্বিত ভাবে বিমল জবাব দিল, উনার জন্য হয়ত ঠিক। যেহেতু তিনি জীবনের কোন অর্থ পাচ্ছিলেন না।
হাসনাত বললেন, তো মইরা গিয়া কী কোন অর্থ পাইল নাকী? লাইফ হ্যাজ নো মিনিং, এবং ডেথ এরও কোন অর্থ নাই। ডেথ যেহেতু কোন অর্থ দিতে পারে না তাইলে মইরা গিয়া তার লাভটা কী হইল? আমি ইদানীং এইসব নিয়া ভাবি, আর আমার মনে হয় বন্ধু মোকসেদ কামডা ঠিক করে নাই।
বিমল হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বলল, স্যার আমাদের ক্রাইম সীনে যাবার সময় হয়ে গেছে।
হাসনাত বললেন, হ, গিয়া দেখি হালায় মরল কোন দুঃখে,
উঠতে উঠতে বললেন, নাকী কেউ মাইরা ফালাইল তারে…বুঝলা বিমল…
কথা বলতে বলতে মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে ডিটেক্টিভ হাসনাত তার জুনিয়র অফিসার বিমলকে নিয়ে কফিশপ থেকে বের হলেন।
বের হয়েই তিনি কিছুটা থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, খাড়াও, এর আগে আমাদের আরেক জায়গায় যাইতে হবে। শান্তনুর ওইখানে যাওয়া দরকার।
বিমল দেখেছে হাসনাত সাহেব অদ্ভুত কিছু মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখেন। শান্তনু এদের একজন। একটি যুবক ছেলে, হ্যাকার। হ্যাকিং জনিত সাইবার ক্রাইমের অপরাধে একবার ওর জেল হয়েছিল। এছাড়া সে মারাত্মক ভাবে মাদকাসক্ত ছিল।
হাসনাত সাহেব শান্তনুকে একটা বাড়িতে রেখেছেন। মাদক নিরাময় কেন্দ্রের চাইতে ভালো ব্যবস্থা। দুইজন পুলিশ থাকে ওদের সাথে। ওদের বলতে আরেকজন লোকও সে বাড়িতে থাকেন। একজন ডাক্তার, আমজাদ মুস্তফী। ইনি একজন স্বাধীন গবেষক। হাসনাত সাহেব তার গবেষনার জন্য টাকা যোগাড় করে দেন ও বাড়িতে রেখেছেন। এরকম আরো অনেক লোককেই হাসনাত সাহেব সাহায্যের জন্য সেট করে রেখেছেন। এর মধ্যে জ্যোতিষি পর্যন্ত আছে।
একবার সে জ্যোতিষির কাছেও নিয়ে গিয়েছিলেন বিমলকে। তার নাম বাবা সদানন্দ। তিনি না হিন্দু, না মুসলমান। মুখভর্তি মেহেন্দি লাল দাঁড়ি, মাথায় পাগড়ী, দুই চোখ ঘোলাটে। আস্তানায় একটি অশীতিপর বটগাছের নিচে বসে ধ্যান করেন।
বিমলকে দেখে তিনি তার খসখসে গলায় বলা শুরু করেছিলেন, ব্যাটা, তোর মনে বড় কষ্ট। বউ বেজায় সন্দ করে। সারাদিন সারারাত, খিটিমিটি লাইগা থাকে, দিনযাপন অতিষ্ট। তবে চিন্তা নাই, বাবার কাছে আইছো যখন, সব ঠিক হইয়া যাইব মওলার ইশারায়।
বাবা সদানন্দ হয়ত আরো কিছু বলতেন। কিন্তু হাসনাত সাহেব বিরক্ত হয়ে বলেন, আরে বাবা সদানন্দ, এ তো বিয়াই করে নাই। কী কন এইগুলা!
বাবা সদানন্দ তখন প্রায় এক মিনিট চোখ বন্ধ করে থাকেন। এরপর চোখ খুলে মিষ্টি হাসি দিয়ে হাসনাত সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, আর বইলেন না, ফিউচার মুডে চলে গেছিলাম।
মিনিট দশেকের মধ্যে শান্তনুর বাসার সামনে গাড়ি পৌছল। পুলিশের একজন লোক দরজা খুলে দিলে হাসনাত সাহেব ও বিমল প্রবেশ করলেন। শান্তনু কম্পিউটারে তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। সে বেশী কথা বলে না। খালি হ্যা হু করে। হাসনাত সাহেব তার খোঁজখবর নিলেন। আমজাদ মুস্তফী সাহেবের সাথেও কথাবার্তা বললেন।
এরপর ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলেন বাসায় থাকা দুইজন পুলিশের লোককে নিয়ে। তাদের জিজ্ঞেস করলেন, সব কেমন চলতেছে? বলতে বলতে তার মোবাইল ফোন বের করলেন।
পুলিশের লোক দুইজনকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিল। কারণ তারা বুঝতে পেরেছে হাসনাত সাহেবের এভাবে বসার নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে।
একজন বলল, ভালো স্যার। কোন ঝামেলা হচ্ছে না।
হাসনাত সাহেব তার মোবাইলে ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস গেইম বের করে ওদের দেখিয়ে বললেন, এইটা চিনো?
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল দুইজন। তারা কিছু বলার আগেই হাসনাত সাহেব বলতে শুরু করলেন, এইটা একটা গেইম। সময় খাইতে থাকা গেইম। মানুষের ভেতরে আদিম যে প্রবৃত্তি আছে ক্ল্যান করার, মারামারি করার সেইটারে কাজে লাগাইয়া এই গেইমের ফিচার। খেললাম কয়দিন। মজা পাইছি, তবে এইটা আমি আর খেলবো না। আশা করি, তোমরাও এইটা খেলা বাদ দিয়া কাজে নজর দিবা। এইখানে সাবেক এক মারাত্মক কোকেনাসক্ত ব্রিলিয়ান্ট পোলারে তোমরা দেইখা রাখতেছ।। ভুইলা যাইও না। অবশ্য যে যদি চায় তাইলে তোমাদের বোকা বানাইতে পারবে, আমারেও পারবে। সেই ট্যালেন্ট তার আছে। কিন্তু কথা হইল, তোমাদের ওলওয়েজ সতর্ক থাকতে হবে। আর কোন ঝামেলা হইলে আমারে ফোন দিবা।
পুলিশের লোক দুইজন মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। মুখে বলল, জি স্যার।
হাসনাত সাহেব তার মোবাইল থেকে ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস ওদের সামনেই ডিলিট করলেন।
এরপর বিমলকে বললেন, চলো এইবার ক্রাইম সিনে যাওয়া যাক। এখানের কাজ শেষ।
অধ্যায়- দুই
একটি বেশ বড় বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামলো। সময় তখন ১০ টা।
এই বাড়ির ছেলে শাহরিয়ার হাসান আত্মহত্যা করেছে। ছেলেটির বয়স ছাব্বিশ সাতাশ। ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছে সে। বাড়ির সামনে পুলিশ, লাশ এখনো পড়ে আছে। হলুদ ফিতায় ডু নট ক্রস লাগিয়ে রেখেছে পুলিশ।
ডিটেক্টিভ হাসনাত এবং জুনিয়র ডিটেক্টিভ অফিসার বিমল গাড়ি থেকে নামলেন ও ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হলেন।
পুলিশের কয়েকজন সদস্য ডিটেক্টিভ হাসনাতকে দেখে সালাম দিল। তিনি একবার তাকালেন কিন্তু উত্তর দিলেন না বা তাদের কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। সোজা এগিয়ে গেলেন মৃতদেহ যেখানটাতে পড়ে আছে সেখানে।
মৃতদেহ উপুর হয়ে পড়ে আছে। মাথা ফেটে রক্ত বের হয়ে জমাট বেঁধে গেছে। ছেলেটির গায়ে একটি শাদা টি শার্ট এবং ত্রিকোয়ার্টার প্যান্ট। মৃতদেহ চিৎ করতেই দেখা গেল টি শার্টে একটি চাকুর ছবি।
ডিটেক্টিভ হাসনাত এগিয়ে গিয়ে লাশটির একেবারে কাছাকাছি গিয়ে হাটু ভেঙ্গে বসলেন। বিমলও তার পাশে গেল। দুয়েক মিনিট লাশ পর্যবেক্ষণ করে হাসনাত মুখ খুললেন।
হাসনাত বিমলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কী মনে হয় বিমল?
বিমল বলল, স্যার, মনে হয় ছাদ থেকে পড়েছে আর পড়ার সাথে সাথেই মারা গেছে।
কিছুটা বিরক্তির সাথে হাসনাত জবাব দিলেন, আরে এইটা তো আমরা এইখানে আসার আগে থিকাই জানি। ছাদ থিকা না পড়লে আর কই থিকা পড়বে? আরো কিছু দেখো, গুরুত্বপূর্ন কিছু পাও কি না।
বিমল জিজ্ঞেস করলো, পোষাক স্যার?
হাসনাত বললেন, ঘুমাইতে গেছিল মনে হয়।
বিমল বললো, দেখে তো মনে হয় না ডিপ্রেসড লোক ছিল। দিব্যি সুস্থ সবল।
হাসনাত বললেন, ইউ ক্যান নেভার নো মনের খবর। দেখতে সুস্থ সবল লোকের মনেও থাকতে পারে বিষাদ বিষাদ।
ডিটেক্টিভ হাসনাত চারদিকে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।
বিমল বললো, আর তো কিছু দেখি না স্যার।
হাসনাত জবাব দিলেন, দেখবা ক্যামনে? আগেই সব ঠিক কইরা বইসা আছো, প্রেমঘটিত মৃত্যু। তাই চোখ তো আন্ধা। দেখো, কয়দিন আগেই পোলাটা চুল কাটছে, দুইদিন বা একদিন আগে মে বি।
বিমল জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু এটা কি স্যার দরকারী তথ্য?
হাসনাত জবাব দেন, পর্যবেক্ষণের কালে খুঁটিনাটি সবই দরকারী। কখন কী কাজে লাগে ঠিক নাই। ছোট খাট জিনিস দেইখাও মানুষের চরিত্র বিষয়ে ধারনা নেয়া যায়। তাই একজনের চুল কাটার ধরন দেইখাও অনেক কিছু বুঝার আছে।
বিমল আগ্রহী ছাত্রের মত হাসনাতের কথা শুনল এবং মৃত ছেলেটির চুলের দিকে দেখছিল।
হাসনাত উঠতে উঠতে বললেন, উইঠা পড়ো, আর দেখার কিছু নাই। এতদিন আমার সাথে থাইকাও তোমার পর্যবেক্ষণের কোন উন্নতি দেখি নাই, তাই সে উন্নতির আশা আমি ছাইড়া দিছি।
বিমল এবং ডিটেক্টভ হাসনাত উঠলেন।
একজন পুলিশ অফিসারকে দেখে হাসনাত বললেন, ঐটা অফিসার রফিক না?
বিমল বলল, জি, রফিক সাহেবই।
হাসনাত স্বগোক্তির মত করে বললেন, লাশ ফালাইয়া রাখছে কেন!
তিনি পুলিশ অফিসারকে ডাক দিলেন, রফিক, আহমদ রফিক!
পুলিশ অফিসার ডাক শুনে তাকাল এবং হাসনাত সাহেবকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলো।
এসে বলল, কেমন আছেন স্যার? আপনার জন্যই আমি অপেক্ষায় আছি।
হাসনাত বললেন, অপেক্ষায় তো আইসা দেখলাম না। আর এই লাশ এইখানে ফালাইয়া রাখছো কেন?
আহমদ রফিক কিছুটা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, স্যার ওইদিকে একটু গিয়েছিলাম, বাড়ির ছাদে। আর লাশ রাখা হয়েছে আপনার দেখার জন্য, উপর থেকে নির্দেশ ছিল স্যার।
হাসনাত বললেন, আমার দেখা শেষ। এখন এইটারে সরাও।
জি স্যার।
আহমদ রফিক গিয়ে পুলিশকে নির্দেশ দিলেন। পাশে রাখা এম্বুলেন্স এদিকে আসছে। এরই মধ্যে হাসনাত ও বিমল হাঁটতে লাগলেন বাড়িটির মূল দরজার দিকে।
হাঁটতে হাঁটতে হাসনাত বললেন, এইবার একটু বাড়ির লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ কইরা কিছু জানা যাক। বিমল, তুমি একটু দেখো তো পরিবারের লোকেরা কথা বলার মুডে আছে কি না। কান্নাকাটিতে ব্যস্ত থাকলে আইজ কথা হবে না। কান্নাকাটি আমার নাপছন্দের জিনিস।
বিমল এগিয়ে গিয়ে আহমদ রফিকের সাথে কথা বলল। আহমদ রফিক একটা ফোন করলেন কাউকে। এরপর জানালেন যে পরিবারের লোকদের সাথে কথা বলা যাবে।
দরজার দিকে আবার হাঁটতে লাগলেন ডিটেক্টিভ হাসনাত ও বিমল।
বিমল একটু ইতস্তত করে বলল, স্যার, কথাবার্তা একটু হিসাব করে বলতে হবে মনে হচ্ছে। এরা মন্ত্রীর আত্মীয়।
তার কথার ধরনে মনে হলো সে ভয় পাচ্ছে ডিটেক্টিভ হাসনাত তার স্বভাবমত উলটাপালটা কথা বলে বসবেন।
ডিটেক্টিভ হাসনাত তার ভয়টি বুঝতে পারলেন। তিনি বিমলের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হাসলেন। তার হাসিটি চমৎকার, শিশুসুলভ হাসি।
ডিটেক্টিভ হাসনাত হাঁটেন ভিন্নভাবে। হাঁটার সময় পায়ের সামনের অংশ আগে ফেলেন, এরপর গোড়ালি বা পেছনের অংশ।
প্রথম যেদিন বিমল হাসনাত সাহেবের এমন হাঁটা দেখেছিল তখন সে ভেবেছিল হয়ত তার পায়ে কোন অসুবিধে আছে। কিন্তু পরে তাকে দিব্যি ফুটবল খেলতে দেখে বিমলের খটকা লাগে। একদিন বিস্ময় গোপন করতে না পেরে জিজ্ঞেস করে, স্যার আপনি মাঝে মাঝে এভাবে হাঁটেন কেন?
হাসনাত তখন মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, আরে ১৫০০ এডি’র আগে তো মানুষ এইভাবেই হাঁটত। তখন উন্নত মানের পাদুকা ছিল নাকি! সামনের পা আগে ফালানো মানে জায়গাটার ব্যাপারে এক ধারণা নেয়া, এবং সেই ধারণা নিয়া পুরা পা ফেলা। জীবনের সব ক্ষেত্রেই এই সতর্কতার স্টাইলটা দরকারী। তাছাড়া এইভাবে হাঁটলে পায়ের মাসল বেশী ব্যবহার হয়।
অধ্যায়- তিন
ড্রয়িং রুমে মৃত শাহরিয়ার হাসানের মা সালেহা খাতুন, বাবা আব্দুস সালাম, বোন মিলি ও তার স্বামী শাহাদুজ্জামান খান উপস্থিত আছেন।
বিমল এবং ডিটেক্টিভ হাসনাতও বসেছেন। পরিস্থিতি থমথমে।
হাসনাত কথা বললেন, আপনাদের জন্য দিনটা খারাপ, তাই আমি বেশী কিছু জানতে চাইব না। দুয়েকটা কোশ্চেন, সরাসরি এবং সত্য উত্তর দিয়ে বাধিত করবেন। আমি আপনাদের বেশী বিরক্ত করব না।
শাহরিয়ারের মা বললেন, বলুন, আপনি কী জানতে চান।
হাসনাত জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ছেলের এই আত্মহত্যার পিছে কী কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয়?
শাহরিয়ারের মা বললেন, আমরা এমন কোন কারণের কথা ভাবতে পারছি না। ও কখনোই আত্মহত্যাপ্রবণ ছিল না, বা কোন হতাশা ছিল এমনও নয়। তাই এরকম আত্মহত্যা ও কেন করবে আমরা ভাবতে পারছি না।
হাসনাত শাহরিয়ারের বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, দ্যাটস গুড। আর কিছু আপনারা জানাইতে পারেন? আপনার পোলার সাথে কারো বিরোধ?
শাহরিয়ারের বাবা উত্তর দিলেন, না, এমন কিছু আমি জানি না।
হাসনাত এবার মিলির স্বামীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনে এখানেই থাকেন? ঘরজামাই?
ভদ্রলোক বিব্রত হলেন এই প্রশ্নে। এই ধরণের প্রশ্নের জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না।
রাগান্বিত ভাবে মিলি বলল, এসব কী প্রশ্ন? ভদ্রভাবে কথা বলুন।
বিমল পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল, স্যার আসলে বুঝাতে চাচ্ছেন আপনারা এখানেই থাকেন কি না। উনি খারাপ ভাবে মিন করেন নি।
হাসনাত বেশ অবাক হবার মতো ভঙ্গী করে বললেন, অভদ্র কী কইলাম! ঘরজামাই তো একটা ভালো শব্দ। আমার নিজেরই ঘরজামাই হওয়ার ইচ্ছা ছিল, শ্বশুর মশাই দূর দূর করে তাড়াইয়া না দিলে তাই হইতাম।
রাগান্বিত ভাবে মিলি বলল, যাইহোক, আপনারা যা জানতে এসেছেন তা নিয়েই কথা বলুন। অপ্রাসঙ্গিক কিছু বলবেন না।
হাসনাত এবার একটু কঠিন স্বরে বললেন, নাথিং ইজ অপ্রাসঙ্গিক। কোন কিছুই অপ্রাসঙ্গিক নয়। আপনার ভাই মারা গেল, এখন আপনার বাবার সব সম্পত্তির মালিক হইবেন আপনে, ফলে আপনার জামাইও। তাই এই খুনে আপনাদের মোটিভ আছে, যুক্তির দিক দিয়া দেখলে। ফলে আপনার জামাই সম্পর্কে জানতে চাওয়াটা অপ্রাসঙ্গিক নয়।
মিলি উত্তেজিত হয়ে উঠল প্রায়। শাহরিয়ারের বাবা সালাম সাহেব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই মিলি বলল, হোয়াট ইজ দিস? আপনি এরকম করে কথা বলছেন কেন? আপনি এটাকে খুনই বা বলছেন কীভাবে? আর আমাদের উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়ার জন্য জানেন আপনার বিরুদ্ধে আমরা অভিযোগ করতে পারি?
হাসনাত সাহেব অমায়িক ভাবে বললেন, জি, জানি। যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। স্বাধীন দেশে সব রকম অধিকার সবার আছে। কিন্তু আমি তো কাউরে অপবাদ দেই নাই। প্রাসঙ্গিকতা দেখাইছি। যুক্তির বিচার দেখাইছি। কেউই সন্দেহের বাইরে নয়। এভ্রিওয়ান ইজ ইনসাইড সন্দেহ। আর খুন না আত্মহত্যা তা এখনো আমি নিশ্চিত না। লাশটা দেইখা আমার কেন জানি মনে হইছে এইটা মার্ডার!
ভ্রু কুচকে শাহরিয়ার বাবা সালাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কেন এটা মনে হচ্ছে?
ডিটেক্টিভ হাসনাত বললেন, কেন তা বলতে পারি না।
বিমলের দিকে দেখিয়ে বললেন, এই যে আমার সহকারী, এন্ড শিষ্য, তিন বছর আমেরিকায় গিয়ে পড়ালেখা আর ট্রেনিং নিয়া আসছে। সে লাশটা পইড়া আছে দেইখাই বলল, স্যার এইটা মার্ডার!
