সাম্প্রতিক কাশ্মীরি গার্লের গুগল ট্রেন্ড কি পরিকল্পিত হতে পারে?

ইতিহাসের নানা সময়ে নারীদের ধরা হতো পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে। কখনো পিতার, বা বাড়ির কর্তার। কখনো স্বামীর। এখনো বিবাহ বিচ্ছেদের আইন দেখলে দেখা যাবে, পুরুষ ইন্সট্যান্ট কারণ ছাড়াই ডিভোর্স দিতে পারে। কিন্তু মহিলারা ডিভোর্স দিতে গেলে নানা কারণ লাগে এবং তা ইন্সট্যান্ট নয়। অর্থাৎ, নারীকে পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে দেখার ধারণাটি এখনো চলে যায় নি, মানবজাতির এই মঙ্গলে বসতি করার পদক্ষেপ নেবার সময় কালেও।

আমি এই অনুবাদ লেখায় একটি ইতিহাস তুলে ধরেছি নারীদের প্রতি বঞ্চনার। এই লেখায় সহিংসতার হিসাবে আবারো এসেছে প্রসঙ্গটি। এবং, দ্বিজেন্দ্রলালের রণ সঙ্গীত ‘ধাও ধাও সমর ক্ষেত্রে’ এর কথা আছে এই লেখায় এবং আছে বিভিন্ন যুদ্ধে নারীদের উপর আগ্রাসনের ছোট ইতিহাস।

উপরিউক্ত লেখাগুলি আপনার পড়া থাকলে ভালো। না পড়া থাকলেও আশা করছি বুঝতে কোন সমস্যা হবে না।

দ্বিজু বাবুর গানটিকে আমি চমৎকার রণ সঙ্গীত মনে করি। কারণ এখানে একটি লাইন আছে,

কে বলো করিবে প্রাণে মায়া, যখন বিপন্ন জননী জায়া

সাইকোলজিক্যাল ওয়ারের অংশ হিসেবে, পুরুষকে অপমান করতে, তাদের ইগোকে ধূলিসাৎ করে দিতে নারীদের আক্রমণ করা হয় যুদ্ধে।

দ্বিজু বাবু এখানে এই প্রসঙ্গটি টেনে এনে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন। যে তোমার জননী জায়া বিপন্ন হবে, লাঞ্চিত হবে, আর তুমি কি বসে থাকবে?

সম্প্রতি কাশ্মিরের সায়ত্ত্বশাসন ভারত সরকার তুলে নিয়েছেন। সেখানে প্যারামিলিটারী পাঠিয়ে, ইন্টারনেট লাইন কেটে, সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করে, সহজ কথায় জম্মু ও কাশ্মির দখল করেছেন। যে আর্টিকেল ৩৭০ এর মাধ্যমে কাশ্মির যোগ হয়েছিল ভারতের সাথে এটি তুলে দিলে যৌক্তিক ভাবেই ভারতের অধিকার থাকে না কাশ্মিরের উপরে। এই আর্টিকেল ৩৭০ এর ইতিহাস জানতে বিবিসি বাংলার এই লেখাটি দেখুন

মোদি সরকারের একটি প্রতিজ্ঞাই ছিল এটি। মোদির সমর্থক হিন্দুত্মবাদী এবং অনেক সাধারণ জাতীয়তাবাদী হিন্দুদের  প্রাণের দাবী ছিল। ১৯৯০ সালে কাশ্মিরে মুসলমান গোষ্ঠি হিন্দু পন্ডিতদের বিতাড়িত করে। অনেক সহিংসতা হয়। এর একটি প্রতিশোধও হবে এবার, এমন সম্ভাবনায় খুশি হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা।

তবে এসব যেহেতু সাধারণ কথাবার্তা, তাই আরো অনেকে এগুলি নিয়ে লিখছেন।

আমার আগ্রহের বিষয় হলো, গুগলে ‘কাশ্মীরি গার্ল’ শব্দটির সার্চ বেড়ে যাওয়া নিয়ে রিপোর্টটি।

বলা হচ্ছে, আর্টিকেল ৩৭০ উঠে যাবার ফলে যেহেতু কাশ্মীরে হিন্দুরা বা অন্য ভারতীয়রা গিয়ে জমি কিনতে পারবেন ও বিয়ে করতে পারবেন তাই কাশ্মীরি নারীদের ব্যাপারে গুগল সার্চ বেড়ে গেছে।

এই নিউজটির ব্যাপারে আরেকটি বিশ্লেষণ আমি করব গুগল ট্রেন্ড থেকে।

প্রথমে বলে রাখা ভালো গুগল ইন্ডিয়ার টপ সার্চে কাশ্মীরি গার্ল বা কাশ্মীর ছিলোই না এই মাসে।

