পুকুরে ব্যাঙদের প্রতি পাথর নিক্ষেপকরা বালকদের গল্পের শিক্ষা কী? 

এই গল্পটা প্রাচীন। নীতিশিক্ষামূলক গল্প হিশেবে পরিচিত। ঈশপের গল্পে এটি আছে। গল্পের সারাংশ এইরকম, এক গ্রামে এক পুকুর ছিল। সেই পুকুরে বাস করতেন কিছু ব্যাঙ। একদিন কিছু বালক মিলে খেলার অংশ হিশেবে সেই পুকুরে ঢিল ছুঁড়তে শুরু করলো। 

ব্যাঙরা মারা যেতে থাকলেন ঢিলের আঘাতে। 

বালকদের ঐদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তারা মজা পাচ্ছিল। অতঃপর, একজন বুড়ো ব্যাঙ পানির নিচ থেকে মাথা উচাইলেন। বালকদের বললেন, প্রিয় বালকবৃন্দ, তোমরা খেলতেছ জানি, কিন্তু যা তোমাদের কাছে মজার খেলা, তা আমাদের জন্য মৃত্যুর কারণ। 

গল্পের নীতিশিক্ষা বলা হয়, আমাদের আনন্দের জন্য করা কাজ অন্যের ক্ষতির কারণ হচ্ছে কি না এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। 

ঠিক আছে। 

কিন্তু, এই শিক্ষাটা আংশিক। 

গল্পে ব্যাঙদের বালকেরা মিলে য পাথর মারতেছিল, এটারে রেনে জিরার্দের স্কেইপগট মেকানিজম হিশেবে ধরা যায়। পাথর নিঃক্ষেপে শাস্তির উদাহরণ জিরার্দের লেখায় এসেছে, যিশু ও গ্রীক পিথাগোরিয়ান এপোলোনিয়াসের ভায়োলেন্স বিষয়ক কথাবার্তায়। 

কিন্তু, এখানে ব্যাঙদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কী? 

গল্পে এই অংশ নাই। আমরা ধরে নিতে পারি, গ্রামে কোন খারাপ ঘটনা ঘটেছে, যার জন্য ব্যাঙদের দোষী মনে করছে বালকেরা, এবং মনে করতেছে যে, এদের মারলেই সমাধান হবে। অথবা, তারা মনে করছিল ব্যাঙরা পুকুরের মাছ খাইয়া ফেলতেছে। অথবা, ব্যাঙরা কেন এই পানিতে কেন আছে। 

স্কেইপগট মেকানিজমে যারা অংশ নেয় তারা বুঝে না এটা স্কেইপগটিং। তাদের কাছে এটা জাস্টিস বা ন্যায়বিচারের যুদ্ধ। এবং এই বালকদের ক্ষেত্রে, এটা বিনোদনের খেলা। 

ব্যাঙদের স্কেইপগট হিশাবে ভাবতে আমাদের গল্পটার কিছু অংশ কল্পণা করতে হয়। কিন্তু বালকদের পাথর নিঃক্ষেপে যে মিমেটিক ডেজায়ার কাজ করেছে, এটা বুঝতে কোন নতুন অংশ কল্পনার দরকার নেই। কারণ গল্পেই আছে ব্যাপারটা। 

তারা একসাথে মিলে নিঃক্ষেপ করছিল। একজনের দেখাদেখি অন্যেরা মিলে এক হয়, গঠন করে ক্রাউডের উন্মত্ততা। আমরা দেখতে পাই তাদের মধ্যে কোন এম্প্যাথী বা সহমর্মীতা কাজ করে না, ব্যাঙরা যে কষ্ট পাচ্ছে, এ নিয়ে তাদের কোন অনুভূতি নেই। কেন নেই? কারণ তারা মিমেটিক ডেজায়ারের বশে ক্রাউড হয়ে কাজ করছে, এই অবস্থায় এম্প্যাথি বিলুপ্ত হয়, ও আমরা পাই এক সাইকোপ্যাথিক ক্রাউড। 

তারা বিনোদনের জন্য, আনন্দের জন্য একসাথে মিলে ঢিল ছুঁড়ে যায়। যার গাইয়ে লাগছে তার অবস্থা ভাবার সময় নেই। ফেসবুকে আমরা যে প্রায়ই সম্মিলিত ট্রল দেখি, আক্রমণ দেখি বা বাস্তবের গণপিটুনি, একই ধরণের জিনিশ। 

এই অবস্থায় প্রয়োজন হয় একজন বিগ আদারের। যিনি এসে ক্রাউডকে বলবেন, তোমরা যা করতেছ তা খারাপ। রেনে জিরার্দের আলোচনায় এটা গডের রেভেলেশন, বড় ধর্মসমূহের বক্তব্য। তারা এসে হিউম্যান স্যাক্রিফাইসের বিরুদ্ধে, মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে, ভিক্টিমের পক্ষে অবস্থান নেয়। আমাদের গল্পে যা করে বুড়ো ব্যাঙটি। 

ব্যাঙ যে মেসেজটা দেয় বালকদের তা হয়ত বালকেরা শুনবে না। কিন্তু, বালকরা তার মেসেজের উদ্দেশ্য না তেমন, মূল উদ্দেশ্য আমাদেরকে মেসেজটা দেয়া, পাঠককে। সেই মেসেজটা কী? 

যখন তুমি নিজেরে গ্রুপের পক্ষে যেকোন একশনে দেখো, তখন এক পা পিছায়ে যাও ও চিন্তা করো কী করতেছ। 

গ্রুপের কম্ফোর্টের বাইরে যাইয়া নিজের কনশেন্সরে জাগাও। কারণ গ্রুপের কম্ফোর্ট খারাপের দিকে নিয়া যায় সব সময়ই। জিরার্দ আরও সতর্ক করেন, ক্রাউড ছাইড়া প্রথমে যে যায়, যে প্রথমে পাথর ছোঁড়া থামাইয়া দেয়, তার ঝুঁকি থাকে পাথর নিক্ষেপকারীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবার। 

অর্থাৎ ব্যাপারটা সহজ না। আপনি ট্রল, সম্মিলিত আক্রমণ, গণপিটুনি, পপুলিজম ইত্যাদির বিরুদ্ধে দাঁড়াইলে নিজেও তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হইতে পারেন। কিন্তু এটাই কর্তব্য, কারণ যে ভায়োলেন্স মানব ইতিহাসের শুরু থেকে বলবত আছে, তারে দূর্বল করতে, তার থেকে নিষ্কৃত হইতে এটাই একমাত্র পন্থা।