বিমলের কথা উঠতেই ডিটেক্টিভ হাসনাতের মনে পড়ল কিছু একটা। তিনি একটু থেমে শাহরিয়ারের মা এবং বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা, আপনার ছেলের কোন প্রেম ট্রেম ছিল? মানে এইটা কি প্রেমঘটিত কেইস?
শাহরিয়ারের বাবা যেন একটু বিব্রত হলেন।
শাহরিয়ারের মা দৃঢ়ভাবে বললেন, না, এরকম কিছু আমাদের জানা নেই।
হাসনাত এবার মিলি ও তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা জানেন?
বিরক্তভাবে মিলি জবাব দিল, না।
ডিটেক্টিভ হাসনাত বললেন, দ্যাটস গুড। আপনাদের সাথে কথা শেষ। এইবার আপনাদের ছেলের রুমটা একবার দেখতে চাই আমরা।
বসা অবস্থা থেকে উঠতে উঠতে হাসনাত সাহেব তার একটি কার্ড টেবিলে রেখে বললেন, পরে কোন বিশেষ যোগাযোগ করতে হইলে এই কার্ডে পাইবেন আমার এড্রেস।
অধ্যায়- চার
শাহরিয়ায়ের রুম। শাহরিয়ারের মা বাবা ডিটেক্টিভ হাসনাত ও বিমলকে নিয়ে শাহরিয়ারের রুমে গেলেন।
যেতে যেতে ডিটেক্টিভ হাসনাত বিমলকে বলছিলেন, রফিকরে ফোন দিয়া বলো এখানে আসতে। কিছু এভিডেন্স নিব আমরা।
শাহরিয়ারের রুমটা বেশ অগোছালো। একটা কাঠের বুকশেলফ বই ভর্তি। টেবিলের উপরেও অগোছালো ভাবে পড়ে আছে কয়েকটি বই। ডিটেক্টিভ হাসনাত পড়ে থাকা বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখলেন, লিংগুইস্টিক্স এর উপর বই। টেবিলের উপরে একটি কাপে অর্ধেক কফি পড়ে আছে। তাতে ভাসছে একটি মৃত কালো মাছি।
ডিটেক্টিভ হাসনাত মাছিটির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। এই রুমে মাছি আসলো কোত্থেকে?
অফিসার আহমদ রফিক চলে এসেছিলেন। তার কাছ থেকে সাদা হাত গ্লাভস নিয়ে এক হাতে পরলেন ডিটেক্টিভ হাসনাত। কাপটি সেই হাতে ধরে নাকের কাছে এনে শুঁকলেন।
শাহরিয়ারের বুক শেলফে টেকনোলজি, স্টার্টাপ, প্রোগ্রামিং নিয়ে বই দেখা গেল অনেক। পিটার থিয়েলের জিরো টু ওয়ান, নিক বস্ট্রোম এর সুপার ইন্টিলিজেন্স, পেড্রো ডোমিংগোস এর দ্য মাস্টার এলগোরিদম, এরিক রাইসের দ্য লিন স্টার্টাপ ইত্যাদি ইত্যাদি।
বইগুলো দেখতে দেখতে ডিটেক্টিভ হাসনাত শাহরিয়ারের বাবাকে লক্ষ করে বললেন, আপনার ছেলে তো পড়ুয়া আছিল। সে কী কাজ করত?
শাহরিয়ারের বাবা বললেন, আমার নিজের কোম্পানিতেই জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে ছিল এক বছর ধরে। তার আগে একটি টেক স্টার্টাপ দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু সফল হয় নি।
হাসনাত জিজ্ঞেস করলেন, তার পড়ালেখা কোন বিষয়ে?
শাহরিয়ারের বাবা উত্তর দিলেন, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ মাস্টার্স করেছিল।
হাসনাত গম্ভীর হয়ে বললেন, গুড।
বুকশেলফ দেখতে দেখতে আরেকবার অবাক হলেন গোয়েন্দা হাসনাত। শেলফে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ক কোন বইই নেই বলতে গেলে। একটি বই দেখা গেল জে ই গর্ডনের স্ট্রাকচারসঃ হোয়াই থিংস ডোন্ট ফল ডাউন।
হাসনাত বুক শেলফে যেন কিছু একটা খুঁজছিলেন। নিচের দিকের তাক থেকে একটি বই হাতে নিতে নিতে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বইয়ের নাম সিকারি। প্রচ্ছদে প্রাচীন জেরুজালেমের ছবি। লেখকের নাম আন্তোনিও গুতিয়ারেস।
বইটি হাতে নিয়েই যেন হাসনাতের সব তদন্ত শেষ হয়ে গেল। তিনি ঘুরে পুলিশ অফিসার আহমদ রফিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখো কী কী নেয়া যায়। কাপটা নিবা, আর ল্যাপটপ। টেবিলের বইগুলাও নিলে নিতে পারো।
আহমদ রফিক বলল, জি স্যার।
হাসনাত বললেন, কাপের মধ্যে দেখবা একটা মাছি মইরা আছে। এইটা কেমনে আইল আর মরলই বা কেমনে তাও বুঝা দরকার। আর দেখো তো ল্যাপটপটা অন কইরা।
গ্লাভস পরিহিত আহমদ রফিক ল্যাপটপ অন করলেন। কিন্তু দেখা গেল পাসওয়ার্ড দ্বারা প্রটেক্টেড।
রফিক বলল, স্যার, এটার পাসওয়ার্ড ভাঙতে হবে।
হাসনাত বললেন, উইনডোজের সাধারণ পাসওয়ার্ড ভাঙতে পারো না?
রফিক কিছুক্ষণ কম্পিউটার স্ক্রিণের দিকে তাকিয়ে ও কিবোর্ড চাপাচাপি করে বললেন, উইনডোজ না স্যার, মনে হচ্ছে অন্য কোন সফটওয়ার ব্যবহার করা হয়েছে লক করতে।
শাহরিয়ারের ঘর দেখে হাসনাত এবং বিমল বের হলেন। তারা হাঁটছিলেন গাড়ির দিকে।
হাসনাত হাঁটতে হাঁটতে বললেন, এই ছেলে বেশ ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার মনে হইল। এত পড়ালেখা কইরা সুইসাইড কইরা বসলো? ফানি!
বিমল বলল, স্যার, আপনি তো রুম ভালো করে দেখলেনই না।
হাসনাত বিরক্ত হয়ে জবাব দিলেন, ওইখানে দেখার কিছু নাই। পুরা জিজ্ঞাসাবাদ ও দেখাদেখিতে এখন পর্যন্ত দুইটা জিনিসই পাইছি আমি।
কী স্যার?
হাসনাত গম্ভীরভাবে, এক- ওর ফ্যামিলি কিছু লুকাইছে। দুই- ল্যাপটপে কিছু থাকলে থাকতে পারে।
বিমল উৎসুক ভাবে জিজ্ঞেস করল, কীরকম জিনিস থাকতে পারে আপনার মনে হয়?
হাসনাত বললেন, ডায়রির মত ইনফরমেশন। এখনকার পোলাপাইনের ডায়রি হইল ল্যাপটপে।
বিমল বলল, মোবাইলেও পাওয়া যেতে পারে।
হাসনাত সচকিত হয়ে বললেন, রাইট! এইটা আমার মনে আসে নাই। রফিকরে ফোন দিয়া কও মোবাইলটাও কব্জা করতে।
বিমল আহমদ রফিককে ফোন দিয়ে কথা বলল।
এরপর জানাল, স্যার, রফিক সাহেব বললেন মোবাইলটা পাওয়া যাচ্ছে না। বোধহয় লাফ দেয়ার সময় পকেটেই ছিল। রাস্তায় কেউ একজন নিয়ে নিয়েছে।
হাসনাত হতাশ মুখে বললেন, স্যাড! এখন তাইলে ল্যাপটপই ভরসা। রফিকরে বলতে হবে টেক টিমের দ্বারা এর পাসওয়ার্ড ভাইঙ্গা আমাদের হাতে দিতে। এরপর তুমি ঐটা চেক কইরা দেখবা। সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট, ফেইসবুক টেইসবুক ইত্যাদি। পারবা তো?
বিমল মাথা নেড়ে বলল, জি স্যার, অবশ্যই।
হাসনাত বললেন, তবে প্রফেশনালি কাজ করবা। ফ্রেন্ডলিস্টে সুন্দরী মেয়েছেলে দেইখা ফ্লার্ট করতে যাইয়ো না আবার!
বিমল হেসে বলল, স্যার যে কী বলেন না!
বিমল ও হাসনাত গাড়ির সামনে চলে এসেছিলেন।
হাসনাত গাড়িতে উঠতে উঠতে বললেন, এইসব জিনিসে আমার কাউরেই বিশ্বাস নাই।
গাড়ি স্টার্ট নিল।
অধ্যায় – পাঁচ
গাড়িতে ডিটেক্টিভ হাসনাত এবং বিমলের কথোপকথন চলছে।
হাসনাত বলতে থাকলেন, আপাতত তোমার কাজ হইতেছে শাহরিয়ার ছেলেটির বন্ধু বান্ধব, প্রেম ছিল কি না, কার সাথে শত্রুতা ছিল ইত্যাদি তথ্য কালেক্ট করা। এরপর কাদের সাথে আমরা কথা বলব গিয়া তাও নির্বাচন করতে হবে।
বিমল বলল, ওকে স্যার।
আর দ্বিতীয় এবং প্রধান কাজ হচ্ছে, আমার জন্য ন্যাশনাল লাইব্রেরী থেকে ক্যালিওগ্রাফির উপর কিছু বই নিয়ে আসা।
ক্যালিওগ্রাফি কেন স্যার?
ভাবতেছি হাতের লেখাটা একটু সুন্দর করতে হবে।
কী বলেন স্যার! আপনার হাতের লেখা এমনিতেই তো অনেক সুন্দর।
হাসনাত বিমলের দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, আমার হাতের লেখা আরেকটু বেশী সুন্দর হইলে তোমার কোন আপত্তি আছে?
বিমল বিব্রত হয়ে বলল, না, তা নেই।
হাসনাত বললেন, তাইলে যা বলেছি তাই করো।
বিমল কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, স্যার আমার একটা প্রশ্ন ছিল।
ডিটেক্টিভ হাসনাত শাহরিয়ারের বুক শেলফ থেকে আনা সিকারি বইটা পড়তে শুরু করেছিলেন। বই থেকে মুখ না তুলেই জিজ্ঞেস করলেন, কী প্রশ্ন?
বিমল বলল, এই যে স্যার এই বইটা নিয়ে এলেন, এর মানে বুঝলাম না। এর মাঝে কি কোন কিছু আছে যা দিয়ে রহস্যের সমাধান হতে পারে?
ডিটেক্টিভ হাসনাত বই থেকে মুখ তুলে বিমলের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই একটি গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন করেছো বিমল। সব সময় চোখকান খোলা রাখবা। মনে রাখবা যে শিখতেছ তুমি। তোমারে বিভ্রান্ত করার জন্য আমি ভুল ক্লু সামনে আইনা তোমারে ধাঁধায় ফেলতে পারি। তোমার মূল কাজ সতর্ক থাইকা আমার কাজ পর্যবেক্ষণ করা, এবং ঠিক জায়গায় ধইরা ফেলা। এই যেমন এখন ধরলা।
বিমল জিজ্ঞেস করল, তাহলে এই বইয়ে কিছু আছে বলছেন?
ডিটেক্টিভ হাসনাত বললেন, এই বইটা হইতেছে সিকারিদের নিয়া। সিকারিরা ছিল ইয়াহুদি এক গুপ্ত ঘাতক দল। ৭০ সিই’তে রোমানরা জেরুজালেমের দখল নেয়। এর পর থিকা ইয়াহুদিদের কিছু অংশ গুপ্ত ঘাতকদল তৈরী করে। তারা পাবলিক প্লেইসে গিয়া রোমান বা তাদের ইয়াহুদি সহকারীদের ছুরি মাইরা পলাইয়া যাইত। ভিড়ে মিশা যাইত।
বিমল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু এর সাথে…?
সে প্রশ্ন শেষ করতে পারে না। ডিটেক্টিভ হাসনাত বলতে শুরু করেন, এই গুপ্ত হত্যা টেকনিক সম্ভবত প্রথম আনছিল সিকারিরা। সিকারি মানে আসলে এক ধরণের ছুরি, যে ছুরি দিয়া তারা কার্য সমাধা করত। ইরানে হাশাসিনেরা এদের স্টাইলেই কাম করত। হাশাসিনেরা এদের দ্বারা প্রভাবিত আছিল। হাশাসিন থেকে এসাসিন বা গুপ্তঘাতক নামটাই আইল।
বিমল বলল, তার মানে স্যার, এটা এরকম কোন দলের কাজ? কিন্তু কি ইঙ্গিত আছে এর পক্ষে?
নিঃশব্দ মৃদু হাসির সাথে হাসনাত বললেন, এইজন্যই তো তোমারে বলি পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়াইতে। পইড়া থাকা শাহরিয়ারের টিশার্ট দেখো নাই। ওইখানে যে চাক্কুর ছবি, ওইটা সাধারণ চাক্কু না। সিকারি। দেইখাই আমার কেমন জানি লাগছিল। পরে বুক শেলফে গিয়া নিশ্চিত হইলাম এইটা সিকারি।
বিমল বলল, কিন্তু এটা তো এমনিতেই হতে পারে।
হাসনাত বললেন, এখনো আমি নিশ্চিত কইরা কিছু বলতেছি না। স্টাডি করতেছি। আমি দেখব এই টিশার্ট আইল কই থিকা। এছাড়াও ইতিহাস আমার প্রিয় টপিক। ফলে বইখান পড়তে ভালোই লাগবে। আর একজন ডিটেক্টিভের জন্য দুইটা জিনিস খুবই দরকারী। এক শক্ত কমন সেন্স, আর দুই নানা বিষয়ে বিস্তর জানাশোনা। নানা বিষয়ে জানাশোনা থাকলে এক কেইস না হোক অন্য কেইসে তা আলো দিতে পারে। এবং এইজন্যই আমি তোমারে পড়তে কই।
বিমল আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। হাসনাত তাকে থামিয়ে দিয়ে পড়ায় মন দিলেন। গাড়ি চলছিলো।
অধ্যায় – ছয়
এপ্রিল ৯, ২০১৭
যে ছেলেটি মারা গেছে, সেই শাহরিয়ার হাসানের কক্ষ। সময় রাত ১১ টা বা এরকম।
শাহরিয়ার তার কম্পিউটারের সামনে। ঘর অগোছালো, শাহরিয়ার খুবই উৎসাহ-উত্তেজনার সাথে চ্যাট করছে কারো সাথে। মেসেঞ্জারের মত একটা পপ আপ উইনডোতে নামটা দেখা যাচ্ছে অমৃতা। একটা ছবিও প্রোফাইল পিকচারে, সুন্দর দেখতে।
চ্যাট দেখা যাচ্ছে।
শাহরিয়ারঃ কেমন আছো?
অমৃতাঃ ভালোই, তবে খুব ভালো না।
শাহরিয়ারঃ কেন?
অমৃতাঃ এমনি।
শাহরিয়ায়ঃ কী করছো?
অমৃতাঃ শুয়ে আছি।
শাহরিয়ারঃ আমি শেষবার তোমাকে যখন দেখলাম, দেখেছিলাম ইউনিভার্সিটি গেইটের পাশে…
অমৃতাঃ সেদিন ফিরে এসে আমি পুরোটা দিন ঘুমিয়ে কাটাই।
শাহরিয়ারঃ ভালো করেছ। তোমার সাথে আসলে আমি জরুরী কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই।
অমৃতাঃ বলো, কী বিষয়?
শাহরিয়ারঃ তার আগে তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, ভালোবাসা মানে কী?
অমৃতাঃ এর কোন উত্তর হয় না।
শাহরিয়ারঃ তবুও বলো?
অমৃতাঃ সাইকোলজিক্যালী, এর কারণ দুইটা। এক- আমরা আমাদের মত লোকদের ভালোবাসি। মানে আমাদের চরিত্রে থাকা যেসব বিষয় আমাদের পছন্দের সেগুলি অন্যদের মধ্যে দেখতে পেলে আমরা তার দিকে আকৃষ্ট হই।
শাহরিয়ারঃ এবং দুই?
অমৃতাঃ দুই হলো, মানুষ সেই বিপরীত লিঙ্গের দিকে আকৃষ্ট হয়, যে ব্যক্তি তাকে তার বাবা বা মায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। এটা ফ্রয়েডিয়ান, এবং অবচেতন।
শাহরিয়ারঃ এই নাকী? এত সহজ সব কিছু?
অমৃতাঃ হ্যা, আমার মতে এমনই।
শাহরিয়ারঃ আমি মৃত্যু নিয়ে ভাবছি ইদানীং। তোমার মৃত্যু চিন্তা হয়?
অমৃতাঃ হা হা।
শাহরিয়ারঃ হা হা কী?
অমৃতাঃ মানুষ বুড়ো হলে তার ভেতর মৃত্যু চিন্তা জাগ্রত হয়। তুমি কী বুড়ো হয়ে গেলে?
শাহরিয়ারঃ না, আমার সব কিছু অর্থহীন লাগে।
অমৃতাঃ লাগাই তো স্বাভাবিক।
শাহরিয়ারঃ কী করছো এখন?
অমৃতাঃ শুয়ে আছি। সারাদিন শুয়ে থাকতে থাকতে শরীর ব্যথা হয়ে গেছে। আমার তোমাদের সাথে কথা বলা দরকার? তুষার কেমন আছে?
শাহরিয়ারঃ ভালো। সবাই তোমার কথা বলে। আমি তোমাকে স্বপ্নেও দেখলাম সেদিন 😛
অমৃতাঃ হাহা। স্বপ্নে মানুষ আসলে নিজেকেই দেখে। J
শাহরিয়ারঃ J
অমৃতাঃ আচ্ছা, একটা ভালো পেন্ড্রাইভ দরকার আমার। রঙ হতে হবে মেরুন। কোথায় পাওয়া যাবে বলো তো?
শাহরিয়ারঃ পেনড্রাইভ পাওয়া যাবে।
অমৃতাঃ আর একটা চাকু লাগবে, সিকারি।
শাহরিয়ার চ্যাট বন্ধ করলো। তাকে বেশ দুশ্চিন্তিত মনে হচ্ছে। কম্পিউটারের ব্রাউজার চালু করে সে সিকারি লিখে সার্চ দিয়ে এ বিষয়ে পড়তে লাগলো, এবং এ বিষয়ে লিখিত একটি বই অর্ডার করলো।
কিন্তু সে বুঝতে পারছে না অমৃতা কেন এই প্রাচীন ইহুদি গুপ্তঘাতক দলের কথা বার বার তুলে আনে, চ্যাটে কথাবার্তা হলেই। কোথাও কিছু একটা সমস্যা হয়েছে এটা নিশ্চিত। শাহরিয়ার তা ঠিকমতো ধরতে পারছে না।
দুই বছর আগে শাহরিয়ার তার এক বন্ধু আব্দুল আজিজের সাথে মিলে শুরু করেছিল তাদের স্টার্টাপ। কাস্টম টি শার্ট ডিজাইনের ব্যবসা। অনলাইনে তাদের সাইটে গিয়ে যে কেউ টি শার্ট ডিজাইন করে অর্ডার করতে পারতো।
সেই সময় নিজেদের নতুন কোম্পানির প্রচারনার জন্য বিভিন্ন পাবলিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিল শাহরিয়ার। কারণ অনলাইন ভিত্তিক এ ধরণের ব্যবসার মূল ভোক্তা হচ্ছে শিক্ষিত তরুণ সমাজ।
সেই কার্যকলাপের সময়ই তার পৃথার সাথে দেখা হয়। সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়ালেখা করছিলো। কন্ট্রিবিউটর হিসেবে দুয়েকটি দৈনিকের সাথে জড়িতও ছিল। তার মাধ্যমেই শাহরিয়ারের টি-শার্ট স্টার্টাপ জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ফিচার হয়।
অধ্যায় – সাত
সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৭
ডিটেক্টিভ হাসনাত জেরা করে যাবার পরের ঘটনা। ছেলে মারা যাওয়ায় বিধ্বস্ত সালাম সাহেব, এবং তার স্ত্রী। শক্ত ধাঁচের মানুষ হওয়ায় ভেঙ্গে পড়েন নি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের সব কিছু ভেঙ্গে যাচ্ছে।
সালাম সাহেব ঘূনাক্ষরেও ভাবেন নি তার ছেলে এইরকম একটা কাজ করতে পারে। গত কয়েক মাসে ধীরে ধীরে প্রায় আগের মতোই স্বাভাবিক সে হয়ে উঠেছিল কাজে কর্মে। হঠাৎ কী এমন হলো?