আগস্টের ৫ তারিখে টপ সার্চের ‘আর্টিকেল ৩৭০’ টপ লিস্টে শক্তভাবে ছিল ১০ মিলিয়ন প্লাস সার্চ নিয়ে। সাথে ছিল ‘আর্টিকেল ৩৭০ কী হিন্দিভাবে সহজে’ এরকম একটি শব্দের ১ মিলিয়ন প্লাস সার্চ ছিল।

আগস্টের ছয় তারিখেই আর্টিকেল ৩৭০ নিয়ে সার্চ টপ লিস্টের তেরোতম জায়গায় চলে যায়। মাত্র ২০ হাজারের উপরে সার্চ নেমে আসে। যেখানে বিখ্যাত লেখিকা টনি মরিসন, যিনি সেদিন মারা গিয়েছিলেন তার নামটিই ছিল ১০ নাম্বারে।

অর্থাৎ বলা যায় আর্টিকেল৩৭০ নিয়ে একদিনেই ভারতীয়রা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

এবার আসা যাক ‘কাশ্মীরি গার্ল’ কিওয়ার্ডটির ট্রেন্ড নিয়ে।

গুগল ট্রেন্ডে ১ থেকে ১০০ ব্যবহার করে কোন কিওয়ার্ডের সাম্প্রতিক সার্চ দেখাতে,  ১০০ হলো মোস্ট পপুলার সার্চ ট্রেন্ড মানে খুবই হাই।

ট্রেন্ডে ৫ থেকে ৬ আগস্টে ‘কাশ্মীরি গার্ল’ কিওয়ার্ডের সার্চ বেড়েছে দেখা গেছে। আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্ট মতে ১ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত ট্রেন্ড ছিল এরকম, কাশ্মীরি গার্ল কিওয়ার্ডের জন্য, ছবিটি আনন্দবাজার পত্রিকার এই রিপোর্ট থেকে,

 

আমিও গুগল ট্রেন্ডে দেখলাম এই কিওয়ার্ডটির জন্য এই সময়ে ট্রেন্ড প্রায় একই।

 

কিন্তু কোন এলাকা থেকে সার্চ হয়েছে তা দেখতে গিয়ে দেখলাম ১০০ তথা মোস্ট পপুলার জম্মু এবং কাশ্মিরেই। অন্যান্য এলাকায় ১০, ১০, ৯ এরকম আছে। যা অনেক বেড়েছে, কিন্তু হুমড়ি খেয়ে পড়া নয়! কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীরে ১০০ কেন, বা কীভাবে? যেখানে ঐ জায়গাতে ইন্টারনেট, মোবাইল, টেলিফোন নেটওয়ার্ক কেটে দেয়া হয়েছে?

 

আবার কিওয়ার্ডটির সম্পর্কিত কিওয়ার্ড দেখলে দেখা যায় বিয়ের প্রসঙ্গটি অনেক পরে ছিল।

 

অর্থাৎ, পত্রিকাগুলি যেভাবে রিপোর্ট করেছে, তার সাথে কোন মিলই নেই।

আনন্দবাজার রিপোর্টটি করে সাত তারিখে বলে তাদের সাইটে বলছে। গুগল সার্চে দেখাচ্ছে তিন দিন আগে। তিন দিন আগে ৬/৭ আগস্ট হয়।

নিউজ১৮ নামের ইংরেজি সাইটটি এই নিউজ পাবলিশ করেছে আগস্টের ছয় তারিখে বলে জানাচ্ছে গুগল।

আচ্ছা, কবে কে নিউজটি প্রকাশ করেছে এটি আমি জানাতে চাচ্ছি কেন, এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই আপনার মনে আসছে।

আমি দেখতে চাই এই নিউজটি ভাইরাল হবার পরে কাশ্মীরি গার্ল , বা কাশ্মীরি গার্লদের বিয়ে করা কিওয়ার্ডগুলির সার্চ কেমন বাড়ল। অর্থাৎ, আমার হাইপোথিসিস হচ্ছে, কাশ্মিরী গার্লদের বিয়ে করা জাতীয় সার্চ আগে ব্রেক আউট পর্যায়ে বাড়ে নি, বরং বাড়িয়েছে এই নিউজগুলিই।

দেখা যাক গতদিন (৮ আগস্ট)  এই কাশ্মীরি গার্ল শব্দটির সার্চে বিভিন্ন অঞ্চলের অবদান।

