সহিংসতার ভূমিকাঃ ধর্ষণ

ধর্ষণ

 

ধর্ষণ সহিংসতার আরেকটি মারাত্মক প্রকার। বর্তমানে আধুনিক বিশ্বে সংঘটিত ধর্ষণের পরিসংখ্যান দেখলে একজন চমকে উঠতে পারেন। যুক্তরাজ্যে ১১ টি ধর্ষণ হয় ঘন্টায়, যুক্তরাষ্ট্রে ৩৩ টি। অনুন্নত বিশ্বে, যেখানে আইনের প্রয়োগ কম সেখানে এই সংখ্যা স্বাভাবিক ভাবেই অনেক বেশী।

জোয়ান্না বউর্কের গবেষণা ধর্ষণ সম্পর্কে নিম্নরূপ প্রস্তাব করেঃ

১। ধর্ষণ একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্ম।

২। ধর্ষণ মারাত্মক রিচুয়ালাইজড বা আনুষ্ঠানিক।

৩। যৌন সহিংসতা নির্দিষ্ট সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কনটেক্সটের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কৃত।

৪। যখন কেউ বলে কোন কাজ “ধর্ষণ” বা “যৌন নির্যাতন”, তাহলে এটি তাই।

ধর্ষণ বলতে আমরা বাংলা বুঝে থাকি, জোরপূর্বক কোন মহিলার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন। এই বুঝার বাইরেও তার আইনি বুঝাপড়া আছে। যেমন, ব্রিটেনে ১৯৯২ সালের আগে ম্যারিটাল রেইপ তথা দাম্পত্য ধর্ষণকে ধর্ষণ ধরা হতো না। দাম্পত্য ধর্ষণ বলতে যখন স্বামী তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করে। ভারত, বাংলাদেশ সহ অনেক দেশে এখনো এ সংস্লিষ্ট কোন আইন নেই।

জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১১ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৫২ টি দেশ দাম্পত্য ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে ধরে এর জন্য শাস্তির বিধান রেখেছে।

কোন কোন কোর্ট, ধর্ষণের ক্ষেত্রে জখম হওয়াকে বাধ্যতামূলক হিসেবে ধরে থাকে। অর্থাৎ, কোন জখমের চিহ্ন না থাকলে তাকে ধর্ষণ হিসেবে ধরে না।

ধর্ষণ কখনো কখনো মারাত্মক ভাবে ব্যবহৃত হয় কোন জনগোষ্ঠীর উপরে। বিশেষত যুদ্ধের সময় এ ধরণের ধর্ষণ হয়ে থাকে।

সাবেক যুগোশ্লাভিয়ায় যুদ্ধের সময় “ধর্ষণ ক্যাম্প” স্থাপন করে মারাত্মক সহিংসতা হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের এশিয়া দখলের সময় কম্ফোর্ট উইমেন নাম দিয়ে তারা ধর্ষণ করেছিল। ১৯৩০ এর শেষের দিক হতে, চীন যখন আক্রমণ করেছিল জাপান তখন ধর্ষণ এবং জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে নামানো ছিল সে আগ্রাসনের একটা অংশ। নানজিং এ ১৯৩৭ সালেই প্রায় ২০,০০০ নারীকে ধর্ষণ করা হয়। প্রায় ৫০,০০০ থেকে ২০০,০০০ মূলত কোরিয়ান, চাইনিজ, তাইওয়ানিজ, ফিলিপিনো নারীদের জোরপূর্বক যৌনদাসত্বে বাধ্য করেছিল জাপানিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, এবং এর পূর্বে। এদের নাম দিয়েছিল তারা ইয়ানফু বা কম্ফোর্ট উইমেন।

পূর্ব এবং সেন্ট্রাল ইউরোপে সোভিয়েত সেনারা গণ রেইপ চালিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষেরদিকে রেড আর্মি সিস্টেমেটিক ভাবে প্রায় দুই মিলিয়ন নারীকে ধর্ষণ করে।

শুধু তারা নয়, মিত্র বাহিনী ফ্রান্স, ফিলিপাইন, ইতালি ও জাপানে ধর্ষণ করেছে। বব লিলির অনুমান মতে, আমেরিকান আর্মি ১৪০০০ থেকে ১৭০০০ নারীকে ধর্ষণ করেছে ইউরোপে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ এর মধ্যে। যুদ্ধের পরের বছরগুলিতে অষ্ট্রেলিয়ান ও নিউজিল্যান্ডের সৈন্যরা হাজারো জাপানি নারীদের ধর্ষণ করেছে, যখন ব্রিটিশ কমনওয়েলথ সেনারা দখল করেছিল জাপান।