সালাম সাহেবের স্ত্রী অর্থাৎ শাহরিয়ারের মা সালেহা খাতুন সব কিছুর জন্য তার স্বামীকেই দায়ী করছেন মনে মনে। তার কথা হলো, কী এমন হতো ছেলের কথা মেনে নিলে? সমাজের লোকজন ও আত্মীয়স্বজন কী বলবে এই ভয় তো ছিল? এখন কি সমাজের লোকজন বা আত্মীয়স্বজন তার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে পারবে? মুখে কিছু বলছেন না তিনি। অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছেন।
ওদিকে শাহরিয়ারের বোন মিলির কক্ষে মিলি ও তার স্বামী শাহাদুজ্জামান। শাহাদুজ্জামান একজন বেশ নামকরা ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। শ্যালকের মৃত্যুতে সে ব্যথিত, এবং সাম্প্রতিক হাসনাত সাহেবের জেরাকর্মের পরে কিছুটা বিরক্ত।
মিলিকে সে বলল, আমার মনে হচ্ছে গোয়েন্দারা এসব খুঁজে বের করবে। সবচেয়ে ভালো হয় এদের কাছে খুলে বললে।
মিলি অবশ্যই একমাত্র ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যুতে শোকাহত। কিন্তু স্বামীর প্রস্তাব শুনে তেজের সাথে বলল, না। এসব পারিবারিক জিনিস বলার কোন মানে হয় না। সামি আত্মহত্যা করলে এর জন্য করে নি।
পরিবারে শাহরিয়ারকে সামি ডাকা হয়। এই ডাকনাম রেখেছিলেন শাহরিয়ারের দাদা মুন্সি আব্দুর রউফ। তিনি ছিলেন একজন বনেদি ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ।
শাহাদুজ্জামান বলল, কিন্তু কিছুই তো বলা যায় না। সামি কেন আত্মহত্যা করেছে তা তো আমরা জানি না। তাছাড়া ওরা কোন খোঁজ নেবে না ভাবছো? ওর ডায়রীটাও নিয়ে গেছে দেখলাম।
মিলি বিরক্তভাবে বলল, নিয়ে যাক। যা ইচ্ছা হয় করুক। আমি এসব নিয়ে ভাবতে চাচ্ছি না আর।
শাহাদুজ্জামান চুপ করে গেল।
কিন্তু তার মনে হচ্ছে সে যে আশংকা করছে তাই হবে। ডিটেক্টিভ লোকটা আবার আসবে। আবার জিজ্ঞাসাবাদ করবে। এবং এইবার কিছু জেনে ও তৈরী হয়ে আসবে। সেক্ষেত্রে তার শ্বশুর, শ্বাশুড়ী বা স্ত্রী যা লুকিয়ে গেছেন প্রথম স্বাক্ষাৎকারে, তা আর লুকাতে পারবেন না। বরং, প্রথমবার লুকিয়ে যাবার জন্য তারা পুলিশের সন্দেহে পড়বেন আরো বেশী।
অধ্যায় – আট
সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৭
গোয়েন্দা অফিস, সময় সকাল ১১ টা।
ডিটেক্টিভ হাসনাত ডিটেক্টিভ ব্র্যাঞ্চের বড় কর্তা হায়দার ফারুকের সাথে কথা বলছেন। হায়দার ফারুক বয়স্ক লোক। তার মাথার চুল ধবধবে সাদা।
হায়দার ফারুক বললেন, হাসনাত সাহেব, কেইসটা কি আত্মহত্যা?
হাসনাত জবাব দেন, কিছুই বলা যায় না স্যার। ইয়াং পোলা পাইনের মামলা, এরা কখন কী করে এর ঠিক নাই।
আপনার কী মনে হয়?
আমার মনে হয় কোন ঘটনা আছে। আমরা দেখতেছি বিষয়টা।
গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। আইন মন্ত্রীর আত্মীয় বলে কথা।
স্যার, এই বিষয়ে আই হ্যাভ নাথিং টু ডু। আমার কাছে মন্ত্রীর কেইস না ফকিন্নির কেইস তা দেখার বিষয় না। আমি অনলি তদন্তে ইন্টারেস্টেড।
হায়দার ফারুক হেসে বললেন, তা ঠিক আছে। কাজ করেন, আর আমারে আপডেট জানাবেন।
ওকে স্যার, উঠি তাইলে।
হাসনাত সাহেব উঠলেন, এবং প্রস্থান করলেন। তিনি তার নিজের চেয়ারে আসার একটু পরেই পুলিশ অফিসার আহমদ রফিক একটি প্যাকেট নিয়ে আসলেন। আহমদ রফিক বললেন, স্যার, এটা শাহরিয়ারের ডায়রী। আমি একবার পড়ে দেখেছি। মনে হচ্ছে এখান থেকে গুরুত্বপূর্ন কিছু আপনি পেতে পারেন।
হাসনাত সাহেব আগ্রহী হয়ে ডায়রিটি হাতে নিলেন ও পড়তে শুরু করলেন। মৃত শাহরিয়ার হাসান যার সাথে দু’দিন আগেও কোনরূপ দেখা স্বাক্ষাত বা কথাবার্তা ছিল না, আজ তার মৃত্যুর পর তাকে ভালোভাবে জানতে হচ্ছে। তার মন মানসিকতা বুঝার চেষ্টা করতে হচ্ছে। বিষয়টা হাসনাত সাহেবের অদ্ভুত লাগে।
অধ্যায় – নয়
সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৭
সকালের দিকে বিমল বের হয়েছে তদন্ত কাজে। শাহরিয়ারের পরিচিত ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা করছে, কথা বলছে। একজন লোককে ভালো করে বুঝতে হলে তার বন্ধুবান্ধবের সাথে কথা বলা বেশ কাজে দেয়।
এই কেইসটাকে বিমলের মনে হচ্ছে সহজ ও সাধারণ কেইস। কিন্তু হাসনাত স্যারের ভাবভঙ্গী দেখে তার খটকা লাগছে। মনে হচ্ছে তিনি বড় রহস্যের সন্ধান পেয়েছেন।
হাসনাত লোকটাকে বিমলের অদ্ভুত লাগে। তাকে যখন হাসনাত সাহেবের সহকারী করে দেয়া হয় তখন বড়কর্তা হায়দার ফারুক বলেছিলেন, বিমল, হাসনাত সাহেবের সাথে কাজ করে তুমি যা শিখতে পারবে, বই পড়ে বা ক্লাস করে এর দশমাংশও শিখতে পারবে না। তাই লেগে থাকো।
লেগে থাকাটা জরুরী। কারণ হাসনাত সাহেবের সাথে কেউ বেশীদিন কাজ করতে পারে না। প্রথমত, তিনি কাজ করেন তার নিজের স্টাইলে। ফলে শিখে আসা অনেক নিয়মের উলটা গিয়েও অনেক সময় কাজ করতে হয়।
বিমল প্রায় ছয়মাস ধরে হাসনাত সাহেবের সাথে কাজ করছে। এই ছয়মাসে সে যা লক্ষ্য করেছে তা হলো, হাসনাত সাহেব স্বাভাবিক প্রকৃতির লোক না। হঠাৎ হঠাৎ তার মুডের পরিবর্তন হয়। গুরুত্বপূর্ন কাজ ফেলে রেখে অনেক তুচ্ছ কাজ অনেক সময় তিনি গুরুত্ব দিয়ে করে থাকেন।
যেমন, কয়েক মাস আগে এক অপরাধী ধরা পড়েছে, তার সাথে কথাবার্তা বলার মত গুরুত্বপূর্ন কাজ তিনি বিমলের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজে চলে গিয়েছিলেন ফুটবল খেলতে। এলাকার ফুটবল ক্রিকেট সংস্থায় তার সদর্প উপস্থিতি। নিয়মিত চাঁদা দেন, খেলেন, খেলা দেখেন ও এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে নিয়মিত অংশ নেন।
এমনিতে বিমল দেখেছে হাসনাত সাহেব বিজ্ঞানমনস্ক লোক। তদন্তের ক্ষেত্রে যুক্তিকে প্রাধান্য দেন। কিন্তু সেই হাসনাত সাহেবকেই তার এলাকার দলের ফাইনাল খেলার আগের দিন রাত জেগে মাঠ পাহাড়া দিতে দেখেছে বিমল। রাত জেগে মাঠ পাহাড়া দিচ্ছিলেন যাতে প্রতিপক্ষ পিচে তাবিজ গেড়ে না রাখতে পারে।
হাসনাত সাহেব বিশ্বাস করেন এমন তাবিজের ফলে ব্যাটসম্যান ক্রিজে বেশীক্ষণ থাকতে পারে না। মনঃসংযোগে ব্যঘাত হয়, গা জ্বালাপোড়া করে। ফলে দ্রুত আউট হয়ে যায়।
এমনিতে প্রথম দেখায় কেউ ভাবতে পারে, অপ্রমিত ভাষায় কথা বলা এই লোকটি হয়ত কিছুই জানে না তেমন। কিন্তু বিমল দেখেছে সাধারণ অনেক বিষয়েও গভীর জ্ঞাণ রাখেন হাসনাত সাহেব। পাখি ও ইঁদুরের বংশবিস্তারের বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজি নিয়ে একদিন এক ঘন্টার লেকচার দিয়েছিলেন বিমলকে, তাও একটি রেইপ কেসের তদন্ত থেকে ফেরার পথে।
হাসনাত সাহেব নিজের পরিবার পরিজন নিয়ে কিছু বলেন না। বিমল জেনেছে বিয়ের পাঁচ বছর পরে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে আমেরিকায় চলে যান। সঙ্গে নিয়ে যান দুই মেয়েকে। এরপর থেকে তাদের সাথে হাসনাত সাহেবের কোন যোগাযোগ নেই।
তিনি একাই থাকেন। তাকে রান্নাবান্না ইত্যাদি করে দিয়ে যান, প্রায় বিশ বছর ধরে এক মহিলা। হাসনাত সাহেব তাকে ডাকেন গয়নার মা বলে। ভদ্রমহিলার দুই মেয়ে, ময়না ও গয়না।
বিমল মৃত শাহরিয়ার সম্পর্কে যেসব তথ্য পেল তার মধ্যে আছে, বছর দুই আগে শাহরিয়ার একটি অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসা শুরু করে এবং এতে তার লস হয়, ব্যবসাটি দাঁড়াতে পারে নি। শাহরিয়ারের সাথে পৃথা নামের একটি মেয়ের প্রেম ছিল।
বিমল সিকারি নামক ছুরি ও গুপ্তসংঘের ব্যাপারে খোঁজ করেছিল গুরুত্ব দিয়ে। কিন্তু এ ব্যাপারে তেমন কোন তথ্য সে পায় নি।
এমনিতে প্রাচীন সিকারিদের সম্পর্কে যা জানা গেলো তা হলো, ৭০ কমন এরায় জেরুজালেমের যখন পতন হলো, তখন ইজরাইলি ইহুদিদের অনেকেই তাদের ভূমি রোমানরা অধিকার করে নিয়েছে এটা মানতে পারে নি। তাদের মধ্যে অনেকে বিদ্রোহী হয়। এর মধ্যে একদল ছিল সিকারি। সিকারিরা ইহুদিদেরও হত্যা করত, যারা রোমানদের সাথে হাত মিলিয়ে ছিল। তাদের প্রথম শিকার ছিল বড় ধর্মযাজক জোনাথন।
প্রথম ইহুদি-রোমান যুদ্ধে সিকারিরা জুদাসপুত্র ম্যানাহেমের নেতৃত্বে রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তাদের সঙ্গে অন্যান্য বিদ্রোহীরাও যুক্ত হয়ে রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ও তাদের জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত করে। কিন্তু পরে নেতৃত্বের জন্য বিভিন্ন গ্রুপ নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত হয়। ম্যানাহেম সব বিদ্রোহীদের একচ্ছত্র নেতা হতে চেয়েছিলেন। তিনি টেম্পলের মেসাইয়াহ রাজা উপাধী নিয়ে নেতৃত্ব দিতে চেয়েছিলেন। এতে অন্যান্য বিদ্রোহী দল ক্ষীপ্ত হয়ে সিকারিদের আক্রমন করে।
ম্যানাহেমকে পরাজিত করা হয়, বন্দী করা হয়। নির্যাতন করা হয় এবং কিছু অনুসরনকারী সহ হত্যা করা হয়।
এরপর সিকারিদের যারা বেঁচেছিল তারা পালিয়ে চলে যায় মাসাদাতে। সেখান থেকে তারা আর রোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হয় নি। আশপাশের ইহুদি গ্রামগুলিতেই তাদের তৎপরতা জারী রেখেছিল।
রোমানরা যখন মাসাদাতে সিকারিদের দূর্গ দখল করে তখন দেখতে পায় দুইজন মহিলা ও পাঁচটি বাচ্চা ছাড়া তাদের প্রায় সবাই আত্মহত্যা করেছে।
এইসব তথ্য জেনে বিমল একটু বিভ্রান্তই হয়। সে ভেবে পায় না এর সাথে কীভাবে শাহরিয়ারের মৃত্যুর কোন সম্পর্ক থাকতে পারে। দুয়েকটা বিষয় এখানে আছে, এই ইতিহাসে। যেমন, বিদ্রোহী গ্রুপদের ভেতরে কলহ, সিকারিদের আত্মহত্যা। এই দুই ইংগিতকে নিলে এমন ভাবা যায় যে, শাহরিয়ারের আত্মহত্যা কোন কলহের দরুণ, সেক্ষেত্রে তার এটি আত্মহত্যা না, কেউ খুন করিয়েছে। আর আরেকটি ব্যাপার হতে পারে, কোন ভয়ংকর অপমানের হাত থেকে বাঁচতে এই আত্মহত্যা, যেমন সিকারিরা করেছিল।
এইসব ভাবলেও কেন যেন বিমলের কাছে যুৎসই মনে হলো না।
অধ্যায়- দশ
মিলি তার ঘরে বসে আছে। একমাত্র ভাইয়ের মৃত্যু তাকে ব্যথিত করেছে। শাহাদুজ্জামান যেসব ব্যাপারে কথা বলতে চাইল, অর্থাৎ যেসব জিনিস ডিটেক্টিভের কাছে লুকিয়েছেন বাবা মা, সেসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে না মিলি। কিন্তু অন্য একটি ব্যাপারে তার খটকা লাগছে।
ছোটবেলা থেকেই খুব সন্দেহপ্রবণ মন। এর কারণ ছিল একটি অনাকাঙ্খিত বাজে অভিজ্ঞতা। সেই ট্রমার কারনেই সম্ভবত মিলি কাউকে তেমন বিশ্বাস করতে পারে না, এবং তার মেজাজ একটু খিটখিটে ধরণের।
যে ব্যাপারটি নিয়ে তার খটকা সেটি হলো প্রায় এক মাস আগে একদিন শাহরিয়ার এসেছিল তার ঘরে। এসে তাদের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশ্ন করলো। নিজের ভাইকে মিলি ছোটকাল থেকেই চিনে। কখনো প্রাচীন ঐসব জিনিস নিয়ে শাহরিয়ারের কোন আগ্রহ ছিল না।
ইতিহাসে, পুরাতন জিনিসে আগ্রহ ছিল মিলির। সে পড়াশোনা করেছে নৃতত্ত্বে। মাস্টার্সের থিসিস ছিল প্রাচীন শহর অংগারকেল নিয়ে, যে শহরের কোন চিহ্ন এখন আর মানচিত্রে পাওয়া যায় না। কিন্তু শহরটি বা সেইসময়ের পর্তুগিজদের সাথে তাদের পরিবারের একটি সংযোগ রয়ে গেছে।
শাহরিয়ার এসে জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা তুমি তো আমাদের পূর্বপুরুষদের নিয়ে কাজ করেছ। বাবার কাছে যে শুনেছিলাম আমাদের পরিবারে পর্তুগিজ রক্ত বইছে, এটা কি সত্যি?
মিলি জবাব দিয়েছিল, আমাদের পূর্বপুরুষদের সাথে পর্তুগিজদের ঘনিষ্ট সংযোগ ছিল। সেই হিসেবে ধারণাটি অমূলক নয় একেবারে। এমন হতে পারে।
শাহরিয়ার জিজ্ঞেস করলো, এটা আনুমানিক কতো সময় আগে?
মিলি বললো, আমি আমাদের পরিবারের সাথে পর্তুগিজদের সংযোগ নিয়ে তো কাজ করি নি। এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্যও নেই। তবে কিছু সংরক্ষিত চিঠিতে প্রমাণ আছে পর্তুগিজদের সাথে আমাদের পূর্বপুরুষেরা ব্যবসা করেছিলেন। কিন্তু পারিবারিক সংযোগ কীভাবে হলো বলতে পারি না। প্রায় ৫০০ বছর আগে প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে পর্তুগিজরা আসে চট্টগ্রামের পূর্বপ্রান্তে। সেখানে তারা প্রতিষ্ঠা করেছিল কয়েকটি শহর। এমন একটি শহর নিয়েই আমি কাজ করেছিলাম।
শাহরিয়ার তখন চিন্তিত মুখে তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে দেখাল। সেখানে ছোট আকৃতির বাঁকানো এক ছুরির ছবি। ছবিটি মিলির হাতে দিয়ে সে বলেছিল, দেখো তো এই ছুরি চিনতে পারো কি না?
ব্যাপারটা মিলির কাছে অদ্ভুত ঠেকেছিল। ছবিটি দেখে সে বলেছিল, এটা তো একটা ছুরি।
শাহরিয়ার বলল, হ্যা, কিন্তু এই ধরনের একটা প্রাচীন ছুরি আমাদের বাড়িতে ছিল না। দাদার কাছে সংরক্ষিত?
মিলি ব্যাপারটা ঠিক মনে করতে পারলো না। দাদা মুন্সি আব্দুর রউফ তাদের পরিবারের স্মৃতি হিসেবে অনেক ঐতিহ্যবাহী জিনিসই সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। তার মধ্যে ছুরি, তরবারি, কারুকাজ করা তরবারির খাপ, নানা ধরণের পুঁথি ইত্যাদি ছিল। ফলে এ ধরণের ছুরি থাকলেও থাকতে পারে।
মিলি জিজ্ঞেস করেছিল, দেখেছিলাম মনে হয়। কিন্তু এটা নিয়ে তোর আগ্রহ কেন?