ওয়েস্ট বেঙ্গলে মোস্ট পপুলার। তার মানে কি বুঝা যায় ওয়েস্ট বেঙ্গলের লোকেরা কাশ্মীরি গার্লদের বিয়ে করতে পাগল হয়ে উঠেছে, নাকি বলা যায় আনন্দবাজারের ভাইরাল নিউজটি দেখে উৎসুক হয়ে সবাই গুগলে সার্চ দিয়ে দেখছে আসলেই কী হচ্ছে। বা আনন্দবাজারের নিউজের পরেই তাদের মিমেটিক ডেজায়ার জাগ্রত হয়েছে। অন্য এলাকার লোকেরা, কেরলের লোকেরা বিয়ে করে ফেলছে, আমরা বসে আছি কেন। মিমেটিক ডেজায়ার হলো আরেকজনের ডেজায়ার দেখে নিজের ডেজায়ার জাগ্রত হওয়া। মানুষের ডেজায়ার এভাবেই জন্ম নেয়। এখানে দেখা গেল ডেজায়ার তৈরি করছে পত্রিকাগুলাই।

সংস্লিষ্ট কিওয়ার্ডগুলি দেখি এবার।

হা হা।

দেখেন বিয়ে সম্পর্কিতই বেশি।

এমনকী বাংলাতে ‘কাশ্মীরি গার্ল’ ব্রেক আউট পর্যায়ে চলে গেছে। এবার তো স্বীকার করবেন আনন্দবাজারের অবদান?

পশ্চিমবাংলায় কাশ্মীরি গার্ল শব্দের সার্চ গতকাল মমতা ব্যানার্জি শব্দটির সার্চের চাইতেও বেশি ছিল। এমনই প্রভাব পড়েছে ভাইরাল নিউজটির।

 

এখন আরেকটু অন্য লেভেলে চলে যাই। আমাদের বাংলাদেশের সার্চে এই কাশ্মীরি গার্ল নিউজের প্রভাব পড়লো কি না দেখি।

নিউজটি ভাইরাল হবার পরে বাংলাদেশেও কিওয়ার্ডটির সার্চ লাফ দিয়ে বেড়ে গেছে। সম্পর্কিত কিওয়ার্ডের প্রথমেই আছে বিয়ে প্রসঙ্গ।

 

ইংরেজি কাশ্মীরি গার্ল কিওয়ার্ডটিও জনপ্রিয় হয়েছে বাংলাদেশে আট তারিখে। নিউজটি প্রকাশিত হবার পরে। বাংলাদেশে ইংরেজি কিওয়ার্ডটির অঞ্চল ভেদে কন্ট্রিভিউশন হল এরকম,

 

ইন্টারেস্টিং দুইটা গ্রাফ দিয়ে শেষ করি। গত সাত দিনের সার্চ হিসাব নিলে দেখা যায় বাংলাদেশে ‘কাশ্মীর সমস্যা” এবং “কাশ্মীরি গার্ল” এই দুই টার্মের মধ্যে কাশ্মীর সমস্যা অনেক এগিয়ে ছিল। সাত তারিখের আগে কাশ্মীরি গার্ল নামে সার্চ ছিলোই না।

আর গত একদিনে দেখেন, কাশ্মীরি গার্ল সার্চটি কাশ্মীর সমস্যা সার্চের প্রায় সমান হয়ে গেছে বাংলাদেশে।

 

অর্থাৎ, প্রসঙ্গটিকে ভিন্ন করে তোলা। এই কাশ্মীরি গার্ল নিয়ে এখন আগ্রহ হু হু করে বাড়বে। বাংলাদেশী অনলাইনগুলি রিপোর্ট করবে। কেউ কেউ বানোয়াট গল্প বানাবে হিটের জন্য।

সুতরাং, এই নিউজটি কি ইঞ্জিনিয়ার্ড? মানে বিজেপির প্ল্যানেরই অংশ ছিল? তা না হলে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে এতো সার্চ কে দিল? অথবা এটা তো খুব সহজেই ইঞ্জিনিয়ারিং করা সম্ভব। নিজেদের কর্মীদের এই টপিকে সার্চ দিতে বলে বা উদ্বুদ্ধ, এবং মিডিয়ায় থাকা নিজেদের লোকদের দ্বারা নিউজ করিয়ে।

কোন পত্রিকা এটি ইঞ্জিনিয়ারিং করেছে, (বা আদৌ করেছে কি না) আর কোনটি লিবারেল বায়াস থেকে কপি করেছে আমি জানি না। নিউজ১৮ দেখা যায় সবচাইতে আগে পোস্ট করেছে।

