হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা গল্পের মেসেজটা কী? সাধারণ প্রতিশোধের গল্প হিশাবে পড়া হয়। জর্মন দেশের এক শহরের নাম হ্যামিলন। হ্যামিলনে অনেক ইঁদুর ছিল। মানুষ ইঁদুরের যন্ত্রণায় অস্থির। তখন আসল এক বাঁশিওয়ালা।
বাঁশি বাজিয়ে সে যেতে লাগল আর ইঁদুরেরা তার বাঁশি শুনে ঘরের কোনা কাঞ্চি থেকে বের হয়ে তার পিছু নিল।
এক পর্যায়ে বাশিওয়ালার নির্দেশে তারা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মারা গেল দলে বলে।
এরপর মেয়রের কাছে তার পাওনা টাকা চাইল বাঁশিওয়ালা, যে চুক্তিতে তাকে ইঁদুর তাড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। যেহেতু কর্ম সমাধা হয়ে গেছে, তাই একজন পলিটিশিয়ানের মত কাজ করলেন মেয়র, টাকা দিলেন না।
বাশিওয়ালা প্রতিশোধ নিবে জানাল।
সেইন্ট জন ও পল দিবসে যখন বড়রা চার্চে ব্যস্ত ছিল তখন আবার ফিরে এলো বাঁশিওয়ালা।
রাস্তায় নেমে সে তার আরেক রঙচঙা বাঁশি বের করে শুরু করল বাজানো। এই বাঁশির সূর্য শুনে মন্ত্রমুগ্ধের মত শিশুরা নাচতে নাচতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। তারা বাঁশিওয়ালার পিছু নিল। আর বাঁশিওয়ালা তাদের নিয়ে হারিয়ে গেলো পাহাড়ের দিকে।
এই গল্প একটা পুরানো, বহুল প্রচলিত গল্প। সবচাইতে পুরান সোর্স ১৩০০ সালের। গল্পটি তারও আগের। বিভিন্ন তত্ত্ব আছে এই গল্পের ইতিহাস নিয়ে। এখনো গল্পটি মানব সমাজে বিরাজমান, সার্চ এঞ্জিন এনালিসিসের টুল এসইএমরাশ দ্বারা দেখলাম, এখনো প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার বার পৃথিবীর মানুষ সার্চ করেন ইন্টারনেটে হ্যামিলনের বাশিওয়ালাকে নিয়ে।
অকৃতজ্ঞের শাস্তি, এটা গল্পের ভাসমান মেসেজ। কিন্তু অন্য লেয়ারে গল্পটারে দেখলে, যদি দেখেন এই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা ব্যক্তিটা কে তখন গল্পটা আরেক ভাবে বুঝার জায়গা তৈরি হয়। তার এই বাঁশিতে এত ক্ষমতা কীসের? কেন বাচ্চারা ও ইঁদুরেরা তারে অনুসরণ করেছিল?
ফ্রেঞ্চ আমেরিকান দার্শনিক রেনে জিরার্দের মিমেটিক তত্ত্ব দ্বারা বিশ্লেষণ করলে, হ্যামিলনের বাশিওয়ালাকে ধরতে হবে মডেল হিসেবে। মডেল হচ্ছে সে যাকে অন্য মানুষেরা অনুকরণ করছে। গল্পের বাচ্চারা অনুকারক।
জিরার্দের তত্ত্বের মূল ইনসাইট এমন, মানুষের নিজস্ব কোন ডেজায়ার নেই। সে অন্যের ডেজায়ার অনুকরণ করে।
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাকে বাচ্চারা যখন অনুসরণ করলো, তখন তাদের কোন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা ছিল না। মডেল যা করেছে, তারা সেদিকে গেছে।
জিরার্দ লেখেন, আমাদের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা নেই, মডেল আমাদের হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। একজন ব্যক্তি তার মডেল দ্বারা সম্পূর্ণ বিনাশও হতে পারে, অনুকরণ সর্বদাই সেই জিনিশ যা আমাদের চিনতে ভুল করায়।
কাকে অনুকরণ করছেন, এই জিনিশ গুরুত্বপূর্ণ নিজের জীবনের জন্য, কারণ আপনি তারে আপনার হয়ে সিদ্ধান্ত নেবার জায়গায় বসিয়ে দিচ্ছেন। তাকে বানিয়ে দিচ্ছেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। সে তৈরি করছে আপনার ডেজায়ার।
অন্য মানুষের প্রাপ্তি, সাফল্য, ভোগ, লাইফস্টাইল, জীবনাদর্শ, জীবন যাপনের তরিকা ইত্যাদি দেখে মানুষেরা নিজেদের জন্য ঐসব ডেজায়ার তৈরি করে। যারে সে ফলো করছে সে যদি এমন সব কাজকর্ম করে যা অনুকারকের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিকর, অনুকারক তা বুঝতে পারবে না।