উৎসাহিত হয়ে শাহরিয়ার বলতে লাগলো, এটা হচ্ছে এক ধরণের ছুরি, যার নাম সিকারি। প্রাচীন এক গুপ্তসংঘের মতো ছিল একবার বর্তমান ইজরাইলে। এরা এই ধরণের সিকারি দিয়ে তাদের শত্রুদের খুন করতো।
মিলি জিজ্ঞেস করলো, তো?
শাহরিয়ার বলতে থাকলো, আমি ঘটনাক্রমে এর ব্যাপারে জানতে পারি। পরে বাংলাদেশে পর্তুগিজদের আগমনের সাথে সাথে এই ধরণের ছুরির এদেশে আগমন হয়, এমন একটি ধারণা আমার মনে পোক্ত হয় দাদার কাছে সংরক্ষিত ছুরিটির কথা ভেবে। ইংরেজ আগমনের পরে পর্তুগিজদের সাথে ঝামেলা হলো না?
মিলি বলল, হ্যা। তাছাড়া প্রথম খ্রিস্টান ধর্ম ও ব্যবসা করার জন্য এলেও পর্তুগিজরা ডাকাতি শুরু করেছিল। মানুষেরাও হার্মাদ পর্তুগিজদের পছন্দ করতো না।
শাহরিয়ারের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে বলল, ঠিক তখনই পর্তুগিজরা সিকারিদের মতো এক গুপ্তসংঘ গঠন করে। এদের কাজ ছিল ইংরেজ কর্মকর্তা ও ইংরেজদের এদেশীয় সহকারীদের খুন করা।
মিলি বেশ মজা পেয়েছিল ভাইয়ের কথাবার্তায়। সে সামান্য হেসে জিজ্ঞেস করল, তাই নাকি?
শাহরিয়ার বলল, এটা হাসির কথা নয়। আমি প্রায় নিশ্চিত। পর্তুগিজদের প্রতাপ কমে যাওয়া এবং ইংরেজদের প্রতাপ বাড়ার সাথে সাথে কিছু এদেশীয় পর্তুগিজ সহকারী চলে গিয়েছিল ইংরেজদের সাথে ব্যবসায়। আর কিছু রয়ে গিয়েছিল পর্তুগিজদের সাথে। পর্তুগিজরা যখন ইংরেজদের সাথে স্থানে স্থানে মার খেয়ে পর্যুদস্ত তখন তারা তাদের এদেশীয় সহকারীদের নিয়েই বানিয়েছিল একটি গুপ্তসংঘ, সিকারিদের আদলে। এ বিষয়ে কিছু জিনিস আমি পেয়েছি। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো আমাদের পূর্বপুরুষ যারা পর্তুগিজদের সাথে ব্যবসা করতেন তারা কি ইংরেজদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন, নাকী পর্তুগিজদের গুপ্তসংঘে যোগ দিয়েছিলেন।
মিলি বলল, আমার এই চিন্তাকে উদ্ভট মনে হচ্ছে। আমি এমন কিছু পাই নি। ঐসময়ের ব্যাপার নিয়ে সেবাস্টিন ম্যানরিকের যে বই…
কথা শেষ হবার আগেই শাহরিয়ার থামিয়ে দিয়ে বলল, ম্যানরিকের বই থেকে সব বুঝা যাবে না। অংগারকেল শহরের খোঁজ কিজন্য মানচিত্রে পাওয়া যায় না?
মিলি বেশ কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন পাওয়া যায় না?
শাহরিয়ার বলল, কারণ কিছু লোক চায় না এটার ব্যাপারে লোকে জানুক। এজন্য ম্যানরিকের বইয়ের কিছু অংশ সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।
মিলি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল, কেন? এবং তারা কারা?
শাহরিয়ার বলল, সেই পর্তুগিজদের গুপ্তসংঘ। তারা এখনো আছে। প্রজন্মান্তরে সংঘের শপথ রক্ষা করে চলেছে।
চোখ বড় বড় করে মিলি জিজ্ঞেস করল, মানে কী? ওরা খুন করছে এখনো, এটা বলছিস?
শাহরিয়ার বলল, না, সেটা স্পষ্ট করে বলার মত যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত আমার কাছে নেই। কিন্তু ওরা আছে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। এবং আমার ষষ্ট ইন্দ্রিয় বলছে ওরা তাদের ব্যাপারগুলো প্রকাশ হয়ে যাবে জানলে, সংঘের শপথ অনুযায়ী খুন করতেও দ্বিধা করবে না।
মিলি জিজ্ঞেস করল, তুই এতসব কীভাবে জানলি?
বিষন্ন মুখে শাহরিয়ার জবাব দিল, পৃথা এ নিয়ে কাজ করছিলো। ওর ফাইল, খসড়া লেখা ইত্যাদি দেখে বুঝলাম প্রায় অনেকটাই জেনে গিয়েছিল।
শাহরিয়ার অল্প ক্ষণ চুপ করে রইল। পৃথার কথা উঠায় মিলিও আর কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। এক ধরণের অপরাধবোধে আক্রান্ত হলো মিলি। এবং একই সাথে একমাত্র ভাইয়ের বিষাদ ও মানসিক সুস্থতার প্রশ্ন তাকে চিন্তিত করে তুললো।
শাহরিয়ার পৃথার কথা উঠায় নিজেই চমকে উঠেছিল। এই পরিবারের কারো সাথে, এমনকী এই বাড়ির চার দেয়ালের ভেতরে পৃথার নাম উচ্চারণ হোক, সে চায় না।
শাহরিয়ার নিঃশব্দে উঠে চলে যায়।
মিলি ভেবেছিল বাবা মা’র সাথে এ নিয়ে কথা বলবে। কিন্তু স্বামীর সাথে কিছু ঝামেলায় ও ব্যবসার ব্যস্ততায় আর বলা হয়ে উঠে নি।
আজ ভাইয়ের মৃত্যুর পরে ঘটনাটি বার বার মনে হচ্ছে। শাহরিয়ার কি মানসিক ভাবে অসুস্থ ছিল? কোন এক কল্পিত গুপ্তসংঘের ভয়ে ভীত, এক ধরণের প্যারানয়েড অবস্থা? নাকী সত্যি সত্যি এরকম কিছু আছে, এবং সেই সংঘই শাহরিয়ারের মৃত্যুর জন্য দায়ী? মিলি স্পষ্টভাবে দেখেছিল মৃত শাহরিয়ারের শাদা টিশার্টের মধ্যে সেই ধরণের এক ছুরির ছবি। ছবিটি চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠছে।
অধ্যায় – এগারো
বিমল সন্ধ্যার দিকে চললো ডিটেক্টিভ হাসনাতের বাসার দিকে। তদন্তের বাইরেও আরেকটি ব্যাপার নিয়ে সে বেশ দুশ্চিন্তায় আছে। তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা ও মা হাই স্কুলের শিক্ষয়ত্রী ছিলেন, তিনিও অবসর নিয়েছেন পাঁচ বছর হলো। কিন্তু সম্প্রতি মায়ের অদ্ভূত এক সমস্যা হয়েছে। তিনি মাঝে মাঝে বিশ্বাস করেন তিনি মারা গেছেন। ডাক্তাররা একে বলেন এক ধরণের ডিল্যুশন, নাম কটার্ড সিন্ড্রোম। কয়েকদিন পর পর এমন ঝামেলা হয়। তখন বাবা’র পক্ষে একা সামাল দেয়া অনেক কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। গুরুত্বপূর্ন কাজ না থাকলে বিমল ছুটি নিয়ে চলে যায়। আজ তার বাবা ফোনে জানিয়েছেন মায়ের সমস্যা আবার শুরু হয়েছে। কিন্তু হয়ত এবার বিমল যেতে পারবে না। কারণ মনে হচ্ছে নতুন কেসটা তাড়াতাড়ি শেষ হবে না।
হাসনাত সাহেবকে মায়ের অসুস্থতার কথা বললে সাথে সাথেই ছুটি দিয়ে দিবেন। কিন্তু কাজ ফেলে রেখে এমন ছুটি নিতে চায় না বিমল। দায়িত্বের ব্যাপারে সে সচেতন।
দরজা খোলাই ছিল। বিমল ভেতরে গিয়ে দেখলো হাসনাত সাহেব ঘর ঝাড়ু দিচ্ছেন। বিমলকে দেখে তিনি হাসলেন কিন্তু তার কাজ বন্ধ করলেন না। বিমল তার পাশে ফাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, এই সময়ে ঝাড়ু দিচ্ছেন কেন? আমার হাতে দেন, আমি দিয়ে দেই।
ঝাড়ু দিতে দিতেই ডিটেক্টিভ হাসনাত বললেন, ঘর ঝাড়ু দিবার আলাদা সময় আছে নাকী! আর তুমি ঝাড়ু দেয়ার কী জানবে? তোমারে যে কাজটা দিলাম সেইটা করতে পারলেই এনাফ।
বিমল বলল, কাজ করা হয়েছে স্যার ঠিকমতো। বেশ কিছু তথ্য মিলেছে। অনেকের সাথে কথাবার্তাও বলেছি।
ঘরের কোনা ঝাড়ু দিতে দিয়ে হাসনাত বললেন, গুড। এবার ঘর ঝাড়ু দেয়ার ব্যাপারে একখানা গুরুত্বপূর্ন কথা বলি। ওলওয়েজ মনে রাখবা, ময়লা গিয়া জমা হয় ঘরের কোনায়। তাই ঝাড়ু দেবার কালে সতর্কভাবে কোনাগুলি ঝাড়ু দিবা।
হাসনাত সাহেব ঝাড়ু দেয়া শেষ করলেন। ময়লা নিয়ে ফেললেন ঝুড়িতে। এরপর চেয়ারে বসলেন। বিমল আরেকটি চেয়ার নিয়ে বসল।
হাসনাত বললেন, এইবার রিপোর্ট পেশ করো।
বিমল কিছু কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল, এইখানে আছে স্যার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এবং আমার পাওয়া তথ্য ও জিজ্ঞাসাবাদের লিখিত বিবরণ।
হাসনাত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, প্রেমিকা পাইলা?
বিমল বলল, জি স্যার, তাকে চিনবেন আপনি।
হাসনাত সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমি চিনব?
বিমল বলল, এই মেয়ের নাম অনিন্দিতা দাশ পৃথা।
হাসনাত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ঐ যে নিউজ চ্যানেলের রিপোর্টার, বেড রুমে খুন হইছিল, এন্ড পরে আর কোন ক্লু পাওয়া যায় নাই, ঐ কেইস?
বিমল মাথা নেড়ে বলল, জি স্যার, ঐ কেইস।
হাসনাত জিজ্ঞেস করলেন, ঐটা প্রায় ছয় সাত মাস আগের কেইস না?
বিমল বলল, জি স্যার, প্রায় ছয় সাত মাস আগেই খুন হয় মেয়েটি।
হকিছুটা বিরক্ত হয়ে হাসনাত সাহেব বললেন, তাইলে এইটা এইখানে টাইনা আনার মানে কী? তোমার মাথাটা কি গেছে? এতদিন পরে আইসা প্রেমিকার শোকে সুইসাইড করছে বলতেছ আমারে?
বিমল বলল, না স্যার, আমার কথা প্রেম ঘটিত সুইসাইডে না, আমি বলতে চাচ্ছি ধরুন, মেয়েটাকে কারা খুন করেছে তা তো বের হয় নি…
হাসনাত সাহেব হাত নেড়ে ধুলো ঝাড়ার মতো ভঙ্গি করে বললেন, উপরের চাপে বের করা যায় নি…
বিমল বলল, জি…মানে আমরা যা ধারনা করছি, কিছু গোপন ফাইলপত্র পেয়ে গিয়েছিল মেয়েটি, তাই তাকে মেরে ফেলা হয়। এখন, আমার মনে হচ্ছে এই ছেলেটিও সেই ফাইলের ব্যাপারে জানত…
হাসনাত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে সে জানাইল না কেন?
বিমল বলল, হয়ত সে বুঝতে পেরেছিল জানালে কিছুই হবে না। কারণ এই ফাইলপত্র পেলে কে মেয়েটিকে খুন করেছে বা করিয়ে থাকতে পারে তা তো তার অজানা থাকার কথা। ফলে সে হয়ত অন্য কোনভাবে…
হাসনাত ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রতিশোধ নিবার ট্রাই করতেছিল?
বিমল বলল, ঠিক তাই স্যার।
হাসনাত সাহেব বললেন, ঠিক আছে। তুমি এখন আমার বাড়ি থেকে বাইর হও। এনাফ কাজ করছো আইজ। আর কাইল দিনে একবার আমারে তোমার বাসায় নিয়া যাইবা।
বিমল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন স্যার?
হাসনাত সাহেব বললেন তোমার বুকশেলফে যত থ্রিলার মার্ডার মিস্ট্রি পপুলার ফিকশন আছে সবগুলা আমি ভাগাড়ে ফেলে দিব। অন্যথায়, তোমার উর্বর মস্তক এইসব উদ্ভট ভাবনা ভাইবাই যাবে।
বিমল চুপ হলো। হাসনাত বিমলের দেয়া কাগজগুলোর উপর চোখ বুলাচ্ছিলেন।
এই সময়ে দরজা খুলে বাজার সদাই হাতে প্রবেশ করলেন গয়নার মা। বিমলকে দেখে তিনি খুশি হলেন।
বিমলকে ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, ভাইজান, আসছেন কখন?
বিমল বলল, এই একটু আগে। আপনি কেমন আছেন?
গয়নার মা হাসিমুখে বললেন, ভালাই আছি। আইজ খাইয়া যাইবেন রাইতে।
হাসনাত সাহেবের দিকে তাকিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, ভাইজান, তুমি ঝাড়ু দিয়ে গোছল করো নাই, না হাত মুখ না ধুইয়াই লাইগা গেলা?
হাসনাত সাহেব মুখ তুলেও তাকালেন না।
এইরকম একটা মানুষ যে হইতে পারে… বলতে বলতে ভদ্রমহিলা রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন।
হাসনাত সাহেব পড়ছিলেন…পড়তে পড়তে মনে হলো তিনি আলাদা কিছু পেয়েছেন।
পড়তে পড়তেই, অনুচ্চ স্বরে বললেন, আরে কী লেখছো এইগুলা…
তিনি পড়তে থাকলেন,
শাহরিয়ারের বন্ধু আফজাল আহমেদ এবং সাব্বিরের সাথে কথা বলে জানা গেছে শাহরিয়ারের ভেতরে উচ্চতা থেকে লাফ দেবার এক অনুভূতি কাজ করত। এটা অনেকেরই থেকে থাকে। জার্নাল অব এফেক্টিভ ডিজওর্ডারে ফ্লোরিডা স্টেইট ইউনিভার্সিটির একদল সাইকোলজিস্ট এ নিয়ে গবেষনা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, তারা এর নাম দেন হাই প্লেইস ফেনোমেনন। মানুষের মধ্যে এই প্রবণতা সাধারণ। উচ্চতায় যখন ব্রেন যখন ঠিক করতে পারে না কী করবে তখন এমন হয়। একে সাইকোলজিতে বলে কগনিটিভ ডিজোন্যান্স, যা কোন অপটিক্যাল ইল্যুশন দেখলে যেমন ব্রেন বুঝতে পারে না কী দেখছে, তার সাথে তুলনীয়।
হাসনাত এ পর্যন্ত পড়ে বিমলের দিকে তাকালেন।
বললেন, বেশ লিখেছো, নাইস ইনফো। কাজে লাগতে পারে। এইটা কি হিচককের ভার্টিগো নাকি?
বিমল মাথা নেড়ে বলল, ঐরকম একটা ব্যাপার ছিল তার মধ্যে।
ডিটেক্টিভ হাসনাত চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বললেন, আচ্ছা, আরেকটা জিনিস আছে, খাড়াও।
তিনি উঠে তার রুমে গেলেন ও শাহরিয়ারের ডায়রিটা নিয়ে ফিরে এলেন।
বিমলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আইজ রাইতে এইটা পড়বা। পুলিশ এইটা পাইছে ওর রুমে। আমি পড়তে লাগছিলাম কিন্তু ভালো লাগে নাই। মনে হইতেছে না এতে কিছু পাওয়া যাইব। তাও সতর্কতার জন্য পড়া দরকার।
বিমল ডায়রিটা হাতে নিল। এইরকম গুরুত্বপূর্ন জিনিসে অনাগ্রহ কেবল হাসনাত সাহেবেরই থাকতে পারে। বিমল প্রচন্ড আগ্রহ বোধ করলো। উলটে পালটে দেখল ডায়রি। সরাসরি দিনযাপনের বিবরণ লেখার জন্য এখন আর কেউ ডায়রি ব্যবহার করে না। তাই সেরকম কিছু আশা করা বৃথা। কিন্তু গুরুত্বপূর্ন তথ্যাদি টুকে রাখার জন্য অনেকেই ডায়রি বা নোটবই ব্যবহার করে থাকেন। এক্ষেত্রে এসব থেকে শাহরিয়ার এবং তার মৃত্যু বিষয়ে জানার কিছু সূত্র পাওয়া গেলেও যেতে পারে।
রাতে খাবার পর ডায়রি নিয়ে বিমল যখন বেরিয়ে আসছিল তখন ডিটেক্টিভ হাসনাত তাকে ডেকে বললেন, তোমার কি মনে হয় সিক্সথ সেন্স বইলা কিছু আছে মানুষের?