বিজেপির উত্তর প্রদেশ মজফফরগঞ্জ বিভাগের বিজেপি এমএলএ ভিক্রাম সাইনি বলেছেন এখন বিজেপির কর্মীরা কাশ্মীরের সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে করতে পারবে।

তার কথাটি বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল, আমি কোট করছি নিউজ১৮ ডট কম থেকে,

“The workers are very excited and those who are bachelors, they can get married there. There is no issue now. Earlier, there was a lot of atrocities on women.”- Vikram Saini

সাইনি জানাচ্ছেন, বিজেপির অবিবাহীত কর্মীরা এখন কাশ্মীরের মেয়েদের বিয়ে করতে পারবে। আগে অনেক অনেক নৃশংসতা হতো মহিলাদের উপরে।

সাইনি নিশ্চয়ই বুঝাচ্ছেন কাশ্মীরে মহিলাদের উপর নৃশংসতা হতো। বিজেপি অবিবাহীত কর্মীরা বিয়ে করে তাদের বাঁচাবেন।

( যাদের বাঁচানো হবে সেই কাশ্মীরি নারীদের কী মত নেয়া হয়েছে, তারা কি চান? বিক্রাম সাইনির কাশ্মীরি নারীদের বিয়ে করার সম্ভাবনার কথা বলাকে সমস্যাপূর্ণ বলে তুলে ধরছে মিডিয়া, কিন্তু গভীর সমস্যাটি হলো তার এই কথায় যে, মহিলাদের উপর অনেক নৃশংসতা হতো আগে, সেখান থেকে তারা বাঁচাবেন। এই অবস্থানটি হলো, আমরা বাঁচাচ্ছি তাদের। কিন্তু যাদের বাঁচানো হচ্ছে, সেই কাশ্মীরি নারীদের মানুষ নয়, বস্তু হিসেবে ট্রিট করা হচ্ছে, ফলে তাদের মতামতকে পাত্তা দেয়ার দরকারই মনে করা হচ্ছে না। ভয়াবহ হলো, অন্য নৃশংসতায় যে এটি করে সে প্রায়ই নিন্দার সম্মুখীন হয়। কিন্তু এই বাঁচানো ধর্মী অবস্থানের মাধ্যমে নারীকে বস্তু হিসেবে দেখে যে নৃশংসতা তা পরোক্ষ ও প্রায়ই বাহবা পায় বা দাবী করে!)

এই নিউজটিও সাত আগস্টের।

বিজেপি কর্মীদের কাছে কাশ্মীরি মহিলাদের নিয়ে একধরনের ফ্যান্টাসী কাজ করার কথা। কারণ বিজেপি প্রচারণা চালায় কাশ্মীরের মুসলিম গোষ্ঠী যখন পন্ডিতদের বিতারণ করে নব্বইয়ে, তখন কাশ্মীরিদের স্লোগান ছিল, ওদের হটিয়ে দাও, কিন্তু ওদের সুন্দরী নারীরা থাকুক।

[“Kashir banawon Pakistan, Bataw varaie, Batneiw saan”, (We will turn Kashmir into Pakistan alongwith Kashmiri Pandit women, but without their men folk.) – Indiandefensereview.com]

এরই প্রতিশোধমূলক ফ্যান্টাসী আছে বিজেপি কর্মীদের। বিজেপি এই আইন প্রণেতা ভিক্রাম সাইনি সেই ফ্যান্টাসীতেই পরোক্ষ সমর্থন দিলেন।

নেতারা, দক্ষ পারসুয়েডররা লোকদের ড্রিমে উৎসাহ দেন। আর ফ্যান্টাসী এখানে বৃহত্তর ড্রিমেরই অংশ। ড্রিমটি হলো, কাশ্মীর হবে ভারতের, এবং বেশি সংখ্যায় হিন্দুরা থাকবে সেখানে।

উপরন্তু, এটি কাশ্মীরি পুরুষদের উপর সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ারের অংশ হতে পারে। তাদের উত্তেজিত করিয়ে তোলা, রাগিয়ে তোলা যাতে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, ও হতাশ বোধ করে সাইকোলজিক্যালি। এবং হতে পারে হুমকিও। যাতে তাদেরকে পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দেয়া যায় যে, লাইনে চলে আসো, নাহলে তোমাদের মহিলারা নিরাপদ নয়।

তবে এটি ব্যাকফায়ারও করতে পারে, যদি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের “কে বলো করিবে প্রাণে মায়া” গানের মতো কাশ্মীরিরা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধে নামে, নিজেদের নারীকূলকে বিপন্ন মনে করে।