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা গল্পে আরেকটা ইন্টারেস্টিং অংশ আছে। ১৩০ জন শিশু বাঁশিওয়ালার পিছে পিছে গিয়েছিল যারা চিরতরে হারিয়ে যায়। তিন জন শিশু শুধু রয়ে যায়, যারা গল্পটি বলেছিল নগরবাসীর কাছে। এই তিনজনের মধ্যে, একজন ছিল পঙ্গু, একজন অন্ধ, একজন কানে শুনত না।
অর্থাৎ, এই তিনজন তাদের তিন শারীরিক অবস্থার জন্য বাঁশিওয়ালাকে অনুসরণ করতে পারে নি।
জিরার্দ লেখেন, যার যত বেশি মিমেটিক ডেজায়ার থাকবে, তত বেশি এই ডেজায়ার বাস্তব জীবনে প্রবেশ করবে, এবং তত বেশি এটা তার জীবনকে ধ্বংস করবে। ব্যক্তিটি হয়ে উঠবে তত বেশি অসুখী।
ভোগবাদ উৎসাহিত করতে, নিরন্তর চাহিদা তৈরি করতে মানুষের সমাজে যারা বিখ্যাত, যারা জনপ্রিয়, যাদেরকে মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মডেল হিশাবে দেখে, তাদেরকে দিয়ে নানাবিদ পণ্যের ডেজায়ার তৈরি করার কাজ করানো হয়। এর জন্য আছে ফিল্ম-বিনোদন ইন্ড্রাস্টি ও নানা ধরণের বিজ্ঞাপন।
অনুকরণ থেকে শতভাগ বাঁচার উপায় নাই যেহেতু এভাবেই সামাজিক মানুষ তৈরি হয়েছে। কিন্তু মানুষ কারে অনুকরণ করবে বা করছে, এ ব্যাপারে সচেতন হতে পারে। যদি না হয়, তাহলেও সে অনুকরণ করছে, না জেনে। সচেতন অনুকরণ তারে তার নিজের সাইকোলজিক্যাল অবস্থান বুঝতে সাহায্য করবে। সে কী করছে এবং কেন। এইজন্য প্রাচীন স্টয়িক দর্শন মডেল ঠিক করতে বলে। স্টয়িকদের জন্য মডেল ছিলেন সক্রেটিস, ক্যাটো দ্য ইয়াংগার, এবং মিথিক্যাল হারকিউলিস। বিভিন্ন ধর্মেও মডেল নির্ধারণে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ তাদের জানা ছিল সচেতনে না করলে অচেতনে মানুষ মডেল ঠিক করবে ও তাদের দ্বারা ডেজায়ার তৈরি করবে, প্রভাবিত হবে, কিন্তু মনে করবে প্রভাবিত হচ্ছে না, নিজেই কাজ করছে।
মডেল খারাপ হতে পারে অনুকারকের জন্য। আবার সব মডেল যে সকল সময় হ্যামিলনের বাশিওয়ালার মত এমনো না।
মডেলকে অনুকরণের আরেকটা দিক আছে, মিমেটিক রাইভালরি, যা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছিল মিমেটিক তত্ত্বের জগত লেখায়, এখানে হালকা করে উল্লেখ করে যাই।
মানুষ যখন এমন একজনের অনুকরণ করে, যে তার সাথে একই তলে অবস্থান করে, তখন তাদের মধ্যে কনফ্লিক্ট শুরু হয়। একসময় দেখা যায়, তারে আগে লাইক করত কিন্তু এখন জানপ্রাণ দিয়ে শত্রুতা করে যাচ্ছে।
সে ওই ব্যক্তি নিয়া অবসেসড, তার মত হতে চায়। কিন্তু এই হতে গিয়ে দেখে, যারে দেখে তার এই চাওয়ার জন্ম নিল, সেই লোকটাই তার প্রতিদ্বন্ধী। আবার লোকটা যদি বহু আগের কেউ হয়, ধরা যাক সক্রেটিস, সেইক্ষেত্রে মিমেটিক রাইভালরির জায়গা থাকে না।
এর সমাধান হিসেবে জিরার্দ লেখেন, “To make an effective imitator, you have to openly admire the model you’re imitating, you have to acknowledge your imitation. You have to explicitly recognize the superiority of those who succeed better than you and set about learning from them”.
আপনে যদি চান, ওই ব্যক্তির কাছ থেকে শিখতে, তার মত হতে বা ওইসব কোয়ালিটি অর্জন করতে, তাহলে নিজের অনুকরণটারে প্রকাশ্যে স্বীকার করেন। অর্থাৎ আবার সেই সচেতন অনুকরণ। যারে মডেল ধরতেছেন তার সুপিরিয়রিটি মানেন। কারণ, আপনে যেগুলা চাইতেছেন তারে দেখেই, সে ঐগুলা বেশি পারে।
এই স্বীকার তার কাছ থেকে শিখতে হেল্প করে, মানসিক বাঁধা থাকবে না, সেও আপনারে হেল্প করবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে। আর বেহুদা ওই লোকের সাথে শত্রুতাও তৈরি করতে হবে না। এবং হয়ত একসময় আপনি ঐসব কোয়ালিটিতে তারেও ছাড়াইয়া যাবেন। পরে আপনারে দেইখাও অনেকের মিমেটিক ডেজায়ার জাগ্রত হবে।
এটাই চক্র, মানব সমাজের খেলা।
আমাদের ডেজায়ার তৈরি হয় অন্যের ডেজায়ার দেখে।