বিমল জিজ্ঞেস করল, কেন স্যার? এ নিয়ে ভাবি নি তেমন।
হাসনাত সাহেব বললেন, আমার সিক্সথ সেন্স বলতেছে ছেলেটার মরাটা সুইসাইড না। কোন ঘটনা আসলেই আছে এর মাঝে।
বিমল জিজ্ঞেস করল, স্যার, ছেলেটির পরিবারের সাথে মনে হচ্ছে আবার কথা বলা দরকার। এক্ষেত্রে তার প্রেমিকার ব্যাপারটি তারা জানতো কি না, জানলে গোপন করল কেন এগুলো জানা যাবে।
হাসনাত সাহেব বললেন, এটা ভালো বলছো। কিন্তু পরিবারের সবার লগে না। ঐ শাহাদুজ্জামানই আমাদের জিনিস। সরাসরি তার অফিসে যাইতে হবে। অফিসের ঠিকানা জোগাড় কইরা আমারে জানাইবা কাল।
বিমল, ওকে স্যার, বলে বাসার উদ্দেশ্যে বের হলো ডিটেক্টিভ হাসনাতের বাসা থেকে।
অধ্যায় – বারো
বিমল বাসায় ফেরার পরে তার বাবা রামতনু দাস ফোন দিলেন। ভাঙা গলা, উদ্বিগ্ন কন্ঠ। বিমলের মা’কে ওষুধ দিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি ঘুমের মধ্যে আছেন। কিন্তু ঘুম ভাঙলেই বলছেন, তাকে কেন সৎকার করা হচ্ছে না? অধিক সময় রাখলে দুর্গন্ধ বের হতে পারে।
মোটামোটি অশান্ত মন নিয়েই বিমল শাহরিয়ারের ডায়রি পড়তে শুরু করলো। ভেতরে নিয়মিত ভাবে লেখা হয়েছে এমন না। ছাড়া ছাড়া ভাবে প্রথম দিকের কিছু পাতায় ও শেষদিকের কিছু পাতায় লেখা। তাও পুরো পৃষ্ঠা না, কখনো এক দুই লাইন, কখনো এক প্যারা দুই প্যারা। বিমল দেখলো প্রথমদিকের এক পাতায় লেখা আছে,
এরিক রাইসের লিন স্টার্ট আপ দারুণ। আমাদের স্টার্ট আপটি লিন হিসেবে শুরু করলে হয়ত ব্যর্থ হতো না।
আরেক পাতায়,
সব সুখী পরিবারই একইরকম ভাবে সুখী, কিন্তু প্রতিটি দুখী পরিবার ভিন্ন ভিন্ন ভাবে অসুখী, তলস্তয়ের আনা ক্যারেনিনার শুরুর লাইন। কিন্তু ব্যবসার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উলটো। ব্যবসার ক্ষেত্রে সব অসফল কোম্পানিগুলি একইরকম, তারা প্রতিযোগীতা এড়াতে পারে নি। আর সফল কোম্পানিগুলির গল্প ভিন্ন ভিন্ন। তারা ভিন্ন ভিন্ন নীশ ধরে এগিয়েছে। এবং সেই জায়গায় মনোপলি ব্যবসা করেছে। পিটার থিয়েলের এই চিন্তাটি ভাবার মতো।
আরেক পাতায়,
আশা এবং আত্মবিশ্বাস বিজয়ের স্বপ্ন দেখতে দেখতে আসে না, বরং আসে পরাজয় নিয়ে ভেবে ও কীভাবে সে পরাজয় এড়ানো যায় তা নিয়ে চিন্তা করে। আপনি যদি এক্সেলেন্ট হতে চান কিছুতে, তা গিটার বাজানো বা জেট বিমান চালনা যাই হোক না কেন, এক্ষেত্রে অতিরিক্ত প্রস্তুতি বলতে কিছু নেই। সব সময়ই নিয়ে আরো প্রস্তুত করার ও আরো উন্নত করার জায়গা রয়ে যায়। নভোচারী ক্রিস হ্যাডফিল্ডের বইটি ভালো।
আরেক পাতায়,
মিখায়েল পর্টারের ফাইভ ফ্যাক্টর মডেল
১। ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিযোগীতা কেমন
২। ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন প্রতিযোগী আসার সম্ভাবনা কেমন (**)
৩। সাপ্লাইয়ারদের ক্ষমতা কেমন
৪। কাস্টমারদের ক্ষমতা কেমন
৫। বিকল্প পণ্যের হুমকি আছে কি
আরেক পাতায়,
একটি সফল স্টার্ট আপের জন্য তিনটা জিনিস দরকারী বলে মনে করেন পল গ্রাহাম। জিনিস তিনটি হলোঃ
এক- ভালো মানুষদের নিয়ে শুরু করা।
দুই- এমন জিনিস তৈরী করা যা ভোক্তারা (কাস্টমার) চায়।
তিন- যত কম পারা যায় ততো টাকা খরচ করা।
পল গ্রাহামের এই কথাটি খুবই সত্যঃ
আইডিয়া নয়, যেসব লোকের কাছে আইডিয়াটি আছে তারাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন। ভালো মানুষেরা খারাপ আইডিয়াকে ফিক্স করে এগিয়ে যেতে পারে, কিন্তু একটি চমৎকার আইডিয়াও খারাপ লোকদের বাঁচাতে পারে না।
এভাবে প্রায় সবই স্টার্ট আপ নিয়ে লেখা। বিমল লেখাগুলি পড়তে পড়তে বুঝতে পারলো ব্যবসার জন্য বেশ ভালোভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিল শাহরিয়ার। প্রথম ব্যবসা ব্যর্থ হবার পর সে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিল তার প্রস্তুতিতে বেশ খামতি আছে। সেগুলো দূর করার জন্য সে বেশ নিবিষ্টভাবে লেগেছিল তা ডায়রি থেকে আঁচ করা যায়। এই অবস্থায় তার তো আত্মহত্যা করার কথা না।
আরো কিছু পাতা ছিল কেন উদ্যোক্তা সংস্কৃতি আমাদের জন্য দরকার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লেখা।
শেষের দিকের কিছু পাতায় বিক্ষিপ্ত আঁকিবুঁকি। বিমলের কাছে একসময় মনে হলো হয়ত সাংকেতিক ভাষায় কিছু লেখা। প্রায় কয়েক পাতাতেই বিভিন্ন ভাবে লেখা,
২ + ৩ = ৫
আর অস্পষ্টভাবে লেখা, পিথাগোরাস!
অধ্যায় – তেরো
পরদিন, অর্থাৎ বারো সেপ্টেম্বর সকাল দশটার দিকে ডিটেক্টিভ হাসনাত বিমলকে ফোন দিলেন। জরুরী দরকার। বিমল তৈরী হয়ে গিয়ে দেখল ডিটেক্টিভ হাসনাত তার ব্যক্তিগত পুরনো এম১৯১১ পিস্তল পকেটে ভরছেন। পিস্তলটি একবার নেড়েছেড়ে দেখেছিলো বিমল। অনেক পুরনো, গায়ে লেখা মডেল অব ১৯১১ ইউ এস আর্মি, নং ৩২২০১৬। এই পিস্তল হাতে আসার কাহিনীও বলেছিলেন হাসনাত। পিস্তলটি একজন লোকের যিনি হাসনাত সাহেবের দাদার বন্ধু ছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিয়েছিলেন। ভদ্রলোক পিস্তলটি হাসনাত সাহেবের দাদাকে দিয়েছিলেন এক বাজিতে হেরে। দাদার হাত হতেই পেয়েছেন তিনি।
বিমল ও হাসনাত সাহেব গাড়িতে উঠলেন। বিমল জিজ্ঞেস করল, স্যার, আমরা যাচ্ছি কোথায়?
হাসনাত সাহেবকে চিন্তিত মনে হলো। তিনি বললেন, গেলেই দেখতে পাইবা।
গাড়িতে বসে থাকার সময়ে ডায়রি বিষয়ে মনে পড়ল বিমলের। সে ডায়রিতে কী কী লেখা তার এক সারাংশ দিল হাসনাত সাহেবকে। এরপর ডায়রি খুলে শেষের সাংকেতিক ২+৩ = ৫ ও তার পাশে লেখা পিথাগোরাস অংশটি দেখিয়ে বলল, কিন্তু এই জিনিসগুলোর কোন অর্থ বুঝতে পারছি না। এটা কি ওই প্রাচীন জ্ঞানী পিথাগোরাস?
হাসনাত সাহেব কাগজে একবার চোখ বুলিয়ে তার মন্তব্য জানালেন, পিথাগোরাস নামে কেউ কখনো আছিলো না।
বিমল এ কথায় অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো, কিন্তু স্যার আমরা তো পড়েছি…
হাসনাত সাহেব তার কথা শেষ হবার আগেই বলেন, কতো কিছুই তো আমরা পইড়া থাকি। দক্ষিণ ইতালিতে কিছু লোকের বা পিথাগোরিয়ানদের একটা গুপ্তসংঘ ছিল। এর অনুসারীরাই তাদের এক গুরু তৈরী করছে। নাম দিছে পিথাগোরাস।
এটা বলার পরে হাসনাত সাহেবের যেন হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়লো। তিনি ডায়রির পাতাটি আবার দেখলেন, ও বললেন, আরে এইখানে, ২+৩ =৫, পিথাগোরিয়ানদের ভাষায় এইটা হইল ম্যারেজ।
ম্যারেজ মানে?
ম্যারেজ মানে হইল বিয়া। দুই আর তিনের বিয়া হইয়া পাঁচ হইছে। পাঁচ বিয়ার নাম্বার। পিথাগোরিয়ানরা এইভাবে বিশ্বাস করতো। তারা বিশ্বাস করতো জোড় হইল মাইয়া আর বিজোড় সংখ্যা হইল পোলা। ইউনিভার্সের পরম সত্য সংখ্যায় এইটা তারা বিশ্বাস করতো। কিন্তু এই জিনিস এখানে কেন? শাহরিয়ার পোলাটা কি এগুলা নিয়ে পড়তেছিলো নাকি?
বিমল জিজ্ঞেস করলো, পিথাগোরিয়ানদের গুপ্তসংঘটা কীরকম ছিল?
হাসনাত সাহেব বললেন, তেমন কিছু জানা যায় না। অনেক আগের তো। এই অন্য গুপ্তসংঘগুলা যেমন হয়, কঠিন শপথ ছিল বাইরে কিছু প্রকাশ করা যাইব না। যা একটু আধটু জানা যায় তা ঐ প্লেটো থিকা। এই অমরত্ব, সংখ্যা, আত্মার ট্রান্সমাইগ্রেশন এইসব নিয়া ওদের আলাদা বিশ্বাস ছিল আর কি।
কথা বলতে বলতে গাড়ি এসে থামলো এক গলির ধারে। বিমল ও ডিটেক্টিভ হাসনাত বের হলেন। এই চিপা গলি দিয়ে একটু গেলে ভেতরেই শহরের সবচাইতে বড় বাজার, নাম মাজন পট্টি। মূল নাম ছিল মহাজন পট্টি, সেই থেকে হয়েছে মাজন পট্টি। এমন কোন জিনিস নেই যে এখানে পাওয়া যায় না। কিন্তু জানতে হবে কোন জায়গায় কী মিলে। অন্যথায় ঘুরে মরতে হবে।
হাসনাত সাহেব একটু এগিয়ে যেতেই লম্বা, রোগা ও কুঁজোমতন একটি লোক একগাল হেসে এগিয়ে হাসলো। লোকটার গায়ে ময়লা লম্বা হাতার শার্ট ও লুঙ্গি। সে হেসে হেসে হাসনাত সাহেবকে বললো, স্যার, কীরাম আছেন? লম্বা দিনকাল এইদিকে আসেন না, সব ভালো তো?
হাসনাত সাহেব বললেন, ভালো। আমারে জায়গায় নিয়া যাও।
হাঁটতে হাঁটতে বিমলের দিকে ইঙ্গিত করে লোকটা জিজ্ঞেস করলো, এই স্যার কেডা?
হাসনাত সাহেব বললেন, ও, পরিচয় করাইয়া দেয়া হয় নাই। এটা হচ্ছে আমার সহকারী বিমল, ব্রাইট গোয়েন্দা অফিসার।
বিমলের দিকে তাকিয়ে লোকটির দিকে দেখিয়ে বললেন, আর এ হচ্ছে হারুন মন্ডল। ভালো লোক।
বিমলের বুঝতে দেরী হলো না এই হারুন মন্ডলও হাসনাত সাহেব আরেক সেট করা লোক।
হারুন মন্ডল অনেক আগে পোস্ট অফিসে পিয়নের কাজ করতো। চুরির দায়ে তার চাকরি যায়। এরপর থেকে সে নানা ধান্দায় ঘুরে বেড়াত। একবার ঘটনাক্রমে পরিচয় হয় হাসনাত সাহেবের সাথে। তখন হাসনাত সাহেব লক্ষ করেন লোকটির এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। মানুষের চেহারা সে একবার দেখলে আর ভুলে না। একদিনের দেখা লোককেও বছর খানেক পর অন্য কোথাও দেখলে ঠিকঠাক চিনতে পারে। নাম ধাম জানলে তো আর কথাই নেই। হারুন মন্ডলের এই ক্ষমতার পরিচয় যেদিন পেয়েছিলেন হাসনাত সাহেব সেদিন তার বোর্হেসের একটি গল্পের কথা মনে পড়েছিল। সেই গল্পের চরিত্র ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পায়, এবং এরপর থেকে একেবারে প্রায় সব কিছু মনে রাখার আশ্চর্য ক্ষমতা অর্জন করে বা বলা যায় ভয়ংকর এক অভিশাপের কবলে পড়ে।
প্রায় মিনিট বিশেক গলি ধরে একেবেকে হেঁটে তারা পৌছলেন কামারদের এলাকায়। এখানে ছুরি কাচি দা ইত্যাদি বানানো হচ্ছে।
হারুন মন্ডল হাসনাত সাহেবকে নিয়ে গেল একটি কামারের দোকানে। সেখানে কয়েকজন লোক কাজে ব্যস্ত ছিল। আগুনে তপ্ত লোহা পিটিয়ে ছুরি কাচি বানানো হচ্ছে। একজন লোক বসেছিল ক্যাশবক্স সামনে নিয়ে, মধ্যবয়স্ক পেটমোটা লোক। সে তার পান খাওয়া দাঁত বের করে বললো, আরে হারুন, কী দরকার?
হারুন চটপট জবাব দিল, পুলিশের লোক। গোয়েন্দা।
লোকটি যেন ভয় পেল মনে হলো। জিজ্ঞেস করল, কী বেত্তান্ত হারুন?
হারুন মন্ডল বলল, ধনু কাকা, তোমার দোকানে আইল না কয়দিন আগে বিদেশী লোকগুলা। স্যাররে এইসব বলো।
লোকটি মুখ কাচুমাচু করে বলল, বাপরে আমি কিছু কইতে পারি না।
হাসনাত সাহেব এগিয়ে গিয়ে বসলেন লোকটির পাশে। আস্তে করে লোকটিকে বললেন, আপনার ভয়ের কোন কারণ নাই ধনুকাকা। আপনে খালি আমারে কইবেন কারা আসছিল, আর কেন আসছিল?
ধনুকাকা অর্থাৎ লোকটি ভয় ভয় মুখে বলল, প্রায় এক হপ্তা আগে দুইটা…না তিনটা লোক আইছিল এইখানে ছার, একজন শাদা লোক, বিদেশী। একটা পোলা আমার এইখান থেইকা কয়টা ছুরি বানাইয়া নিয়া গেছিল পুরান রাজার আমলি এক ছুরির আদলে। সেই ছুরিটার কথা জানতেই এরা আইছিল।
হাসনাত সাহেব তার পকেট থেকে একটা ছবি বের করে লোকটির সামনে ধরে বললেন, যে পোলাটা ছুরি বানাইছিল সে তো এই পোলা?
লোকটি ছবি দেখে বলল, হ, এইটাই।
বিমল ছবিটা দেখলো, শাহরিয়ারের ছবি।
হাসনাত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কয়টা ছুরি বানাইছিল সে?
লোকটি বলল, তিনটা।
হাসনাত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এই ডিজাইনের ছাঁচ বা কোন কিছু কি আছে, আমি এইরকম আরেকটা বানাইতে চাই।
লোকটা বলল, বানাইয়া দিতে পারব স্যার।
ডিটেক্টিভ হাসনাত বললেন, ঠিক আছে। আমি টাকা হারুণের কাছে দিয়া দিব। তার কাছেই জিনিস দিবা।
লোকটি মাথা নেড়ে বলল, জি।
হাসনাত সাহেব উঠতে উঠতে আবার কী মনে করে বসে পড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন, আইচ্ছা, ঐ পোলার কাছে যে রাজার আমলি ছুরি আছে তা বিদেশীরা জানলো কেমনে?
লোকটা বলল, পোলাটা যেইদিন আসে বানাইতে সেইদিন দোকানে অনেকেই আছিল, তারা দেখছে। ছুরিটা নিয়া অনেক মাতামাতি হইছে। এইটা বলে আকবর বাশশার ছুরি।
হাসনাত সাহেব তীক্ষ্ণ ভাবে লোকটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ঐ লোকগুলারে তুমি পোলাটার ঠিকানা দিছলা তো তোমার খাতা থিকা? ঠিক কি না? কতো দিছিল ওরা?
লোকটা মাথা নিচু করে বলল, এক হাজার টাকা।
হাসনাত সাহেব ব্যঙ্গাত্মক ভাবে বললেন, এক হাজার টাকায় ব্যবসার নীতি বেইচা দিলা মিয়া!
তিনি মানিব্যাগ থেকে এক হাজার টাকা বের করে লোকটার ক্যাশবক্সের উপরে রেখে বললেন, আমার ছুরির জন্য এইটা। যা ম্যাটেরিয়ালস লাগে, আর মজুরীসহ। কম পড়লে হারুনরে বলবা।
লোকটা বলল, না স্যার এইটাতেই হবে।
হাসনাত সাহেব কামারের ঘর থেকে বের হলেন। আবার গলি ধরে হেঁটে বের হতে হবে। এবার ঘুরিয়ে অন্যপথ ধরে নিয়ে গেল হারুন মন্ডল। মাঝে এক চায়ের দোকানে বসে সবাইকে নিয়ে মালাই চা খেলেন হাসনাত সাহেব। চা খেতে খেতে তিনি বিমলকে বললেন, সারা শহরের মধ্যে সবচাইতে ভালো চা হয় এইখানে, এই মানিকবাবুর টি স্টলে।
বিমল লক্ষ করলো ডিটেক্টিভ হাসনাতের চরিত্রে দুশ্চিন্তা স্থায়ী হয় না। ঘোঁট পাকানো তদন্ত মাথায় নিয়ে তিনি দিব্যি ক্রিকেট নিয়ে বা মাছের দামবৃদ্ধি বিষয়ে আয়েশী আলাপ চালিয়ে যেতে পারেন।
অধ্যায় – চৌদ্ধ
মহাজন পট্টি তথা মাজন পট্টি থেকে চা খেয়ে হাসনাত সাহেব ও বিমল আবার গাড়িতে উঠলেন। উঠার আগে অবশ্য গলি ধারে এক অন্ধকার কোণে গিয়ে হাসনাত সাহেব হারুন মন্ডলের সাথে আস্তে আস্তে কিছু কথা বলেন, এবং কিছু একটা তার হাতে দিলেন বলে মনে হলো বিমলের। তার কৌতুহল হচ্ছিল, কিন্তু জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। হুটহাট এমন প্রশ্নে হাসনাত উত্তর এড়িয়ে যান।
গাড়িতে উঠার পর হাসনাত সাহেব বিমলকে বললেন, এখন আমরা যাব, শাহাদুজ্জামানের অফিসে। তার সাথে কথা কওয়াটা দরকারী। আমার এক লোকের কাছ থিকা যা জানলাম তাতে মনে হইতেছে শাহাদুজ্জামান হয়ত জানে কিছু।
বিমল চুপ করে শুনে কিছুক্ষণ পর বলল, স্যার আপনি যে এতো লোকদের বিভিন্ন জায়গায় সেট করে রাখেন এরা প্রায় সবাই একেক সময় অপরাধ করেছে বা তাদের বিভিন্ন ধরণের শক্ত প্রতিভা আছে। এটা কি বিপদজনকও নয়, এমন সেট করে রাখা?
হাসনাত সাহেব যেন অবাক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, বিপদজনক কেন হবে?
বিমল বলল, মানে তারা যদি কোন অপরাধ করে বা আপনাকে ব্যবহার করে?
হাসনাত সাহেব বললেন, সেই সম্ভাবনা আমি পয়লাই হিসাবে রাখি। প্রাচীন গ্রীসের সেইজ পেরিয়ান্দার একবার দুই লোকরে বলল এক জায়গায় গিয়া তৃতীয় একটা লোকরে খুন করে কবরস্থ করতে। এবং আরো চাইরজন লোকরে সেট করলো ঐ খুনি দুইটা লোকরে ধইরা খুন করতে। এরপর আরো একদল লোকরে সেট করলো চাইরজন খুনিরে খুইজা বাইর কইরা খুন করতে। অতঃপর সে প্রথম দুইজন লোকের সাথে দেখা করতে গেলো, কারণ সেই ছিল তৃতীয় লোক। বুঝলা কিছু?
বিমল বিব্রত মুখে তাকাচ্ছে দেখে সামান্য হেসে ডিটেক্টিভ হাসনাত বললেন, মানে সেট করতে হবে বিপদের সম্ভাবনা মাথায় রাইখাই। ঠিকমত ক্যালকুলেশন থাকলে কেউ লাইন ছাড়া হইলে পার পাবে না। বাঘরে সেট করবা, আর বাঘের উপর সেট করবা টাগরে, এবং বাঘরে এইটা জানাইয়াও দিবা যে তার উপরে টাগরে সেট কইরা রাখা আছে। বেলাইনে গিয়া পার পাওয়া যাইব না ধরায়।
বিমলের বিব্রত মুখ দেখে হাসনাত সাহেব বললেন, তোমার কি জানতে ইচ্ছা হইতেছে হারুনরে কী দিলাম?