১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের সময় পাঞ্জাবে ৭৫,০০০ থেকে ১০০,০০০ নারী কিডন্যাপ এবং ধর্ষণের শিকার হন।

১৯৭১-৭২ সালের নয়মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশের প্রায় ২০০,০০০ নারীকে ধর্ষণ করে, এর ৮০ ভাগই ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী।

১৯৯০ সালে ব্যাপক ধর্ষণ হয় সিয়েরালিওন, তিমুর, গুয়েতেমালায়। এর সাথে হত্যা জাতীয় নৃশংসতায় চলে।

রুয়ান্ডান গণহত্যার সময় ১৯৯৪ সালে ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ তুতসি নারীরা যৌন আক্রমণের শিকার হন।

২১ শতকে দারফুরে ধর্ষণ হয়েছিল যাতে লোকদের দামী জমি থেকে সরিয়ে মরুভূমির দিকে নেয়া যায়।

ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কংগোতে দিনে ১০০০ নারী ধর্ষণের শিকার হন। সেখানে এখন প্রায় ২০০,০০০ ধর্ষণ আক্রান্ত রয়েছেন। তিন ভাগের এক ভাগ বয়সে ১৮ বছরের নিচে।

যুদ্ধে এইসব ধর্ষণের নানা কারণ থাকেঃ

এগুলি যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

প্রতীকি হিসেবে বিপক্ষ দলের পুরুষত্ত্বের উপর আঘাত হিসেবে প্রযুক্ত হয়।

কখনো কখনো জাতি ঘৃণা থেকে এর প্রয়োগ হয়।

ফলে যুদ্ধ ধর্ষণ অপরাধ হিসেবে ভিন্ন মাত্রা নিয়ে হাজির থাকে।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটক রাণা প্রতাপ সিংহ নাটকে একটি রণসঙ্গীত আছে, যুদ্ধে নারীর উপর আক্রমণ পুরুষের উপর কী প্রভাব ফেলে তা বুঝাতে সক্ষম। গানটি যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করার গান। দ্বিজেন্দ্রলাল লেখেনঃ

ধাও ধাও সমরক্ষেত্রে গাও উচ্চে রণজয় গাথা-

রক্ষা করিতে পীড়িত ধর্মে শোন ঐ ডাকে ভারতমাতা

কে বল করিবে প্রাণে মায়া

যখন বিপন্না জননী জায়া

সাজ সাজ সকলে রনসাজে

শুন ঘন ঘন রণভেরী বাজে

 

জননী জায়া যখন বিপন্ন তখন প্রাণের মায়া তো ভীরুও করতে পারে না, দ্বিজেন্দ্রলাল সেদিকে ইঙ্গিত করেই যুদ্ধে আহবান করেছেন। এটি একটি শক্তিশালী যুদ্ধ আহবান। এই গানের আরেক জায়গায় আছে যেথা হবে ‘কোষ-নিবদ্ধ র’বে তরবারি, যখনি হবে লাঞ্চিত ভারত নারী’।

 

 

 

রেফারেন্সঃ

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রানা প্রতাপ সিংহ, (গুরুদাস এণ্ড সন্স, ১৯০১), ১৪৫।

Joanna Bourke’s Rape: A History from the 1860s to the Present (London: Virago, 2007).

Georges Vigarello’s A History of Rape: Sexual Violence in France from the 16th to the 20th Century, translated by Jean Birrell (Malden, PA: Polity Press, 2001).

Sharon Block, Rape and Sexual Power in Early America (University of North Carolina Press, 2006).

Estelle Freedman, Redefining Rape: Sexual Violence in the Era of Suffrage and Segregation (Cambridge: Harvard University Press, 2012), pp. 168-90.

Ann J. Cahill, Rethinking Rape (Ithaca: Cornell University Press, 2001).

Raphaelle Branche and Fabrice Virgili, Rape in Wartime (Basingstoke: Palgrave Macmillan, 2012).

Dagmar Herzog, Brutality and Desire. War and Sexuality in Europe’s Twentieth Century (Basingstoke: Palgrave, 2009).

Yuki Tanaka, Japan’s Comfort Women: Sexual Slavery and Prostitution During World War II and the US Occupation (London: Routledge, 2002).

 

সহিংসতার ভূমিকা’র বাকি সব লেখাঃ

১। সহিংসতার ভূমিকাঃ প্রারম্ভ

২। সহিংসতার ভূমিকাঃ সহিংসতা কী এবং কেন?

৩। সহিংসতার ভূমিকাঃ আদিম সমাজে সহিংসতা ও বউ পেটানো

৪। সহিংসতার ভূমিকাঃ নবজাতক হত্যা