বিমল বলল, জি…।
হাসনাত সাহেব বললেন, টাকা, তার পারিশ্রমিক বলতে পারো। কিন্তু তোমার সামনে দিলে তার আত্মসম্মানে লাগতে পারে, তাই সরাইয়া নিয়া দিলাম। অন্যরে কিছু দিবার সময় এটা খেয়াল রাখা খুব দরকার।
বিমল কথাটি বিশ্বাস করবে কি না বুঝতে পারল না।
এদিকে মিলি ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল হাসনাত সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য। সে রাতে ঘুমাতে পারছে না। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছে সেই ছুরির ছবি, এবং শাহরিয়ারের বলা কথাগুলো তার কানে ভাসছে। যদি সত্যি এমন হয়ে থাকে, হয়ে থাকতেও তো পারে, সেক্ষেত্রে গোয়েন্দাকে জানানোই সমীচীন। এই ভেবে সে হাসনাত সাহেবকে ফোন দিয়েছিলো।
হাসনাত সাহেব ফোন রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে ঠান্ডা গলায় মিলি বলল, আমি মৃত শাহরিয়ারের বোন। আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।
হাসনাত সাহেব বললেন, ঠিক আছে। আপনে ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমার বাসায় চইলা আসেন। কার্ডে এড্রেস আছে।
শাহাদুজ্জামানের সাথে দেখা করার ব্যাপারে আগে থেকে বলে আসেন নি হাসনাত সাহেব। কিন্তু তার লোকের মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত হয়ে এসেছেন শাহাদুজ্জামান অফিসে।
অফিসে হাসনাত সাহেব ও বিমলকে দেখে শাহাদুজ্জামান অবাক ও ভীত হলো, তা সহজেই বুঝতে পারলো বিমল। কথা বলার সময় তার গলা কাঁপছিল।
হাসনাত সাহেব ও বিমল শাহাদুজ্জামানের গোছানো অফিস রূমে বসে শাহরিয়ার ও ইত্যাকার বিষয়াদি নিয়ে কথা বলছিলেন শাহাদুজ্জামানের সাথে। এই কথাতেই বের হয়ে আসলো মিলি ও শাহাদুজ্জামানের দাম্পত্য সমস্যার বিষয়টি।
শাহাদুজ্জামান মফস্বলের এক সাধারণ পরিবারের ছেলে। বাবা মা ও দুই ভাই বোন। পড়ালেখায় ব্রিলিয়ান্ট শাহাদুজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়েই মিলির সাথে তার প্রেম হয়। অতঃপর বিয়ে। এবং একসময় শাহাদুজ্জামান নিজের ব্যবসা গুছিয়ে আনে, মিলিও তাদের পারিবারিক ঐতিহ্যমতো ব্যবসা শুরু করেছে, এবং ভালো করেছে। ফলে টাকা পয়সার অভাব তাদের নেই।
কিন্তু সমস্যা হলো মিলি সন্দেহপরায়ণ। সে মনে করে শাহাদুজ্জামান টাকা পয়সা বাড়িতে তার বাবা মা’কে দিয়ে দিচ্ছে সব। তার বোনও মা বাবা’র সাথে থাকে, স্বামীর সাথে বনিবনা না হবার দরুন।
এ নিয়ে মিলি ও শাহাদুজ্জামানের মধ্যে অল্প বিস্তর খিটিমিটি লেগে থাকত প্রায় সব সময়। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে সমস্যা আরো গুরুতর হয়। শাহাদুজ্জামান সকল সময়েই এটা অনুভব করতো যে, তার বাবা মা তাকে যে কষ্ট করে মানুষ করেছেন, এর পূর্ন প্রতিদান সে দিতে পারছে না। তাই সে চাইছিলো নতুন বাড়ি বানিয়ে মা বাবা ও বোনকে শহরে নিয়ে আসতে। কিন্তু এতে বাধ সাধে মিলি। সে কোনভাবেই এটা মেনে নিবে না। সে তার বাবা মাকে ও নিজেদের বাড়ি ছেড়ে নড়তে নারাজ।
এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছিল শাহরিয়ার, অকপটে জানালো শাহাদুজ্জামান। সে তার বোনকে এবং বোনজামাই উভয়পক্ষকেই বুঝিয়ে একটা সমঝোতায় আনার চেষ্টা করছিলো।
হাসনাত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, শাহরিয়ারের সাথে আপনার সম্পর্ক ভালো ছিল?
শাহাদুজ্জামান তার কাঁপা কন্ঠেই বলল, জি। চমৎকার ছিল। মূলত ওর মাধ্যমেই আমি বাবা অর্থাৎ আমার শ্বশুর ও শ্বাশুড়ীর সাথে মিশতে পারি। অন্যথায় তারা তো আমাকে মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না। আমাদের বিয়েতে উনাদের মনের সায় ছিলো না।
চা এসেছিল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে হাসনাত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, শাহরিয়ারের প্রেমিকা ব্যাপারে কিছু বলবেন?
শাহাদুজ্জামান এই প্রশ্নে একটু থমকে গেল। এরপর আস্তে আস্তে বলতে শুরু করল, মেয়েটাকে আমি চিনতাম। শাহরিয়ার প্রথমে আমার সাথেই ওকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। এই অফিসে, এই রুমেই ওরা এসেছিল একবার। হাসখুশি, চমৎকার একটি মেয়ে।
হাসনাত সাহেব প্রশ্ন ছুঁড়লেন, শাহরিয়ারের বাবা সালাম সাহেব নিশ্চয়ই ক্ষীপ্ত হয়েছিলেন মেয়েটি হিন্দু জেনে?
শাহাদুজ্জামানের চোখে ধরা পড়ে যাবার মতো একটা ভঙ্গি ছিল। সে বলল, এর আগে আমি আমার শ্বশুরকে এমন করতে দেখি নি। তারা কোনভাবেই মানতে চাইলেন না। সামাজিক সম্মান সব ধুলায় মিশে যাবে। ঐতিহ্যবাহী পরিবার তাদের।
হাসনাত সাহেব বললেন, আর মিলির কী মত ছিল?
শাহাদুজ্জামান বলল, ওদের ফ্যামিলি পুরনো ঐতিহ্যকে খুব দাম দেয়। মিলিও বয়েস বাড়ার সাথে সাথে তার বাবার মতো ওদিকেই হেঁটেছে। তাদের ধ্যান ধারণা তাদের ঐতিহ্যবাহী ফ্যামিলির মান সম্মান কেন্দ্রিক। একধরনের আভিজাত্য বলতে পারেন। ফলে স্বাভাবিক ভাবে ফ্যামিলির সবারই একই মত ছিল। তারা হিন্দু মেয়েকে ঘরের বউ করার কথা ভাবতেই পারলেন না। শেষে অবশ্য আমার শ্বাশুড়ি একটু নরম হলেন, কারণ শাহরিয়ার প্রায় নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল তখন।
হাসনাত সাহেব বললেন, তারপর? এইটা কতদিন আগের?
শাহাদুজ্জামান বলল, প্রায় বছরখানেক আগের ঘটনা।
একটু থেমে সে আবার বলতে লাগলো, এরপর শ্বাশুড়ি বুঝালেন হিন্দু মেয়ে যদি মুসলমান হয়ে যায় তাহলে কী সমস্যা। এতে বরং সওয়াব আছে। তাদের পূর্বপুরুষরা, ইরান তুরান থেকে যখন এদেশে প্রথম এসেছিলেন প্রাচীনকালে, তখন এদেশীয় মেয়েদেরই তো বিয়ে করেছিলেন মুসলমান করে। তাহলে এতে সমস্যা হবে কেন আজ? এইসব কথাবার্তার পরে শ্বশুর একটু নরম হন। পরে এরকম সিদ্ধান্ত হয় যে মেয়ে মুসলমান হলে ঠিক আছে।
হাসনাত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এরপর?
শাহাদুজ্জামান বলল, কিন্তু মেয়েটি রাজী হলো না। সে সাফ জানিয়ে দিলো কোন কারণেই ধর্ম ত্যাগ করে সে মুসলমান হতে পারবে না। শাহরিয়ারও তাকে জোর করতে পারে নি। কারণ সে নিজেও হয়ত এমনটি চাইত না। এরকম চলছিলো, শাহরিয়ার পরিবারের প্রায় সবার সাথেই কথা বলা বন্ধ করে দিল। আর এর মাঝে, কিছুদিন পর একদিন শোনা গেল মেয়েটি খুন হয়েছে। বেডরুমে কে যেন খুন করে ফেলে রেখে গেছে।
হাসনাত সাহেব শান্তভাবে বললেন, শাহরিয়ারের প্রতিক্রিয়া কী হলো?
শাহাদুজ্জামান বলল, সে আরো চুপ হয়ে গেল। প্রায় একমাসে অনেক শুকিয়ে যায়। ডাক্তার পর্যন্ত দেখাতে হয়েছিল। কিন্তু আত্মহত্যার কোন প্রবণতা তার ভেতরে তখনো ছিল না। ওকে ডাক্তার দেখাতে আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে বলছিলো শাহরিয়ার, সে পৃথার অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে চায় ও তার খুনিদের বের করতে চায়, এজন্য ভালোভাবে বেঁচে থাকা দরকারী। মূলত এই কারণেই, স্বাভাবিক হবার জন্য সে তার বাবার অফিসে কাজে যোগ দিয়েছিল।
হাসনাত সাহেব মনযোগ দিয়ে শুনলেন। শাহাদুজ্জামানের সাথে কথা শেষ হতে হতে প্রায় আধ ঘন্টা লেগে গেল।
অধ্যায় – পনের
গাড়িতে ফেরার সময় বিমল কয়েকটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলো। নিছক আত্মহত্যা বলে মনে হওয়া ঘটনাটি বেশ রহস্যপূর্ন মনে হচ্ছে এখন। হাসনাত সাহেবের আচরণ ও কথাবার্তায় যেসব বিষয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্যে আছে প্রথমেই এই প্রাচীন গোপন গুপ্তসংঘের কথা। যারা কোন গোপন সত্য গোপন রাখতে চায়, এবং যারাই এটি জেনে যায় তাদের খুন করে ফেলে। বিমল এই ফিল্মি চিন্তাটাকে পাত্তা দিতে চায় না। তার মনে হয় ডিটেক্টিভ হাসনাত প্রতিভাবান হলেও ইতিহাসের প্রতি বিশেষ দূর্বলতার জন্য তিনি এমন একটা অবাস্তব জিনিসের কল্পনা করছেন।
মহাজন পট্টিতে কামারের সাথে আলোচনা করে যে জিনিসটা জানা গেছে তা অপেক্ষাকৃত বেশী বাস্তবসম্মত। প্রাচীন রাজাদের ছুরি বা তৈজসপত্রের ঐতিহাসিক মূল্য আছে, আবার সেজন্য চড়া দামে বিক্রিও হয় বিদেশে। আর কারুকাজ করা ছুরিতে দামী পাথর টাথর থাকলে তো কথাই নেই। এর জন্য একজন বিদেশী সহ দেশী কয়েকজন লোকের যে চক্রটি শাহরিয়ারের ব্যাপারে খোঁজখবর করেছিল, এরা পরে শাহরিয়ারের সাথে যোগাযোগ করে থাকবে। এই ধরণের চক্রগুলো খুব ভয়ংকর হয়ে থাকে। এদের হাতে শাহরিয়ারের মৃত্যু হয়েছে যদি বের হয়, তাহলে খুব অবাক করার মতো বিষয় হবে না।
একটু আগে শাহাদুজ্জামানের সাথে আলোচনায় জানা গেল শাহরিয়ারের প্রেমের ব্যাপারে, এবং তার পরিবারে এ সংস্লিষ্ট জটিলতা বিষয়ে। এই ব্যাপারটিকে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন মনে হলো বিমলের। হতে পারে মেয়েটির মৃত্যুর পিছনেও প্রেমটি জড়িত থাকতে পারে কোনভাবে। মেয়েটির মৃত্যুর পরে তদন্ত শুরু হয়েছিল এবং কোন এক অজ্ঞাত কারণে উপরমহলের চাপে তা বন্ধ করে দেয়া হয়।
কিন্তু, প্রেম ঘটিত জটিলতা যদি শাহরিয়ারের আত্মহত্যার কারণ হয়, তাহলে এতদিন পরে কেন? তাছাড়া, শাহরিয়ারের বাবা সালাম সাহেব কি কোনভাবে মেয়েটির মৃত্যুর জন্য দায়ী, বিমলের মনে কেন যেন প্রশ্নটি আসলো। ক্ষমতাবান পরিবারের লোক, বনেদি টাকাওয়ালা। সালাম সাহেব ছেলেকে প্রেমের জাল বের করতে এই পথে গিয়ে থাকলে তিনি ভুল করেছেন, কিন্তু ভাবনাটি খুব অবাস্তব মনে হলো না তার কাছে।
বিমল নিশ্চুপ হয়ে ভাবছিলো এর মাঝে তার বাবা ফোন করলেন। ফোনে জানালেন তার মায়ের অবস্থা একটু ভালো হয়েছে।
কথাবার্তা শুনলেন হাসনাত সাহেব। বিমল ফোন রাখার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মা’র অবস্থা কি খারাপ হইছে আবার?
বিমল বলল, জি স্যার, কয়দিন ধরেই অসুস্থতা একটু বেড়েছে।
হাসনাত সাহেব বললেন, তাইলে ছুটি নিয়া বাড়িত যাও। মাতৃসেবার চাইতে দেশ সেবা বড় না।
বিমল বলল, অবস্থা তেমন বেশী খারাপ না স্যার। আর আমি ভাবছি এই কেইসটা শেষ হলেই ছুটির জন্য বলবো।
হাসনাত সাহেব বললেন, কেইস শেষ হইতে দেরী হইলে এই ব্যাপারে গাফিলতি করবা না বিমল। লাইফে গুরুত্বপূর্ন জিনিস অনেক সময় আমরা বুঝতে ভুল কইরা ফেলি, আর পরে একসময় দেখি দেরী হইয়া গেছে।
বিমল হেসে বলল, কিন্তু স্যার দেশও তো মা, জননী।
হাসনাত সাহেব বললেন, দেশরে মা মা করার আরেকটা কারণ আছে, কেবল ভক্তি শ্রদ্ধা একমাত্র কারণ এইটা কিন্তু না। দেশের টাকা যারা মাইরা খায়, চুরি চামারি করে এদের জন্য দেশ মা হইলেই সুবিধা। মা সর্বংসহা। সন্তানরে তিনি দিয়াই যান কেবল। চুরি চামারি করলেও তিনি মাফ কইরা দিবেন, দয়ার শরীর, মায়ার হৃদয়। কিন্তু এইখানে বাপ হইলে কিন্তু মাইর মাটিতে পড়বে না একটাও। পকেট থিকা টাকা চুরি করা পোলারে একসময় বাপ বাইর কইরাও দিতে পারে ঘর থিকা। তাই দেশরে মা বলাই সেইফ।
হাসনাত সাহেবের ব্যাখ্যা শুনে বিমল হাসলো। এরই মধ্যে হাসনাত সাহেবের বাড়ির সামনে গাড়ি থেমেছে। তারা নেমে বাড়িতে প্রবেশ করলেন।
মিলি ড্রয়িং রুমে বসেছিল।
প্রাথমিক আলাপের পর মিলি তার মূল প্রসঙ্গে চলে গেল দ্রুতই। কথাবার্তায় তার ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। বিমল লক্ষ করলো প্রথমদিনের চাইতে তাকে বেশী শান্ত ও প্রস্তুত মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই গুছিয়ে এনেছে কী কথা বলবে।
মিলি সিকারি ছুরিটার প্রসঙ্গে বলল তাদের পূর্বপুরুষদের পর্তুগিজ বনিকদের সাথে ব্যবসা করার কথা। সেই সময়ের প্রাচীন এক গুপ্তসংঘের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল শাহরিয়ার এমন জানাল সে।
হাসনাত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনার জানামতে এমন কোন গুপ্তসংঘ কি আছিল?
মিলি শক্তভাবেই জবাব দিল, না। এমন কোন সংঘের অস্তিত্বের কথা জানা যায় না। ঐ সময়ের ইতিহাস নিয়ে যেহেতু আমার কাজ আছে তাই আমি একরকম নিশ্চিত ছিলাম যে এমন কোন গুপ্তসংঘ ছিল না।
হাসনাত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ছিলাম? তার মানে এখন আপনে সন্দেহ করতেছেন কিছু একটা?
মিলি জবাব দিল, হ্যা। আমার বার বার মনে হচ্ছে শাহরিয়ারের বলা কথাগুলির ব্যাপারে। এছাড়া পৃথা মেয়েটাও এই ধরণের একটা কিছু নিয়ে কাজ করছিলো, আপনারা হয়ত জেনে থাকবেন। পৃথার ব্যাপারে আপনারা জানেন নিশ্চয়ই?
ডিটেক্টিভ হাসনাত বললেন, জানি কিছুটা। আইজই জানলাম আপনার হাজবেন্ড শাহাদুজ্জামান সাহেবের কাছ থিকা। উনার ওখান থিকাই আইলাম আমরা।
মিলির মুখে যুগপৎ বিরক্তি ও ভীতি দেখা গেল, এবং দ্রুতই সে রেশ চলে গিয়ে এক ধরণের কাঠিন্য চলে আসলো মুখে। হাসনাত সাহেব সহজেই তা ধরে ফেললেন। এটা দেখার জন্যই তিনি কথাটা বলেছেন।
মিলি শান্তভাবে বলল, আচ্ছা।
এবার হাসনাত সাহেব যে প্রশ্ন করলেন তার জন্য বিমলও প্রস্তুত ছিল না। তিনি হাসিমুখে বললেন, আপনার হাজবেন্ড লোকটা ভালো। আপনার উচিত তার ব্যাপারে কেয়ারফুল হওয়া। ভালো লোক তো পাওয়া ইজি না।
মিলি বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, এটা মনে হয় কেইসের সাথে যুক্ত কিছু না। আমার যা বলার ছিল বললাম। এবার আমি তাহলে উঠি।
হাসনাত মৃদু হেসে বললেন, বসেন একটু। আপনে কি সাইকোএনালিসিসের নাম শুনছেন?
মিলি ভ্রু কুঁচকে বলল, না।
হাসনাত সাহেব বলতে লাগলেন, এইটা হইল মানুষের মন বিশ্লেষণের এক টেকনিক। জর্মন এক বড় চিন্তক ছিলেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড। ভদ্রলোক এই জিনিস শুরু করছিলেন। এইটা ব্যবহার কইরা মানুষের আচরণের ব্যাখ্যা দেয়া যায়, কোন সমস্যা আইডেন্টিফাই করা যায়, ফলে সমাধানের পথ বাইর হয়।
মিলি বিরক্তির সাথে জিজ্ঞেস করল, এসব আমাকে কেন বলছেন?
হাসনাত সাহেব নরম সুরে বললেন, কিছু মনে কইরেন না। আপনারে ধরেন এমনেই বলতেছি। আমার এক বন্ধু ছিল এইরকম যে তার প্রেমিকার লগে বিয়া জাতীয় সিরিয়াস সম্পর্কে যাইতে ভয় পাইত। একটা ইনসিকিউরিটি ছিল তার মাঝে। যদিও সে মাইয়ারে ভালোবাসত, এই ব্যাপারে কোন ডাউট নাই।
মিলি মনে হলো বেশ আগ্রহ পাচ্ছে এবার শুনতে। সে আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকাল কিন্তু কোন কথা বলল না। বিমল সমস্ত ব্যাপার লক্ষ করছিলো। হাসনাত সাহেব কন্ঠস্বর হঠাৎ বদলে মায়াবী ও নরম হয়ে গেছে, তিনি আন্তরিকভাবে কথা বলছেন।
হাসনাত সাহেব বলতে থাকলেন, এইটা এক সিরিয়াস প্রবলেমে রূপ নিল। পরে প্রেমিকার চাপাচাপিতে অনেক ঝামেলার পর সে বিয়া করে। বিয়ার পরেও ঝামেলা হইতে থাকে তার ভিতরে থাকা ইনসিকিউরিটির জন্য। এরপর, সে একজন সাইকোএনালিস্টের কাছে যায়। ইনি তার বাচ্চাকালের কথা, কিশোরকালের কথা শুনতে শুনতে সমস্যাটা আইডেন্টিফাই করেন।
হাসনাত সাহেব থামলেন।
মিলি জিজ্ঞেস করল, সমস্যাটা কী?
হাসনাত সাহেব বললেন, সে যখন বাচ্চা ছিল, মানে দশের কম বয়েস ধরেন, ঐ সময়ে একটা ট্রমা তার ভেতরে রইয়া গেছিল। সে দেখতো যে তার বাবা, যিনি একজন সরকারী ভালো কর্মকর্তা আছিলেন, তিনি তার বউরে অর্থাৎ আমার বন্ধুটির মা’রে মারতেন। প্রহার করতেন। এই জিনিস তার মনের ভিতরে রইয়া গেছিল। এবং এই ট্রমাই তারে অবচেতনে এই ভয় দেখাইত যে সেও তার বাপের মতো আচরন করবো তার বউয়ের লগে। এর কারণে সে ভয় পাইত, ও সে চাইত না যে যারে সে ভালোবাসে তার সাথে সে ঐরকম আচরণ করুক। ফলে তার দূরে থাকাটা, প্রেমিকারে বিয়া করতে না চাওয়াটা বা বিয়ার পরের জটিলতাগুলাও ছিল প্রকারান্তে তার প্রেমিকার প্রতি বা বউয়ের প্রতি ভালোবাসা তাড়িত। জিনিসটা বেশ কমপ্লিকেটেড।
মিলি জিজ্ঞেস করল, এরপর?
হাসনাত সাহেব মৃদু হেসে বললেন, সমস্যা আইডেন্টিফাই হওয়ার পরে তার বউ তারে হেল্প করতে থাকে সমস্যা থেকে বাইর হইতে, এবং একসময় সে বাইর হইতে সক্ষম হয়। কিন্তু ট্রমা আসলে শেষ হয় না একেবারে, প্রশমিত হয়।
হাসনাত সাহেব এরপর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। অল্পক্ষণ কেউই কথা বললেন না। মিলি বিদায় জানিয়ে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল।
মিলি চলে যাবার পর বিমল হাসনাত সাহেবকে জিজ্ঞেস করল, এই ঘটনা কি সত্যি?
হাসনাত সাহেব বললেন, সত্য বলতে কিছু আছে নাকী, সত্য তো তৈরী হয়।
এরপর থেমে গিয়ে বললেন, নীচার একটা কথা আছে, ল্যাক অফ লাভ না, ল্যাক অব ফ্রেন্ডশিপই আনহ্যাপি ম্যারেজের জন্য দায়ী।
এই কথা বলার পরেই যেন হাসনাত সাহেব সচকিত হয়ে উঠলেন। তার মুখের অবস্থা হলো ধরা পড়ে যাওয়া ভ্যাবাচেকা চোরের মুখের মতো। তিনি খুব দ্রুত অন্যপ্রসঙ্গে যেতে চাইলেন। তাই উঠে দাঁড়ালেন ও নিজের রুমে যেতে যেতে বলতে থাকলেন, আইজ সন্ধ্যায় আমার একটা মিটিং আছে পাড়ার ক্রিকেট টিমের লগে। নয়া সিজন তো শুরু…
বলতে বলতে তিনি চলে গেলেন তার রুমে।
গোয়েন্দা বিমল ব্যাপারটা ধরতে পেরে হাসবে না দুঃখিত হবে ঠিক করতে পারলো না।
অধ্যায় – ষোল
শাহরিয়ারের ল্যাপটপ এবং অন্যান্য জিনিসপাতি যা সংগ্রহ করা হয়েছিল তার ফরেনসিক টেস্টে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না। কিন্তু ল্যাপটপটির লক খুলতে পারলো না পুলিশের টেক টিম। বড় অদ্ভুত প্রযুক্তি ব্যবহার করে লক করে রাখা হয়েছে।
এই ল্যাপটপের মধ্যে আত্মহত্যা বা খুনটির রহস্য লুকিয়ে আছে এমন সন্দেহ করা খুব স্বাভাবিক, যেহেতু এটি এতো সূক্ষ্ণভাবে লক করে রাখা হয়েছে। কিন্তু, আবার এটাও প্রশ্ন আসে যে, ল্যাপটপে গুরুত্বপূর্ন কিছু থাকলে, এবং কোন খুনির মাধ্যমে হত্যাটা হয়ে থাকলে, অবশ্যই খুনি ল্যাপটপ নিয়ে যেতো।
সন্ধ্যায় হাসনাত সাহেব ও তার এলাকার ক্রিকেট টিমের খেলোয়াড় ও মুরুব্বীরা মিলে আলোচনায় বসলেন খেলা নিয়ে। সে এক অদ্ভূত আলোচনা। বিমল এই সময় বাসায় ফিরে এলো এবং তার নিজের চক কষতে লাগলো।
সে ভাবলো প্রথমত হাসনাত সাহেব ইচ্ছে করেও তার কাছে ভুল তথ্য, ভুল অনুমান সামনে দিতে পারেন। কারণ তিনি তাকে একরকম শেখাচ্ছেন এবং বিমল অবশ্যই তার কাছ থেকে শিখছে। তাই, হাসনাত সাহেবের এমন ফাঁদের ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে এবং কখনোই ফাঁদে পড়া যাবে না। বিমল নিজের “গাট ফিলিং” অর্থাৎ মন যা বলছে তাকেই প্রাধান্য দিতে চাইল। তার মনে হলো শাহরিয়ারের বাবা সালাম সাহেবকে একবার জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। এটাই সবচাইতে জরুরী।
রাত দশটার দিকে হাসনাত সাহেব বিমলকে নিয়ে, শাহরিয়ারের ল্যাপটপ সাথে নিয়ে বের হলেন শান্তনুর বাসার উদ্দেশ্যে। শান্তনুর মাধ্যমে তিনি লক খোলাবেন।
রাস্তায় যেতে যেতে হাসনাত সাহেব রিয়ার ভিউ মিররে তাকাতে তাকাতে একবার বিমলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ঐ কালা গাড়িটা কি আমাদের ফলো করতেছে?
সচকিত বিমল কয়েকবার দেখার চেষ্টা করলো। হ্যা, পেছনে একটি কালো গাড়ি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ফলো করছে কি না বুঝা যাচ্ছে না।
সোজা রাস্তা থেকে হাসনাত সাহেব হঠাৎ টার্ন নিয়ে একটি গলিতে ঢুকে পড়লেন এবং ভিন্ন রাস্তা ধরে ঘুরে পৌছলেন শান্তনুর বাসার সামনে। এই সাবধানতা তিনি অবলম্বন করলেন, কিন্তু এতে বিশেষ লাভ হলো না। শান্তনুর বাসার সামনে দাড়াতেই বিমল অনতিদূরে একটি কালো গাড়িকে সরে যেতে দেখলো। তার মনে হলো এটি ঐ গাড়িটির মতোই যেটি ফলো করছিল বলে মনে হচ্ছিল।
কলিং বেল বাজল।
দরজা খুলল এসে শান্তনু। উষ্কখুষ্ক চু্ল, দাড়িগোঁফের জঙ্গলের কারণে তার রোগা শরীরটাকে আরো অদ্ভুত দেখায়।
হাসনাত সাহেব হেসে বললেন, কী খবর হ্যাকার? কেমন চলতেছে তোমার?
শান্তনু মাথা নেড়ে বলল, জি স্যার ভালোই…
হাসনাত সাহেব ল্যাপটপ এগিয়ে দিয়ে বললেন, এইটা দেখো তো কী…খুলতেই পারতেছে না এরা।
শান্তনু হাত বাড়িয়ে ল্যাপটপটি নিল এবং দুই অতিথিকে নিয়ে গেল তার রুমে। রুমটি আধো অন্ধকার, কয়েকটি কম্পিউটার রয়েছে অন অবস্থায়, এবং তাতে কীসব কোডিং চলছে। কয়েকটি বিয়ারের ক্যান টেবিলে, এশট্রে ভর্তি ছাই এবং সিগারেটের পেছনের অংশ।
বিমল রুমের চারপাশটা দেখলো একবার।
হাসনাত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, বাকীরা কই?
শান্তনু ইতিমধ্যেই ল্যাপটপ নিয়ে লেগে গেছে। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। এমন লোক এমনে থাকে নেতিয়ে পড়ার মতো, কিন্তু শক্ত চ্যালেঞ্জ পেলে যেন প্রাণ ফিরে পায়।
শান্তনু কাজ করতে করতেই বলল, আছে… তবে ল্যাপটপটা লক করতে একটা পাওয়ারফুল সফটওয়ার ইউজ হয়েছে মনে হচ্ছে। এটা সম্ভবত কেনা হয়েছে ডার্ক ওয়েব থেকে। ল্যাপটপের সব ডাটা ঠিক রেখে খুলতে সময় লাগবে।
হাসনাত সাহেব বললেন, আচ্ছা, করো। আর ডার্ক ওয়েবটা কী?
শান্তনু মাথা তুলে একরকম উৎসুক কন্ঠে বলল, একেবারে সহজ করে বলতে গেলে, ওয়েবের একটা লুকানো অংশ যেখানে অনেক নিষিদ্ধ জিনিসও ক্রয় বিক্রয় হয়। এ ব্যাপারে আমার বুক শেলফে কয়েকটা বই আছে। আপনি চাইলে নিয়ে পড়তে পারেন। আমি কি বের করে আপনাকে দেব?
হাসনাত সাহেব বললেন, না, তুমি তোমার কাজ করতে থাকো, বই আমি বাইর কইরা নিতে পারব। আর তোমার ব্যাপারে আমি কিন্তু ডাক্তারের রিপোর্ট পাইতেছি নিয়মিত এইটা মনে রাখবা, নো কোকেন। কম্পিউটারের লক ভাঙতে পারলে আমারে ফোন দিবা।
শান্তনু কম্পিউটারটা নিয়ে কাজ করতে করতেই বলল, ওকে স্যার।
হাসনাত এবং বিমল গেলেন অন্য রুমে। সেখানে আমজাদ মুস্তফীকে দেখা গেল।
হাসনাত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর, মুস্তফী সাহেব, কেমন আছেন?
মুস্তফী জবাব দিলেন, ভালো স্যার। আপনি হঠাৎ?
শান্তনুর কাছে একটা কাজে আইলাম।
আবার কোন কেইস নাকী?
হ, মার্ডার কেইস মে বি। আপনার কাজের কী আপডেট? ওর উপরে চউখ রাখতেছেন তো?
কাজ চলছে ভালোই। আর শান্তনুর ব্যাপারে আপনাকে যা রিপোর্ট দিয়েছি তাই। গত ছয়মাসে একবারের জন্যও কোকেন নেয় নি। আমার মতে সে এখন নেশামুক্তই। অল্প বিয়ার আর সিগারেট খায়।
পুলিশ দুইটা কই?
এরা এতক্ষণ ছিলোই। আপনি আসার মিনিট পাঁচেক আগে বাইরে গেলো কী একটা কাজে।
তাই বইলা দুইজন? এরা দেখি মহা ফাঁকিবাজ! আপনে একটু সিরিয়াসলি খেয়াল রাইখেন। আর আমারে জানাইয়েন কোন প্রবলেম হইলে।
মুস্তফী মাথা নেড়ে বললেন, জি, অবশ্যই।
হাসনাত সাহেব এগিয়ে গেলেন একপাশে রাখা বইয়ের তাকের দিকে। বইয়ের তাকে প্রোগ্রামিং, মেশিন লার্নিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ভবিষ্যত ইত্যাদি নানা টেকনোলজির বিষয় আশয় নিয়ে বইয়ে ভর্তি।
হাসনাত সাহেবের মনে হলো এগুলি পড়ে তিনি বুঝবেন না। কালো কভারের একটি বই তিনি হাতে তুলে নিয়ে আমজাদ মুস্তফীকে বললেন, তাইলে আজ আসি আমরা। পুলিশের লোক দুইটা আসলে বইলেন আমরা আসছিলাম।
ফেরার সময় হাসনাত সাহেব বইটি উলটে পালটে দেখছিলেন কভার। বইটির নাম ডার্ক।
বিমল জিজ্ঞেস করল, স্যার, এই শান্তনুর কোকেন খাওয়ার ব্যাপারটা ছাড়া আর কিছু আমাকে বলেন নি। ওকে ব্যাপারটা আসলে কী?
হাসনাত সাহেব বললেন, তোমারে বোধহয় বলছিলাম আগে, আমার এক বন্ধুর ছেলে, তবে ছেলেটা জানেনা আমি ওর বাপের বন্ধু। বন্ধু শিল্পপতি। ছেলে কোকেনাসক্ত, তার চোখে নাই ঘুম। তাই এই ব্যবস্থা করছিলাম। আমার তত্ত্বাবধানে আছে, কড়া পাহাড়ায় আছে এতোদিন। মুস্তফী সাব থাকায় হেল্প হইছে। কাউন্সেলিং টাউন্সেলিং, ইভেন হালকা মাইরও ব্যবহার হইছে তারে লাইনে আনতে। এখন মনে হয় নেশা মনে হয় কাইটা গেছে তার।
বিমল বলল, আমার তাকে প্রায় সুস্থই মনে হয়েছে।
হাসনাত সাহেব বললেন, হ, মানুষ লাইফে মিনিং চায়। যে কাজ সে করতেছে সে যদি ভাবে ওইটা মিনিংফুল, তাইলে ড্রাগস ফাগস নিবে না। ফলে এইসব কাজ দেয়াটাও ট্রিটমেন্টের অংশ ধরতে পারো।
এর কিছুক্ষণ পরে হাসনাত সাহেব বললেন, কাইল যাইতে হবে ঐ বিদেশী চক্রের সাথে। আমি খোঁজ পাইছি তারা কোন হোটেলে আছে।
বিমল এই সময় বলল, স্যার, আমি একটু সালাম সাহেব অর্থাৎ শাহরিয়ারের বাবার সাথে কথা বলতে চাই?
হাসনাত সাহেব রহস্যপূর্ন হাসি হেসে বিমলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভেরি গুড! তাহাই হউক।
অধ্যায় – সতেরো
হাসনাত সাহেবের দেয়া ল্যাপটপটির লক দেখেই শান্তনু কৌতুহলী হয়ে উঠেছিল। ডার্ক ওয়েবের ওলিগলি তার বেশ ভালোভাবে চেনা। কোথা হতে সাহায্য নিতে হবে তা জানা ছিলো। তবে বেশ কিছু ডলার খরচ হলো। কিছু কোড দিয়ে অদ্ভুত উপায়ে লক করে রাখা হয়েছিল ল্যাপটপটি।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে কার্যসমাধা করে একটা বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে শান্তনু ভেবেছিল হাসনাত সাহেবকে ফোন দিবে। কিন্তু সেই সময়েই মেয়েটির মেসেজ সে পায়। একটি পপ আপ উইনডো কোত্থেকে হাজির হয় কম্পিউটার স্ক্রিণে আর মেয়েটি মেসেজ দিতে থাকে।
মেয়েটির নামের জায়গায় লেখা অমৃতা।
অমৃতা বলল, কেমন আছো? এতদিন পর তোমার সাথে চ্যাট। কোথায় ছিলে?
শান্তনু লিখলো, আসলে…আমি আপনার বন্ধু না।
অমৃতাঃ কে তাহলে?
শান্তনু লিখলো, আমার নাম শান্তনু। আমি সরি। আপনার বন্ধুর ল্যাপটপ আমার কাছে।
অমৃতাঃ তো?
শান্তনুঃ তো কিছু না। আপনার সাথে আমার কথা বলা উচিত হচ্ছে না।
অমৃতাঃ কেন অনুচিত হবে?
এইভাবে চ্যাট চলতে লাগলো। স্কুল থেকেই কম কথা বলা, কারো সাথে মিশতে না পারা ছেলে শান্তনু। তাই নারীসঙ্গ সে পায় নি। কলেজ পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে কিন্তু কোন মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হয় নি। অনলাইনেও কারো সাথে জমাতে পারে নি। কোডের বিভিন্ন পথঘাট চিনলেও হৃদয়জনিত ব্যাপারে তার চিন-পরিচয় নাই বললেও চলে।
ফলে মেয়েটির সাথে চ্যাট করতে সে মজা পেল। মেয়েটি একজন লেখক, অমৃতা ছদ্মনামে বই লিখবে। বইটি সম্পর্কে এবং আরো নানা কিছু সম্পর্কে কথা বলতে লাগলো। শান্তনুর ব্যাপারেও আগ্রহী হয়ে সে নানা কিছু জিজ্ঞেস করতে লাগলো। এমন আগ্রহী তার ব্যাপারে আর কেউ হয় নি। হলে হয়ত সে আজ নিঃসঙ্গ থাকতো না।
সময় গড়িয়ে যেতে লাগলো। উত্তেজনায়, এবং নতুন এক ধরণের আনন্দের আহবানে শান্তনু ঘেমে উঠল। এদিকে সময়ঘড়ি এগিয়ে চলেছে, ঠিক ঠিক শব্দে, এগিয়ে চলেছে গন্তব্যহীন এক পথের দিকে।
অধ্যায় – আঠারো
পরদিন সকালে হাসনাত সাহেব গেলেন রেইনবো হোটেলে বিদেশী চক্রটির সাথে দেখা করতে, বিমল গেল শাহরিয়ারের বাবা সালাম সাহেবের সাথে দেখা করতে।
বিদেশী চক্র বা ঠিক ভাবে বললে দেশী-বিদেশী ঐতিহাসিক বস্তু পাচারকারী চক্রটির সাথে হাসনাত সাহেবের অভিজ্ঞতা বেশ ভালো হলো না। প্রাথমিক আলাপেই সমস্যা শুরু হলো, তারা ডিটেক্টিভের সাথে কথা বলতে আপত্তি জানাল।
বিদেশী লোকটার নাম এরিক। সে বেশ হম্বিতম্বি শুরু করে দিল। সাথে কালোমতন একটি এদেশীয় লোক ছিল, নাম মোশাররফ।
হাসনাত সাহেব সরাসরি বললেন, আমার কাছে তথ্য আছে আপনারা কিছুদিন আগে মৃত শাহরিয়ারের সাথে দেখা করতে গেছিলেন।
এরিক ইংরেজিতে জবাব দিল, আমরা যেতেই পারি। কিন্তু তার মানে এটা হয় না যে আমরা তার মৃত্যুর সাথে জড়িত। আপনি বের হোন প্লিজ।
মোশাররফ নামের লোকটি বলল, দেখেন ভাই, হ্যারাস করবেন না। একজন ইউএস সিটিজেনকে অযথা হ্যারাস করার পরিণতি কী হতে পারে ভেবে দেখেছেন আপনে?
হাসনাত সাহেব কিছুতেই সুবিধা করতে পারলেন না কথাবার্তায়। তিনি এদের সাথে কথা বলার আগে ভেবেছিলেন হয়ত এদের সাথে শাহরিয়ারের খুনের সম্পর্ক থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। কিন্তু আসার পর, কথাবার্তা বলার পর তার নিশ্চিত মনে হতে লাগলো এরা অপরাধী, এবং এরা কিছু লুকাচ্ছে।
হাসনাত সাহেব ঠিক করলেন এদের সাথে লেগে থাকবেন জোঁকের মতো, যতক্ষণ পারা যায়। একেবারে ইলিয়ার প্রি-সক্রেটিক জ্ঞানী ব্যক্তি জেনো’র কামড়ের মতো। টাইরান্ট নিয়ার্চাসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অপরাধে তাকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। জেনো তখন বলেন তিনি গোপন কিছু কথা বলতে চান, এবং তা কেবল নিয়ার্চাসের কানে কানে বলবেন। নিয়ার্চাস এলো, কান বাড়িয়ে দিল। জেনো তখন তা কামড়ে ধরে রইলেন। সে এক দারুণ শক্তিশালী কামড়। ছুরি তরবারি দিয়ে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করা হলেও তিনি ছাড়লেন না, মরার আগ পর্যন্ত কামড়ে ধরে রইলেন।
হাসনাত সাহেব নানা ধরণের প্রশ্ন করতে থাকলেন। চতুর এরিক ও মোশাররফ উত্তর না দিয়ে কেবল তাদের বেরিয়ে যেতে বলতে লাগলো।
হাসনাত সাহেব এক পর্যায়ে বললেন, আপনাদের তাইলে অসহযোগীতার জন্য গ্রেফতার করতে হইব আমার।
মোশাররফ ব্যঙ্গাত্মক ভাবে বলল, গ্রেফতারি পরোয়ানা আনেন, কাগজ আনেন। হুটহাট একজন ইউএস সিটিজেনরে বিনা কারণে গ্রেফতার করতে পারেন না আপনি। আর গ্রেফতারের টাইমই পাবেন না।
বলে একটা হাসি দিলো সে এরিকের দিকে চেয়ে।
হাসনাত সাহেবের মাথায় ক্রুর একটা চিন্তা খেলে গেল। তার সবচাইতে বাজে অস্ত্রটি এবার ব্যবহার করতে হবে। একটু অভিনয়ের জন্য তিনি এরিক ও মোশাররফের সামনেই ফোন দিলেন সরাসরি তার বস হায়দার ফারুককে। সংক্ষিপ্তাকারে সব বলার পর অনুমতি বা পরামর্শ চাইলেন গ্রেফতার করবেন কি না। তিনি যেমন ভেবেছিলেন তাই, হায়দার ফারুক সরাসরি না বলে দিলেন। হায়দার ফারুক বললেন, হাসনাত সাহেব, দয়া করে আপনি ওখান থেকে চলে আসুন। এভাবে কিছু করলে, পরে যদি দেখা যায় বিনা কারণে করেছেন, আমাদের মানহানি হবে।
অগত্যা হাসনাত সাহেবকে উঠতে হলো। তিনি দেখলেন এরিক ও মোশাররফের মুখে তাচ্ছিল্য ও বিজয়ের হাসি। হাসনাত সাহেব তখনো দাঁড়িয়ে আছেন দেখে এরিক উঠে এসে ধাক্কা দিয়ে তাকে বের করে দিল।
হাসনাত সাহেব বাসায় ফেরার পথে শহরের সবচাইতে হিংস্র বস্তিটিতে একবার ঢুঁ মারলেন। আলম খানের বস্তি। মারামারি, মাদক ব্যবসা, পতিতা-ব্যবসা ইত্যাদি সব বাজে কাজ কারবার চলে এখানে। এটা সবাই জানলেও এখানে খুব প্রয়োজন ছাড়া পুলিশও হানা দেয় না। হাসনাত সাহেব মনে করেন সব শহরেই এমন একটা জায়গা থাকে। এমন জায়গা যেন শহরের অন্যান্য স্থানের পাপ শুষে নেয় এবং শহরকে বাসযোগ্য রাখে। অন্যথায় সারা শহরই যেন হয়ে উঠত এক নর্দমা।
আলম খানের বস্তির নামকরণ হয়েছে নবাব আব্দুল আলম খানের নাম অনুসারে। শোনা যায় শহরের উদ্বাস্তু, ছিন্নমূল লোকদের জন্য নবাব জায়গাটি দান করে দিয়ে গিয়েছিলেন। জায়গাটির এখন কোন মালিক নেই। শহরের ধনকুবেররা জায়গাটি অবশ্যই দখল করে নিত যদি এখানে বাসরত লোকগুলো হিংস্র বা তথাকথিত রাফ না হতো। সুতরাং, বলা যায় একরকম প্রয়োজনের তাগিদেই আলম খানের বস্তি তার বুকে ধারণ করা লোকগুলোর চরিত্র নির্মান করেছে।
আলম খানের বস্তি থেকে থেকে ফিরে যখন বাসায় ফিরলেন হাসনাত সাহেব, ততক্ষণে বিমল তার কাছে রিপোর্ট দিতে চলে এসেছে। হাসনাত সাহেব সংক্ষেপে বললেন তার রেইনবো হোটেলের অভিজ্ঞতার কথা।
বিমল চোখ বড় বড় করে বলল, সালাম সাহেব এদের কথাই বলেছিলেন। এরা কয়েকবার গেছে শাহরিয়ারের সাথে দেখা করতে। সালাম সাহেব এক সাদা চামড়ার বিদেশীর কথা বলছিলেন। তাদের মধ্যে কথাকাটাকাটিও হয়েছে প্রায় সপ্তাহ খানেক আগে।
হাসনাত সাহেব মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, সালাম সাহেব লোকটাকে কেমন মনে হইল?
বিমল বলল, নিরীহ গোছের লোক। আমি যা ভেবেছিলাম তা হয়ত নয়।
হাসনাত সাহেব হেসে বললেন, বাজে লোকেরাও নিরীহের ভান ধরতে পারে। এমন কি হইতে পারে না সালাম সাহেবই বিদেশীদের কাছে বেঁচতে চাইছিলেন ওই ছুরি…আচ্ছা ছুরিটা তো দেইখা আসছো?
বিমল বলল, জি স্যার। তবে ওতেও আহামরী কিছু আছে বলে মনে হলো না।
হাসনাত সাহেব বললেন, আমার মনে হইতেছে কাহিনী আমি ধইরা ফেলছি। হোটেলের ঐগুলাই কোনভাবে জড়িত।
বিমল বলল, তাহলে তো এদের ধরা দরকার।
হাসনাত সাহেব কথাটাকে পাত্তা দিলেন বলে মনে হলো না। তিনি বাকী সময় ঘরেই থাকলেন। সন্ধ্যার দিকে এলাকার কয়েকটা ছেলে এলো, ক্রিকেট ক্লাবের। এদের সাথে হাসনাত সাহেব মিলি মিলিশিয়া নামে একটা গেইম খেললেন মোবাইলে, আর ক্রিকেট নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠলেন।
অধ্যায় – উনিশ
রাতে হাসনাত সাহেব খেতে বসেছেন সেই সময়েই আমজাদ মুস্তফীর ফোন এলো মোবাইলে। রিসিভ করলেন হাসনাত সাহেব।
ওপাশ থেকে ভয়ার্ত কন্ঠে মুস্তফী বললেন, স্যার, সর্বনাশ হয়েছে! শান্তনু আবার কোকেন নিয়েছে, এত বেশী নিয়েছে যে জ্ঞান ফিরছে না, আমি বাসার পাশের নিউ লাইফ ক্লিনিকে ভর্তি করেছি।
হাসনাত বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কীভাবে ঘটল ঘটনাটা? কোকেন পাইল কই?
মুস্তফী বললেন, কিছু বুঝতে পারছি না স্যার, আপনি কি আসতে পারবেন?
হাসনাত বললেন, ওকে, আমি আসতেছি।
হাসনাত সাহেব বের হলেন গাড়ি নিয়ে। নিউ লাইফ ক্লিনিকে পৌছে দেখা গেল মুস্তফী সাহেবের উদ্বিগ্ন মুখ।
হাসনাত সাহেবকে দেখে তিনি এগিয়ে এসে বললেন, জ্ঞান ফিরে নি স্যার।
হাসনাত সাহেব চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করলেন, এরকম কেইসে ডেথ পসিবিলিটি আছে?
মুস্তফী বললেন, জি, রেসিপাইরেটরী ফেইলর, স্ট্রোক…
হাসনাত সাহেব শান্তভাবে বললেন ওকে, বাসার চাবি দেন।
মুস্তফী পকেট থেকে চাবি বের করে এগিয়ে দিলেন।
হাসনাত সাহেব বললেন ওর জ্ঞান ফিরলে আমাকে জানাবেন।
বলে তিনি ছুটলেন শান্তনুর বাসার দিকে। এই সময় তিনি বিমলকে ফোন করে আসতে বললেন শান্তনুর বাসায়। হাসপাতালে পুলিশের লোক দুইজনও ছিল। হাসনাত সাহেব একবার ওদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন কেমন ভালোমানুষ ভালোমানুষ চেহারা করে দাঁড়িয়ে আছে। হাসনাত সাহেব তখনি তাদের কিছু বললেন না, যদিও তিনি বুঝতে পারছিলেন এরা সতর্ক থাকলে হয়ত শান্তনু কোকেন পেত না বা এতো কোকেন নিতে পারতো না।
হাসনাত সাহেব প্রায় ছুটে গেলেন শান্তনুর কক্ষে।
আগের মতোই আধো অন্ধকার এবং অগোছালো। খুব সতর্কভাবে ডিটেক্টিভ হাসনাত দেখতে লাগলেন। শাহরিয়ারের ল্যাপটপের পাশে দুয়েকটি বই খোলা ফেলে রাখা অবস্থায়।
শাহরিয়ারের কম্পিউটার খোলা। সেখানে চ্যাটের পপ আপ উইনডো। চ্যাট হিস্টরী, আস্তে আস্তে অটোমেটিকভাবে ডিলিট হয়ে যাচ্ছে। হাসনাত সাহেব দেখলেন স্ক্রিণে,
অমৃতাঃ কোকেইন যদি নিতে ইচ্ছেই হয়, তাহলে না নেয়াটাই বরং অন্যায়।
শান্তনুঃ (শাহরিয়ার নামে) কী বলো?
অমৃতাঃ হ্যা, এভাবেও জীবন, ওভাবেও জীবন। তাছাড়া এসবের কী কোন অর্থ আছে। তার চাইতে ঐ ইচ্ছাটাকে প্রাধান্য দেয়াটাই কি ঠিক নয়?
হাসনাত সাহেব ভ্রু কুঁচকে দেখতে লাগলেন লেখাটি। হঠাৎ তিনি বসে পড়লেন, এবং মেয়েটিকে মেসেজে লিখলেন, কেমন আছো?
অমৃতাঃ ভালো। শুয়ে আছি। তোমার কি অবস্থা? ভালো লাগছে না? আমি বলেইছিলাম তো যা ভালো লাগে তাই করা উচিত।
মিনিট পনেরো’র মধ্যে বিমল এলো। তখন হাসনাত সাহেব চ্যাট করছেন, ও পাশে পড়ে থাকা কয়েকটা বই দেখছেন।
তিনি বিমলের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা স্বরে বললেন, খুনই!
বিমল জিজ্ঞেস করলো, কীভাবে হলো স্যার?
ডিটেক্টিভ হাসনাত ল্যাপটপ দেখিয়ে বললেন, টেকনিক্যালি এই ল্যাপটপ, আরো সঠিকভাবে এর একটা প্রোগ্রাম খুনটা করেছে।
প্রোগ্রামিং-এ ভালো ছিল শাহরিয়ার; একটা নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরী করছিল। সেইখানে সে তার মৃত প্রেমিকার পুরানো টেক্সট মেসেজগুলা সেট করে একটা রোবট বানাইছিল। তবে সে এইটা ডার্ক ওয়েব থিকা কিনতেও পারে, শিওর না।
একটা বই দেখিয়ে হাসনাত সাহেব বললেন, এইখানে বইয়ের পেইজে লেইখা গেছে শান্তনু, সে বুঝতে পারছিলো, কিন্তু নিজেরে সংযত করতে পারে নাই।
বিমল জিজ্ঞেস করল, কিন্তু এটা তৈরী করলো কেন?
হাসনাত সাহেব বললেন, সম্ভবত শাহরিয়ার এই কাজ করছিল মৃত প্রেমিকার সাথে চ্যাটে কথাবার্তা বলতে। স্মৃতিচারণ হয়ত, স্মৃতির সাথে কথা বলতে। ডিজিটালি নিজের প্রেমিকারে অমর কইরা রাখতে। অমৃতা, যার মৃত্যু নাই!
কিন্তু এই প্রোগ্রাম যারা বানাইছে তারা এমনভাবে বানাইছিল যে, কোনভাবে এটা নিজেরেই নিজে এডিট করতে শিইখা ফেলে। প্রোগ্রামারেরা এটা ইচ্ছাকৃতভাবে করছিল এমন না হয়ত, এটা হইয়া গেছে। এমন প্রোগ্রাম যে নিজেই নিজেরে বদলায়, নিজেই চিন্তা করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়া বিতর্কের কালে স্টিফেন হকিং এর মত বড় বিজ্ঞানীরাও এই জিনিসের আশংকা কইরা ভয় পাইছেন, ও সাবধান করছেন মানবজাতিরে। মেশিন যদি নিজেই নিজে চিন্তা করতে পারে তখন তা মানুষের জন্য বিপদজনক।
হাসনাত সাহেব বলতে থাকলেন, এই চ্যাট বটরে যে বুদ্ধিমত্তা দেয়া হইছিল এর চাইতে সে আগাইয়া যাইতে থাকে। সে তখন নিজে নিজে মেসেজ তৈরী করে তা দিতে থাকে। লিঙ্গুইস্টিকস এর উপর বটের দখল চলে যায়। ভাষার ধরণ দেখে সে অনুভূতি ধরে নিতে পারে। এবং তা শেষপর্যন্ত এমন হয় যে চ্যাট করতে থাকা মানুষের ধ্বংসাত্মক নেশা বা আগ্রহের কথা জাইনা, সেইদিকেই তারে ঠেইলা দেয়া শুরু করে। এইটা সে ক্যামনে করে আই ডোন্ট নো।
তোমার রিপোর্ট থিকা জানছিলাম শাহরিয়ারের উচ্চতা নিয়ে এক ধরনের ব্যাপার ছিল, উঁচা জায়গা থিকা লাফ দিবার প্রবণতা। হাই প্লেইস ফেনোমেনন। ধারণা করি, এই চ্যাট বট তা উসকাইয়া দিয়া তারে ছাদ থিকা লাফ দিতে প্ররোচিত করে।
একই ভাবে এই চ্যাট বট শান্তনুরে চ্যাটে উসকানি দিয়া হাই ডোজ কোকেন নিতে প্ররোচিত করছে।
বিমল বলল, অসম্ভব মনে হচ্ছে স্যার!
হাসনাতঃ অসম্ভব না, আমি এর সাথে চ্যাট কইরা দেখছি তো। আর এই কয়দিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়া অল্প কিছু জানার সুযোগ হইছে আমার। তাতে এখন আমি নিশ্চিত হইছি এইটাই বিষয়। অন্যথায়, এই অমৃতা মেয়েটা তো খুনই হইছে গতবছর। এছাড়া, এখানে যেই বট চ্যাট করে, এইটা কোন সোশ্যাল নেটওয়ার্কের প্রোফাইল না। ঐ মাইয়ার ছবি দিয়া বানানি একটা চ্যাট রোবট, যার তথ্য কোথাও হোস্ট কইরা রাখা হইছে। তাই নেটওয়ার্ক কানেকশন ছাড়া সচল হয় না। ঐসব পূর্বের দেয়া তথ্যরে, অর্থাৎ মৃত অমৃতার পুরানো টেক্সট মেসেজরে রিএরেঞ্জ কইরাই এই বট নিজে নিজে কথা কয়। ভাষার প্যাটার্ন সে বুইঝা ফেলছে।
আমরা প্রথম এসব বুঝতে পারি নাই কারণ এই ল্যাপটপটা শক্ত ভাবে লক করা ছিল।
বিমল জিজ্ঞেস করলো, তাহলে কি যেকোন ব্যক্তিকে…?
তার কথা শেষ করার আগেই হাসনাত সাহেব বললেন, যেকোন ব্যক্তিকে কাবু করতে পারবে কি না জানি না। শাহরিয়ার তো এর প্রতি দূর্বল ছিল। আর শান্তনু এমনিতেই মেন্টালি ভালনারেবল একটা ছেলে।
বিমল জিজ্ঞেস করল, কিন্তু শাহরিয়ারের প্রেমিকার নাম তো পৃথা?
হাসনাত সাহেব বললেন, কিন্তু সে অমৃতা ছদ্মনামে লেখত। শাহরিয়ার অমৃতা নামের অর্থ যে মৃত্যুহীন বা মৃত না, এইজন্যই বোধহয় বটের এই নাম দিছিল। স্যাড।
অধ্যায় – বিশ
চ্যাট রোবট জনিত মৃত্যুর খবরটি পত্রিকায় দেয়া হয় নি জনমনে ভয় সৃষ্টি হবে ভেবে। পরিবারকে জানানো হয়েছিল কেবল।
পরদিন খবরের কাগজে এমন একটি খবর বের হলো নারী ও শিশু পাচারকারী চক্রের তিন সদস্য পুলিশের হাতে গ্রেফতারের খবর। চক্রের তিন সদস্যের একজন বিদেশী। কে বা কারা এদের বেদম প্রহার করে রাস্তায় ফেলে রাখে ও পুলিশে খবর দেয়। তারা সেদিন এয়ারপোর্ট যাচ্ছিল। ঘটনাক্রমে পুলিশ এদের হোটেল রুম সার্চ করে বেশ গুরুত্বপূর্ন কিছু তথ্য পায় ও সে সূত্রে কিছু নারী এবং শিশুকে উদ্ধার করে যাদের পাচার করার চেষ্টা চলছিলো।
খবরটি পড়ে বিমল সহজেই বুঝতে পারল এই কে বা কারা আসলে কার পাঠানো লোক।
হাসনাত সাহেব নিউজটি পড়ে বললেন, এইজন্যই আমার ঐরকম লাগছিলো সেইদিন।
বিমল অবাক হয়ে হাসনাত সাহেবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি নিশ্চিত না জেনেই?
হাসনাত সাহেব বললেন, না জেনেই কী, আমি কী করলাম। কিছুই তো করি নাই।
তিনি গুণ গুণ করে একটা গান ধরলেন। রাধারমণ দত্তের গান। তুমি নিদাগেতে দাগ লাগাইবায় ছাইও, পাষান মনরে বুঝাইও, তুমি ছিনিয়া মানুষের সঙ্গ লইও।
বিমলের অদ্ভুত অনুভূতি হলো। এই লোকটা নিশ্চিত না হয়েই ভাড়া করা লোক পাঠিয়ে অন্যদের পেটাতে পারে, তাও বিদেশী একজন আছে এর মধ্যে। এছাড়া আইনের লোক হয়েও আইন বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে! এরকম একটা লোকের সঙ্গ নেয়া কি তার জন্য ঠিক হবে?